আঁধার পর্ব-২৭

0
1239

আঁধার

২৭.

ঘুম ভাঙলো শ্বশুর আব্বার ডাকে। ঘুমে চোখ তখনো ভেঙে যাচ্ছিল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি সকাল সাড়ে সাতটা! ঘুমাইছিই তো ভোর পাঁচটায়। মাত্র আড়াই ঘণ্টা ঘুমে কিছু হয়? ঘুম থেকে ডাকার কারণ, তিন শ্বাশুড়ি আম্মা মিলে তিন জামাইয়ের জন্য পুলি পিঠা বানিয়েছেন। শীতের সময় মূলত পিঠা বানানোর হিরিক পড়ে যায়। কিন্তু এখানে বর্ষাকালে আমাদের আগমনেই শীত নেমে এসেছে। কোনোমতে ব্রাশ করে, হাত মুখ ধুয়ে রান্নাঘরের সামনে উঠোনে সবার সাথে যুক্ত হলাম৷ মিলা তার ভাগ্নীদের নিয়ে ব্যস্ত। রাতে যে পরিমাণ আমাকে ভয় দেখিয়েছে। তাতে তো ওকে আমার এখন ওকে ভয় লাগছে। মিলা হচ্ছে রহস্যময় নারী। সে রহস্য করতে পছন্দ করে। নিজের চারপাশে রহস্যের জাল বিছিয়ে রাখে। আর সেই জালে ভালোবাসার মানুষকে আটকে ফেলে! আর সে গতকাল এই কাজটাই করেছে। আমাকে তার রহস্যের জালে আটকে ফেলেছে।
মেজ দুলাভাই বললেন, ” আরেক দফা চা হয়ে যাক রাসেলের উদ্দেশ্যে! ”

” একা একা চা খাওয়ার মানেই হয়না। ”

বড় দুলাভাই বললেন, ” মেশু তার স্পেশাল খেজুর গুড়ের চা বানিয়েছে। সেটা কি আর একা একা খাওয়া যায়? ”

” তাহলে আর বসে আছি কেনো? চা পাঠানো হোক। খাওয়া দাওয়া শেষ হলেই তো ভালো। ” কথাগুলো না বলে পারলাম না। ঘুম এখনো পুরোপুরি যায়নি। এভাবে ঘুমের সমস্যা হলে তো অসুস্থ হয়ে যাবো। মোবাইলও ভুলে বিছানায় রেখে এসেছি। রাকা যদি একবার ফোন দিয়ে বসে। আর মিলার হাতে পড়লে…!
আগে আমাকে পছন্দ করতো না তাই আমার কোনো বিষয়ে তার মনোযোগ ছিল না। কিন্তু এখন তো সে আমাকে ভালোবাসে। তাও খুব বেশি ভালোবাসে। আমার প্রতিটা পদক্ষেপ এখন সে তার নখদর্পনে রাখতে চাইবে। এক্ষেত্রে আমিও না করতে পারবো না৷ কারণ ওর প্র‍তি আমিও আসক্ত। ওকে কষ্ট দেয়ার কথা ভাবতেই পারিনা। রাকা একসময় বাধ্য হয়ে আমাকে ছেড়েই দিবে!

ছোট চাচা শ্বশুড় আমার কথার পৃষ্ঠে বললেন, ” হ্যাঁ, যাতে তুমি ঘরে গিয়ে ভুসভুস করে ঘুমাতে পারো। ”

বড় আপা এইসময় চায়ের ট্রে নিয়ে রান্নাঘর থেকে বের হয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছিলেন। ছোট চাচার কথা শুনে বললেন, ” এতো ঘুম কীসের হা? শ্বশুড়বাড়ি এসেছ গল্প করবে, আড্ডা দিবে, কব্জি ডুবিয়ে খাবে দাবে। তা না করে দু’জনে মিলে দরজা আটকে পরে থাকো। ”
বড় আপার কথা শুনে লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললাম৷ মিলার এদিকে খেয়াল নেই। সে বড় ভাগ্নীর চুলে বেণি করে দিচ্ছে। আমি ভেবেছিলাম সে বাচ্চা পছন্দ করে না৷ এখন তো দেখছি উল্টো! অনন্যাকে অপছন্দ করার কারণ হয়তোবা ওর খারাপ লাগাটা। আমাকে তার অপছন্দ ছিলো। এখন তো আর সেটা নেই। আমাদের ছোট্ট একটা পরী হবে। সেই পরীর চুল মিলা ঠিক এইভাবে বেণি করে দিবে আর গল্প করবে। আমি এভাবে ওদের থেকে দূরে বসে শুধু দেখবো। মা মেয়ের মধ্যে কাঁটা হতে যাবো না!
মিলার প্রথম সন্তান হলেও আমার হবে দ্বিতীয়! আমি ওর মায়ের গর্ভে একটু একটু করে বেড়ে উঠা দেখতে পারবো। এই পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরেই তাকে আমার কোলে নিতে পারবো। ওশানকে নিয়ে যত ইচ্ছা, পরিকল্পনা ছিল সব পূরণ করবো। হয়তোবা অনুভূতি গুলো অতো তীব্র হবেনা। তারপরও নিজের সন্তান তো!
আমাদের সামনে বড় আপা চায়ের ট্রে রেখে গেলেন। রান্নাঘরে বেশ আয়োজন চলছে। শ্বশুড় আব্বাকে আশেপাশে দেখলাম না।
চায়ের ট্রে থেকে দ্রুত চায়ের কাপ উঠিয়ে নিলাম। ঘুম ঘুম ভাব কাটানো খুব দরকার। দুপুরের আগে ঘুমানোর যে সুযোগ হবেনা বোঝাই যাচ্ছে।
বড় দুলাভাইয়ের চায়ের কাপে চুমুক দেয়ার ভঙ্গি দেখে আমি না হেসে পারলাম না।
হাসতে হাসতেই আমি চায়ের কাপে চুমুক দিলাম। খুব একটা খারাপ স্বাদ না। তবে বড় দুলাভাই যেমন ভঙ্গিতে খাচ্ছেন তাতে তো ভেবেছিলাম অনেক স্বাদের হবে!
মেজ দুলাভাই আমাকে হাসতে দেখে বললেন, ” হাসেন ক্যান? জানেন নাকি বড় আপার হাতের চা কতো মজা হয়? দুলাভাই এই চায়ের গুণ গান যেখানে যান সেখানেই বলেন। ”

মারিয়া কবিরের দ্বিতীয় একক উপন্যাস ‘ হলুদ খাম ‘ সংগ্রহ করতে চাইলে নিম্নের যেকোনো অনলাইন বুকশপ থেকে নিতে পারেন।

বইটি অর্ডার করার জন্য নিচে দেওয়া লিংকে ক্লিক করুন ।রকমারি

https://www.rokomari.com/book/207068/holud-kham
বড় দুলাভাই বললেন, ” তোমরা এসব বুঝবা না। বউয়ের হাতের রান্নার স্বাদ কেমন হয়। রেশু তো রান্নাঘরেই যায়না। আর মিলার কথা বাদই দিলাম। ”

মিলা মনে হয় এই কথা শুনেছে। ও বলল, ” আপনার ভাইরা ভাইকে জিজ্ঞেস করে দেখুন তো, রান্না করে কে? ”

আমি হেসে বললাম, ” মিলাই রান্না করে মূলত। ”

বড় দুলাভাই ভূত দেখার মতো মুখ করলেন। তারপর বললেন, ” শালী আমার তোমাকে ভালো বশ করেছে দেখছি! মিথ্যাটাও সুন্দর করে বলে দিলা? ও তো চা ছাড়া কিছুই রান্না করেনি বিয়ের আগে। ও রান্না কীভাবে করবে বলো?”

” আমি রান্না করিনি। কিন্তু রান্নাঘরে বসে রান্না করা দেখেছি অনেক। স্বাদ ভালো হয়না কিন্তু খাওয়া তো যায়? ” মিলা মুখ ভার করে বলল।

” হ্যাঁ, মিলা ঠিক বলেছে। স্বাদ ভালো হয়না। তবে খাওয়া যায়। আমি প্রাইমারি স্কুল থেকে ফিরে কি আর ওইসব ঝামেলা ঘাড়ে নিতে পারি? ”

বড় দুলাভাই বললেন, ” ওকে ওকে আমি আত্মসমর্পণ করলাম। তবে রাসেল তোমার উচিৎ অন্যান্য চাকরির পরীক্ষা দেয়া। তুমি ভালো স্টুডেন্ট। একটু চেষ্টা করে দেখ। ”

” আমি নিবন্ধনের ফর্ম ফিলাপ করেছিলাম বিয়ের আগে আগে। ফরিদপুরে গিয়ে প্রস্তুতি নিতে হবে। ”

” বিসিএস? ” মেজ দুলাভাই প্রশ্ন করলেন।

” ওটা আমার দ্বারা হবেনা। শুধু শুধু সময় নষ্ট করা। ”

” তারপরও চেষ্টা করে দেখ। হাতে তো একটা চাকরি আছেই। বিয়েও করে ফেলেছ। এমন না যে, প্রেমিকার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। আর তোমাকে তার জন্য খুব দ্রুত ফার্স্ট বা সেকেন্ড ক্লাস কোনো চাকরি খুঁজতে হবে। ধীরে সুস্থে আগাও। আল্লাহর রহমতে ভালো কিছুই হবে। ” মেজ দুলাভাই বললেন।

” হ্যাঁ, খারাপ বলেননি। তাহলে তাই করবো। ” তারপর এটা নিয়ে ওটা নিয়ে গল্প চলতেই লাগলো। ঘুমও কেটে গেছে। খারাপ লাগছেনা।
গল্পে গল্পে জানা গেল, সকালের জন্য তিন ধরনের পুলি পিঠার আয়োজন করা হয়েছে। ভাপা পুলি, দুধ পুলি আর নারিকেল পুলি। আর সন্ধ্যার পরে চিতই পিঠা, বিবিখানা পিঠা, পাটিসাপটা পিঠা। এই সময় এতো পিঠা বানানোর আয়োজন দেখে অবাক লাগছে। শীতে মূলত পিঠা খাওয়ার ধুম পড়ে। মিলাকে উঠে শোবার ঘরের দিকে যেতে দেখলাম। ভয়টা আবার জেকে বসলো। আমি টয়লেটে যাওয়ার অজুহাতে উঠে মিলার পিছু নিলাম।
আমাকে পিছুপিছু আসতে দেখে মিলা বলল, ” কিছু বলবেন? ”

” না, মোবাইলটা আনতে যাচ্ছি। ”

” আপনার মোবাইলে সকালে কে যেন ফোন করেছিল। কারো ব্যক্তিগত জিনিসে হাত না দেয়াই ভালো। তাই আমি রিসিভ করিনি। আবার আপনাকে যে ডেকে দিব সেটাও পারলাম না। আপনার ঘুমে তো ঝামেলা হতো। ”

” ভালো করেছ। আমারও গতকাল তোমার ফোন ঘাটাঘাটি করা ঠিক হয়নি। ”

” আমার অতীত যেহেতু খুব একটা ভালো ছিলোনা। তাই আপনার সন্দেহ করাটা অমূলক না। ”

” মোটেও না। তুমি যথেষ্ট ভালো মেয়ে। আসলে আমার ভয় করে। ”

এতক্ষণে ঘরে আমরা পৌঁছে গেছি। মিলা বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, ” কীসের ভয়? ”

আমি দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় বললাম, ” যদি তুমি তাদের কারো সাথে আমাকে ছেড়ে চলে যাও। সেই ভয়। আমি আসলে তোমার যোগ্য না। কোনোদিক থেকেই না। ”

” আপনি অনেক বেশি ভাবেন। আর যা ভাবেন সেটা সম্পূর্ণ ভুল। কারণ আপনি আমার যোগ্য বলেই আল্লাহ আমাদের জোড়া হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ হচ্ছেন সর্বশ্রেষ্ঠ বিচারক, মহাজ্ঞানী। তারচেয়ে ভালো কেউই জানে না। তিনি জানেন আপনিই আমার জন্য নিটোল একজন পুরুষ। তাই আপনাকে আমার জীবনে নিয়ে এসেছেন। সেখানে আপনার ভাবনা নিছকই ভুল ভাবনা ছাড়া কিছুই না। ”

” তুমি আমার এই অল্প বেতনে সুখী? ”

” হ্যাঁ, আমার তো সমস্যা নেই। এখন আপনি যদি চান তাহলে অন্য চাকরির চেষ্টা করতে পারেন। আমার আপনি আর তিন বেলা খাবার হলেই হবে। ”

” তুমি চাইলে পড়াশোনা চালাতে পারো। ”

” না, ইচ্ছা নাই। আপনাকে একটা কথা বলতে ভুলে গেছিলাম। সামনের মাসেই আমরা নতুন ফ্ল্যাটে উঠে যাবো। সবকিছু কমপ্লিট শুধু আসবাবপত্র কেনাকাটা বাকি। ”

” এটা নেয়া কি ঠিক হচ্ছে? ”

” অবশ্যই। আপনি আপনার বাবার কাছ থেকে পাওয়া সম্পত্তি কি নিবেন না নাকি ফিরিয়ে দিবেন বলুন? ”

” নিবো। ”

” তাহলে আমি আমার জন্য রাখা জিনিস কেনো নিবো না? এই ফ্ল্যাট আমি নিজে পছন্দ করেছিলাম বিয়ের আগে। আমার পছন্দের জিনিস কেনো হাতছাড়া করবো? ”

” তারপরও ব্যাপারটা কেমন লাগে না দেখতে? শ্বশুড়বাড়ির দেয়া ফ্ল্যাটে এভাবে উঠে গেলে মানুষ কী বলবে?”

” মনে করুন এই সেইম ফ্ল্যাট আপনার বড় দুলাভাই দিছেন। তখন কী করতেন? আমাকে নিয়ে উঠতেন না? ”

” হ্যাঁ, উঠতাম। ”

” তাহলে এটাকেও তেমন ভাবুন। ”

মিলা হেসে চোখ বন্ধ করলো। মনে হয় ও এখন ঘুমাবে। ওশানকে নিয়ে আসার পরিকল্পনা বাদ। সে এমনিতেই আমাকে বাবা হিসেবে মানতে চাইবে না। কারণ সে মাহমুদ ভাইকে বাবা হিসেবে চিনে। উল্টো ওর উপর একটা বিশ্রী ব্যাপার চাপিয়ে দেয়া হয়ে যাবে। ওর ছোট্ট মন আমাকে বাবা হিসেবে মানতেই চাইবে না। জোরজবরি করতে গেলে হিতে বিপরীত হয়ে যেতে পারে। এদিকে ওর খরচ চালানোর মতো সামর্থ্য আমার নেই। আমার এক মাসের ফুল বেতন ওর এক মাসের খরচ। রাকার পেছনেও মাহমুদ ভাই অনেক টাকা ঢালেন। রাকা হাত দিয়ে ভাত বেড়ে পর্যন্ত খায় না। তার মাসিক পার্লার খরচ দেয়ার সামর্থ্য তো হবেই না। ব্যাংকে টাকা আছে কিন্তু বসে বসে খেলে রাজার গোলায় ফুড়ায়। এরচেয়ে ওরা দূরে ভালো থাকুক। আর আমি আমার মিলাকে নিয়ে ভালো থাকি। মিলাও কষ্ট পাবেনা আর ওশানও ভালো থাকবে।
এক বা দেড় বছর বয়স হলেও ওশানকে মানানো যেত। কিন্তু বয়স সাড়ে তিনের বেশি!
মিলাকে ছাড়াও আমার থাকা অসম্ভব। এই মেয়ে আমার চোখের সামনে থাকলেও শান্তি!

চলবে…

~ Maria Kabir

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে