অস্পষ্টতা – পর্ব : ৪

0
1349

#অস্পষ্টতা
পর্ব – ৪

লেখা : শঙ্খিনী

বাগান ঘেরা বিশাল এক বাংলাে বাড়ি। প্রথমবারের মতো বাড়িটা দেখে কয়েক সেকেন্ডের জন্যে থ বনে চলে গিয়েছিলাম।

কলিংবেল চাপতেই দরজা খুলে দিলেন তারিফের মা। ‘মা’ বলে বর্তমানে যে মানুষটাকে আমি চিনি, তার সঙ্গে এই আমার প্রথম সাক্ষাৎ।

তারিফ ওর মাকে বলল, “মা, ওর নাম আশফা। আমার বন্ধু।”
আমি সঙ্গে সঙ্গে ভদ্রভাবে বললাম, “আসসালামওয়ালাইকুম।”
মা বলল, “ওয়ালাইকুমসালাম। তা তারিফ, তোর যে এত সুন্দর একটা বন্ধু আছে আমাকে আগে বলিসনি কেন? মনে আছে? ছোটবেলায় তোর নতুন কোনো বন্ধু হলেই সাথে সাথে বাসায় নিয়ে আসতি।”
তারিফ থেমে থেমে বলল, “মনে আছে। মা আমি, মানে আমরা একটা অন্যায় করে ফেলেছি!”
“অন্যায়? কিসের অন্যায়?”
“মা আমরা… মা আমরা বিয়ে করে ফেলেছি।”

ছেলেটা বলে কি! আমাদের বিয়ে তো আজ সন্ধ্যায়। বিয়ে করে ফেলেছি মানে কি? আমার কান দিয়ে কোনো কথা ঢুকছিল না। মুহূর্তের মধ্যে মাথাটা গরম হয়ে গেল।

মা বেশ অনেকক্ষন চুপ করে থেকে বলল, “কতদিনের পরিচয়?”
তারিফ বলল, “ছয় বছরের।”
“কি?”
“না মানে, ছয় মাসের।”
“বিয়েটা হয়েছে কবে?”
“আজকেই।”
“এত দিনের পরিচয়, আর আমাকে জানানোর কোনো প্রয়োজনই বোধ করলি না? বিয়েও করে ফেললি আমাকে না জানিয়ে? কেন? জানালে কি আমি বাঁধা দিতাম”
“মা বলতে চেয়েছিলাম, কিন্তু…”
“তুই আমার সঙ্গে কোনো কথা বলবি না। তোর সঙ্গে কথা বলার কোনো ইচ্ছে আমার নেই!”

মা এবার আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমার নাম যেন কি মা?”
আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, “আশফা। আশফা আরিয়ানা।”
“বিয়ের কথা তোমার বাবা মা জানে?”
“আমার বাবা মা নেই।”
“আত্মীয়-স্বজন, অভিভাবক – তারা জানে?”
আমি কিছু বলতে যাবো, তার আগেই তারিফ বলল, “ওর আত্মীয় স্বজনেরা ঢাকায় থাকে না মা, নারায়ণগঞ্জে থাকে। বিয়ের আগে তাদের ফোন করে জানানো হয়েছে।”
“আমাকে জানালে কি হতো? আমাকে কি এতটাই খারাপ মনে হয় তোর?”
“সাহস হয়ে ওঠেনি।”
মা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে! এখন আর কথা বাড়িতে লাভ নেই। মা আশফা, তুমি আমার সঙ্গে এসো।”

আমি গেলাম মায়ের ঘরে। বাড়ির বসার ঘরটা যেমন সুন্দর, ভেতরের ঘরগুলোও তেমনি সুন্দর।

একটা গয়নার বাক্স মা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, “এটা আমাদের পারিবারিক অলংকার। বিয়ের সময় আমার শাশুড়ি এটা আমাকে দিয়েছিল। আজ আমি তোমাকে দিচ্ছি।”

আমি নিবো কি নিবো না এই নিয়ে দ্বিধায় ভুগছিলাম। আমাদের বিয়েই তো এখনো হয়নি! কিসের গয়না আর কিসের কি!

মা আবার বলল, “ইতস্তত বোধ করার কিছু নেই। এই গয়না তোমার জন্যেই তোলা ছিল। এসো তো, আমি তোমাকে পরিয়ে দিচ্ছি। ওহ্ ভালো কথা। আমি আমার ছেলের বউয়ের জন্যে অনেক আগে একটা শাড়ি কিনেছিলাম, যত্ন করে রেখে দিয়েছি। দাঁড়াও বের করে আনছি। শাড়িটা পরে ফেলো। নতুন বউ শাড়ি পরে ঘুরবে, দেখতেও তো শান্তি লাগে।”

এই বলেই মা আলমারি ঘাটাঘাটি করে লাল রঙের একটা শাড়ি বের করে আমার হাতে দিলো। শাড়িটা দেখতে খানিকটা বিয়ের শাড়ির মতো।

মায়ের কথা মতো শাড়ি গয়না পরে নিলাম। নতুন বউয়ের মতো লাগছিল আমাকে সেদিন। আমার মধ্যে আনন্দ এবং রাগ দুটো একসঙ্গে কাজ করছিল।

আমি তৈরি হয়ে বসার ঘরে গেলাম। মা আর তারিফ সেখানেই বসে ছিলে। লক্ষ করলাম, তারিফ আমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সে প্রাণপন চেষ্টা করে চোখদুটো অন্য দিকে সরাতে, কিন্তু পারছে না।

আমাকে দেখে মা বলল, “বাহ্! খুব সুন্দর লাগছে। এই তারিফ, তুই যা ডেকোরেটরের কাছে গিয়ে বড় টেবিলের অর্ডার দিয়ে আয়। ছাদে টেবিল পাতা হবে। এদিকে আমি রান্নাবান্নার ব্যাবস্থা করি। আজকে রাতে আমাদের সব আত্মীয় স্বজনদের খবর দেওয়া হবে।”
তারিফ অসহায় গলায় বলল, “আজকেই?”
“আজকে না তো কালকে? আমার ছেলের আজকে বিয়ে হয়েছে, আজই সব আয়োজন হবে!”
“তাহলে মা, আমি আশফাকেও সাথে নিয়ে যাই?”
“ওকে নিয়ে যেতে হবে কেন? বেচারিকে অন্তত একটু রেস্ট নিতে দে!”
“মা ও তো এতদিন বান্ধবীদের সাথে ফ্ল্যাটে থাকে। সেখানেই ওর বই খাতাসহ সব জিনিসপত্র। আমার সাথে গিয়ে এখন সেগুলো নিয়ে আসতো।”
“ওহ্, তাহলে নিয়ে যা। তোমার কোনো আপত্তি নেই তো মা?”
আমি বললাম, “জি না।”

আমরা বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম।

বাড়ির সামনে দাঁড়িয়েই কঠিন গলায় আমি তারিফকে বললাম, “এই ছেলে! তোমার জীবন তো পুরোই মিথ্যায় ঘেরা! ও আল্লা, আমি কার সাথে সংসার করবো!”
তারিফ বাঁকা হাসি হেসে বলল, “আমার জীবন মিথ্যায় ঘেরা না ম্যাডাম, আমার জীবন বুদ্ধিমত্তায় ঘেরা।”
“হুহ! চোরের মায়ের আবার বড় গলা।”
“তুমি ভুল করছো। চোরের মায়ের বড় গলা হয় না, ওটা হবে জিরাফের মায়ের বড় গলা!”
“তা আমার বুদ্ধিওয়ালা! নিজের মাকে মিথ্যা বলাটা খুব বুদ্ধিমানের কাজ না? আমাদের বিয়ে হয়ে গেছে? আমার আত্মীয় স্বজন ঢাকায় থাকে না? আমি বান্ধবীদের সাথে ফ্ল্যাটে থাকি?”
“তোমার মামা মামী তো এক সপ্তাহের মধ্যেই ঢাকার বাইরে চলে যাবে, আমি না হয় একটু আগেই পাঠিয়ে দিলাম। আর আমাদের বিয়ে হতে আর মাত্র তিন ঘণ্টা বাকি। আমি মিথ্যা বললেও, মিথ্যাগুলো কিন্তু কিছু সময়ের মধ্যে সত্যি হয়ে যাবে?”
“লাভটা কি হলো?লাভটা কি হলো এতগুলো মিথ্যা কথা বলে? আমরা না হয় বিয়ের পরেই আসতাম এখানে।”
“ওইযে বললাম না, একটা কথা বলার আগে সেটা বলার পরিণাম কি হবে এই নিয়ে ভাবতে হয়। এইযে মা তোমাকে এত সুন্দর করে বউ সাজিয়ে দিলো, এটাই আমার লাভ। তুমি কি সালোয়ার কামিজ টামিজ পড়ে বিয়ে করতে না-কি?”
“শাড়ি গয়না, এসব না আমাদের বাসায়ও আছে। এর জন্য এত বড় একটা মিথ্যা বলবে?”
“শুধু এটা না, আরও একটা কারন ছিল অবশ্য।”
“কি সেই কারন?”
“আমার মায়ের মনটা একটু উৎসবমুখর। কথায় কথায় আত্মীয় স্বজনদের দাওয়াত দিয়ে খাওয়ানোর বাতিক আছে। শুনলে না, আজকেই না-কি ছাদে কি কি করবে।”
“হ্যাঁ তো?”
“আমার বিয়ে নিয়ে মায়ের অনেক ইচ্ছা ছিল। মা চেয়েছিল আমার বিয়ে হবে কক্সবাজারের কোনো এক বীচের পাড়ে। সব আত্মীয় স্বজনদের সেখানে নিয়ে যাওয়া হবে নিজ খরচে। এখন যদি আমার মা শুনতো, সীমিত পরিসরে আমাদের বিয়ে হবে নির্ঘাত স্ট্রোক করতো।”
“বলো কি?”
“ঠিকই বলছি।”
“তাহলে তো ভালোই করেছ।”
“বললাম না, আমার জীবনটা বুদ্ধিমত্তায় ঘেরা।”
আমি হেসে বললাম, “হয়েছে, আর নিজের বড়াই করতে হবে না। মনে আছে? মামা কিন্তু আমাদের পাঠিয়েছিল তোমার বন্ধু বান্ধবদের নিয়ে যেতে।”
“চিন্তা করো না। আমি ওদের ফোন করে জানিয়ে দিয়েছি। তোমার বান্ধবী শিলাকেও জানিয়েছি। ওরা তোমাদের বাসায় সামনে স্ট্যান্ড বাই থাকবে। ভালো কথা, ডেকোরেটরের লোকদের সাথেও তো কথা বলতে হবে!”

ছেলেটা যে কি পরিমান পাগল ছিলো, সেটা শুধুমাত্র আমি জানি।

বাসার সামনে রিকশা থামতেই দেখি সত্যি সত্যি তারিফের বন্ধুরা দাঁড়িয়ে আছে, আমার বান্ধবী শীলাকেও দেখতে পেলাম। বাড়ির ভেতরে ঢুকে দেখি আরেক কান্ড। বিশাল রান্নাবান্নার ব্যাবস্থা করা হয়েছে। ছোট মামা মামীকেও খবর দেওয়া হয়েছে।

কাজী সাহেবকে ডেকে আনা হলো ঠিক সাড়ে সাতটায়। আমি লক্ষ করলাম, ঠিক ষোলো মিনিট লাগলো বিয়ের কাজ সম্পূর্ণ হতে।
আমার পাশে বসে তারিফ এখন আমার, অফিসিয়ালি আমার। আমি ভাবতেই পারিনি আমার জীবনটা এক দিনের মধ্যে বদলে যাবে।

বিবাহ সম্পন্ন হওয়ার প্রায় দুই ঘণ্টা পর আমরা ফিরে গেলাম তারিফদের বাসায়। অথবা, আমার নতুন বাসায়।

সেখানে গিয়ে দেখি আরেক কান্ড! রাজ্যের সব আত্মীয় স্বজন বাড়ির ছাদে। সবাইকে সালাম দিতে দিতে আমার কোমর ব্যাথা হয়ে গেল। এরপর শুরু হলো ছবি তোলার পর্ব। একজন একজন করে আসছে আর নতুন বউয়ের সঙ্গে ছবি তুলছে। সে এক অসম্ভব বিরক্তিকর ব্যাপার।

এরপর শুরু হলো খাওয়া দাওয়ার পর্ব। রান্নার ব্যাবস্থা দেখে মনে হলো, সত্যিই এটা বিয়ে বাড়ি। এত কম সময়ের মধ্যে এরা এত আয়োজন কিভাবে করলো কে জানে!

আমি ফিসফিস করে তারিফের কানে বললাম, “এই তারিফ!”
“কি?”
“এইমাত্র তো আমাদের বাসা থেকে কত কিছু খেয়ে আসলাম! এখন আমার এতকিছু খাবো কিভাবে?”
“আরে খাও তো! জীবনে একটাই মাত্র বিয়ে করলে। আজকে খাবা না তো কবে খাবা?”
“একটাই মাত্র বিয়ে মানে? আর কয়টা বিয়ে করতে চাও তুমি?”
“আরও দুই তিনটা বিয়ে হলে ভালো হতো না?”
আমি রাগী গলায় বললাম, “কি বললা?”
তারিফ হেসে বলল, “তুমি আসলেই বোকা! এখন খাও তো। এত কথা বলতে দেখলে সবাই আমাদের অসভ্য ভাববে।”

শুনলাম বাসর হবে তারিফের ঘরে। সবার আকর্ষন এখন বাসর ঘর সাজানোর দিকে।

মোটামুটি রাত বারোটার দিকে তারিফের। কয়েকটা কাজিন আমাকে বাসর ঘরে রেখে গেল। ‘বাসর ঘর’ – এত ভারী একটা শব্দ এই ঘরটার সঙ্গে ঠিক যাচ্ছে না। ঘরের সাজসজ্জা টিপিকাল বাঙালি বাসর ঘরগুলোর মতো। গাঁদা আর গোলাপের ছড়াছড়ি সারা ঘরে। আমাকে বললেই হতো, ঘরটা ক্লাসিকভাবে সাজিয়ে দিতাম। নিজের বাসর ঘর নিজে সাজানো কি দোষের কিছু? কে জানে!

আমি বাসর ঘরের বিছানায় বসে আছি প্রায় বিশ মিনিট ধরে, অথচ স্যারের আসার কোনো নাম নেই! আর অপেক্ষা করার অর্থ নেই। আমি বিছানা থেকে নামলাম। ফ্রেশ হতে হবে। প্রচণ্ড টায়ার্ড ছিলাম সেদিন।

ফ্রেশ হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়তেই শুনতে পেলাম দরজার শব্দ। এতক্ষণে স্যারের আসার সময় হলো। আমি ভাব ধরলাম, ঘুমিয়ে পড়েছি।

তারিফ আমার কাছে এসে বলল, “আশফা?”
আমি ইচ্ছে করেই ঘুমজড়ানো কণ্ঠে বলল, “হুঁ!”
“এই আশফা?”
“বলো!”
“ঘুমিয়ে পড়েছো?”
“হুঁ।”
“তাহলে কথা বলছো কিভাবে?”
“উফ, বলো তো কি বলবা।”
“ঘুমিয়ে না পরলে, উঠো।”
“উঠবো কেন?”
“আরে, বাসররাতে কেউ ঘুমায় না-কি?”
“তো কি করে?”
তারিফ অনিশ্চিত গলায় বলল, “গল্প করে!”
আমি উঠে বসতে বসতে বলল, “বলো!”
“কি বলবো?”
“তোমার গল্প বলো।”
“ও আমি আগে বলবো?”
“হুঁ।”
“শোনো তাহলে, একদেশে এক রাজকন্যা ছিলো। রাজকন্যার নাম আশফাকুমারী।”
“আশফাকুমারী? বাহ্ সুন্দর নাম তো!”
“হুঁ! সে ইংলিশ গান খুব ভালো গাইতো, বিশেষ করে লেডি গাগার গান।”
“লেডি গাগা?”
“হ্যাঁ, আর এখন সে আমাকে লেডি গাগার গান শোনাবে।”
আমি হাসতে হাসতে বললাম, “লাভ নাই।”
তারিফ কিঞ্চিৎ মন খারাপ করে বলল, “লাভ নাই মানে?”
“লাভ নাই মানে লাভ নাই। কোনো লাভ নাই। তোমার আশফাকুমারী এখন ঘুমাবে। তুমি বরং এক কাজ করো, তোমার বেয়াদপ কাজিনগুলোর কাছে যাও। তারা নিশ্চয়ই এখনো ছাদে বসে আড্ডা দিচ্ছে। তাদের কাছে গিয়ে তুমি বানিয়ে বানিয়ে, যুক্তি খাটিয়ে মিথ্যা কথা বলো। গুড নাইট!”

(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে