আঁধার ভিড়ে সন্ধ্যাতারা পর্ব-৩৭+৩৮

0
2556

#আঁধার_ভিড়ে_সন্ধ্যাতারা❤️
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️
#পর্ব-৩৭

বাড়িতে খুশির আমেজ।আরিয়ান নিজে যেয়ে এত এত মিষ্টি নিয়ে এসেছে।খবর শুনেই মামা-মামি এসেছে।তন্ময় তার বাবা-মা কে আনতে গিয়েছে।তবুও মায়ার সাথে একটু আগে ফোনে কথা হয়েছে তার।খুশিতে কথাই বলতে পারছিলোনা সে বারবার বলছিলো”আমি আসছি ম্যাম,তাড়াতাড়িই আসছি”।মায়া বুঝিয়ে শুনিয়ে বলে দিয়েছে যেন ধীরেসুস্থেই বাড়ি ফিরে।তাড়াহুড়োর কিছু নেই।
মায়া বসে আছে নিজের রুমে।বিছানার সাথে হেলান দিয়ে।তার সামনে বসে আছে ইতি।আর একপাশে বসে আরিয়ানের মামী নানান কথা বলে যাচ্ছে।সব কিছুই প্রেগন্যান্সি বিষয়ক।মায়ার মুখে মুচকি হাসি।একবারের জন্যও বিরক্তবোধ আসেনি তার।বরং মনোযোগ দিয়ে মামীর কথাগুলো শুনছে সে।

—“বুঝলে মা,আরিয়ানের বাবা-মা মারা যাওয়ার পর ছেলেটা একদম নির্জীব হয়ে গিয়েছিলো।ওইটুকু বাচ্চা খেলতোনা,হাসতোনা,প্রয়োজন ছাড়া কথা বলতোনা।বড় হওয়ার সাথে সাথে আমাদের সাথে আরো দুরত্ব হয়ে যায়।তারপর তো এই বাসায়ই একা থাকতে শুরু করে।কম কষ্ট করেনি ও।টাকা পয়সা থাকলে কি হবে?জীবনে মানসিক শান্তিটা কখনোই ছিলোনা।কিন্তু তুমি আসার পর থেকে ওর আচরণের পরিবর্তন গুলা সত্যিই চোখে পরার মতো।আরিয়ানের মুখের হাসিটা যেন সবসময় আজকের মতোই থাকে।তুমি ওকে দেখে রেখো মা।”

ঠিক সেসময়ই আরিয়ান দরজা দিয়ে ঢুকতে ঢুকতে বললো,
—“ও আমাকে দেখে রাখবে মামি?তুমি একটা ধমক দাও।ভয়ে এখানেই অজ্ঞান হয়ে যাবে।”

আরিয়ানের কথায় শব্দ করে হেসে উঠে ওর মামি।মায়া ভ্রু কুচকে তার দিকে তাকায়।সে একটু ভীতু দেখে আরিয়ান এমনে তার মজা নিলো।শুধু মামি সামনে আছে দেখে কিছু বললোনা।তবে নিজের কথাগুলো তুলে রাখলো।যখন একা পাবে তখন আচ্ছামতো বলবে।
আরিয়ান কাছে এসে দাড়ায়।তার হাতে টুকরা করে আপেল কাঁটা প্লেট।
সে যেয়ে মায়ার পাশে বসে।গায়ের কম্বল ঠি ক করে দিয়ে মায়ার মুখের সামনে আপেলের টুকরা ধরে।মায়া মুখ খুলেনা।আরিয়ান তার ঠোঁটে ঠেকিয়ে ধরতেই কোন কথা না বলে সেটা মুখে তুলে নেয় মায়া।
মামি নি:শব্দে হাসলো।আরিয়ান কখনো নিজেরও এতো খেয়াল রাখেনি।
মায়াকে খাওয়াতে খাওয়াতেই মামির সাথে কথা বলছে আরিয়ান।ইতিমধ্য মামাও এসে পরেছে তাদের রুমে।

বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা হতে চলেছে।বাইরে গাড়ির হর্ণ শোনা যাচ্ছে।তন্ময়রা এসে পরেছে হয়তো।মামা-মামি চলে গিয়েছে একটু আগে।কাল দুপুরে ইতি-তন্ময়ের বিয়ে পরানো হবে।তখন আবার আসবেন তারা।
আরিয়ান মানা করা সত্তেও নিচে নেমেছে মায়া।তন্ময়ের বাবা-মার সাথে দেখা করার জন্য।

আরিয়ানের হাত ধরে নিচে নামে মায়া।তন্ময়ের বাবা-মা সোফায় বসে আছে।তাদের পাশে ইতি-তন্ময়।
সামনে যেয়ে তাকে পরিচয় করিয়ে দেয় আরিয়ান।তন্ময়ের মা দাঁত কেলিয়ে হেসে বলে,
—“তোমার বউ তো বহুত সুন্দরী বাবা।শুনলাম পোয়াতি হইসে?

মায়া একটু বেসামালভাবে তাকায়।আরিয়ান হেসে বলে,
—“জি,আজকেই জেনেছি আমরা।”


পরের দিন বেশ ভালোভাবেই ইতি-তন্ময়ের বিয়ে হয়ে যায়।
পবিত্র একটা বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যায় তারা।বিয়ে শেষে মায়া শুভেচ্ছা জানাতেই তন্ময় লাজুক হেসে বলে,
—“ধন্যবাদ ম্যাম।”

চট করে একটা বিষয় মাথায় খেলে যায় মায়ার।ভ্রু কুচকে সে বলে,
—“আপনি আমাকে এখনও ম্যাম বলেন কেন?”

মায়ার এমন হঠাৎ প্রশ্নে থতমত খেয়ে যায় তন্ময়।শূণ্য মস্তিস্কে বলে,
—“জি ম্যাম?বুঝলাম না।”

আরিয়ান দাড়িয়ে আছে মায়ার পাশেই।অন্যদিকে তাকিয়ে ফোনে কথা বলছে।তাদের কথোপকথনে কান থেকে ফোন নামিয়ে সে বলে,
—“ভাবি ডাকবি ওকে।এটাই বলতে চাচ্ছে।”

আরিয়ানের কথার সাথে তাল মিলিয়ে মায়া বলে,
—“জি জি ভাবি ডাকবেন।”

—“আচ্ছা ম্যাম,ভাবি ডাকবো।”

মায়া তীক্ষ্ণ চাহনী নি:ক্ষেপ করতেই তন্ময় বোকা হেসে বলে,
—“একটু তো সময় লাগবেই ম্যাম।সরি ভাবি।”

এবার মায়া উজ্জল হেসে বলে,
—“আর ইতি তুমিও।আপু বলবা আমাকে।ম্যাম ম্যাম আর চলবেনা।”

ইতি সম্মতিসূচক মাথা নাড়ায়।তার খুব খুশির দিন আজকে।এখানকার মানুষ গুলা কতো ভালো।সবাই যদি এমন হতো,তাহলে পৃথিবীটা কতোই না সুন্দর হতো।অথচ রাশেদ চৌধুরির মতো কিছু নিকৃষ্ট মানুষগুলোর জন্য তার বাবা-মাকে হারিয়ে ফেলেছে সে।নয়তো এমন একটা দিনে তারাও তার সাথে থাকতো।
_______________
কেটে গেছে আরো তিনমাস…
সাড়ে চারমাস চলছে মায়ার।পেট ফুলেছে বেশ অনেকটা।হাঁটতে চলতে একটু অসুবিধা হয়।এখন আর থ্রিপিস পরেনা মায়া। সবসময় ঢিলেঢালা ফ্রক পরে থাকে।আরিয়ান যতটা পারে তাকে সময় দেয়।তাড়াতাড়ি অফিস থেকে ফিরে।ছুটি ছাড়াও মাঝেমধ্য যায়না।

রাতবিরাতে উঠে পা ভাঁজ করে সোজা হয়ে বসে আছে মায়া।ঘুম আসছেনা তার।নির্ঘুম চোখদুটোয় কোন ক্লান্তি নেই।তার কোলের উপর একহাত রেখে উপুর হয়ে শুয়ে আছে আরিয়ান।ফর্সা সাদা পিঠ তার চোখের সামনে।মায়া হাত দিয়ে ঝাঁকায়।তপ্ত কন্ঠে বলে,
—“উঠেননা।আমার ঘুম আসছেনা।”

আরিয়ান নিভু নিভু চোখে তাকায়।তারপর আবারো চোখ বন্ধ করে জড়ানো কন্ঠে বলে,
—“মায়া,জান আমার।,,,শুয়ে চোখ বন্ধ করো।ঘুম চলে আসবে।”
তারপর বিরবির করে কি যেন বললো মায়া বুঝতে পারলোনা।ছোট্ট একটা শ্বাস ছাড়ে মায়া।এক সপ্তাহযাবত রাতে ঘুম আসেনা তার।রোজই তার সাথে সারারাত জেগে থাকে আরিয়ান।গল্প করে,ঘুম আনানোর চেষ্টা করে।
সারাদিন পরে পরে ঘুমালেও রাতের বেলা নিশাচর পাখির মতো জেগে থাকে সে।ডক্টরের কাছে নিয়ে গিয়েছিলো আরিয়ান।বলেছে এটা খুব স্বাভাবিক।এইসময় অনেকের এমন হয়।
এসব ভাবতে ভাবতেই পাশ থেকে উঠে বসে আরিয়ান।একহাতে চোখ কচলে আরেকহাতে মায়াকে বুকে টেনে নেয়।মায়ার ঠোঁটের কোঁণে মলিন হাসি।দুহাতে আরিয়ানের পিঠ জড়িয়ে ম্ল্রান কন্ঠে সে বলে,
—“আপনাকে খুব বিরক্ত করি তাইনা?”

উওরে আরিয়ান গম্ভীর কন্ঠে বলে,
—“ফালতু প্যাঁচাল পেরোনা,ঘুমানোর চেষ্টা করো।এত রাত জেগে থাকলেতো এমনিই শরীর খারাপ করবে।”

মায়া জবাব দেয়না।খানিকবাদে আরিয়ান আবার জিজ্ঞেস করে,
—“ক্ষুধা পেয়েছে??কিছু খাবা মায়া?”

মায়ার উওর না পেয়ে তার চোখে মুখে হাত বুলায় আরিয়ান।চোখের পাতা বন্ধ।ঘুমিয়ে গেছে মেয়েটা।খুব সাবধানে মায়াকে বালিশে শুইয়ে দিলো সে।আজকাল মেয়েটাকে ধরতেও কেমন একটা আদর আদর পায়।
সাস্থ্য হয়েছে একটু।গোলুমলু লাগে।আবার ভয়ও করে।সবসময় তাকে আলতো হাতের ছোঁয়ায় স্পর্শ করে আরিয়ান।মনে হয়,শক্ত করে ধরলেই ব্যাথা পেয়ে যাবে।

আরিয়ান ঝুঁকে যেয়ে পেটের মাঝখানে চুমু খায়।বিরবির করে বলে,
—“নিজেই একটা বাচ্চা,তারও নাকি বাচ্চা হবে।”
________________
এই সময় নাকি চুলের গ্রোথ হয় বেশি।আর সেক্ষেত্রে মায়ার মনেহয় একটু বেশিরও বেশি।আগে কোমড়ের অনেকটা উপর পর্যন্ত ছিল চুল।আর তিনমাসে এখন সেটা হয়েছে হাঁটুর কাছাকাছি।
সকাল সকাল আউলা ঝাউলা চুল নিয়ে বসে আছে মায়া।একটু আগে তাকে ধরে ধরে ওয়াশরুমে নিয়ে হাতমুখ ধুইয়ে ফ্রেশ করিয়ে দিয়েছে আরিয়ান।অত:পর তাকে বিছানায় বসিয়ে নিজে গিয়েছে ফ্রেশ হতে।
সকালবেলা শরীরটা একটু খারাপই থাকে মায়ার।মাঝেমধ্যে খালিপেটেও বমি হয়।ঘুম থেকে উঠলে মাথা ঘোরায়।আরো কতশত সমস্যা।

আরিয়ান ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে মায়াকে এভাবে বসে থাকতে দেখে বলে,
—“কি হয়েছে?”

—“আপনাকে কতদিন বললাম চুলগুলো কেটে আসি।এতবড় চুল সামলানো যায়?”

আরিয়ান হাতে চিরুনি নেয়।মায়ার পিছে গিয়ে চুলের জট ছাড়াতে ছাড়াতে বলে,
—“তোমাকে সামলাতে বলেছে কে?”

মায়া মুখ উপরে উচিয়ে আরিয়ানের দিকে তাকায়।তার মাথার উপরিভাগ ঠেকে আছে আরিয়ানের পেটে।
বাচ্চাদের মতো ঠোঁট উল্টে সে বলে,

—“কেটে ছোট করলে কি সমস্যা?”

আরিয়ান আঙ্গুল দিয়ে তার ঠোঁট ঠি ক করে।মাথা সোজা করে দিয়ে বলে,

—“অনেক সমস্যা।কোন চুল কাটাকাটি চলবে না।”

—“আপনারও তো কষ্ট হয়।”

ততক্ষনে চুলের জট ছাড়িয়ে নিয়েছে আরিয়ান।হাল্কা করে বেণি করে দিয়ে চিরুনিটা পাশের টেবিলে রাখে আরিয়ান।মায়া পাশ থেকে ওড়না নিয়ে গায়ে জড়াবে মাত্র তখনই হুট করে তার ঠোঁটে ঠোট মেলায় আরিয়ান।মায়া জমে যায়।আরিয়ান বেশ কিছুক্ষন ঠোঁটের স্বাদ নিয়ে তাকে ছাড়ে।লজ্জায় মাথা নিচু করে রাখে মায়া।আরিয়ান তার গাল গলিয়ে গলার পাশে হাত রাখে।বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে লজ্জায় লাল হওয়া গালদুটোতে স্লাইড করতে করতে বলে,

—“গোটা তুমিটাকে যখন সামলাচ্ছি,তখন তোমার চুলগুলো সামলানো কঠিন কিছু না আমার জন্য।এই চুলগুলো আমার ভীষণ প্রিয় মায়াবতী।ভীষণ ভীষণ প্রিয়।”
________________
মায়ার পেট স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি বেড়েছে।সাড়ে চারমাসে সাধারণত এতটা বড় দেখায়না পেট।
মায়াকে দেখে মনে হয় সে ছয় সাত মাসের গর্ভবতী।আরিয়ান বেশ চিন্তিত।এই ব্যাপারে ভাবতে ভাবতে অফিসের কাজে মন দিতে পারছিলোনা।তাই বিকেলেই ফিরে এসে মায়াকে নিয়ে হসপিটালে যাচ্ছে সে।সিটে বসলে মায়ার পেট প্রায় সামনে ঠেকে যায়।চুলে সেই সকালের বেণিই করা।শুধু পরণের জামাটা আসার আগে চেন্জ করে দিয়েছে আরিয়ান।
মায়া জানালার সাথে মাথা ঠেকিয়ে রেখেছে।চোখেমুখে ঘুমঘুম ভাব।তবে ঘুমায়নি সে।সজাগ আছে।
আড়চোখে কয়েকমিনিট পরপর আরিয়ানকে দেখছে।আরিয়ানের কপালের সুক্ষ্ণ ভাঁজগুলো স্পষ্টই চোখে পরছে তার।
—“আপনি এতো চিন্তা করছেন কেন?আমি তো সুস্থই আছি।”

—“সেটাতো আমি জানি।তবুও তোমাদের জন্য চিন্তাটা মাথা থেকে সরাতে পারিনা মায়া।”

“তোমাদের জন্য” কথাটা বুঝতে একটু সময় লাগে মায়ার।যখন বুঝে আরিয়ান মায়ার আর বাচ্চার কথা বলছে খিলখিলিয়ে হেসে উঠে সে।হাসতে হাসতেই বলে,
—“আপনার বাচ্চা মনে হয় আপনার মতোই পালোয়ান টাইপের।এজন্যই তাড়াতাড়ি বড় হচ্ছে।”

—“আমি পালোয়ান টাইপের?”

—“অবশ্যই।আমার পুঁচকে সাইজের তুলনায় আপনাকে পালোয়ানই মনে হয়।”

এত চিন্তার মাঝেও আরিয়ান হাসে।কি সব যে বলে মায়া!
________________
আলট্রাসোনোগ্রাফির রিপোর্ট হাতে মুখে হাসি নিয়ে তাকিয়ে আছে ড.মিতালী।সামনেই মায়াকে একহাতে জড়িয়ে ধরে রেখেছে আরিয়ান।এই চারমাসে তাদের মাঝে একটা দৃঢ় বন্ধন সৃষ্টি হয়েছে।আরিয়ান সময় অসময়ে তাকে ফোন করে।মায়ার বিভিন্ন সমস্যার কথা জানায়।ড.মিতালী মুগ্ধ না হয়ে পারেনা।কেউ কাওকে এতোটা ভালো কি করে বাসে?

আলট্রাসোনোগ্রাফির রিপোর্টটা টেবিলের উপর রাখে ড.মিতালী।মৃদু হেসে বলে,
—“মর্নিং সিকনেস এর ব্যাপারটা শুনেই আমার সন্দেহ হয়েছিলো।তবু কনফার্ম না হওয়ায় আমি বলিনি।
কিন্তু রিপোর্টে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে,ইউ গাইস আর গোয়িং টু বি পেরেন্টস্ অফ টুইন্স।

~চলবে~

#আঁধার_ভিড়ে_সন্ধ্যাতারা❤️
#লেখিকা-মালিহা_খান❤️
#পর্ব-৩৮

আকাশ থমথমে।বৃষ্টি হওয়ার আগাম আভাসের আনাগোনা আকাশজুড়ে।বারকয়েক গুড়ুম গুড়ুম শব্দও কানে এসেছে।ঠান্ডা হাওয়া বইছে।হসপিটালের করিডোর ধরে মায়াকে একহাতে জড়িয়ে নিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে আরিয়ান।ঠান্ডা বাতাসে গা শিরশির করছে।বাতাসে মায়ার ওড়নার আচঁল দিয়ে টানা ঘোমটা পরে গেছে।কপালের দিকে কিছু চুল বেরিয়ে পরেছে।ঠোঁটগুলো শুষ্ক।ঘন পাঁপড়িগুলো দিয়ে বারবার পলক ফেলছে সে।আরিয়ান একটু থেমে মায়ার ঘোমটা উঠিয়ে দেয়।তার আজকাল খুব ভয় লাগে।বাইরে আসলে মনে হয় সবার নজর লেগে যাবে মায়ার।যদিও এই বিষয়গুলো একেবারেই অযৌক্তিক,অহেতুক।আরিয়ান জানে,তারপরও অবচেতন মন মানতে চায়না।
ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে একবার আকাশের দিকে তাকায় আরিয়ান।মনে মনে ভাবে,যত দ্রুত সম্ভব বাসায় পৌছাতে হবে।বজ্রপাতের শব্দে বেশ ভয় পায় মেয়েটা।কয়েকদিন আগে বজ্রপাতের শব্দে সারারাত তাকে জাপটে ধরে বসেছিলো।একবিন্দু ঘুমোয়নি।এখন গাড়িতে থাকা অবস্থাতেই যদি বিদ্যুৎ চমকায় তবে মায়াকে সামলানো কঠিন হয়ে যাবে।ভাবনার মাঝেই হঠাৎই থমকে দাড়ায় মায়া।হাপাতে হাঁপাতে বলে,
—“একটু দাঁড়ান।অস্থির লাগছে।”

আরিয়ান থামে।একটু দূরে বসার সিট আছে।মায়ার মাথাটা বুকের সাথে লেপ্টে নিয়ে সে বলে,
—“বসবে?”

—“নাহ্,বসলে আবার উঠতে কষ্ট হবে।”

আরিয়ানে স্বস্নেহে তার পিঠে হাত বুলিয়ে দেয়।মায়ার কষ্টটা সে নিতে পারেনা।একদমই পারেনা।
হসপিটালে কত মানুষ!যে যে যার যার ধ্যানে আছে।সবাই ব্যস্ত সবার আপনজন নিয়ে।হঠাৎই একটা কোলাহলে ছেঁয়ে যায় হসিপিটাল।একটু দূরেই গেট।তারা যেখানে দাড়িয়ে আছে সেখান থেকে সব দেখা যাচ্ছে।কয়েকজন ওয়ার্ডবয় মিলে দ্রুত স্ট্রেচার নিয়ে এগিয়ে আসছে পিছন থেকে।আরিয়ান মায়াকে নিয়ে একটু সরে দাড়ায়।
গেট দিয়ে একজন ভদ্রলোক ঢুকছেন।তার শার্টে হাল্কা রক্ত।কোলে সন্তানসম্ভবা বউ।মহিলা অচেতন।একটু খেয়াল করতেই আরিয়ান লক্ষ্য করলো মহিলার পেছন সাইডের জামা রক্তে ভিজে গেছে।সাথে সাথে মায়াকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিলো আরিয়ান।রক্ত দেখলে আবার প্যানিক হয়ে যাবে মেয়েটা!
ভদ্রলোক তার বউকে স্ট্রেচারে শুইয়ে দিলো।তাকে দ্রুত ভেতরে নিয়ে যাওয়া হলো।নার্সরা বারবার রক্ত ম্যানেজ করার কথা বলছে।ভদ্রলোকের চেহারা উদ্ভ্রানতের মতো অবস্থা।কোনদিকে কি করবে বুঝতে পারছেনা সে।মহিলাকে নিয়ে গেলে মায়াকে ছেড়ে দেয় আরিয়ান।তার বুক থেকে মুখ তুলে মায়া।
ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে সরল মনে আরিয়ানকে বলে,
—“আপনি রক্ত ম্যানেজ করে দিননা উনাকে।”

আরিয়ান একপলক মায়ার দিকে তাকায়।পরক্ষনেই ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে বলে,
—“আচ্ছা,দেখছি।,,,,তোমার অস্থিরতা কমেছে?গাড়িতে নিয়ে বসাই।তারপর দেখি কি করা যায়।”

মায়া মুচকি হেসে বলে,
—“চলুন”।

খুব সাবধানে মায়াকে গাড়িতে বসায় আরিয়ান।দায়িত্ব এখন আরো বেশি।আগে ছিলো দুইজন এখন তা বেড়ে হয়েছে তিনজন।একদিকে একসাথে দুটো বাচ্চা হওয়ার অগাধ খুশি আরেকদিকে মায়ার জন্য দুশ্চিন্তা।সব মিলিয়ে এক মিশ্রঅনুভূতির ভেতর দিয়ে যাচ্ছে আরিয়ান।
গাড়ির গেট লাগিয়ে আবারো ভেতরে যায় আরিয়ান।আধাঘন্টার মধ্য লোকটার বউয়ের জন্য রক্ত ম্যানেজ করে দিয়ে তার হাতে বেশ কিছু টাকা দিয়ে ফিরে আসে।এর মধ্যে অবশ্য তিন-চারবার এসে মায়াকে দেখে গিয়েছে।

গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি পরছে।আরিয়ান দ্রুত যেয়ে গাড়িতে বসে।মায়া চোখ-বন্ধ করে আছে।ঘুমিয়ে পরেছে হয়তো।মাথাটা জানালার সাথে ঠেকানো।
আরিয়ান ঠোঁট এলিয়ে হাসে।মেয়েটার সৌন্দর্য কি দিনদিন বেড়েই চলেছে?মায়া অতিরিক্ত রূপবতী।অন্তত তার চোখে দেখা সবচেয়ে সুন্দরী,আদুরে,মায়াবী রমনী!!
গাড়ি স্টার্ট দিতেই নড়েচড়ে উঠে মায়া।ঘুমের মাঝে মাথা এ কাত করতেই আরিয়ান তা ঠি ক করে নিজের বাহুতে রাখে।একহাতে ধরে রেখে আরেকহাতে গাড়ি ড্রাইভ করে।
এখন শান্তিতে ঘুমাচ্ছে আবার মাঝরাতে জেগে উঠে বলবে,”আমার ঘুম আসছেনা,চলেন গল্প করি।”
___________
বৃষ্টিতে ভিজে আছে বাগান।জ্যাক আর জেনিকে ভিতরে নিয়ে আসা হয়েছে।আরিয়ান মায়ার পিছু পিছু ওরাও ঢুকেছে রুমে।আরিয়ান বারণ করেনি।মায়ার খুব আদুরে এরা দুজনই।সে অফিসে গেলে ঘুমব্যাতিত প্রায়শই তাদের সাথে খেলা করে মায়া।
মায়া ফিরতেই ইতি এসে পরেছে।আরিয়ান গেছে শাওয়ার নিতে।মায়ার সাথে ইতিই আছে।অনেকক্ষনের
জন্য মায়াকে একা রুমে রেখে সাধারণত কোথাও যায়না আরিয়ান।
ফ্লোরে কার্পেটের উপর হাত পা ছড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে জ্যাক আর জেনি।
ইতির মুখে চওড়া হাসি।টুইন্স বেবি হবে খবরটা শুনতেই খুশিতে মনটা লাফাচ্ছে তার।দুটো বাচ্চা একসাথে সারাবাড়িতেই দৌড়াবে।কি সুন্দরই না লাগবে দৃশ্যটা!
তিড়িংবিড়িং করা কন্ঠেই সে বলে,
—“আচ্ছা আপু,ওরা যদি দেখতে একদম একরকম হয় তবে ওদের আলাদা করবেন কি করে?”

মায়া শব্দ করে হাসে।খানিকটা চিন্তা করে বলে,
—“জানিনা ইতি।আগে আসুক তারপর ভেবে দেখবো।তন্ময় ভাইয়া কখন আসবেন?”

—“বললোতো ঘন্টাখানেক লাগবে।ওর তো কথাবার্তার ঠি ক নেই।দেখা যাবে তিনঘন্টা লেট করে বলবে,রাস্তায় জ্যাম ছিলো।তবে আজকে মনে হয়না দেরি হবে।টুইন্সদের কথা শুনেছেতো।দৌড়ে চলে আসবে”

মায়া আবারো খিলখিল করে হাসে।তন্ময়ও কম পাগলামি করেনা।মায়াকে এটা ওটা এনে দেয়।আরিয়ান আইসক্রিম,কোক এসব খেতে মানা করলেও মায়া খেতে চাইলে তন্ময় এনে দেয়।আরিয়ানের সাথে ঝগড়া করে হলেও এনে দেয়।
একবারতো মায়ার জেদে রাত দশটা বাজে মায়াকে নিয়ে আরিয়ানের অফিসে চলে গিয়েছিলো।আরিয়ান ফিরতে দেরি করছিলো বলে মায়া জেদ করছিলো তার অফিসে যাবে তখন তার সাথে না পেরে তখন ই মায়াকে নিয়ে বেরিয়েছিলো তন্ময়।

_______________

আয়নার সামনে দাড়িয়ে আছে মায়া।সাতমাসের ভরা পেট তার।একটু মোটা হয়ে গিয়েছে।মা মা একটা ভাব শরীরে।শরীরটা খুব ভারি ভারি লাগে ইদানীং।পেটে আলতো করে হাত বুলায় সে।হঠাৎই ভাবনা আসে তাকে কি খুব বাজে দেখায়?
একবার আরিয়ানের দিকে তাকায় সে।পাশের সোফায় বসে ল্যাপটপে কাজ করছে আরিয়ান।আজকে অফিসে যেতে পারেনি।সকালবেলা তার শরীরটা খারাপ হয়ে গিয়েছিলো।এত মাসেও খাওয়ার রুচিতে কোন সমস্যা হয়নি মায়ার।কোনরকম গন্ধও লাগেনা।সবই খেতে পারে।বরং তুলনায় অনেক বেশি খাবার খায়।
দুজন বাচ্চা পেটে।ক্ষুধা তো বেশি লাগবেই।সকালে নাস্তার পর তিনবার বমি হয়েছিলো তার।যা খাচ্ছিলো তাই বমি করে দিচ্ছিল।ডক্টরকে বলে আরিয়ান ওষুধ খাওয়ানোর পর কিছুটা ভালো লাগছে এখন।

আয়নার সামনে মায়ার এমন ঘুরাফেরা আর হতাশ চোখের চাহনী দেখেই আরিয়ান মায়ার মনের কথাটা বুঝতে পারে।ড.মিতালী বলেছিলো,এসময় মেয়েটা নিজের বাহ্যিক সৌন্দর্য নিয়ে হীনমন্যতায় ভোগে।মায়াও হয়তো সেরকম কিছুই ভাবছে।
আরিয়ান ল্যাপটপ বন্ধ করে উঠে গিয়ে পেছন থেকে তাকে জড়িয়ে ধরে।গালে গাল ঘষে বলে,
—“মায়াবতী,তোমার কি মনে হচ্ছেনা তোমার একটু কম সুন্দর হওয়ার দরকার ছিলো?”

—“ফালতু কথা বলবেন না,,আমি জানি আপনি আমাকে খুশি করার জন্য বলছেন।”

—“এমনটা কেন মনে হলো?”

মায়া এবার আয়নার দিকে তাকিয়ে হতাশ কন্ঠে বললো,
—“আমি খুব মোটা হয়ে গেছি তাইনা?”

আরিয়ান ছোট্ট করে তার গালে ছোট ছোঁয়ায়।বলে,
—“তুমি মোটা হওনি।গোলুমোলু হয়েছো।আমার গোলুমোলু মায়াবতী।আমি কি ভাবছি জানো?”
মায়া উৎসুক কন্ঠে বলে,
—“কি ভাবছেন?”

—“ভাবছি তোমাকে সবসময় প্রেগন্যান্ট বানিয়ে রাখব।যেন তুমি সবসময় এমন গোলুমোলু থাকো।কেমন আইডিয়াটা?”

মায়া ঝামটা মেরে তাকে সরায়।চোখমুখ কুঁচকে বলে,
—“ছিহ্,কিসব বলেন এগুলা!”
_______________
রাতের বেলা ঘুম ভেঙে যায় আরিয়ানের।পাশ থেকে ফোন নিয়ে দেখে রাত বাজে দুইটা পঁয়ত্রিশ।তার একহাত মায়ার পেটের উপর রাখা।সোজা হয়ে ঘুমোচ্ছে মায়া।রোজ মাঝরাতে এসময় মায়ার ঘুম ভাঙে।ক্ষুধা লাগে অথবা ঘুম আসেনা কোন একটা কারণে হলেও ঘুম থেকে উঠে সে।তাই আরিয়ানেরও অভ্যাস হয়ে গেছে এসময় ঘুম থেকে উঠার।কিন্তু আজকে মায়া উঠলোনা কেন?আরিয়ান হাই তুলে উঠে বসে।পাশের ল্যাম্পলাইট জ্বালাতেই ঘর অনেকটা আলোকিত হয়ে যায়।ঝুঁকে গিয়ে মায়ার কপালে চুমু খায় সে।মায়া খুব ঘনঘন শ্বাস নিচ্ছে।ভ্রু কুচকে আসে আরিয়ানের।বারদুয়েক গালে হাল্কা করে থাপ্পড় দেয়।মায়ার কোন হেলদোল নেই।বুকটা প্রচন্ডভাবে কেঁপে উঠে আরিয়ানের।কাঁপা গলায় সে দ্রুত ডাকে,
—“মায়া?মায়া উঠো?মায়াবতী?ক্ষুধা লাগেনি মায়া?শরীর খারাপ লাগছে?”

আর কথা বের হয়না গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়।মায়া অচেতন।ঘুমের মাঝে মেয়েটা অচেতন হলো কিকরে?আরিয়ান দ্রুত নিজের গায়ের কম্বল সরায়।জোরে সরানোতে মায়ার গা থেকেও কম্বল সরে যায়।বিছানার দিকে তাকাতেই আৎকে উঠে আরিয়ান।সাদা চাদরে লালরক্ত লেগে আছে।মাথা কাজ করা বন্ধ হয়ে যায়।মায়ার গা থেকে সম্পূর্ণ কম্বল সরিয়ে তাকে একটু কাত করতেই নজরে আসে মায়ার পিছন সাইড রক্তে ভিজে গেছে খানিকটা….

~চলবে~

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে