আগন্তুক পর্ব-০৮

0
805

আগন্তুক
– সাবিহা বিনতে রইস

পর্ব – ৮

গাড়িটা চলছিলো লাল মাটির মেঠো পথ ডিঙিয়ে। বৃষ্টি ভেজা গ্রামীণ পথের এখানে ওখানে পানি জমেছে। দুপাশে সুউচ্চ গগনচূড়া, শাল, জারুল, শিমুল গাছের মহা অরণ্য। কিছু দূর পর পর দু একটা করে কৃষ্ণচূড়া গাছও আছে। গাছগুলোতে ফুল নেই। বর্ষার মৌসুমে এইসব গাছে ফুল থাকার কোন কথাও নেই। কেবল লকলকে পাতা, হাওয়ায় তোড়ে দুলছে। সবুজ, স্নিগ্ধ সবুজ। চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছিলো তনিমার।

– শোনো, সামনে আর পথ নেই, এগুনো যাবে না গাড়ি নিয়ে। নামতে হবে

– এক সাইডে গাড়ি দাড় করাও, নেমে পড়ছি।
– হাঁটতে পারবে এই রাস্তা দিয়ে?
অন্তু ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞাসা করলো তনিমাকে।
– বেশ পারব। আর না পারলে তুমি তো আছই, কোলে করে পৌছে দিবে।

তনিমার কথা শুনে শিষ দিয়ে উঠলো অন্তু। হেসে বললো,

– ম্যাডাম আজ খুব খোশমেজাজে আছে বুঝতে পারছি।

গাড়ির দরজা খুলে সন্তর্পণে কাঁদাজল এড়িয়ে পা রাখলো তনিমা। তৎক্ষনাৎ ভেজা মাটির সেঁদো গন্ধ এসে লেগেছে নাকে। সাথে নাম না জানা মৃদু ফুলের ঘ্রাণ। তনিমা এগিয়ে এলো। অন্তুও ততক্ষণে নেমে পড়েছে গাড়ি থেকে। সে এসেই তনিমার হাত ধরলো, তারপর এগিয়ে গেল খানিকটা। তনিমাও তার হাত ধরে এগুলো ধীর পায়ে। অন্তুর সাথে তার পরিচয় মাস সাতেক আগে। পরিচয় থেকে একটু একটু প্রণয়। অন্তু পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত আছে। তনিমা মাসখানেক আগে বাড়িতে অন্তর বিষয়ে জানিয়েছে। অন্তুও তার পরিবারে বলেছে তনিমার কথা। দুই পরিবারের প্রাথমিক সম্মতিতে এগুচ্ছে বিয়ের আলোচনা। তবে এখন করোনা মহামারীর ভয়ে বিয়েও আপাতত স্থগিত।

– এই, কি সুন্দর একটা ঘ্রাণ, পাচ্ছো? কিসের বলো তো? লেবু ফুল নাকি?

তনিমার কথাশুনে অন্তু পেছনে ঘুরে তাকালো। তারপর নিজের নাকের দিকে নির্দেশ করে বললো,

– ঘ্রাণ নিয়ে মরব নাকি? এই বাতাসে যে ভাইরাস নেই, কে বলতে পারে? তোমাকে কতবার বললাম মাস্ক পরে নাও, শুনলে না তো।

– এই বাতাসে করোনা থাকবে না। এটা স্পর্শের মাধ্যমে ছড়ায়।

– সাবধান থাকলে ক্ষতি কি?

তনিমা শ্বাস ছাড়ল। সে ভুলেই গিয়েছিলো অন্তু মাস্কে নাক ঢেকে রেখেছে। সত্যিই তো চারিদিকে যা ভাইরাসের ভয়! সতর্ক না থেকে উপায় কি! এই মধ্যে তো বাসা থেকে বের হওয়ায় উচিৎ নয়। তিন মাস পেরিয়ে গেছে। তবুও করোনা থেকে রেহাই নেই। মানুষ অবশ্য এত কিছু মানছে না। অনুষ্ঠান, আয়োজনের শেষ নেই তাদের৷ এই তো সেদিন মিলনায়তনে হয়ে গেল সেরার সেরা লেখক এওয়ার্ড। এত মানা করছে এখন ভিড় না করার, শুনছে কে? অবশ্য এবছর অনুষ্টানে লোক সংখ্যা ছিলো নগন্য। প্রায় সবাই টিভিতে বসেই অনুষ্ঠান উপভোগ করেছে। তনিমা নিজেও। গত দুই বছরই সে লাবণ্যর সাথে নিজে অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকেছে। এইবার কি থেকে যে কি হয়ে গেল! লাবণ্য লেখালেখি বন্ধ করে দিয়েছে। শুধু লেখালেখি কেন, কোন কিছুই সে করছে না আর। বোঝা যায়, একদম স্বাভাবিক নেই সে। দিন রাত একটা ঘরে বন্দি হয়ে পড়ে থাকে, মাঝে মাঝেই বুক ফাটানো চিৎকার দিয়ে কেঁদে ওঠে, কখনো অদ্ভুত ভয়ে অজ্ঞান হয়ে যায়। তনিমার বিশ্বাস হয় না এটাই তার সেই লাবণ্য। কতগুলো বছর পাশাপাশি কাটিয়েছে তারা। তবে লাবণ্যর থেকেও বেশি মায়া লাগে তার চয়নকে দেখে। মানুষটা ভিষণ ভেঙে পড়েছে। তনিমার সাথে শেষ যেদিন দেখা হলো, সেদিন দেখলো চোখের নিচে কালি, মুখটা শুকনো৷ চকিতে তনিমার মনে পড়ে গেল সেই হ্যান্ডসাম চয়নের কথা। কাউকে কোনদিন বলতে পারেনি, একসময় লাবণ্যর সাথে সাথে সেও চয়নের প্রেমে পড়েছিলো। প্রিয় বান্ধবীর ফিয়ন্সের প্রেমে পড়া নিশ্চয় সভ্য কোন ব্যাপার নয়! তাই মনের দুর্ণিবার প্রেম আর ভালোবাসাকে চাপা দিয়ে তাদের শুভ কামনা জানিয়েছিলো সে। নিজেও সব ভুলে নতুন করে জীবন শুরু করতে চলেছে। কিন্তু তবুও কেন যেন চয়নকে খারাপ থাকতে দেখলে তার বুকের ভেতর ঝড় ওঠে। সেদিনের চয়নের মিইয়ে পড়া মুখটা দেখে তার মনে হয়েছিলো লাবণ্যর পাশে এবার দাঁড়ানো দরকার। চয়নকে ভালো দেখতে চাইলে, লাবণ্যকে সুস্থ করতে হবে। আর এমনিতেও লাবণ্যর বিষয়টি নিয়ে প্রথম থেকেই প্রচণ্ড সন্দেহ ছিলো তনিমার। একটা অশরীরির এত ক্ষমতা, যে সুস্থ সুন্দর একটা জীবনকে নিমিষেই শেষ করে দিলো? তবে তাকে দেখতে হবে বিষয়টা, এই ভেবেই অন্তুকে নিয়ে তার বেরিয়ে পড়া। গাড়িতে পুলিশ ডিপার্টমেন্টের লোক দেখলে ঝামেলায় পড়ার সুযোগ কম ভেবে, তাকে প্রস্তাব দিয়েছিলো তনিমা৷ অন্তুও রাজি হয়েছে তনিমার সাথে সময় কাটানোর লোভে।

– অবশেষে পৌছালাম তোমার অতি আকাঙ্ক্ষার শ্বেত মহলে। দারুণ, তাইনা?

হঠাৎ অন্তুর কথায় ঘোর ভাঙলো তনিমার৷ নিজের মনে ভাবতে ভাবতে গন্তব্যে পৌছে গেছে খেয়ালই করেনি সে। সামনে বড় গেট পেরিয়ে উঁকি দিচ্ছে তাজমহলের মতো ধবধবে দারুণ সুন্দর এক শ্বেত মহল৷

– আসো, ভেতরে যাই।

অন্তু যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই হাত টেনে ধরেছে তনিমা।

– এই, আমরা ঠিক জায়গায় এলাম? এটায় শ্বেত মহল?

অন্তু ভ্রু কুচকালো।

– এটা ছাড়া কোনটা হবে? তুমি যা বর্ননা দিয়েছিলে তার সাথে হুবহু মিলে যাচ্ছে। আর এই গ্রামের থানার দারোগাকে ফোন দিয়ে আমি ঠিকানা জেনে নিয়েছিলাম। তিনি নিজে বলেছেন, এই বাড়িতে কিছুদিন আগে শহর থেকে আসা দুই নারী আত্মহত্যা করেছে।

তনিমা তখনও অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। এতক্ষণ অন্তু তার হাত ধরে রেখেছিলো। তনিমা এবার হাত ছাড়িয়ে এগিয়ে গেল মহলটির দিকে৷ সামনে বিশাল লোহার গেটে তালা ঝুলছে। সে ওদিকে না তাকিয়ে ডান পাশে ঘুরলো, যেখানে শ্বেত পাথরের শেওলাধরা ফলকের উপরে লেখা আছে “নয়নতারা”। সাথে ১২০৮ বঙ্গাব্দ। তার মানে প্রায় ২১৮ বছর আগে তৈরি।
তনিমা নিজের মনেই বলে উঠলো

– অসম্ভব। হতেই পারে না।

অন্তু অবাক হয়ে বললো,

– সমস্যা কি, তনি? কি হয়েছে?

তনিমা তাকালো অন্তুর দিকে। বললো,

– ফলকটা পড়ো, আর এই মহলটা দেখো। তারপর আমাকে বলো, কি বুঝলে!

অন্তু মিনিট তিনেক শ্বেত মহলের দিকে তাকিয়ে চুপ করে থাকলো। তারপর ঠোঁটের কোনে মৃদু হাসি ফুটিয়ে বললো,

– ইন্টিলিজেন্ট। গোয়েন্দা কর্মকর্তার যোগ্য স্ত্রী বটে! কেউ লাবণ্যদের বোকা বানিয়েছে।

তনিমা এবার ভ্রু নাচালো, বললো

– কিংবা শুধু লাবণ্যকে।

( চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে