আংটি পর্ব-০৮ এবং শেষ পর্ব

0
3464

আংটি – সমাপ্তি পর্ব

অপরিচিত নাম্বার থেকে পাওয়া মেসেজটা দেখে চমকালাম। এমন অদ্ভুত মেসেজ আমাকে কেন পাঠিয়েছে বুঝতে পারলাম না। আমি মেসেজটা আবার পড়লাম, পড়ার মাঝেই এই নাম্বারটা থেকেই ছোট একটা ভিডিও আসলো।

ভিডিওটা চালু হতে দেরি হচ্ছে। আমি আনিকার সামনে থেকে একটু দূরে এসে দাঁড়ালাম। মা সোফায় বসে আনিকার বাবার সাথে আমাদের বিয়ের তারিখের ব্যাপারে আলোচনা করছেন। মোবাইলে তিন মিনিটের ছোট ভিডিওটা চালু হয়েছে। আমি গভীর আগ্রহ নিয়ে তাকালাম। কয়েক সেকেন্ড যাওয়ার পর আমার পুরো শরীর কেঁপে উঠলো। পুরো এক জীবনে কোন ভিডিও দেখে এতটা বিস্মিত হইনি। দু’জনের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ভিডিও। ভিডিওতে দেখানো মানুষটা ফয়সাল, তার পাশে তিশা নামের মেয়েটা। আমি বুঝতে পারার সাথে সাথে ভিডিওটা বন্ধ করে মোবাইলটা পকেটে রেখে দিলাম।

ফয়সালের সাথে তিশার ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের ভিডিও এই মেয়েটা কিভাবে পেয়েছে ? আমাকে জানতেই হবে, জানতে হবে ভিডিও টার পেছনের আসল রহস্য। আমি মায়ের পাশে সোফায় এসে বসলাম।

বিয়ের তারিখ ঠিক হয়েছে, তিন মাস পর বিদেশ থেকে ছুটিতে দেশে ফিরলেই আমাদের বিয়েটা হবে। বিয়ের তারিখ ঠিক করার পর আমি মায়ের কানের কাছে গিয়ে বললাম,
– মা দেখো, আনিকা কতোটা খুশি।

মা আমাকে আস্তে করে ধাক্কা দিয়ে বললো,
– পছন্দের মানুষটাকে আপনজন করতে পারলে প্রতিটা মানুষই ঠিক এতটা খুশি হয়। মেয়েটাকে ঠিক এরকমভাবে সারাটা জীবন সুখী রাখার চেষ্টা করবি।

মায়ের কথা শুনে আমি হেসে ফেললাম। আনিকা আমার দিকে তাকিয়ে আছে, কেন জানি আনিকার দিকে তাকাতে লজ্জা লাগছে। আমি লজ্জায় আনিকার দিকে তাকাতে পারলাম না, মাথা নিচু করে ফেললাম।

আনিকার বাড়ি থেকে বাসায় ফিরলাম। মা আমাদের বিয়ের কথাটা সবাইকে ফোন দিয়ে জানাচ্ছে। আমি মায়ের কাছ থেকে উঠে রুমে ঢুকলাম। দরজা বন্ধ করে অদ্ভুত সব প্রশ্ন নিয়ে ভাবতে ভাবতে ফয়সালকে ফোন দিলাম। ফয়সাল ফোনটা রিসিভ করেছে। রিসিভ করতেই বললাম,
– তোমার ফোনে একটা ছোট ভিডিও পাঠিয়েছি, যদি সময় থাকে ভিডিও দেখে নিও একবার।

ফয়সাল সহজ গলায় বললো,
– কিসের ভিডিও ?

আমি জবাব না দিয়ে ফোনটা কেটে দিলাম। খাটে হেলান দিয়ে বসলাম। অপেক্ষা করছি ফয়সালের ফোনের। ভিডিও টা দেখে ফয়সাল আমাকে ফোন দিতে দেরি করার কথা নয়।

পাঁচ মিনিট পরেই ফয়সালের ফোন আসলো। আমি রিসিভ করার সাথে সাথে বরফ শীতল গলায় বললো,
– কোথায় পেয়েছেন আমার এই ভিডিও ?

আমি বললাম,
– খুব ভয় পেয়েছ ? সত্যি করে বলবে এই ভিডিও টার সাথে আমার বোন তানিয়ার আত্মহত্যার কিসের সম্পর্ক ?

– কোন সম্পর্ক নেই, বিশ্বাস করেন আমাকে। ভিডিও টার সাথে তানিয়ার আত্মহত্যার কোন সম্পর্ক নেই।

– আমি জানতাম, তুমি সত্যি বলবে না। এই ভিডিও টাই তানিয়ার মৃত্যুর পেছনের সব সত্যি বের করে দিবে। আমি এখনি উচ্চ আদালতে যাবো, ভিডিও হাতে আছে। আশা করি মৃত্যু রহস্য বের করতে খুব একটা দেরি হবে না।

ফয়সাল মুহূর্তেই কাঁদতে শুরু করেছে, ওপাশ থেকে কান্নার শব্দ আসছে। কাঁদতে কাঁদতে বললো,
– আবারো বলছি বিশ্বাস করেন আমায়, তানিয়ার আত্মহত্যার পেছনে ভিডিও টার কোন সম্পর্ক নেই।

আমি ফোনটা কেটে দিলাম। কেটে দেওয়ার সাথে সাথে ফয়সাল আবার ফোন দিয়েছে। ফোনটা রিসিভ করলাম। ফয়সাল বললো,
– ফোনটা কেটে দিয়েছেন কেন ?

– এখনি উচ্চ আদালতে যেতে হবে, হাতে খুব একটা সময় নেই। মামলা করার পর আত্মহত্যার পেছনে আসল রহস্য খুঁজে করবো। তাই ফোনটা কেটে দিয়েছি।

কথা শুনে ফয়সাল প্রচণ্ড ভয় পেলো। আমাকে বিষন্ন গলায় বললো,
– প্লিজ তানিয়ার মৃত্যুর ব্যাপারে আদালতে যাবেন না। যদি আইনি জটিলতায় না জড়ান তাহলে আপনাকে সত্যিটা বলবো, সত্যিটা শোনালে পুলিশের হাত থেকে আমাকে বাঁচিয়ে দিবেন তো ?

আমি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললাম,
– আচ্ছা ঠিক আছে, কথা দিলাম।

ফয়সাল বললো,
– সেদিন তানিয়া আত্মহত্যা করেনি। তানিয়াকে আমি নিজেই শ্বাসরুদ্ধ করে মেরে ফেলেছি। আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেবো বলেই পাখায় টানানো রডের সাথে তানিয়ার লাশ ঝুলিয়ে দিয়েছি।

কথাটা শুনে আমার পুরো শরীর কাটা কাটা দিয়ে উঠলো। কানের কাছে ফোনটা ধরে রাখতে কষ্ট হচ্ছে। আমি আমতা আমতা করে বললাম,
– কেন খুন করেছিলি আমার প্রিয় বোনটাকে ?

ফয়সাল বললো,
– কারণ আপনার পাঠানো এই ভিডিওটা। অফিসে যাওয়ার সময় ভুল করে আমার মোবাইলটা বাসায় রেখে চলে যাই, আমার ফোনে থাকা এই ভিডিওটা তানিয়া দেখে ফেলে। তিশার সাথে কাটানো আমাদের ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের ভিডিও টা দেখার পরে তানিয়া ভয়াবহ ধরণের পাগলামি শুরু করে। তানিয়া এটা মেনে নিতে পারেনি। যখন শুনলো তিশার সাথে বিয়ের পরে ও সম্পর্ক চলমান রেখেছি সে আমার এই অপরাধ সবাইকে জানিয়ে দিতে চেয়েছিল। তানিয়াকে অনেকভাবে আটকে রাখার চেষ্টা করেছি। আটকাতে পারিনি। তাইতো শ্বাসরুদ্ধ করে মেরে ফেলেছি।

বিষন্নতা মাখানো একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললাম,
– তুমি একজন খুনী। তিশা এটা জানে ?

– হুম জানে, তানিয়াকে খুন করার আইডিয়াটা তিশাকে সাথে নিয়ে দু’জনে মিলেই তৈরি করেছি। তবে খুন করার আগে তানিয়া বলেছিল, এই ভিডিও টা সে তার একটা বান্ধবীর কাছে পাঠিয়ে রেখেছে। আমি তানিয়াকে খুন করার পর সেই বান্ধবীর মোবাইল নাম্বারটা মোবাইল থেকে নিয়ে নিলাম, নাম্বারটা নিয়ে ও বান্ধবীটাকে খুঁজে বের করতে পারিনি। অনেক খুঁজেছি, কোথা ও খুঁজে পাইনি।

আমি জবাব দেওয়ার ভাষা হারিয়ে ফেললাম। ফয়সাল বললো,
– প্রথমেই তিশাকে বিয়ে না করে তানিয়াকে বিয়ে করেছি কেন জানেন ?

আমি জানতে চাইলাম না। কোন কিছুই জানতে ইচ্ছে করছে না। ফোনটা কেটে দিয়ে দৌড়ে মায়ের রুমে গেলাম। মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলাম। মা বার বার জিজ্ঞাসা করছে, কাঁদছি কেন ? কান্নার কারণটা মাকে বলতে গিয়ে ও বলতে পারছি না।

হাতে মাত্র একটা দিন সময় রয়েছে। একদিন পরেই ফ্লাইট। আমি পুরো দিনটা কিছুই মুখে দিলাম না। খেতে ইচ্ছে করছে না। মা কয়েকবার করে খাওয়ার কথা বলে যাচ্ছে, মায়ের কথা রাখতে রাতে এক প্লেট ভাত খেয়েই ঘুমিয়ে পরলাম।

ঘুম ভাঙ্গলো খুব সকালে, মাথাটা ব্যথা শুরু হয়েছে। ফয়সালের মুখ থেকে কথা গুলো শোনার পর তা বার বার মনে পড়তেই মাথা ব্যথা শুরু হয়ে যায়। আমি তানিয়ার কথা ভাবতে ভাবতে আঙ্গুলে লাগানো আংটিটার দিকে তাকালাম। আশ্চর্য তো ? এটা কিভাবে সম্ভব ? আংটিটা আঙ্গুলে নেই!

আংটিটা আঙ্গুলে না দেখে বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠলাম। খাটের বালিশ উল্টালাম, চাদরটা নিচে নামিয়ে দীর্ঘ সময় নিয়ে দেখলাম। নেই, আংটিটা কোথা ও নেই। দৌড়ে গেলাম মায়ের কাছে। মাকে দ্রুত গলায় বললাম,
– রাতে আমার রুমে গিয়েছিলে ?

– নাতো, তুই তো দরজা বন্ধ করে ঘুমিয়েছিস। তাহলে রুমে যাবো কিভাবে ? রাকিব তোর কি হয়েছে ? ঠিকভাবে খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিস কেন ?

আমি জবাব না দিয়ে দ্রুত পায়ে নিজের রুমে ছুটে আসলাম। আরো একবার পুরো বিছানাটা উল্টেপাল্টে দেখলাম। আংটিটা আঙ্গুল থেকে খুলে যাওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই, খুললে ও বিছানার উপরে থাকার কথা! তাহলে কোথায় উধাত্ত হয়ে গেল ?

তানিয়ার রহস্যময় এই আংটিটা খুনিকে বের করার জন্য হৃদয়ে যে তাড়া তৈরি করেছিল, আংটিটা হারিয়ে যাওয়ার পর থেকেই সেটা পুরোপুরি কমে গেছে। আংটিটা হারিয়ে যাওয়ার পর তানিয়ার মৃত্যু নিয়ে অনেকবার ভাবার চেষ্টা করেছি, চেষ্টা করেছি সবার চোখের আড়াল হয়ে মৃত্যুর দিন আমাকে আংটিটা দিয়ে যাওয়ার পেছনে রহস্য বের করতে।দুটি ঘটনার কোন রহস্যই বের করতে পারিনি। আনিকার কাছে পুরো ঘটনাটি বলতে খুব ইচ্ছে হয়। বলবো বলবো করে বলা হয়না, মাঝে মাঝে মনে হয় ঘটে যাওয়া এই দুটি ঘটনা থাকুক না হয় রহস্যময় হয়।

শনিবার সন্ধ্যার একটু পরেই এয়ারপোর্ট এসে পৌঁছলাম। আমাকে এগিয়ে দিতে মায়ের সাথে আনিকা এসেছে। আনিকার ভীষণ মন খারাপ। পুরো সময়টা একদম চুপচাপ। এয়ারপোর্টের ভেতরের গেইটে ঢুকার সময় হয়ে গেছে। মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আনিকার কানের কাছে এসে বললাম,
– মাত্রই তো তিনটা মাস, দেখবে সময়টা দ্রুত কেটে যাবে। এভাবে মন খাারাপ করে থাকলে দেশে এসে কিন্তু একসাথে বৃষ্টিতে ভিজবো না।

আনিকা মুচকি হাসি হাসলো। মা তাকিয়ে আছে আমার দিকে, আনিকা হাসি লুকানোর চেষ্টা করছে।

পরদিন দুপুরে বিমান থেকে বিদেশের মাটিতে নামলাম। নেমেই ফোন দিয়ে আনিকাকে জানালাম পৌঁছার খবর। বড় মামা এগিয়ে নিতে আগে থেকেই অপেক্ষা করছে। বড় মামার সাথে গাড়িতে উঠেই চারদিকে তাকিয়ে সবুজ গাছপালা মিস করতে শুরু করলাম। মনে হলো নিজ জন্মভূমির মতো সবুজে মাখানো প্রকৃতির রূপ কোথা ও নেই।

গাড়ি থেকে নেমে রুমে আসলাম। বড় মামার পাশের রুমে থাকার জায়গা হয়েছে। রুমে ঢুকে মোবাইলে ইন্টারনেট কানেক্ট নিয়ে অনলাইনে ঢুকার পর পরই আনিকার ফোন আসলো। ফোনটা রিসিভ করতেই আনিকা দ্রুত গলায় বললো,
– রাকিব শোন, আমার দূর সম্পর্কের খালাতো ভাই মামুন ফোন দিয়েছিল। ওই যে তোকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম। ফয়সালের সাথে একই অফিসে চাকুরি করে। চিনতে পেরেছিস ?

আমি জোরালো গলায় বললাম,
– হ্যাঁ, চিনতে পেরেছি।

আনিকা বললো,
– মামুন ফোন দিয়ে বললো, ফয়সাল এবং তিশা দু’জনেই ভয়াবহ বিপদে পরেছে। গতকাল অফিসে আসতে পারেনি। দু’জনের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের একটা ছোট ভিডিও কে যেন অনলাইনে ছেড়ে দিয়েছে। ভিডিওটা এতো দ্রুত ভাইরাল হয়েছে, এখন কেউ লজ্জায় ঘর থেকে বের হতে পারছে না।

আমি সহজ গলায় বললাম,
– ভিডিওটা আমি ছেড়েছি। ফয়সালকে কথা দিয়েছি আইনের হাত থেকে বাঁচিয়ে দেবো। কথা রেখেছি, তবে।

– তবে কি ?

আমি আত্মবিশ্বাসী গলায় বললাম,
– তবে ফয়সালের উপলব্ধি করা উচিত। আমার প্রিয় বোন তানিয়াকে মৃত্যুর পরে ও ড্রাগ এডিক্টেট হিসেবে পরিচিতি করিয়ে যে অপবাদ ছড়িয়েছে। এই রকম অপবাদ নিয়ে বেঁচে থাকাটা প্রতিটা মানুষের জন্য কতটা কঠিন।

আনিকা কঠিন গলায় বললো,
– তিশা মেয়েটার কি অপরাধ ছিল, মেয়েটাকে ক্ষমা করা যায়নি ?

আমি শীতল গলায় বললাম,
– খুনীদের ক্ষমা করতে নেই।

আনিকা চুপ করে আছে। আমি ফোনটা কেটে দিয়ে নিজকে নিজে প্রশ্ন করছি, যা করেছি ভুল করিনি তো ?

[ সমাপ্তি ]

লেখকঃ- #মতিউর_মিয়াজী

[ গল্পটির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়ার জন্য ধন্যবাদ]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে