আমি তুমিতেই আসক্ত পর্ব-০৭

0
1831

#আমি_তুমিতেই_আসক্ত।
#পর্ব_৭
#সুমাইয়া_মনি।

শিশির ভেজা প্রকৃতির আস্তরণ ভেদ করে সূয্যিমামা আলাে ছড়ায়। সকালের মিষ্টি রােদ খুবই ভালাে লাগে। স্নিগ্ধ বাতাস শরীরে শিহরণ জাগায়। নিভ্র আজ জগিং করতে গিয়েছিল। ফিরে আসার পর দরজার সামনে দুটি গোলাপ ফুল দেখতে পায়। সঙ্গে কোনো চিরকুট ছিল না। শুধু ফুল রাখা ছিল। হাতে তুলে নেয়। তীক্ষ্ণ নজরে পর্যবেক্ষণ করছে। অদ্ভুত বিষয় হলো? কাল এবং আজ সকালে এই সময়ই দরজার সামনে গোলাপ ফুল পেয়েছে। এর আগে কখনোই সে পায়নি।
বেশি মাথা ঘামায় না। ফুল গুলো নিয়ে পানি ভর্তি একটি কাঁচের গ্লাসের মধ্যে রেখে দেয়। সেখানে আরো দু’টি ফুল রাখা ছিল। কালকের ফুল ছিল সে-ই ফুল দু’টি।
একটু পর নবনীর আগমন ঘটে। আজ আর টমি নবনীকে দেখে ঘেউঘেউ আওয়াজ তুলে না। কারণ নবনী সঙ্গে করে তার ক্যাথিকে নিয়ে এসেছে। টমি শান্ত হয়ে ক্যাথিকে দেখছে।
দেখে মনে হচ্ছে তার ক্যাথিকে মনে ধরেছে। বাহিরে ক্যাথিকে রেখে সে ভেতরে আসে। প্রথমে একটু উঁকিঝুঁকি দিয়ে “নিভ্র স্যার” বলে ডাকতে ডাকতে রুমে উঁকি দেয়।

কোনো সাড়া শব্দ পায়না। নবনী রুমে প্রবেশ করে। কেমন ইতস্তত বোধ করছিল। তবুও সে রুমের ভেতরেই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ডানে-বামে তাকায়। বিছানার ওপর নিভ্রর ইউনিফর্ম রাখা ছিল সঙ্গে পুলিশের টুপি। দুষ্টু বুদ্ধি খেলে নবনীর মাথায়। একবারের জন্য নিভ্রর কথা মাথা থেকে ঝেড়ে বসে। টিফিনবাক্স টেবিলের ওপর রেখে টুপিটা হাতে উঠিয়ে নেয়। ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে টুপিটি মাথায় পড়ে। সেখানে কালো রঙের সানগ্লাস রাখা ছিল। সেটি উঠিয়ে চোখে দেয়। এখন একদম পুলিশ ম্যাডামের মতো লাগছে নবনীকে।

ভাব নিয়ে দু বার পায়চারি করে নবনী। নাকের ডগায় সানগ্লাস নামিয়ে আয়নার দিকে তাকিয়ে মুড নিয়ে বলে,
-“আমি হলাম মিসেস.নিভ্র আহমেদ।”

-“কবে হয়েছো মিসেস. নিভ্র আহমেদ?” ক্ষুব্ধ কন্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল নিভ্র।

নবনী আয়নার মধ্যে নিভ্রকে দেখতে পায়। ওর ঠিক চার-পাঁচ হাত পিছনেই দাঁড়িয়ে আছে সে। পরনে সেদিনের সেই স্লিক নাইটি। হঠাৎ নিভ্রর কন্ঠের স্বর শুনে ভড়কে ওঠলো। নিমিষেই নবনীর মুখমন্ডল হয়ে গেল বিবর্ণ। ধীরেধীরে পিছনে ফিরে নিভ্রর রাগান্বিত চেহারা দেখতে পায় সে। কিছু বলার সাহস হয় না তার। বুক দুরুদুরু করছে। এই বুঝি সে রাগের বশে কিছু একটা করে বসছে। ভেবেই নবনীর হাত-পা অবশ।
নিজেরই এখন আফসোস হচ্ছে। কেন যে বলতে হলো কথাটা। না না কেন যে রুমে ঢুকলাম। আগে কেন সিনেমার নায়িকাদের মতো দেখলাম না নায়ক গোছলখানায় আছে, কি নেই? তার হাজারটা ভুলচুক ধরতে ব্যস্ত সে। কিন্তু এখন আর বলে লাভ নেই। কথায় আছে, ভাবিয়া করিও কাজ। করিয়া ভাবিও না। প্রবাদটি নবনীর সঙ্গে একদম মিলে গেছে।

কিছুক্ষণ পর…..

বড়ো একটি গর্তে বালতি দিয়ে জল ঢালছে নবনী। যত জল ঢালছে সব জল শুঁকিয়ে যাচ্ছে। শুকানোরই কথা। ক’দিন আগেই নিভ্র বাড়ির পিছনটায় দু’জন লোক দিয়ে মাটি খুঁড়ে গর্ত বানিয়েছে ছোট হাউস বানানোর জন্য। দেখতে অনেকটাই কূয়োর মতো। সেখানেই নবনী বালতিতে পানি ক্যারি করে নিয়ে এসে জল ঢালছে। এটা নবনীর শাস্তি। সয়ং নিভ্র দিয়েছে তখনকার বলা কথাটির জন্য। বলে গেছে পুরো কূয়োয় যেন পানি ভরে রাখে। নবনী শাস্তি মাথা পেতে নিয়েছিল। কিন্তু বিপত্তি হয় তখন, যখন দেখে পানি ঢালছে আর উধাও হয়ে যাচ্ছে। এবার নিয়ে দশবার হবে। সব পানি মাটিতে চুষে নিয়ে যাচ্ছে। বালতি রেখে নবনী কোমড়ে হাত রেখে দাঁড়ায়। রাগ হচ্ছে তার। নিভ্র অফিসে চলে গেছে। যাওয়ার সময় কঁড়া গলায় বলে গেছে, এসে যেন পুরো গর্তে পানি ভর্তি দেখে। আজ নবনীর কলেজে যাওয়া হবে না। চুপ করে দাঁড়িয়ে ভাবতে থাকে কি করা যায়। কিভাবে গর্তে পানি ভরা যায়।

ভাবতেই আইডিয়া পেয়ে যায়। দৌড়ে ফুলের বাগানে আসে। সেখানে পাইপ রাখা ছিল। সম্ভবত নিভ্র পাইপ দিয়ে ফুল গাছে পানি দেয়। সেটি নিয়ে ছুটে আসে গর্তের কাছে। এখন আরাম করে পানি গর্তে দিচ্ছে। নেই ঝামেলা,নেই কষ্ট।
পানি দিতে দিতে নিভ্রকে তখনকার বলা কথাটি মনে করতে থাকে। লজ্জায় মুচকি মুচকি হাসে।
.
আজ নবনী কলেজে আসেনি দেখে মায়া কয়েকবার কল দেয়। কিন্তু নবনী ফোন ধরে না। ধরবেই বা কি করে ফোন বাড়িতে, আর সে নিভ্রর বাড়িতে। শেষে বিরক্ত হয়ে আর কল দেয় না। ক্লাসে চলে যায়।
_______
নিভ্র অফিসে বসে নবনীর কথা ভাবে। মেয়েটা কী জন্মগত পাগল, না-কি মাথায় আঘাত পেয়ে এমন পাগলামি করছে?
স্বভাব, আচরণ মোটেও স্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছে না তার কাছে। আর না হলে কি কেউ এভাবে অন্যের ওয়াইফ হিসাবে দাবী করে! ভেবেই মৃদু হাসে সে। পরক্ষণে মনে পড়ে নবনীর শাস্তির কথা৷ একবার ফোন দেওয়ার কথা ভাবে। অবশ্য সকালে আসার সময় নাম্বার নিয়েছিল নবনীর কাছ থেকে। কিন্তু কল দিতে প্রস্তুত নয় সে। সেলফোন হাতে নিয়েও রেখে দেয়।

একটার দিকে নবনী বাড়িতে যায়। সঙ্গে সঙ্গে নিলুফা বেগমের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। ভুলভাল বুঝিয়ে রুমে এসে শাওয়ার নেয়। নামাজ পড়ে খাবার খেয়ে ক্যাথিও খাবার খাইয়ে দেয়। তারপর দু’জনেই বের হয় নিভ্রর বাড়ির উদ্দেশ্যে। এসে দেখে নিভ্র অলরেডি বাসায়। কিছুক্ষণ আগেই এসেছে। আজ খাবার সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে। খেয়েও নিয়েছে। নবনী ক্যাথিকে কোলে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। নিভ্র তখন কিচেনে ছিল। এঁটো থালা পরিষ্কার করছিল।
নবনী ক্যাথিকে ছেড়ে দেয় বাহিরে। তারপর কিচেনে ঢুকতে যেতেই নিভ্রর একদম মুখোমুখি পড়ে যায়। নবনী সরে দাঁড়ায় না। নিভ্রকে একদম কাছ থেকে দেখে নিচ্ছে। এ দেখা যেন শেষ হবার নয়। মনে মনে চাইছে সময়টা এখানেই স্থির হয়ে যাক। দেখে নিক মন ভরে আরো কিছুক্ষণ! কিন্তু এমনটা হয় না। নিভ্র একটু পিছনে সরে হাতে তালি দিয়ে ‘নবনীতা’ বলে ডাক দেয়। চৈতন্য ফিরে পায় সে। লজ্জায় মাথা নত করে ফেলে। সরে দাঁড়ায়। নিভ্র বিরক্ত মুখে বলে,
-“হোয়াট?”

-“পানি ভরেছি গর্তে। এখন আমার শাস্তি কী শেষ হয়েছে স্যার?” মৃদুস্বরে বলে নবনী।

-“প্রথমত, গর্তে পানি নেই, দ্বিতীয়, তুমি চিটিং করেছো। পাইপ দিয়ে পানি দিয়েছো গর্তে।”

মাথা তুলে অবাক চোখে নিভ্রর পানে তাকায় নবনী। পানি দেওয়া শেষ করার পর পাইপ গুছিয়ে ঘরের ভেতরে এনে রেখেছে। যাতে করে নিভ্র বুঝতে না পারে সে পাইপ দিয়ে পানি দিয়েছে। ভ্রুকুটি কিঞ্চিত বাঁকিয়ে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নবনী। নিভ্র আঙ্গুল তুলে বলে,
-” ধরা পড়ে গেছ, তাই আফসোস হচ্ছে। যে নিজেকে চালাক বলে মনে করে, সেই বড্ড বোকা। তুমি যদি পাইপটি বাগানেও রেখে আসতে তবুও আমি বুঝতে পারতাম পাইপ দ্বারা পানি দেওয়া হয়েছিল গর্তে।”

-“কিভাবে স্যার?” মিনমিন করে বলে।

-“সিক্রেট!”

পাল্টা প্রশ্ন করে না নবনী। নিভ্র হেঁটে ড্রইংরুমে এসে বসে। নবনী কিচেনের দরজার সামনেই মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রয়। ভুলেই গিয়েছিল সে পুলিশের সঙ্গে চালাকি করতে গিয়েছিল। তাইতো ধরা পড়ে গেল। নিভ্র নবনীকে ডেকে তার সামনে এনে দাঁড় করায়। গম্ভীর চোখেমুখে বলে,
-“আজকে যেটা বলেছো, আর করেছো। তার জন্য তোমার ডাবল শাস্তি হবে।”

নবনী চোরের মতো দাঁড়িয়ে থেকে নরম স্বরে বলে,
-“আপনি যে শাস্তি দিবেন আমি সেটা মাথা নত করে নিবো।”

-“অলরেডি করেছো।”

-“কী?” ভ্রু কুঁচকে মাথা তুলে জিজ্ঞেস করে।

-“মাথা নত।”

শুনেই মাথা ফের নত করে ফেলে। নিভ্রর রাগ হয়। একবার বলা শর্তেও এই মেয়ে কেন যে সবসময় মাথা নত করে রাখে, বোঝার বাহিরে। নিভ্র সরু নিশ্বাস ফেলে বলে,
-“প্রতিদিন আমার বাড়িতে এসে ফুল গাছে পানি দিবে। দুই বেলা। সকাল, সন্ধ্যা।”

-“ঠিক আছে স্যার। আর কিছু?”

-“নাহ! তুমি ডগ কবে কিনেছো?”

-“কালকে।”

-“কেন?”

-“পুষবো তাই।”

-“সত্যি কথা বলো নবনীতা। ” কঁড়া গলায় শুধায়।

-“আপনার কুকুরের জন্য কিনেছিলাম।” আমতা আমতা করে বলে।

-“কারণ?”

-“টমি আমাকে দেখলেই ঘেউঘেউ করে। আমার ভীষণ ভয় লাগে। তাই ওর জন্য মেয়ে কুকুর কিনেছি। যাতে করে টমি আমাকে দেখলে আর না চিল্লায়। আর এমনেতেও টমি কতদিন আর সিঙ্গেল থাকবে। ওর তো মিঙ্গেল হতে ইচ্ছে করে তাই না।” নক খুঁটতে খুঁটতে কথা গুলো বলে নবনী।

নিভ্রর চোখেমুখে অপ্রীতিকর ছাপ। কপালে একবার হাত রেখে অপ্রসন্ন ভাবে সরু নিশ্বাস ফেলে। আগে ভেবেছিল অর্ধেক পাগল, এখন পুরো পাগলের প্রমান দিয়েছে সে। নবনী একবার নিভ্রর দিকে তাকিয়ে, আবার নজর নিচু করে রাখে।
নিভ্র কপালের ওপর থেকে হাত সরিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে বলে,
-“তুমি যে মেন্টালি সিক্, তোমার পরিবার জানে বিষয়টা?”

-“নাহ! আপনি গিয়ে বলুন স্যার।”

-“ও মাউ গড!” বলেই বিরক্তিতে মাথার দু পাশে হাত রাখে নিভ্র।

নবনী মুখ টিপে হাসে। নিভ্রকে কথার জ্বালে ফেলে টর্চার করে বেশ মজা পাচ্ছে সে। তারপর স্বাভাবিক হয়ে পূনরায় বলে,
-“স্যার,আপনার কি মাথা ব্যথা করছে?”

-“এতক্ষণ মাথা ব্যথা ছিল না। তোমার কথা শুনে শুরু হয়েছে ব্যথা।” রুষ্ট কন্ঠে বলে নিভ্র।

-“স্যার এক কাপ কফি বানিয়ে দেই,খে’লে হয়তো মাথা ব্যথা কমে যেতে পারে।”

-“গো..।”

-“আচ্ছা। ”

নবনী খুশি হয়ে কিচেনের দিকে রওয়ানা হয়। কিন্তু মাঝপথে নিভ্র থামিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করে,
-“কিচেনে কোথায় যাচ্ছো?”

-“কফি বানাতে।”

-“আমি তোমাকে কফি বানাতে বলেছি?” ভর্ৎসনা স্বরে বলে।

-“আপনিই তো বললেন গো! আমি ভাবলাম হয়তো কফি বানাতে যেতে বলেছেন।” ইতস্তত বোধ নিয়ে অস্ফুট স্বরে উত্তর দেয়।

বিরক্তির চরম সীমায় পৌঁছে গেছে নিভ্র। রাগ নিয়ে এক প্রকার চিল্লিয়ে বলল,
-“ইউ ক্যান গো…!”

নবনী এক দৌড়ে বাহিরে চলে যায়। নিভ্র সোফার সঙ্গে হেলান দেয়। মাথা খারাপ করে দিয়েছে। নবনী চলে যাওয়াতে নিভ্র কিছুটা স্বস্থি পায়। এদিকে নবনী বাহিরে এসে টমির কাছ থেকে ছোঁ মেরে ক্যাথিকে নিয়ে নেয়। রাগ দেখিয়ে আঙ্গুল তুলে বলে,
-“টমির বাচ্চা সর আমার ক্যাথির কাছ থেকে।” বলেই হাঁটা ধরে। নিভ্রর রাগ টমির ওপর দেখাল। বেচারা টমি নবনীর ব্যবহারে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রয়। বোবা প্রাণী কিছু বলতেও পারছে না। মানুষ হলে এতক্ষণে ঠিকই জিজ্ঞেস করতো।
________________________
পরদিন সকাল আটটার দিকে নবনী গাছে জল দিতে আসে নিভ্রর বাড়িতে। প্রথমে বাড়ির ভেতরে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু পরমুহূর্তে গাছে জল দেওয়ার কথা ভাবে, তারপর না হয় ভেতরে যাওয়া যাবে। ভাবা অনুযায়ী কাজে লেগে পড়ে সে। খুব যত্নসহকারে ফুল গাছে পানি দেয়। কিছু আগাছা পরিষ্কারও করে দেয়। সব কাজ সম্পূর্ণ করে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে। ড্রইংরুমে উপস্থিত অচেনা রূপবতী এক বালিকাকে দেখে নবনী থামকাল। পরনে তার গোলাপি রঙের সেলোয়ার-কামিজ। তিনি একাই বসে ছিলেন। নবনীর আগমনে সেও তার দিকে তাকায়। নবনী স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রয়। মনে তার হাজারো প্রশ্ন? কে এই অচেনা বালিকা? নিভ্র স্যারের সঙ্গে তার কী সম্পর্ক? তাহলে কি সে তাকে হারাতে বসেছে! ভাবতেই বুক ভার অনুভব করে সে। বুকে চিনচিন ব্যথা আরম্ভ হয়। এ কোন নতুন ঝড়ের আলামত!
.
.
.
#চলবে?

কার্টেসী ছাড়া কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে