আগন্তুক পর্ব-০২

0
1049

#আগন্তুক
– সাবিহা বিনতে রইস
পর্ব : ২

– কি সমস্যা? কিছু হয়েছে? ছুটে এলে যে?

লাবণ্য মুখ তুলে তাকালো চয়নের দিকে। তার চোখে এখনো ভয় খেলছে। নিজেকে খানিকটা ধাতস্থ করে বললো,

– মনে হলো, কাকে যেন দেখলাম জানালার বাইরে, মানে কারো যেন শাড়ির একটা অংশ উড়ে গেল।

চয়ন এগিয়ে এসে জানালার বাইরে তাকালো৷ দারুণ মনোরম এক বসন্ত দুপুর খেলা করছে বাইরে। চয়ন লাবণ্যর কাঁধে হাত রাখলো৷ আস্বস্ত করে বললো,

– সবসময় এক হরর আর থ্রিলার লিখতে লিখতে তোমার এই অবস্থা! কতবার বলি, এই জনরা থেকে বেরিয়ে এসো৷ তুমি ভালো লেখ, যা লিখবে তাই জনপ্রিয়তা পাবে।

– জনপ্রিয়তা সব কিছু নাকি? আমি তো আমার মনের আনন্দে লিখি!

– তাহলে আর কি? এখন আতঙ্কে ভোগো! যাগ গে, দেখছো তো, আমরা দোতলায় আছি। এখানে কোন কার্নিশও নেই৷ এখানে কে দাড়িয়ে তোমাকে ভয় দেখাবে বলো তো?

লাবণ্য মাথা নাড়লো।

– হয়তো ভুলই দেখেছি৷

– হুম, তুমি যাও, ফ্রেশ হয়ে নাও৷ চোখেমুখে পানি দিয়ে একটু রেস্ট নাও।

লাবণ্য দ্বিধা নিয়ে সরে এলো জানালা থেকে৷ তাদের রুমের সাথে লাগোয়া এটার্চ বাথ। বোঝা যাচ্ছে এটা পরে তৈরি করা। বাড়ির প্রতিটি ঘরে প্রাচীনত্বের ছোঁয়া পাওয়া গেলেও, বাথরুমগুলো বেশ আধুনিক। লাবণ্য গোসল সেরে নিলো৷ যখন বেরুলো, তখন চয়ন ঘুমে বিভোর। ওদিকে অনিন্দিতার হাঁক ডাক শোনা যাচ্ছে। মনে হয় দুপুরের খাবার তৈরি। লাবণ্য চয়নকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে ওয়াসরুমে পাঠালো। তারপর বেরিয়ে এলো ঘর থেকে৷ সামনে প্রসস্থ বারান্দায় দাড়ালে অনেকদূর পর্যন্ত দেখা যায়। সামনে ফোয়ারার মাঝে মার্বেল পাথরের জলপরীটি দারুণ মোহময়। বাড়ির গাড়ি বারান্দায় রাখা আছে তাদের তিনটি গাড়ি। লাবণ্য কল্পনা করার চেষ্টা করলো, যখন এখানে জমিদার সাহেব তার পরিবার নিয়ে থাকতেন, কেমন এলাহী কারবার হতো তখন! তবে একটা বিষয় সে খেয়াল করলো, এ বাড়ির বহুদূর পর্যন্ত কোন জনবসতি নেই৷ গ্রামের শেষ হয়েছে অনেক আগেই৷ তারপর বহু পথ পাড়ি দিয়ে এসে এই বাড়ির অবস্থান। চয়ন ফ্রেশ হয়ে আসার পর তারা দুজনে নিচে নেমে এলো। বিশাল রাজসিক এক খাবার ঘর। পুরানো কাঠের লম্বা টেবিলের এমাথা থেকে ওমাথা অব্দি থরে থরে সাজানো চেয়ার৷ অনিন্দিতা, মল্লিকা, প্রত্যয়, রূপম ততক্ষনে বসে পড়েছে টেবিলে। তাদের দেখেই প্রত্যয় হাত তুললো,

– ওই যে, আমাদের হানিমুন কাপল অবশেষে এসেছে!

রূপমও সাথে সাথে গলা মেলালো,

– কি হে, কোথায় ছিলে এতক্ষন? অনিন্দিতা কতবার গিয়ে ফিরে এলো!

চয়ন হাসলো৷ তাদের সাথে গলা মিলিয়ে বললো,

– হানিমুনেই তো এসেছি বন্ধু! এত ডাকাডাকিরই কি দরকার?

– ইশ! চুপ করো না। খেতে বসো।

লাবণ্যর তাড়া খেয়ে বসে পড়লো চয়ন৷ অনিন্দিতা সকলের প্লেটে খাবার তুলে দিয়ে এক সাথেই খেতে বসলো। খেতে খেতে লাবণ্য প্রশ্ন করলো,

– একটা বিষয় খেয়াল করলাম, এই বাড়ির আশেপাশে এত বিশাল জায়গা পড়ে আছে, অথচ কারো বসতি নেই। আজব ব্যাপার, তাই না?

মল্লিকা সাথে সাথে বলে উঠলো,

– ও মা! থাকবে কিভাবে? এই পুরো জায়গাটা তো এই জমিদার বাড়িরই অংশ৷ জমিদার রাজ চন্দ্রের।

– আচ্ছা, এই জমিদার বাড়িতে কি যেন একটা ঘটনা ঘটেছিলো বলছিলি, কি হয়েছিলো?

চয়নের প্রশ্ন শুনে মাথা নাড়লো রূপম। বললো,

– সে বিশাল এক রক্তক্ষয়ী ঘটনা!

লাবণ্য সাথে সাথে আগ্রহী হয়ে উঠেছে।

– তাই নাকি? কি ঘটনা? বলো শুনি।

খেতে খেতেই গল্প শুরু করলো রূপম।

– আমি ঘটনা টা শুনেছি আমার দাদুর কাছে থেকে। দাদু শুনেছিলেন, তার বাবার থেকে৷ তার আগে কে কিভাবে শুনেছে, জানা নেই আমার৷ তবে এই গ্রামে শত শত বছর ধরে লোকমুখে প্রচলিত এই কাহিনী৷ জমিদার রাজ চন্দ্রের এই অঞ্চলে বিশাল আধিপত্য ছিলো৷ টাকা পয়সার কমতি ছিলো না। জনদরদী শাসক ছিলেন। লোকমুখে তার দান দক্ষিনার কথা প্রচলিত ছিলো৷ উনার সন্তান বলতে ছিলো এক কন্যা। নাম তার নয়নতারা।

লাবণ্য বললো,

– যার নামে এই বাড়ির নাম?

– ঠিক ধরেছো। গেটের পাশে শ্বেত পাথরের ফলকে যার নাম খোঁদায় করা আছে। তো, নয়নতারা ছিলো দারুণ রূপবতী। গায়ের রঙ শ্যামলা হলেও, মুখশ্রী নাকি ভিষণ সুন্দর৷ সেই সাথে নাচ-গানে পারদর্শী। সেই আমলে জমিদার সাহেব দিল্লি থেকে মেয়েকে তালিম দেওয়ার জন্য শিক্ষক নিয়ে এসেছিলেন। নয়নতারা অশ্ব চালনা জানতেন। ঘোড়ার পিঠে চড়ে ধূলো উড়িয়ে তিনি ছুটে বেড়াতেন তার বিশাল সাম্রাজ্যে। নয়নতারার একুশ বছর বয়সে তার বাবা ঠিক করেন মেয়ের বিয়ে দিবেন। পাত্র ঠিক হয় আরেক জমিদার পুত্রের সাথে। তো নির্ধারিত সময়ে বিয়ে হয়ে যায় তাদের। নয়নতারার শ্বশুরবাড়ি ছিলো এই অঞ্চল থেকে বহু দূরে। পালকিতে করে পাড়ি দিতে হবে প্রায় ১৪-১৬ ঘন্টার হাঁটা পথ। এর মাঝে বিশাল এক জোড়া দীঘি পেরুতে হতো তাদের। কিছুদিন পর পর যেখানে ডাকাতের কবলে পড়তো যাত্রীরা। জমিদার ঠিক করলেন, নয়নতারা যাত্রা করবে রাতে। রাতে তাদের অঞ্চল পেরুতে পারলে জোড়া দীঘি যখন পৌছাবে, তখন ভোর হয়ে যাবে। দিনের আলোতে সেখানে কোন অসুবিধা নেই। ভাবনা মতো সন্ধ্যের পর পরই বরযাত্রী সমেত বেরিয়ে পড়ে নয়নতারা৷ পথিমধ্যে আরেক দল তীর্থযাত্রী তাদের সাথে যোগ দেয়। কিন্তু নয়নতারার কপাল পোড়া। সেই তীর্থযাত্রীরূপী দল ছিলো আসলে এক ঠগীর দল। রাতের শেষ প্রহরে তারা তাণ্ডব চালায় বরযাত্রীদের উপর। হত্যা করে নয়নতারার স্বামীসহ সকল পুরুষদের। ঠগীদের হাত থেকে বাঁচতে পারেনি নয়নতারা নিজেও৷ ঠগীরা নারীদের হত্যা করত না। নয়নতারাকে তারা মারেনি, কিন্তু সম্মান ছিনিয়ে নিয়েছিলো। আই মিন, তাদের হাতে রেপড হতে হয় নয়নতারা কে৷ নয়নতারার স্বামী পালকির পাশে ঘোড়ার পিঠে যাচ্ছিলো। সেই ঘোড়াতে চড়ে ভোরের আলো ফোটার আগ মুহুর্তে নিজের বাড়িতে ফিরে আসে নয়নতারা৷

– তারপর?

প্রত্যয়ের প্রশ্ন শুনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে রূপম। এর পরের ঘটনা আরো মর্মান্তিক৷ নয়নতারা সে সময়ের জন্য প্রাণে বেঁচে গেলেও, আজ থেকে প্রায় দুশো বছর আগের সমাজে তার বেঁচে থাকাটা অতটা সহজ ছিলো না। ভোর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্রামের সব আঁনাচে কাঁনাচে ছড়িয়ে পড়ে এই ঘটনা। নড়েচড়ে বসে ধর্মান্ধ সমাজ। নয়নতারাকে নিয়ে হাজারটা কু কথা ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে। জমিদার সাহেবও লজ্জায় কুঁকড়ে যায়। ঠিক তার পরের দিন ভোরে বাড়ির চাকর বাকররা নয়নতারার ঘর থেকে তার ঝুলন্ত মৃতদেহ আবিষ্কার করে। সকলে ছুটে যায় জমিদার সাহেবকে খবর দিতে। কিন্তু হায়! জমিদার সাহেবের ঘরের কড়িকাঠে ঝুলছে তার আর গিন্নীমার দেহ। নয়নতারা মৃত্যুর আগে ঠিক বিয়ের দিনের মতোই সেজেছিলো৷ গ্রামবাসীরা চোখের জলে সৎকার করে তাদের৷

রূপম গল্প শেষ করার পরও অনেকক্ষণ পর্যন্ত তারা কেউ কোন কথা বলে না। অনিন্দিতা খাবার শেষ করার তাড়া দেয়। নিঃশব্দে সবাই খাবার মুখে তোলে৷ কেবল লাবণ্যর মাথায় হঠাৎ করে আবার নাড়া দিয়ে যায় দুপুরের ঘটনাটি। আচ্ছা, সে কি সত্যিই ভুল দেখেছিলো তখন? পুরোটি কি তার ভ্রম? নাকি এর পেছনেও লুকিয়ে আছে অন্য কোন গল্প?
(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে