আমার পূর্ণতা পর্ব-২৩+২৪

0
599

#আমার_পূর্ণতা
#রেদশী_ইসলাম
পর্বঃ ২৩

আজ সাপ্তাহিক ছুটির দিন। এ দিনটায় সাধারণত তাফসির একটু বেশিই ঘুরাঘুরি করে। কখনো বা সাথে শাহিন থাকে আবার কখনো বা থাকে না। তবে বেশিরভাগ সময়ই সে একায় থাকে। শাহিন অলস প্রকৃতির। সে আরামপ্রিয় মানুষ। যেখানে রাত সেখানে কাইত টাইপ। তবে তাফসিরের ধাতে আবার এসব নেই। সে ফিট থাকতে পছন্দ করে। হার্ড ওয়ার্ক করে। সপ্তাহের দু’টি ছুটির দিন যখন শাহিন ঘুমিয়ে কাটায় তখন তাফসির সকাল সকাল উঠে দৌড়ে বেরায় টরেন্টোর কোনো জগিং পার্ক বা স্বচ্ছ রাস্তার অলিতে-গলিতে। আজ এমনই জগিং করতে এসেছে সে একটা পার্কে। পার্কের শেষ প্রান্তে একটা বিশাল নীল পানির নদী। পার্কের ভেতর সরু আঁকাবাকা চিকন রাস্তা। রাস্তার দু’ধারে ওক,পাইন,বার্চ, লাল পাতার কুসুম গাছ সহ আরোও অনেক নাম না জানা গাছ। যার অধিকাংশ পাতায় রাস্তায় অবহেলিত হয়ে গড়িয়ে আছে। অনেকক্ষণ দৌঁড়ানোর পর একটা সময় ক্লান্ত হয়ে সে ধপ করে বসে পড়লো একটা খয়েরি রঙের কাঠের বেঞ্চিতে। এমন বেঞ্চ এখানে আরও অনেক আছে। চার পা হাঁটলেই এমন একেকটি বেঞ্চ পাওয়া যায়।
তাফসিরের ঘামে ভেজা এ্যাশ কালারের টিশার্টটি লেপ্টে আছে তার গায়ে। গলায় ঝুলানো ওয়ারলেস এক্সপেন্সিভ কালো হেডফোন। যেটি সে গত ভ্যাকেশনে ইতালি থেকে কিনেছিলো। এটি বেশ পছন্দ তাফসিরের। গেলো ও বহুদিন। এখনো নষ্ট হয় নি। পরনে কালো ট্রাউজার এবং পায়ে কালো স্নিকার্স। তাফসির সেই ঘর্মাক্ত অবস্থায় বেঞ্চে হেলান দিয়ে চোখ বুঝলো। চোখের সামনে ভেসে উঠলো কিছু সুন্দর মুহুর্ত। প্রতিদিন সকালে জগিং শেষে বাড়িতে ফিরে প্রাচুর্যকে কলেজে পৌছে দেওয়া। তার সাথে ঝগড়া করা। প্রাচুর্যের রাগী মুখটাকে দেখার জন্য বিভিন্ন ভাবে রাগিয়ে দেওয়া। প্রতিদিন রাতে লুকিয়ে লুকিয়ে প্রাচুর্যের ঘরে ঢুকে অনেকক্ষণ যাবত তাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা। মাঝে মাঝে উষ্ণ পরশ দেওয়া।
কিন্তু কুম্ভকর্ণ মেয়েটি তো বুঝতেই পারে না। আবার বিয়ের ডেট ঠিক করার দিন রাতে ছাঁদে প্রাচুর্যকে প্রথম জড়িয়ে ধরা। আর সব শেষে ওইদিন রাতের ওইসব দৃশ্য সব কেমন জীবিত এখনো। আর কি কোনো স্মৃতি আছে? না আর তো কোনো স্মৃতি মনে পরছে না তার। এতো কম স্মৃতি? আরও কিছু স্মৃতি হলে কি সমস্যা হতো? তাহলে তো তাফসির অনায়াসেই সেইগুলো ভেবে ভেবে কানাডার দিন গুলো পার করতে পারতো। নাহ আর কিছু ভাবতে পারছে না সে। বুকের ভেতর হালকা চিনচিনে ব্যাথা হচ্ছে তার। এই অনুভুতি গুলো সম্পূর্ণ নতুন তার কাছে। সে আরও চাই। অনেক অনেক স্মৃতি চাই প্রাচুর্যের সাথে। যাতে গল্প করতে করতে গোটা দিন শেষ হলেও স্মৃতি না শেষ হয়।

হঠাৎ পাশে কারও উপস্থিতি অনুভব করে আস্তে আস্তে চোখ খুলে তাকালো তাফসির। তাকে তাকাতে দেখে পাশে বসা নারীটি উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বললো—

” থ্যাংক গড তুমি চোখ খুলে তাকিয়েছো তাফসির। আমি তো ভেবেছিলাম ঘুমিয়ে পরলে নাকি ”

সোনালি রেশমি চুলের স্লিভলেস ট্যাংক টপ এবং শর্ট লেগিংস পরা মেয়েটিকে দেখে বিশেষ ভালো লাগলো না তাফসিরের।চোখ ফিরিয়ে নিলো সামনে। যদিও কানাডায় এমন অহরহ নারী দেখা যায় বরং এর থেকে শর্ট ড্রেস পরেও তারা অনায়াসেই ঘুরে বেড়ায়। তবে তাদের দিকে বেশিক্ষণ দৃষ্টি স্থির রাখতে পারে না তাফসির। অস্বস্তি হয় তার। তাফসির সামনের লাল পাতার গাছটির দিকে দৃষ্টি দিয়ে বললো—

” তুমি এখানে কি করছো ক্যামিলি? ”

” ওমা আমাকে দেখে বোঝা যাচ্ছে না বুঝি যে আমি হাঁটতে এসেছি? অবশ্য ভালো করে তো দেখলেই না। ”

” তুমি তো সচারাচর এদিকে আসো না। আজকে আসলে যে? ”

” আজকে মনে হলো এদিকে একটু আসা উচিৎ। অনেকদিন আসা হয় না। তাই এলাম। ”

তাফসির আর খুঁজে পেলো না যে এরপর কি বলা উচিৎ। তাই মাঝের সময় টুকু নিরবতায় থাকলো। নিরবতা ভঙ্গ করে ক্যামিলি নামের কানাডিয়ান মেয়েটি বলে উঠলো—

” শুনলাম বাংলাদেশে গিয়েছিলে। তা কেমন ঘুরলে দেশে?”

” বেশ ভালোই। তারপর বলো তোমার কি অবস্থা? দিনকাল কেমন যাচ্ছে? ”

” আমার দিনকাল তো ভালোই যাচ্ছে। চলো না ব্রেকফাস্ট করে আসি একসাথে। ”

” সরি ক্যামিলি আজ বোধহয় সম্ভব নয়। শাহিন অপেক্ষা করছে বাড়িতে। অন্য কোনোদিন হবে। ”

তাফসিরের কথায় ক্যামিলি মন খারাপ করে বললো—

” ওও মাই ব্যাড লাক। ওকে নেক্সট টাইম। ”

তাফসির বসা থেকে উঠে দাড়াতে দাড়াতে বললো—

” আচ্ছা থাকো তাহলে। কালকে অফিসে দেখা হবে। বাই ”

এই কথা বলে তাফসির আর কোনো দিকে না তাকিয়ে সোজা বাড়ির পথ ধরলো।

ক্যামিলি তার অফিসের কলিগ। বাংলাদেশে যাওয়ার পর এই মেয়েই তাকে আই লাভ ইউ লিখেছিলো যেটা কিনা প্রাচুর্য দেখেছিলো। কিন্তু সেদিন সে ক্যামিলি কে রিজেক্ট করলেও ক্যামিলি পেছন ছাড়ে নি তার। যদিও বাংলাদেশে থাকা কালীন আর বিরক্ত করে নি তবে কানাডায় আসার পর আবার প্রপোজ করেছিলো। তখন তাফসির বলেছিলো সে বিবাহিত। তারপর থেকে আর কিছু বলে নি। স্বাভাবিক ভাবেই কথা বলেছে। কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই তাফসির এড়িয়ে চলেছে ক্যামিলিকে। মেয়েটা কে বেশি সুবিধার বলে মনে হয় না তাফসিরের কাছে। ক্যামিলিকে নিয়ে সে অনেক কথায় শুনেছে। ইভেন সে এটা ও শুনেছে বছর দুয়েক আগে ক্যামিলি স্টিফেন নামের এক ছেলের সাথে লিভ-ইন রিলেশনে ছিলো। যদিও এটা এদের কাছে কমন কিন্তু তার কাছে তো আর না। বিদেশের মাটিতে পা দিলেই যে নিজের ধর্ম,সংস্কৃতি সব ভুলে যেতে হবে তার তো কোনো কথা নেই।
.
.
.
.
তখন সন্ধ্যা ৭ টা। রাস্তার দু’ধারে লালচে সোডিয়াম লাইটের আলোয় চারপাশ আলোকিত। ফুটপাত ধরে আইসক্রিম খেতে খেতে হাঁটছে প্রাচুর্য আর রিয়া। গন্তব্য বাড়ি। অলরেডি মিসেস শাহানা দু তিন বার ফোন দিয়ে ফেলেছে রিয়ার নম্বরে। কিন্তু তখন তারা দু বোন স্ট্রিট ফুড খেতে ব্যস্ত তাই ফোন ধরার অতো সময় কোই। তাই এখন ফ্রি হয়ে রিয়া ফোন বের করে কল লাগালো মিসেস শাহানার ফোনে। মিসেস শাহানা ফোন রিসিভ করে গড়গড় করে বললেন—

” রিয়া কোথায় তোরা? তাড়াতাড়ি বাড়িতে আয়। দশ মিনিটে। ”

মিসেস শাহানার কথায় রিয়া ভ্রু কুঁচকে বললো—

” কি হয়েছে ছোট মা? এতা তাড়াহুড়ো করছো কেনো? কোনো সমস্যা? ”

” এতো কথা বলার সময় নেই। যা বলেছি তাড়াতাড়ি কর। দশ মিনিটেই যেনো বাড়িতে দেখি। “__বলে সাথে সাথে ফোন কেটে দিলেন মিসেস শাহানা।

রিয়ার চোখেমুখে ভাজ দেখে প্রাচুর্য রিয়াকে জিজ্ঞেস করলো—

” কি হয়েছে আপু? মা কি বললো তোমাকে? ”

” বললো দশ মিনিটে বাড়িতে যেতে। কথা শুনে মনে হলো ইমার্জেন্সি কিছু। চল তো তাড়াতাড়ি যায়। ”

” হ্যাঁ চলো। সিরিয়াস কিছু নাহলে তো আর এতো জরুরি তলব করবে না। ”

তারা দু’জন রিকশা নিয়ে চৌধুরী বাড়ির গেটের সামনে আসলো। রিয়া রিকশা মিটিয়ে তাদের বাড়ির দিকে তাকাতেই দেখলো একটা গাড়ি পার্ক করা। রিয়া হাতের কনুই দিয়ে প্রাচুর্যকে গুতা মেরে বললো—

” এই প্রাচুর্য বাড়িতে কে এসেছে বল তো? এটা তো আমাদের বাড়ির গাড়ি না। ”

” আমি কিভাবে জানবো আপু? তুমিও যেখানে আমিও সেখানে। ভেতরে গেলেই না বুঝবে? ”

” হ্যাঁ তাই তো। চল তো গিয়ে দেখি। ”

রিয়া আর প্রাচুর্য সদর দরজা পেরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখলো ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে আছে অচেনা এক মহিলা ও পুরুষ। রিয়া মাথায় চাপ দিয়ে মনে করার চেষ্টা করলো যে আগে কোথাও দেখেছে কিনা এই মধ্যবয়সী মহিলা ও পুরুষকে। কিন্তু না মনে পরলো না তার। এর মধ্যেই মিসেস মুমতাহিনার চোখ পরলো রিয়ার দিকে। তিনি হেসে সামনে বসে থাকা দম্পতিকে বললেন—

” ওই তো এসে গেছে আমার মেয়ে রিয়া। রিয়া মা এদিকে আয় তো। এখানে এসে বোস। ”

মিসেস মুমতাহিনার কথায় ড্রয়িংরুমে অবস্থিত সকলের একঝাঁক চোখের দৃষ্টি এসে পরলো তার দিকে। তাতে রিয়া অস্বস্তিতে গাঁট হয়ে পরলো। কিন্তু তবুও কিছু করার নেই।মা যখন ডেকেছে তখন হাজার অস্বস্তি হলেও তার যেতে হবে। নাহলে ব্যাপারটা বেয়াদবি হয়ে যাবে। তাই রিয়া ধীর পায়ে এগিয়ে যেয়ে সোফায় মিসেস মুমতাহিনার পাশে বসলো। ক্ষীণ স্বরে সামনে বসা দম্পতিকে সালাম দিলো।
সামনে বসা দম্পতি তার সালাম নিলো। সাথে সাথে মহিলাটি হেঁসে বললো—

” মাশাল্লাহ মা তোমাকে তো খুব মিষ্টি দেখতে। ভাগ্যিস দেখতে এসেছিলাম নাহলে তো জানতাম না তুমি এতো সুন্দর। ”

মহিলাটির কথায় রিয়া থম মেরে গেলো। তার আর বুঝতে বাকি রইলো না যে কাহিনী কি। কিন্তু সে যা ভাবছে তা যদি সত্যি হয় তাহলে তো সর্বনাশ।

প্রাচুর্য এসে মিসেস শাহানার পেছনে দাঁড়ালো। জিজ্ঞেস করলো—

” এরা কে মা? ”

” রিয়াকে দেখতে এসেছে। তোর মেজো বাবার বন্ধু আর তার বউ। ওনার ছেলে নাকি ভালো চাকরি করে। তাফসিরের মতোই ইন্জিনিয়ার। তোর মেজো বাবার কাছে সম্মন্ধ দিয়েছিলো। তোর মেজো বাবা রাজি হয়েছে। আমাদের তো কিছু বলে নি। হুট করে হাজির হয়েছে এখন। ”

মিসেস শাহানার কথায় প্রাচুর্য কিছু বললো না। কেনো জানি ঠিক ইন্টারেস্ট পাচ্ছে না এখানে থাকতে। তাই সাত পাঁচ না ভেবে ঘরে চলে গেলো সে। তার এখন কথা বলতে ইচ্ছা করছে তাফসিরের সাথে। গতো তিনদিন ঠিক মতো কথা হয় নি তাদের। ঠিক মতো কি? কথায় তো হয় নি। শুধু একবার ফোন দিয়ে বলেছিলো কি করছিস,খেয়েছিস কিনা,বিজি আছি পরে কথা হবে এইটুকু। একে কি আর কথা বলা বলে? সে দেখেছে মানুষ তার গার্লফ্রেন্ড বা বউয়ের সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলে। কিন্তু তার বেলায় কি হলো? তার স্বামীর পাঁচ মিনিট ও কথা বলার সময় থাকে না। আর যখন সময় হয় তখন তো বাংলাদেশে মাঝ রাত। ঘুমিয়ে পরে প্রাচুর্য। তাই কথা ও হয় না তেমন।

প্রাচুর্য চার্জ থেকে ফোন খুলে রিং দিলো তাফসিরের নাম্বারে। একবার,দু’বার, তিনবার তারপরেই খট করে কেটে গেলো কল। তাতে প্রাচুর্যের মনে একরাশ কালো মেঘ জমা হলো। পরমুহূর্তেই ফোনের স্ক্রিনে ভেসে উঠলো ভিডিও কল। তাফসির ভিডিও কল দিচ্ছে। মনের কালো মেঘ সরে যেয়ে প্রাচুর্যের মনে ধরা দিলো দিনের মতো ঝলমলে সূর্যের আলো। প্রাচুর্য সময় নষ্ট করলো না। চটপট ফোন রিসিভ করলো। তাতে ভেসে উঠলো তাফসিরের মুচকি হাসি মিশ্রিত মুখ। প্রাচুর্য ঝকঝকে দাত বের করে চমৎকার হাসলো। অতি উৎসাহ মিশ্রিত কন্ঠে বললো—

” কি করছেন তাফসির ভাই? ”

প্রাচুর্যের ওই ঝলমলে হাস্যরত মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হলো তাফসির অনায়াসেই কাটিয়ে দিতে পারবে বহু যুগ। তাফসির ঠোঁটের কোণের হাসি চওড়া হলো। অতি আবেগ মিশ্রিত কন্ঠে বললো—

” এইতো বউয়ের ফোনের অপেক্ষাতেই ছিলাম। ”

লাল আভায় ছেঁয়ে গেলো প্রাচুর্যের মুখ। তা দেখে ঠোঁট কামড়ে হাসলো ফোনের ওপাশে থাকা অতি সুদর্শন যুবকটি। ঠোঁটে মুচকি হাসি বজায় রেখে তাফসির বললো—

” এতোক্ষণ কোথায় ছিলেন ম্যাডাম? আরেকটু আগে ফোন দিলে তো পারতেন। ”

” বাসায় ছিলাম না তো। জানেন রিয়া আপুকে দেখতে এসেছে? ”

” বাহ বেশ ভালো তো। ওর পর্ব শেষ হলেই আপনি পার্মানেন্টলি আমার ঘরে। কিন্ত কি করে ছেলে? ”

” মা বললো ইন্জিনিয়ার। এখনো ভালো ভাবে জানি না। মেজো বাবা রাতে হয়তো আপনাকে ফোন দিতে পারে। তখন ভালো করে জেনে নিবেন। কিন্তু একটা কথা কি জানেন? আমার মনে হয় না আপু রাজি হবে। আমি না একটা জিনিস টের পেয়েছি। বলতে পারেন শুনেছিও। এটা যদি সত্যি হয় তাহলে আমার মনে হয় বাড়িতে একটা ঝামেলা হলেও হতে পারে। ”

#চলবে

#আমার_পূর্ণতা
#রেদশী_ইসলাম
পর্বঃ ২৪

প্রকৃতিতে সকাল নেমেছে। বাইরে রোদ উঁকি দিচ্ছে। পাখিরা কিচিরমিচির শব্দে সবাইকে উঠার আহবান জানাচ্ছে। তাফসির উঠে দরজা খুলে বারান্দায় যেয়ে দাঁড়াতেই ঠান্ডা হাওয়ার শরীর ছুঁয়ে দিলো। এখন ডিসেম্বর মাস। এ সময় কানাডায় বেশির ভাগ দিনই বরফে আচ্ছাদিত থাকে। গাছের পাতা সহ শুরু করে রাস্তাঘাট সব জায়গাতেই বরফের মোটা আস্তরণ। ওয়েদার ফোরকাস্টে মাইনাস ডিগ্রি দেখাচ্ছে। অফিসও ছুটি আছে আজ।
তাফসির ফ্রেশ হয়ে শাহিনকে ডেকে ওঠালো ঘুম থেকে। শাহিন ঘুমে ঢুলতে ঢুলতে লিভিং রুমের সোফায় ধপ করে শুয়ে পরলো। শাহিনের দিকে এক পলক তাকিয়ে তাফসির ব্রেকফাস্ট রেডি করতে থাকলো। তাফসির টোস্টারে ব্রেড দিতে দিতে শাহিনের গলা পেলো।

” ভাই তোর ফোন বাজছে। নিয়ে আসবো? ”

” হ্যাঁ নিয়ে আয়। ”

অনুমতি পেয়ে এক লাফে সোফা থেকে উঠে ফোন আনতে গেলো শাহিন। রুম থেকে বের হতে হতে বললে—

” উইলসন ফোন দিচ্ছে। এখন আবার ওর কি দরকার?”

” ফোন রিসিভ করলেই না বুঝবো? ”

তাফসির শাহিন থেকে ফোন নিয়ে কানে ঠেকাতেই উইলসন বললো—

” কি খবর তাফসির কি করছো? ”

” ব্রেকফাস্ট রেডি করছি। কি হয়েছে এতো সকাল সকাল ফোন দিলে যে? আজ তো অফিস ছুটি। ”

” আজ যে আমার বার্থডে এটা কি তোমরা ভুলে গেলে তাফসির? একবার তো উইশ ও করলে না। ”

কিছুক্ষণ ভাবার পর মনে পরলো যে হ্যাঁ আজ তো উইলসনের জন্মদিন। কিন্তু তার তো মনে নেই। অবশ্য মনে না থাকায় স্বাভাবিক। ইদানীং তার উপর যে প্রেশার যাচ্ছে। তাই দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো—

” দুঃখিত উইলসন। জানোই তো কি পরিমাণ প্রেসারে আছি। একদমই ভুলে বসেছি। আমি সত্যিই দুঃখিত। যাই হোক শুভ জন্মদিন। ”

” ধন্যবাদ। আচ্ছা সেসব বাদ দাও। রাতে একটা পার্টি রেখেছি। অবশ্যই আসছো তো তুমি আর শাইন? ”

” সঠিকভাবে বলতে পারছি না। আসার চেষ্টা করবো। ”

” আমি কোনো কথা শুনতে চাই না তাফসির। তোমরা আসছো তো আসছোই। তোমরা না আসলে আমি অনেক কষ্ট পাবো। ”

” আচ্ছা বেশ। আসবো। ”
.
.
.
.
সপ্তাহ খানিক হলো প্রাচুর্যের কলেজে প্রি-টেস্ট পরীক্ষা শেষ হয়েছে। তবুও ছুটি পাওয়া দুষ্কর। যেহেতু কিছুদিন পরেই এইচএসসি তাই পড়ার চাপ ও অনেক বেশি। যেমন এখনো সে পরার টেবিলে বসে আছে। এর মধ্যে ঘরের ভেতর উঁকি দিলো রিয়া। মাথা অর্ধেক ঢুকিয়ে জিজ্ঞেস করলো—

” এই প্রাচুর্য পড়ছিস? থাক তাইলে পরে আসবো। ”

” সমস্যা নেই আপু। আসো তুমি। ”

রিয়া ঘরে ঢুকে খাটের উপর বসতে বসতে বললে—

” তাফসির ভাই কবে আসবে রে? ”

” বললো তো খুব তাড়াতাড়ি আসবে। কেনো? ”

রিয়া করুন স্বরে বললো—

” বাবা আজকেও একটা পাত্র পক্ষ আনছে। আমি আর কতো রিজেক্ট করবো বল! রীতিমতো হাঁপিয়ে উঠছি তো। ভাইয়া তো বললো ম্যানেজ করবে কিন্তু বাবা যদি না শোনে তখন? ”

” আরে শুনবে শুনবে। অতো চিন্তা করো না তো। ”

” চিন্তা করবো না বলছিস? আমার তো মনে হচ্ছে যেভাবেই হোক আজকের ছেলেটার সাথে আমার বিয়ে দিয়েই ছাড়বে। কারন এতোদিন তো যতগুলো বাহানা শিখেছি সব দেওয়া শেষ। আর কি বাহানা দেবো বল। ”

” আরফান ভাইয়াকে বলো পরিবার নিয়ে দেখতে আসতে। তুমি আর কতোদিন অপেক্ষা করবে বলো। ”

” আর আরফান। ওই ব্যাটা আস্ত এক বজ্জাত। প্রতিদিন তিন বেলা করে বলছি যে বাসায় প্রস্তাব নিয়ে আসো। ব্যাটা আসবো আসবো করে আসেই না। আজকে আর একবার বলবো। আসলে আসলো নাইলে একদম ব্রেকআপ। হুহ আমিও কম যায় না। ”

” তাফসির ভাইকে বলো যেনো আরফান ভাইয়াকে বলে প্রস্তাব নিয়ে আসতে। উনি বললে আরফান ভাইয়া শুনবে আমি শিওর। ”

” বলেছি ভাইয়াকে। ভাইয়া বলেছে জানাবে। ভাগ্যিস ভাইয়া একটু ম্যানেজ করছে বাবাকে। আমাকে বিয়ে আটকানোর পথ বলে দিচ্ছে নাহলে তো সেদিনই বাবার সেই বন্ধুর ছেলের সাথে বিয়ে ঠিক হয়ে যেতো। ”

” এক্ষেত্রে ক্রেডিট কিন্তু আমারই৷ আমি যদি না বলতাম তাহলে তাফসির ভাই জানতো কোথা থেকে বলো। তুমিও তো বলো নি প্রথমে। ”

” আরে আমি তো ভয় পেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম ভাইয়া রাজি হবে না। পরে দেখি ওমা সে-তো রাজি। তখন যে কি খুশি লাগছিলো জানিস না। আর আমি জানি ভাইয়া রাজি মানেই কোনো না কোনোভাবে বাবা ও রাজি হয়ে যাবে। আচ্ছা তুই কিভাবে জানলি আমার আর আরফানের রিলেশনের কথা। ”

” সারাদিন যেভাবে ফুসফুস করে কথা বলতে। আগে তো তোমার হাতে তেমন একটা ফোন ই দেখা যেতো না আর এখন তো খেতে গেলেও ফোনটা সাথে নিয়ে যাও। তাই সন্দেহ হয়েছিলো আমার। আর তারপর কিভাবে শিওর হলাম জানো? টিএসসিতে তোমাকে আর আরফান ভাইয়াকে একসাথে দেখেছিলো প্রিয়তি। ওই আমাকে বলেছিলো। ”

” ভালোই কুটনী আছে তো। ওরে তো ভালো ভাবতাম। ”

” যাহ কিসব বলছো। ভুলে যেয়ো না ও কুটনামতি করেছে বলেই কিন্তু আমি জানতে পেরেছি। আর আমার থেকে তাফসির ভাই। ”

” লিস্টে তুই ও আছিস দেখছি। ”

” ইহ ছিলাম বলেই বিয়ে এখনো আটকাতে পেরেছো। কোথায় বাহবা দিবা তা না। ”

এর মধ্যেই ঘরে ঢুকলো মিসেস মুমতাহিনা। তিনি রিয়াকে দেখেই চিল্লিয়ে বললেন—

” তুই এখনো এখানে বসে আছিস? ওইদিকে পাত্র পক্ষ চলে আসলো বলে। যা তাড়াতাড়ি রেডি হ। প্রাচুর্য ওকে রেডি হতে হেল্প কর তো। আর শোন রিয়া সুন্দর শাড়ি পরবি সাথে সুন্দর করে সাজবি। যেনো পাত্র পক্ষের দেখলেই পছন্দ হয়ে যায়। যদি অন্যদিনের মতো করিস তাহলে আজকে তোর বাবা হাড্ডি গুড্ডি আলাদা করে দেবে মনে রাখিস। ”

বলে রুম থেকে বের হয়ে গেলো মুমতাহিনা বেগম। সাথে সাথে রিয়া মুখ ভেঙচি কেটে বললো—

” সুন্দর করে রেডি হবো না তো আরও কতো কি করবো!!এমন ভাবে রেডি হবো যাতে পছন্দ তো দুরেরই কথা সাথে সাথে রিজেক্ট করে দেয়। ”

” থাক আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। চলো তোমাকে রেডি করে দি। ”

এই তিন মাসে রিয়া নানা রকম বাহানা দিয়ে বিয়ে ভেঙেছে। আর সেসব বাহানা তাফসিরই শিখিয়েছে রিয়াকে। তাদের ভাই-বোনের এসব কাহিনি দেখে মাঝে মাঝে প্রাচুর্যের হাসতে হাসতে পেট ফেটে যায়। সেদিন প্রাচুর্য নিজের সন্দেহের কথা বলেছিলো তাফসিরকে। কিন্তু তখন তাফসির কিছুই বলে নি। পরে যখন ইকরাম চৌধুরীর বন্ধুর ছেলের সাথে বিয়ে ঠিক হবে হবে ভাব সেই মুহুর্তে রিয়ার মাথায় সর্ব প্রথম তাফসিরের কথায় মাথায় আসলো। সেই মুহুর্তে তাফসির ছাড়া আর কেউই সাহায্য করতে পারতো না তাকে। আর সে জানতে যদি তাফসিরকে সবকিছু বুঝিয়ে বলে তাহলে নিশ্চয়ই বুঝবে সে। কারন সে নিজেও তো প্রাচুর্যকে ভালোবাসে। তাই ভালোবাসার মর্ম টা অন্তত বুঝবে। অনেক দেনা মনা করে ভয়ে ভয়ে সে তাফসিরের সামনে স্বীকার করলো সব। তাফসির পরে আরফান সম্পর্কে সব খোঁজ খবর নিয়েই রাজি হয়েছে। আর ততোদিনে রিয়াও তাফসিরের সাথে আরফানের পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। এখন দু’জনের সম্পর্ক ও বেশ ভালো।

” আপু দেখো তো সব ঠিকঠাক আছে নাকি? ”

প্রাচুর্যের কথায় ঘোর কাটলো রিয়ার। সে এতোক্ষন মনে মনে নানা জল্পনা কল্পনা করছিলো কিভাবে বিয়ে ভাঙা যায়। এবার নিজের দিকে ভালোভাবে তাকিয়ে নাক শিটকালো সে। গজগজ করে বললো—

” তোকে বললাম এতো ভালো ভাবে সাজাতে হবে না। তুই সেই ঠিকভাবে সাজিয়ে দিলি। আয়না টা ও দেখতে দিলি না। ধুর তুই কোনো কাজেরই না। ”

” শোনো কপালে যা আছে তাই হবে। তুমি ভালো করে সাজলেও কি আর না সাজলেও কি। ”

” পাত্র পক্ষ চলে এসেছে। নিচে চল। “__ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন মিসেস ফারাহ।

পাত্র পক্ষ চলে এসেছে শুনেই হাত পা কাঁপা কাঁপি শুরু হয়ে গেলো রিয়ার। মানে আবার সেই সেজেগুজে বসে থাকতে হবে অন্য পুরুষের সামনে। মনে মনে একজনকে ভালোবেসে আরেকজনের জন্য সেজে বসে থাকা যে কি পরিমাণ কষ্টের সেটা যার সাথে হয় একমাত্র সেই বোঝে। এর মধ্যেই মিসেস ফরাহ উঠে দার করালেন রিয়াকে। মাথায় ভালো করে ঘোমটা টেনে রিয়াকে সাথে করে নিয়ে গেলেন। আর প্রচুর্য সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকলো। তাফসিরের কঠর নিষেধাজ্ঞা আছে যেনো বাড়িতে রিয়াকে দেখতে আসলে সে কখনো নিচে না যায়। না জানি কখন দেখা গেলো আবার পাত্র পক্ষ তাকে পছন্দ করে বসলো। আর সে তার বউকে নিয়ে এক বিন্দু রিস্ক নিতেও রাজি নয়।
রিয়া শক্ত করে মিসেস ফারাহর হাত ধরে আস্তে নিচে আসলো। আর ফারাহ বিভিন্ন কথা বলে ভরসা দিচ্ছে রিয়াকে। এতো টুকু পথ সে একটুও মাথা তুলে তাকায়নি। সে অবস্থাতেই সে সালাম দিলো সবাইকে। সালামের উত্তর দিয়ে একটি মহিলা শান্ত কন্ঠে বললেন—

” এসো মা তুমি আমার পাশে এসে বসো। ”

মিসেস ফারাহ হাতে হাতে মহিলাটির পাশে এনে বসিয়ে দিলো রিয়াকে। বাড়িতে ইশতিয়াক চৌধুরী বা ইনসাফ চৌধুরী কেউই নেই। ব্যবসার কাজে বাইরে গেছেন তারা তাই ইকরাম চৌধুরীই সব সামলাচ্ছেন। হঠাৎ ইকরাম চৌধুরী ভরাট কন্ঠে সামনে বসে থাকা যুবকের উদ্দেশ্যে বললেন—

” তো তুমি তাফসিরের বন্ধু? ”

” জ্বি ”

” নাম কি তোমার?”

” আরফান খন্দকার ”

রিয়া নামটা কি ঠিক শুনলো? বুক কেঁপে উঠলো তার। এই ঠান্ডার মধ্যে ও কেমন গরম লাগছে তার। কান দিয়ে গরম ধোঁয়া বের হচ্ছে যেনো। ধীরে ধীরে মুখ তুলে পাশে তাকাতেই বিমূর্ত হয়ে গেলো সে। না ভুল দেখেনি সে। এটাই তো তার প্রেমিক পুরুষ। যাকে সবটা উজাড় করে ভালোবাসে সে। অবশেষে এতোদিন পর আসলো তবে। কিন্তু সে তো কিছু জানে না। কোথার থেকে কি হলো।

” তাফসির যখন তোমার কথা বলেছে সেহেতু বোঝায় যাচ্ছে তুমি ভালো ছেলে। আমার আর খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজন নেই। যায় হোক কি করো তুমি? ”

” এস আর কোম্পানির নাম শুনেছেন আশা করি। আমি সেখানকার ম্যানেজার পদে আছি।”

রিয়া মনে মনে ভাবলো—এস আর কোম্পানির ম্যানেজার মানে কও? কবে পেলো জব? সে তো কিছুই জানে না।

” হ্যাঁ শুনবো না কেনো। ভালো বড় কোম্পানি। তা আমার মেয়ের ভরনপোষণ পোষাতে পারবে তো? ”

আরফান হালকা হেঁসে বললো—

” কি বলছেন আঙ্কেল? আপনার মেয়ে তো রাক্ষস নয় যে ভরনপোষণ পোষাতে পারবো না। আশা রাখছি পারবো। বাকিটা আল্লাহ ভরসা। ”

” বেশ। তো কেমন লাগলো আমার মেয়েকে? পছন্দ হয়েছে? ”
.
.
.
গভীর রাত। গালে পিঠে কারও আলতো হাতের স্পর্শে ঘুম হালকা হলো তাফসিরের। বোঝার চেষ্টা করলো কি হচ্ছে তার সাথে। এখনো ঘুম পুরোপুরি ভাঙে নি তার। ঘুমিয়েছে ঘন্টা খানিক হলো। তাই ঘুম এখন গাঢ় হবে এটাই স্বাভাবিক। এখনো বাইরে থেকে মৃদু মিউজিকের আওয়াজ আসছে। ছেলে থেকে শুরু করে মেয়ে সবাই-ই মদ খেয়ে পরে আছে সোফা থেকে শুরু করে একেক জায়গায়। কারোরই কোনো দিকে হুঁশ নেই। তবে তার সাথে এমন করছে কে? শাহিন? কিন্তু সে নিজেই তো ঘুমিয়েছে তাফসিরের আগে। তবে?

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে