আকাশের চেয়েও বেশী তোমায় ভালোবাসি পর্ব-০৩

0
1943

#আকাশের_চেয়েও_বেশী_তোমায়_ভালোবাসি
লেখনীতে:Waziha Zainab (নিহা)
তৃতীয় পর্ব

রাত একটায় কারো কথার আওয়াজে ঘুম ভাঙে আঁচলের। আঁচল তাকিয়ে দেখে আবির পাশে নেই। আঁচল বেশ অবাক হয় এতো রাতে মানুষটা কোথায় গেলো। আঁচল বিছানা থেকে নেমে বারান্দায় যায়। বারান্দায় গিয়ে দেখে আবির কারো সাথে ফোনে কথা বলছে আর হাসছে।
“রাগ করে না জান আমরা খুব তাড়াতাড়ি বিয়ে করবো। একটু বোঝার চেষ্টা করো প্লিজ।দেখো আমার হাতে এখন কোনো চাকরি নেই তাই তোমাকে বিয়ে করলে তো ঠিকভাবে খাওয়াতেও পারবো না। বাবা বলেছে কিছুদিন পর আমাকে ওনার ব্যাবসার সবকিছু বুঝিয়ে দেবে। ”
আঁচল শুধু মাত্র আবিরের কথাগুলোই শুনছে ফোনের ওপাশের কথা গুলো আঁচলের কানে আসছে না। আঁচল আবার শুনতে পেলো
“আরে ওই থার্ড ক্লাস মেয়ের কথা তোমাকে ভাবতে হবে না। আর তুমি আমার ওপর বিশ্বাস রাখো। ওকে আমি খুব তাড়াতাড়ি ডিভোর্স দেবো”
এতোটুকু শুনে আঁচলের চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়তে লাগলো। ওদের প্রেমালাপের আর একটা শব্দ ও আঁচলের পক্ষে শোনা সম্ভব না। আঁচল ঘরে গিয়ে বিছানায় শুয়ে বালিশ চেপে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়লো।আবির ফোনে কথা বললেও আঁচলের কান্নার শব্দ আবিরের কান এড়ায়নি। আঁচল ঘুমিয়ে পড়ার পর আবিরও এসে চুপচাপ আঁচলের পাশে ঘুমিয়ে পড়লো।

পরদিন সকাল নয়টায় আঁচল ঘুম থেকে উঠলো। ঘড়ির দিকে তাকাতেই আঁচল চমকে উঠলো। এতো বেলা পর্যন্ত ঘুমানো আঁচল পছন্দ করে না কিন্তু আজ সে নিজেই ঘুম থেকে দেরিতে উঠলো। কে জানি বলেছিলো “ঘুম মৃত্যুর সমান”। ” ঘুম ভাঙলে সকাল আর না ভাঙলে পরকাল”
আঁচল তাড়াতাড়ি করে উঠে ফ্রেশ হয়ে নেয়। বাড়ীর বউয়ের এতো বেলা পর্যন্ত ঘুমানো টা মানায় না।আঁচল ভাবছে
“ইসস বাবা মা সবাই আমাকে খারাপ ভাবছে। আমার এতো কেয়ারলেস হওয়াটা একদমই উচিত হয় নি।রাতে এলার্ম দিয়ে ঘুমানো উচিত ছিলো আমার”

আঁচল ফ্রেশ হয়ে রান্না ঘরের দিকে যায়। আঁচলকে দেখে আঁচলের শাশুড়ী রাহেলা বেগম বলে
“আরে বউ মা উঠেছো। টেবিলে ব্রেকফাস্ট রাখা আছে যাও গিয়ে ব্রেকফাস্ট করে নাও”
আঁচল খানিকটা কাচুমাচু হয়ে বললো
“আসলে মা আমি”
আঁচলের এতোটুকু কথার মাঝেই আঁচলের শাশুড়ী আঁচলকে থামিয়ে দিয়ে বললো
“কোনো ব্যাপার না মা। এইসময় একটু বেলা করে উঠলে সমস্যা নেই।যাও গিয়ে নাস্তা করে নাও”

বাইরে কড়া রোদ। উত্তপ্ত সূর্যের উত্তাপে মাটি ফেটে চৌচির হয়ে গেছে।আঁচল রান্নাঘরে চুলায় রান্না বসিয়েছে। আঁচলের পাশে আঁচলের শাশুড়ী রাহেলা বেগম একটা চামচ হাতে দাঁড়িয়ে আছে। শাশুড়ী বউমা দুইজনই ঘেমে একাকার হয়ে গেছে। আঁচল কিছুক্ষণ পর পর রান্নার দিকে তাকাচ্ছে আর আঁচলের শাশুড়ী আঁচলের পাশে দাঁড়িয়ে আঁচলকে রান্নার রেসিপি বলে দিচ্ছে।কার কি পছন্দ সেটাও বলে দিচ্ছে। আঁচল কপাল ভাজ করে তেলের মধ্যে মাছ দিতে গিয়ে তেল কিছুটা ছিটকে গিয়ে আঁচলের হাতের ওপর পড়ে৷ গরম তেল পড়ায় আঁচল চিৎকার করে ওঠে।আঁচলের শাশুড়ী তাড়াতাড়ি গিয়ে ফ্রিজ থেকে বরফ এনে আঁচলের হাতে লাগিয়ে দেয়। মেডিসিন দিতে বলে আঁচল বলে বেশী কিছু হয় নি সে ঠিক আছে।

রাতে আবির খাওয়ার টেবিলে আঁচলকে দেখতে না পেয়ে বেশ চমকে যায়। আবিরের মা রাহেলা বেগম আবিরকে বলেন।
“আসার সময় আঁচলকে ডেকে নিয়ে আসলে তো পারতি?”
আবির ভ্রু কুচকে বলে
“কেনো আঁচল খায়নি?”
আবিরের মা পানির জগ থেকে গ্লাসে পানি ডালতে ডালতে বলেন
“মেয়েটা সকাল থেকে কিচ্ছু খায় নি এএখন আসার সময় আমি অনেকবার ঢেকে এসেছি। কিন্তু ও বললো ওর খিদে নেই খাবে না। তুই বললে হয়তো তোর কথা শুনতো”
আবির কপাল ভাজ করে বললো
“খাবে না কেনো? এমনিতেই তো অন্য সময় দেখা যায় খাই খাই করে বাড়ী মাথায় তুলে ফেলে”
আবিরের মা পানির গ্লাস টা টেবিলে রেখে বলেন
“খাবে কি করে। মাছ ভাজা করতে গিয়ে হাত পুড়ে গেছে। আমি অনেকবার বলেছি হাতে মেডিসিন লাগিয়ে নিতে কিন্তু আমার কথা শোনে নি”
আবির এবার বিরক্তিকর ভাবে বলে ওঠে
“উফ মা। তোমারও কি আঁচলকে দিয়ে কাজ করানো টা বেশী দরকার ছিলো৷ পরে হয়তো ওই মেয়ে বাপের বাড়ি গিয়ে বলবে শাশুড়ীর নির্যাতনে তার হাতের এই অবস্থা”
আবিরের মা অবাক হয়ে বলে
“আরে আঁচল এমন না। আর আমি তো ওকে বার বার বারণ করেছিলাম রান্নাঘরে আসতে। ওর শেখার আগ্রহ দেখে আর কিছু বললাম না। আর স্বামীর সংসার করা মুখের কথা নয় সংসার করতে গেলে হাত কাটা হাত পোড়া অনেক কিছুই সহ্য করতে হয়”

আবির উঠে একটা প্লেটে করে খাবার নিয়ে ঘরে গিয়ে দেখে আঁচল বিছানার এককোণে গুটিশুটি হয়ে শুয়ে আছে। যা দেখে আবিরের মেজাজ বিগরে গেলো। আবির আঁচলের সামনে গিয়ে প্লেট টা রেখে বললো
“খেয়ে নাও”
আঁচল কোনো রিয়েক্ট করলো না
আবির আবারো বলে উঠলো
“সকাল থেকে কিচ্ছু খাওনি খেয়ে নাও।”
আঁচল আবারো কিছু বললো না। আবির এবার রেগে বললো
“এই মেয়ে তোমার সাহস তো কম না তুমি আমার সাথে পার্ট নিচ্ছো। শোনো তোমার প্রতি আমার কোনো ইন্টারেস্ট নেই। যাস্ট তোমাকে খেতে বলেছি এই জন্য যেনো পরে বাপের বাড়ি গিয়ে আমাদের বাড়ীর নামে বদনাম না করতে পারো”
আবিরের কথায় আঁচলের চোখ থেকে টপটপ করে দুফোটা পানি পড়ে। আবিরের মেজাজ চরম পর্যায়ে খারাপ হয়ে যায়। আবির এবার ধমক দিয়ে বলে
“এই মেয়ে একদম ন্যাকা কান্না করবে না। তোমাদের মতো মেয়েদের খুব ভালো করে জানা আছে আমার। আর হ্যা তুমি রান্নাঘরের ত্রিশ সীমানায় ও যাবে না। আমার মায়ের সংসার আমার মা একাই সামলাতে পারবে। এতো আগ বাড়িয়ে কাজ করার কোনো দরকার নেই তোমার। চুপচাপ খেয়ে নাও”
কথার মাঝেই আবিরের ফোন বেজে উঠলো আবির ফোনের স্ক্রিনে বিরক্তিকর ভাব নিয়ে তাকিয়ে দেখলো “Jaan ” দিয়ে সেইভ করা নাম্বার ভেসে উঠলো। আবির হাতে থাকা প্লেট টা টেবিলে রেখে ফোন নিয়ে বারান্দায় চলে যায়।।

কিছুক্ষণ পর আবির রুমে এসে দেখে আঁচল এক হাতে প্লেট ধরে অন্য হাত দিয়ে খাওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু হাত পুড়ে থাকার কারণে ঠিকভাবে খেতে পারছে না।।আবির ধীরে পায়ে এসে আঁচলের হাত থেকে প্লেট টা নেয়,,,,তারপর নিজের হাত দিয়ে খাবার আঁচলের মুখের সামনে ধরে বলে
“হা করো”
আঁচল আবিরের থেকে এমন কিছুই আশা করে নি। আবির আবার ধমক দিয়ে বলে
“হা করতে বলেছি তোমায়”
আঁচল আর কিছু না বলে চুপচাপ খাবার খেয়ে নেয়।

আঁচলকে খাইয়ে আবির হাত ধুয়ে প্লেট টা রান্নাঘরে গিয়ে রেখে আসে। এসে দেখে আঁচল ঘুমিয়ে পড়েছে। আবির ফাস্ট এইড বক্স টা নিয়ে আস্তে আস্তে আঁচলের হাতে মেডিসিন লাগিয়ে দেয়।। তারপর নিজেও গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।।

চারদিকে কিচিরমিচির নানা পাখির ডাকে আঁচলের ঘুম ভাঙে।আঁচল ধীরে পায়ে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়।রাস্তাঘাট সবকিছুই জনমানবহীন। আর গাছে গাছে পাখিরা এদিক ওদিক ছোটাছুটি করছে খাবারের খোঁজে।দূরের মসজিদ গুলোর আস্পষ্ট আজান কানে আসছে আঁচলের। চারদিকে আবছা আলো ছড়িয়ে গেছে৷ খোলা চুলগুলো হাত খোপা করে নেই আঁচল।হঠাৎ হাতের পোড়া অংশের দিকে চোখ যায় আঁচলের। আঁচল ভালোভাবে লক্ষ করে তার হাতের পোড়াস্থান মলম লাগানো আছে। আর হাত থেকে মেডিসিনের উদ্ভট গন্ধও আঁচলের নাকে লাগছে_হাতের পোড়ার যন্ত্রণাটা আগের থেকে বেশ কমে গিয়েছে।আঁচলের আর বুঝতে বাকী রইলো না মেডিসিন কে লাগিয়ে দিয়েছে। আঁচল মুচকি হাসে।

খারাপ সময় সবার জীবনেই আসে। কিন্তু খারাপের পরে ভালো দিনও আসে মানুষের জীবনে। আঁচলও সেই উত্তম সময়ের অপেক্ষায় আছে। হয়তো আবির কখনো তার ভুলটা বুঝতে পারবে আঁচলকে কাছে টেনে নেবে। পরোকিয়া থেকে দূরে সরে আসবে। হয়তো আঁচলের জীবনের সব অন্ধকারের ছায়া কেটে আবার আলোর দেখা মিলবে।। খারাপ সময় প্রতিটা মানুষের জীবনেই আসে তাই বলে প্রিয় মানুষের হাত ছেড়ে দেওয়াটা নিতান্তই বোকামি।

চলবে
[রি-চেইক করা হয়নি]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে