আমিরাহ্ পর্ব-০৭

0
528

#আমিরাহ্

৭,

বিয়ের সঙ্গীত আর উলুধ্বনিতে আমিরাহ্দের বাড়ি গমগম করছে। আত্মীয় এবং প্রতিবেশী নারীরা সবাই চলে এসেছে। তারা থেকে থেকেই হাসছে, বিয়ের গান গাইছে, হাত ভরে মেহেদি পরছে, থেকে থেকেই সমস্বরে উলুধ্বনি দিচ্ছে। গতরাতেই আল আবাদি পরিবার থেকে আমিরাহ্ এর জন্য নিকাহ্ এর প্রয়োজনীয় সাজ-পোশাক এবং গয়না পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেসব দেখে সবার মুখে একই কথা ঘুরে ফিরে যাচ্ছে, ” আমিরাহ্ এর নামকরণ যথার্থ হয়েছে। আক্ষরিক অর্থেই সে এক ধনী নারী হতে যাচ্ছে।”

তাদের এসব আলোচনা অযৌক্তিক না। আমিরাহ্ এর জন্য যেসব সাজ-পোশাক পাঠানো হয়েছে তা সাধারণ কোনো বিয়েতে কেউ চোখে দেখেনি। বিশেষ করে আমিরাহ্ এর জন্য পাঠানো গয়না দেখে সবাই বিস্মিত হয়ে গেছে। এমনিতেই আরবরা বিয়ের সময় কনেকে অনেক গয়না দেয়– হাত-পায়ের সব আঙুলের জন্য আঙটি, হাত ভর্তি চুড়ি, হার, কোমড়ের বেল্ট, মাথার তাজ ইত্যাদি।

আমিরাহ্ এর জন্য এসবই এসেছে তবে অনেক ভারি এবং নয়নাভিরাম ডিজাইনে। হাত-পায়ের চল্লিশটা আঙটি, দুই হাতের চব্বিশটা চুড়ি, গলার হার আর কোমড়ের বেল্ট প্রতিটি এক কেজি করে ওজনের, মাথার রাজকীয় তাজ, দুই হাতের মোটা মোটা চুড়ের সাথে সোনার চেইন লাগানো পাঁচ আঙুলের আঙটি– এসব শুধু সোনার নয়; হিরা, চুনি, পান্না খচিত। তবে সবচেয়ে অভিনব গয়না হচ্ছে সোনার অবগুন্ঠন ও পুরো ডান হাতের ঝালর।

অবগুন্ঠনটা কপালে পরার টায়রার মতো, সাথে মুখ ঢাকা সোনার তারের জাল, জালে আটকানো ছোটো ছোটো স্বর্ণমূদ্রা। হাতের ঝালরটার প্রথম চুড়িটা বাজুবন্ধের মতো বাহুতে পরতে হবে। তার সাথে সোনার পয়সা যুক্ত সোনার জাল কব্জিতে পরার চুড়িতে এসে থেমেছে। সেখান থেকে আবার সেই একই পয়সাওয়ালা জাল একদম মধ্যমায় পরার আঙটিতে এসে শেষ হয়েছে। এতসব গয়নার ভারে আমিরাহ্ হাঁটতে পারবে কিনা এসবও অনেকে বলাবলি করছে। কেউ কেউ নোংরা রসিকতাও করছে।

বাড়ির পিছনের আঙিনায় চলছে রান্নার বিশাল আয়োজন। একের পর এক উট, দুম্বা, খাসী জবাই করা হচ্ছে। রান্না হচ্ছে খাবসা, মেনদিল, শোরবা, আস্ত খাসী পোড়া, মুরগি পোড়া আরও নানা মুখরররোচক খাবার। থরে থরে সাজিয়ে রাখা হয়েছে হরেক রকম ফল, সালাদ, জুস, কাস্টার্ড, পুডিং।

কিন্তু যাকে ঘিরে এতসব আয়োজন তার কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। সেদিনের সেই সন্ধ্যার পর থেকে কেউ আমিরাহ্কে আর হাসতে দেখেনি। আবার কেউ কাঁদতেও দেখেনি। যেন দম দেওয়া এক পুতুল, যে সবার ইচ্ছেতে সব কাজ ঠিকঠাক করে দিচ্ছে। ওর এই অবস্থা দেখে ওর মা আড়ালে ওরনায় মুখ ঢেকে কাঁদছেন। সালমা গিয়েছিল আমিরাহ্ এর বাবার কাছে, তিনি যেন এই নিকাহ্ ভেঙে দেন। কিন্তু এত ধনী এক লোককে কথা দেওয়ার পরে তা ফিরিয়ে নেওয়ার সাহস আমিরাহ্ এর বাবার নেই। তিনি এক রাতে মেয়ের কাছে এসে মাফ চেয়ে গেছেন। কিন্তু আমিরাহ্ কিছুই বলেনি। শুধু চুপ করে সব শুনে গেছে।

আজ নিকাহ্ শেষে বরপক্ষ এসে আমিরাহ্কে নিয়ে যাবে তাদের সাথে। আমিরাহ্ তার নতুন জীবনে পা রাখবে। এই নতুন জীবন নিয়ে আর দশটা মেয়ের মতো আমিরাহ্ও অনেক স্বপ্ন দেখেছে, অনেককিছু কল্পনা করেছে। স্বপ্নের রাজকুমার এসে তাকে রানির মতো সাজিয়ে সাথে করে নিয়ে যাবে তার রাজপ্রাসাদে। বাস্তবে কল্পনার চেয়েও অনেক বেশি কিছু সে পাচ্ছে। আজ রাজরানির মতোই সাজবে, কোনো এক রাজপ্রাসাদেও ঠিকই যাবে। কিন্তু যেই রাজপুরুষকে ঘিরে এত সব ভাবনা, সেই মানুষটার মুখটাই বদলে গেছে।

তাই এই এত সবকিছু উপহার, শান-শওকতে আমিরাহ্ এর কিছু আসে যায় না। সবাই বলছে সে ধনী নারী হতে চলেছে, কিন্তু তার নিজের কাছে নিজেকে রাস্তার ভিখিরির চেয়েও গরিব মনে হচ্ছে। যে মানুষের জীবনের সব আশা, আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন, হাসির কারণ এক নিমিষেই শেষ হয়ে যায় তার চেয়ে ভিখিরি আর কে আছে?

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে