আমার মেয়ে পর্ব-০৫

0
935

#আমার_মেয়ে
#Khadija_Akter
#পর্ব_০৫

বোতলে কইরা পানি নেওয়ার লাইগা কলপাড়ে যাইতেই,কলপাড়ের পেঁয়ারা গাছটায় শাকিলার ঝুলন্ত লাশটি সবার প্রথমে আমিই দেখি!

তারপর আর কি,আমার চিৎকার শুনে সবাই কলপাড়ে ছুটে আসে।একে একে সবাইই দেখতে পায় শাকিলার লাশ।

গতকাল সমাজের নির্মম উপহাস,পরিহাসের স্বীকার হয়ে আজ আবার মেয়ের মৃতদেহ দেখতে হচ্ছে!সবার মাঝে যেটুকু প্রাণ ছিল, সেটুকুও শেষ হয়ে গেল।
আমার শাশুড়ী মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন।শ্বশুর মশাইকে দেখে তো মনে হচ্ছিল আশেপাশে কি ঘটছে না ঘটছে তিনি তার কিছুই বুঝতে পারতাছেন না।আসলে তিনি তখন মানসিক ভাবে একদমই স্বাভাবিক ছিলেন না।

একদিকে সকাল হবার আগেই গ্রাম ছাড়তে হবে,অন্যদিকে নিজেদের একমাত্র বোনের মৃত্যুর শোক পালন করবে নাকি মৃতদেহের কি ব্যবস্থা করবো সেইটা ভাবতে ভাবতেই তোমার বড় ভাসুর আর আমিও দিশাহারা হইয়া যাই।
আর তখন আমার দেবররা তো সব ছোড ছোড,অরা আর কি করবো।

সকাল হইতেই এই ব্যাপারটা জানাজানি হইয়া যাইব যে শাকিলা আত্মহত্যা করছে।তহন তো গ্রামবাসী আরও বেশি কইরা ঝাপাইয়া পড়বো আমাগো নিন্দা করার জন্যি।পুলিশি ঝামেলাও হইয়া যাইতে পারে।

সেদিন সেই ভোর রাত্রিরে আমার শাশুড়ী কঠিন,খুব কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নিছিল।
শাকিলার মৃতদেহ না দেখার ভান কইরা,রাতের আঁধারেই ঐ বাড়ি ছাইড়া চইলা আসি আমরা চিরতরে!

আম্মা আমাগো সংসারের প্রত্যেকটা মানুষের মাঝে ঘোষণা কইরা দিছিল,ঐদিনের পর থেইকা কেউ যেনো শাকিলার নামটা মুখে উচ্চারণও না করে।কেউ যদি আর শাকিলার কথা জিকির করছে তাইলে আম্মা নিজ হাতে তারে কোতল করবো।বার বার বইলা দিছে আমগো ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যাতে এই কলঙ্কের কথা কখনো না জানে।
আমরাও নিজেদের আত্মগ্লানি ভুলে থাকবার লাইগা শাকিলা নামের ইতিহাসটাকে নিজেগো মধ্যেই দাফন কইরা দিছিলাম।
এই আইজকা তুমিই প্রথম জানলা।আমাগো কোনো পোলাপাইন বা আমার অন্য কোনো জা’য়েরা কিন্তু এই ব্যাপারে এখনো কিছুই জানে না।

এই যে এই ভিটামাটি যেইটাতে এহন আমরা আছি?এইটা ছিল আমাগো শাশুড়ীর দূর সম্পর্কের একটা মামার পৈতৃক সম্পত্তি।এইখানেই আমাগো শাশুড়ী মা তার ৫ ছেলে,বউ আর স্বামীকে নিয়া উঠছিল ২১ বছর আগে।
সেইসময় আম্মার অই মামা আছিলেন শয্যাশায়ী। তাকে দেখাশোনা করার জন্য তহন কেউই ছিলো না।উনার মা মরা বড়লোক ছেলেপিলেরা সব বিলেতে চইলা গেছিল আধমরা বাপটাকে রাইখা।

আমাগো তহন দরকার আছিল একটা আশ্রয় আর সেই নানার তহন দরকার আছিল সেবা করার মানুষ, কথা কওয়ার জন্যি মানুষ।তাই এই বাড়িত্তেই উইঠা যাই।

৩/৪ বছর রোগেশোকে ভুগে সেই নানা মারা যান।আর যাওয়ার আগে তার সহায় সম্পত্তি পোলাগো নামে না কইরা,আমার শাশুড়ীর নামে দিয়া যান।
নানার বড়লোক বিলেতি পোলারাও আর এইটা নিয়া ক্যাচাল করে নাই কখনো।বৃদ্ধকালে বাপের দায়ভার এড়াইতে পারছিল ঐটাই ঢেঢ় আছিল তাদের কাছে।

নানাশ্বশুর মইরা যাওয়া কয়েকদিন পরেই আমার শ্বশুরও মইরা যায়।
তয় একটা কথা জানো রাকা,শ্বশুর মইরা যাওয়াতে কিন্তু আমরা সবাই খুশিই হইছিলাম।

তুমি কি কখনো শুনছো কোন স্ত্রী তার স্বামীর মৃত্যু কামনা করে?আমার শাশুড়ী কিন্তু এইটাই করছিল।প্রতি ওয়াক্ত নামাজ শেষে তিনি আল্লাহর কাছে চাইতেন যেন আল্লাহ তার স্বামীকে এই দুনিয়া থেকে মুক্তি দেন।

কারণ মানুষটার কষ্ট চোখে দেখবার মতোন ছিল না।
শাকিলার সেই ঘটনা আব্বার মস্তিষ্কে যেই প্রভাব ফেলাইছিল,সেইটা থেইকা তিনি আর বার হইতে পারেন নাই এই জীবনে।দিনদিন তার অবস্থা অনেক খারাপ হইতাছিল।ঠিক মতো খাইতেন না,গোসল করতেন না।শরীরে নানান রকম রোগ বাসা বাঁধতাছিল।
মাঝেমাঝে নিশুত রাইতে শাকিলা শাকিলা করতে করতে ঘর থেইকা বাহির হইয়া যাইতেন।
জীবনের শেষ সময়গুলাতে উনারে তো শিকল দিয়া বাইন্ধা ঘরে বন্দী কইরা রাখতে হইছিল।সবাই বুঝছিলেন,একমাত্র মৃত্যুই আব্বাকে দুনিয়ার এই আজাব থেইকা মুক্তি দিবার পারবো।
আহ্ রে জীবন!

সেই যে সে থেইকা আমাগো শাশুড়ী একটু একটু, একটু একটু কইরা এই সংসারটা গইড়া তুলছে।অহন আমরা এই এলাকার সবচেয়ে অবস্থাসম্পন্ন কৃষক ঘরের বউ।

আমার শাশুড়ী বেশ শক্ত মনের মানুষ হইলেও,শাকিলার ব্যাপারটা শাশুড়ী আম্মাকেও মানুসিক রোগী বানাইয়া দিছে এহন।
উনি মনে করেন কন্যা সন্তান মানেই পাপ,কলঙ্ক।
উনি যেই পাপের বোঝা মাথা নিয়া ঘুরতাছে,উনার সরল সোজা স্বামী যেই পাপের বোঝা সইতে না পাইরা পাগল হইয়া এক সময় মারা গেল,উনি চান না উনার কোনো পোলার লগে বা পোলার বউয়ের লগে এই ঘটনা কখনো ঘটুক।
তাই উনি আমাদের মেয়ে বাচ্চা নিবার দেয় না আমি জানি এইটা ঠিক না।
কিন্তু সব কিছু তো আমার চোখের সামনেই ঘটছে রে রাকা,তাই চাইলেও শাশুড়ীর লগে কড়া কইরা কোনো কথা কইবার পারি না।

প্রায় প্রায় রাত্তিরে আমি আম্মার ঘর থেইকা কান্নার আওয়াজ পাই। হয়তো শাকিলার কথা মনে কইরাই কান্দে নয়তো তার মৃত স্বামীর কথা।
অপরাধবোধ আমারও কম না রাকা।শাকিলার সেই মৃতদেহ অমনি করে রেখে আসা,কোনো ব্যবস্থা করতে না পারা,সেই লাশটা শিয়ালে নিল নাকি কুত্তায়,শকুনে খাইলো সেই খবর না রাখার গ্লানি আমাদের সংসারের প্রত্যেকটি মানুষের বিবেককে কুঁইড়া কুঁইড়া খায় এখনো।কিন্তু আমরা তো নিরুপায় ছিলাম রে রাকা……..!”

যতটা সম্ভব পুরো কাহিনী বলে ভাবী হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলেন।আমার চোখ দিয়েও টপটপ করে পানি পড়ছিল।
খুবই মর্মান্তিক ঘটনা।আমার শাশুড়ী তাহলে কতটা কষ্ট তার বুকে ধামাচাপা দিয়ে আছেন!অথচ কাউকে একটুও বুঝতে দেননি।

———————-

গভীর রাত,
শুয়ে আছি কিন্তু চোখে একফোঁটাও ঘুম নেই।শাকিলা আপার কথাই বারবার মনে পড়ছিল।কতই বা বয়স ছিল তখন!না বুঝে করে ফেলা একটা ভুলের কারনে না জানি সমাজের কতটা অপমান তাকে সহ্য করতে হয়েছে!বাবা-মায়ের আদরের দুলালীয়া না জানি মনে কত্ত অভিমান নিয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে!

আচ্ছা সমাজ শুধু মেয়েদের দোষই কেন দেখে!সমাজ কি পারলো না সেই ছেলেটিকেও খুঁজে এনে শাস্তি দিতে?সেও তো সমান অপরাধীই ছিল।তাহলে শাস্তি শুধু মেয়ে পাবে কেন?কারন সে ‘মেয়ে’ বলেই?
কিংবা সমাজ তো এই সমস্যার অন্য সমাধানও করতে পারতো।ছেলেটিকে খুঁজে এনে বিয়েও দিয়ে দিতে পারতো তাদের।তাহলে তো ঝরে যেত না দু’টি প্রাণ।

আহ্,কি কঠিন ছিল তখন সমাজব্যবস্থা!
তখনকার সমাজের কথাই বা বলছি কি,এখনকার সমাজের মানুষের ধ্যানধারণাই কি খুব বেশি পাল্টেছে?
এখনকার সমাজ ব্যবস্থা তো আরও খারাপ। বিপদে পড়লে মানুষকে ধিক্কার দিতে জানে,অপমান লাঞ্চনা করতে জানে এই সমাজ;আবার সেই মানুষটিই যখন তাদের দেওয়া অপবাদের বোঝা নিতে না পেরে আত্মহত্যা করে বসে।তখন ঠিক এই সমাজই আবার সেই মৃত মানুষটির জন্য সহানুভূতি,সহমর্মিতা দেখাতে আসে।বাহ্!

তবে একটা ব্যাপার তো পরিষ্কার হয়ে গেলাম,আমার শাশুড়ী ঠিক কি কারণে মেয়ে সন্তান চান না।
আমি ভাবলাম আমি যদি উনাকে ভালো করে বুঝাতে পারি যে, একজন খারাপ হলেই যে সবাই খারাপ হবে এমন তো কথা নাই।
ভালো করে শিক্ষা দিলে,চোখে চোখে রাখলে,ভালোমন্দ বোঝার ক্ষমতা তৈরি করে দিলে নিশ্চয়ই সব মেয়েই শাকিলার মতো ভুল করবে না।
কিন্তু তা না করে মেয়ে জন্ম দেওয়াই যদি বন্ধ করে দেন এটা কেমন হলো!উনি যেটা করছেন সেটা তো আসলে ভুল,অন্যায়,এটা উচিত না।শাশুড়ী নিশ্চয়ই আমার কথা মানবেন।

আমার অবুঝ মনে আর তর সইলো না।একটুও দেরী না করে তখনই ঘুমন্ত রাশেলের পাশ ঘেষে চুপিসারে নেমে চলে গেলাম শাশুড়ীর ঘরের দিকে।

দুইবার টোকা পড়তেই শাশুড়ী দরজা খুলে দিলেন;হয়তো উনি জেগেই ছিলেন।আমাকে দেখে উনি কিছুটা অবাক হয়ে চেয়ে রইলেন,মুখে কিছু বললেন না।

আমি ঘরে ঢুকেই কোনোরকম ভনিতা না করে নরম গলায় আম্মাকে বুঝাতে শুরু করে দিলাম,

–দেখেন আম্মা,মেয়ে সন্তান কিন্তু অভিশাপ না কোনোভাবেই।কন্যা সন্তান আল্লাহর নেয়ামত।আল্লাহ যদি নিজে আমাদের এই নেয়ামত দিতে চান আর আমরা যদি নিতে অস্বীকার করি সেটা কত বড় পাপ হবে বলেন তো।আম্মা দূর্ঘটনা তো ঘটেই যায় কোনো না কোনোভাবে।এখন আমরা যদি একটা ঘটনাকে কেন্দ্র করে…

কথার মাঝপথে আমাকে থামিয়ে দিয়ে শাশুড়ী গলায় বেশ বিরক্তি নিয়ে বললেন,

–এতো রাত্তিরে তুমি আইছো আমারে ওয়াজ শুনাইতে?তুমি কইতে কি চাও, সেইডা সোজাসুজি কইয়া বিদেয় হও এহন বউমা।আমি ঘুমামু।

আমি বেশ কাতর গলায় ফস করে বলে বসলাম,

–আম্মা আমি শাকিলা আপার ব্যাপারে সব জানি।কিন্তু আমি বলতে চাচ্ছিলাম যে সবাই যে শাকিলা আপার মতো…

–কিহ্,কি কইলা তুমি?শাকিলা?শাকিলার ব্যাপারে তুমি জানো?কি জানো হা, কি জানো?কার এত্তো সাহস আমার বাড়িত্তে থাইক্কা আমার বংশের কলঙ্ক ছড়ায়।আজ আমি দেইখা ছাড়মু।এই মাইয়া এই,কার কাছ থেইকা শুনছো এইসব কথা কও,এক্ষুনি নাম কও….।

এতো রাতে শাশুড়ীর এমন হাঁকডাকে পাশের ঘরে থাকা বড় ভাসুর ও বড় জা দৌঁড়ে এলেন।রাশেলও ঘুম ভেঙে দৌঁড়ে চলে এলো মা’র কাছে।
মেঝো ভাসুর হয়তো বাহিরে বেরিয়েছিল কোনো কারণে, মায়ের ঘরে আলো দেখে আবার সোরগোল শুনে সেও দ্রুত চলে আসলো এই ঘরে।
সবাই হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে বুঝতে চেষ্টা করছে এখানে ঘটছেটা কি!

রাগের চোটে আমার শাশুড়ীর মুখ দিয়ে কথার সাথে সাথে ফেনাও বেরিয়ে আসছে,যার কারণে তিনি এক নিঃশ্বাসে কিসব বলে যাচ্ছেন কোনো কথাই বুঝা যাচ্ছে না।

তবে কোনো না কোনো কান্ড ঘটিয়ে আমিই যে শাশুড়ীকে রাগিয়ে দিয়েছি এটা এই ঘরে সদ্য আসা ৪টি প্রাণীই বেশ বুঝতে পারছিল।
তারা একবার আমার দিকে তাকাচ্ছে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে, আমার কাছ থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে আবার মা’র দিকে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করছেন তাদের মা এক নাগাড়ে কি বলে যাচ্ছেন।

‌এদিকে আমি ভয়ে ঘরের এক কোণে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপছি।শাশুড়ীর রাগ আমি নিত্যদিনই দেখি, এটা কোনো ব্যাপার না।কিন্তু আমার জীবনে এই প্রথমবারই শাশুড়ীকে এতো পরিমান রাগতে দেখছি আমি।

‌যদিও বড় জা আমাকে প্রথমেই নিষেধ করে দিয়েছিল,শাকিলা আপার ব্যাপারে কারো সাথে কোনো কথা না বলতে।
‌কিন্তু আমি ভেবেছিলাম,আমি যদি শাশুড়ীকে ঠিকভাবে বুঝাতে পারি তাহলে কাজ হয়ে যাবে।কিন্তু আমার চিন্তা ভাবনার হিতে বিপরীত করে উনি যে এভাবে রেগে যাবে একদম বুঝতে পারিনি।আসলে আমি হয়তো একটু বেশিই আবেগপ্রবণ হয়ে গেছিলাম।

‌এতোক্ষণে আমার শাশুড়ী কিছুটা স্পষ্টভাবে কথা বলতে সক্ষম হলেন।বড় বউ আর ছেলেদের উদ্দেশ্য করে এক নাগাড়ে বলে যাচ্ছেন,

‌–ক ক,তোরা কে শাকিলার সম্পর্কে এই পাকনা মাইয়াডারে কইছোস।ক কার এত্তো সাহস,কে আমার মুখে কালি মাখবার চাস।এক্ষুনি ক…

‌শাশুড়ীর মুখ থেকে শাকিলা আপার কথা শোনামাত্র দেখলাম আমার স্বামী,জা ও ২ ভাসুর সবাই একদম পাথরের মতো জমে গেলেন।তাদের মুখ শুকিয়ে গিয়ে চোয়াল ঝুলে পড়লো।

‌তারমানে আমি ছাড়া এখানকার প্রত্যেকেই শাকিলা আপার কথা উঠলে মায়ের এই ভয়াবহতার কথা জানেন!
‌কি ভুলটাই না আমি করে ফেলেছি,শাশুড়ীর সাথে শাকিলা আপার ব্যাপার নিয়ে কথা বলতে এসে।আমার প্রচুর কান্না আসতে লাগলো।
‌এবার শাশুড়ী আমার দিকে ফিরে বললেন,

‌–অরা তো কইবো না জানি।এই মাইয়া তুই ক,কে তোর কানে এইসব দিছে।না কইলে এক্ষুনি তো পেডে লাত্থি মাইরা তোর মাইয়া পয়দা করার খায়েশ মিটাই দিব।

‌এবার আমি দুহাতে পেট ঢেকে সত্যি সত্যি ঝরঝর করে কেঁদে ফেললাম।শাশুড়ী যেভাবে ধরেছেন,আমার মুখ থেকে নাম বের না করে ছাড়বেন না।আর নাম না বললে আমার পেটের বাচ্চাটার ক্ষতি করতেও উনি দ্বিধাবোধ করবেন বলে আমার মনে হচ্ছে না।

‌আমি কাঁদতে কাঁদতেই মুখ তুলে বড় জা’য়ের দিকে তাকালাম।বেচারীর অবস্থা তো আমার চেয়েও খারাপ।দেখে মনে হচ্ছে উনার নামটা নেওয়ার সাথে সাথেই উনি মূর্ছা যাবেন।চোখের ইশারায় উনি উনার নাম না বলার জন্য মিনতি করে যাচ্ছেন আমার কাছে বারবার।
‌এদিকে শাশুড়ী বারবার তাড়া দিচ্ছেন,কে আমার কাছে শাকিলা আপার ব্যাপারে বলছে নাম বলার জন্য।

‌আমি চোখটা বন্ধ করে নিয়ে এক মুহূর্ত ভাবলাম।তারপর মুখটা শক্ত করে একজনের দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে দিলাম।

‌শিকারের পরে খাওয়ার লোভে হিংস্র প্রাণীর চোখ যেভাবে চকচক করে উঠে, প্রশ্নের উত্তর পেয়ে আমার শাশুড়ীর চোখও ক্রোধে চকচক করে উঠলো।

তিনি এক লাফে ঘর থেকে বের হয়ে উঠানে রাখা লাকড়িগুলোর থেকে একটা শক্তপোক্ত কাঠের চ্যালা নিয়ে আসলেন।
কেউ কিছু বুঝে উঠার আগেই রাশেলের উদলা পিঠে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে এক ঘা বসিয়ে দিলেন।
আমি সাথে সাথে চোখ বন্ধ করে মাথা চেপে ধরে চিৎকার দিয়ে উঠি।

শাশুড়ী রাশেলের পিঠে আরেক ঘা বসাতে যাবেন,তখনি আমার ভাসুরেরা মাকে আটকায়,একজন হাত থেকে লাঠিটা নিয়ে বাহিরে ছুড়ে ফেলে দেয়।

রাশেল মূর্তির ন্যায় কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে এক দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে আছে।সেই দৃষ্টিতে কি ছিল! বিস্ময়, ভয়,ক্রোধ,ঘৃণা নাকি বেদনার নীল ছায়া তা আমি বুঝতে ব্যর্থ হলাম।
কঠিন এই আঘাতের পরেও তার মুখে বরাবরের মতো কোনো প্রকার অভিব্যক্তি নেই।

হ্যাঁ জা’কে বাঁচাতে গিয়ে আমি আমার স্বামীর দিকেই আঙুল তুলে দিয়েছিলাম।
আবেগের বশে শাশুড়ীকে বুঝাতে আসা আমার ভুলের ফলভোগ আমার স্বামীই করলো।

কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে রাশেল হঠাৎ মাথা নত করে বাহিরে চলে গেল।ও যখন পিছন ফিরে যাচ্ছিল,লক্ষ্য করলাম ওর পিঠ বেয়ে কেটে যাওয়া তাজা ক্ষতস্থান থেকে ফিনকি দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত পড়ছে।দেখে আমার গা টা শিউরে উঠলো।
অমসৃন কাঠের লাকড়ি হওয়ায়,সেটার আঘাতে রাশেলের পিঠের মাঝামাঝি কেটে গিয়ে একদম ছেড়াবেড়া হয়ে গেছে!

এদিকে আমার জা আমাকে ধরে আমার ঘরের দিকে নিয়ে গেলেন।

শাশুড়ীকে আমার বড় ২ভাসুর মিলে শান্ত করার চেষ্টা করছেন।
যেতে যেতে উনার গজরানো এখনো বেশ শুনতে পাচ্ছি আমি,

“সবচেয়ে আদর সোহাগ দিয়া আমি তোরেই পালছিলাম,তোরে লেখাপড়া শিখাইয়া শিক্ষিত করছি আমি এই দিন দেখার লাইগা!নিজে নিজে বিয়া কইরা লইয়া আইছোস,মাইনা নিছি।এহন বউয়ের কথায় চইলা তুই মা’র আর নিজের মরা বইনের বদনাম করস বউয়ের কাছে!এত্তো সাহস তোর,বংশের কলঙ্কের কথা জনে জনে বইলা বেড়াস!অরে আমি ভালা ভাবছিলাম,এহন দেহি এই ছোড পোলাডাই সবচেয়ে খারাপ হইছে,মায়ের আদেশ অমান্য করে……..”

সারারাত কেটে গেল রাশেল আর ঘরে ফিরলো না।
চোখ বন্ধ করতেই রাশেলের কাটা পিঠটা চোখের সামনে ভেসে আসছে শুধু।আমার কলিজাটা পুড়ে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে মনে হচ্ছে।

রাশেল ঘরে না আসাতে একদিক থেকে ভালোই হয়েছে,ওর সামনাসামনি হতে হয়নি আমাকে।
নিজের কাছেই নিজেকে এতো ছোট লাগছে যে,সকালে ওর সামনে আমি কোন মুখে দাঁড়াবো আর কি বলবো সেটা চিন্তা করতে করতেই রাতটা নির্ঘুম কাটিয়ে দিলাম।
মাঝেমাঝে সবচেয়ে কাছের মানুষটার সামনা করাটাই বুঝি পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজগুলোর মধ্যে একটি হয়ে দাঁড়ায়!

——————

সকালে দরজা খুলতেই উঠানে একটা দৃশ্য চোখে পড়তেই আমার মনের মেঘ অনেকটাই কেটে গেল।
মিষ্টি রোদে গা এলিয়ে রাশেল একটা পিঁড়িতে বসে আছে,আমার শাশুড়ি ওর পিঠে হলুদ আর কি কি লাগিয়ে দিচ্ছেন আর একটু পর পর আঁচলে নিজের চোখ মুছে চলছেন।

সারাটা দিন চলে গেল,রাশেলের সাথে কথা হলো না।ওর সামনাসামনি হইনি যে তা না।কিন্তু ওকে দেখলেই আমার ভিতরটা কেমন মিহিয়ে যাচ্ছিল।আর রাশেলও নিজ থেকে আমার সাথে কথা বলার কোনো আগ্রহ প্রকাশ করলো না।

সন্ধ্যায় বাজার থেকে ঘরে ফিরতেই আমি আর থাকতে পারলাম না,রাশেলের হাতটা খপ করে ধরে বললাম,

–প্লিজ আমাকে মাফ করে দাও।আমি ভয় পেয়ে তোমার নামটা বলে ফেলেছি।আমার জন্যই তো তুমি ঐভাবে মার খেলে।

রাশেল ওর হাতের উপর থেকে আমার হাতটা সরিয়ে নিয়ে অত্যাধিক শীতল কন্ঠে বললো,

–রাকা,আমার এটাতে কোনো কষ্ট নেই যে আমি আমার মায়ের হাতে মার খেয়েছি।আমার কষ্ট এটাই,তুমি শাকিলা আপার কথা তুলে আমার মাকে কষ্ট দিয়েছো।
তোমাকে আমি বলেছিলাম তুমি এই নামটা মুখে নিবে না,কিন্তু তুমি কি করলে?তুমি ঠিক আমার মায়ের সামনে গিয়েই শাকিলা আপার কথা তুললে!

–আমি,আমি না বুঝতে পারিনি ঠিক।আমি তো…..

–শাট আপ রাকা।জাস্ট শাট-আপ!
তোমার কোনো কৈফিয়ত আমি শুনতে চাই না।আমি কি তোমাকে কিছু বলেছি রাতের ব্যাপারে?
বলিনি তো?আমার মাথা গরম হলে তুমি আমার কে সেটাও ভুলে যাব।তাই ভালো হয় তুমিও চুপ থাকো

রাশেল তার নিজের রাগ আর ধরে রাখতে না পেরে চেচিয়ে উঠলো আমার উপর।তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
আমি চুপচাপ কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।সত্যি বলতে রাশেলের মা আমার সাথে যেমনি করুক না কেন,রাশেল অত্যন্ত আমার সাথে এই গলায় আগে কখনো কথা বলেনি।কখনো খারাপ ব্যবহারও করেনি। লজ্জায় আমার ইচ্ছে করছে মাটির নিচে ঢুকে যাই।

রাতে রাশেল অনেক রাত করেই ঘরে আসলো।ঘরের লাইট জ্বালালো না।অন্ধকারেই হাতড়ে মেঝেতে পাটি বিছিয়ে বিছানা করে শুয়ে পড়লো।
আমি জেগে থেকেও ঘুমের ভান করে খাটের উপরে পড়ে রইলাম।
তখনো জানতাম না পরের দিন আমার কপালে কি অপেক্ষা করছে।

——————–

পরদিন সকাল থেকে দুপুর অব্দিও রাশেলের সাথে আমার কোনো কথা হলো না।প্রিয় মানুষটির সাথে একই ঘরে থাকছি,খাচ্ছি,ঘুমাচ্ছি অথচ কথা বলতে পারছি না।এর চেয়ে কষ্টের হয়তো কিছুই হয়না।

কিছু করতে পারুক বা না পারুক এই একটা লোকের কাছেই আমি আমার সমস্ত অভিযোগগুলো পেশ করতাম।এই বাড়িতে আমার আপন বলতে শুধু সেই ছিল যার কাছে আমার পেটে জমে থাকা সকল কথা শেয়ার করতমা।সে নীরব হয়ে শুনতো শুধু আমার কথা,কখনো বা টুকটাক উত্তর দিত।
এখন তার সাথেও কথা বলা যাচ্ছে না।
কিন্তু আমার সামনে তো আরও বড় ধাক্কা অপেক্ষা করছিল তখনো।

দুপরবেলায় খেতে বসে সবার সামনেই আম্মা ঘোষণা দিলেন,

–রাশেল,যত দ্রুত সম্ভব তুই এই মাইয়াকে তালাক দিবি।আমি দেইখা শুইনা ভালা ঘরের মাইয়া আনমু এবার তোর জন্যে।

মায়ের কথা শুনে রাশেল চমকে উঠে মায়ের দিকে তাকায় একবার,পরক্ষণেই আবার আমার দিকে একনজর দেখে মাথা নিচু করে ফেলে।
তারপর সে আগের মতোই নির্লিপ্ত হয়ে ভাতের থালায় ভাত নাড়াচাড়া করতে থাকে।

এদিকে শাশুড়ীর কথা শুনে আমার বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠে!কি বলছেন এটা আমার শাশুড়ী! শেষমেষ কিনা উনি ঘর ভাঙার কথাই চিন্তা করলেন!

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে