অপ্রেমের প্রিয় অধ্যায় পর্ব-২২+২৩

0
639

#অপ্রেমের_প্রিয়_অধ্যায়
#পর্ব_২২ (আমার না-রওয়া মানুষটা তোমার হোক)
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ

“উনি এখন অনেকটা এগিয়ে, তাই ভাবছেন? নাহ! আসলে উনি এখনও এই ‘আপনি’-তেই থমকে আছেন। এই যে, এত সব কাহিনি আপনার অজানা!”

ওই মুহূর্তে সিদ্দিক গুমোট পরিবেশে মুখ খুলে ভারি আওয়াজে বলে উঠল, “জানি সবটাই।”

শুদ্ধ অবাক হলো, “জানতেন?”

সিদ্দিক বলল, “বললাম না? যখন জানতে পেরেছিলাম, তখন পরিস্থিতি আমার বিপরীতে ছিল; আমার ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।”

শুদ্ধ অবুঝপানে তাকিয়ে রইল। সিদ্দিক দম নিয়ে বলা শুরু করল, “আমি আশাকে ওভাবে মেনে নিতে পারিনি। আমার সময় লেগেছিল। যখনই আশার কাছাকাছি যেতাম, তখনই সেই মায়াবী মুখটা ভেসে উঠত। এক ঘরে, এক বিছানায় বছর খানেক থেকেও, আমি ওকে ছুঁতে পারিনি। কীভাবে ছুঁতাম? সেখানটায় একজনের স্মৃতি ছিল তো!”

শুদ্ধর গা শিরশির করে উঠল এটা ভাবতেই। সিদ্দিক বলল, “আমি পারতাম না। আমিও মানুষ, তাই-না? মা যেভাবে ওর ব্রেইনওয়াশ করেছে, আমারও ব্রেইনওয়াশ করেছিল। মা আমার মাথায় সেট করে দিয়ে গিয়েছিল, ‘আমার বউ অন্য পুরুষের হাত ধরে পালিয়েছে।’ আর আমি তাই-ই মেনে নিয়েছিলাম।
অনেক চেষ্টা করেছি, আশার সাথে একটা স্বাভাবিক লাইফ লিড করার। এমনও হয়েছে, অফিস থেকে ফেরার আগে ওকে কল দিয়ে বলতাম—সেজে-গুজে থাকতে। ও বুঝে নিত, খুশি হতো। তখন ও আর জব করত না। বাড়িতেই থাকত।
ও প্রতিবার রেডি হয়ে থাকত। বাড়ি ফিরে আমি ওর কাছাকাছি গেলেই যেন অদৃশ্য কোনো শেকলে আটকে যেতাম। এগোতে পারতাম না। তারপর ওকে রুমে রেখেই ছাদে হাঁটাহাঁটি করে সিগারেটের প্যাকেট খালি করতে থাকতাম।
ওর ধৈর্য্য, সহনশক্তি, ভালোবাসা দেখে এক সময় আমার মনেও পুরোনো প্রেম জেগে ওঠে। ওর কাছাকাছি যাবার আপ্রাণ চেষ্টা করি, সফল হই। আমাদের মাঝের দাম্পত্য জীবনটা ধীরে ধীরে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে।
এরপর একদিন অফিশ্যিয়াল পার্পাজে, আনন্দমোহন কলেজের একটা ফাংশনে এটেন্ড থাকি আমি। সেখানে দীর্ঘ তিন বছর পর আমি ওকে দেখতে পাই। কেমন যেন শুকিয়ে গেছে, চুপচাপ কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে বসে আছে একা; কলিজাটা ছিঁড়ে যাচ্ছিল আমার। আমি ওর খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, হলেই থাকে ও।
বাকি খোঁজ নেওয়ার জন্য কল লাগাচ্ছিলাম একজনকে। সেই মুহূর্তে আমার ফোনে আশার কল আসে। ও খুব খুশি। ঠিকমতো কথাই বলতে পারছিল না খুশির চোটে। অর্ধ-স্পষ্ট বুলিতে এ-ই বুঝলাম—আশা প্রেগন্যান্ট। প্রচণ্ড খুশি হলাম আমি। সেই খুশি হাওয়ায় মিইয়ে গেল একজনকে পেয়েও কাছে টেনে না নেবার ব্যর্থতায়। আমি আর তার খোঁজ নিলাম না। দ্বিতীয়বার সেই কলেজের ধারের কাছেও গেলাম না, সেই শহরেই গেলাম না। সেই বছর থেকে ওর কোনো চিঠি আমি পড়লাম না ভুল করেও। ও কত বড়ো ভুল করেছে, তা কি আদতে বুঝতে পারছে? আমার কী দোষ ছিল? আমাকে কেন এরকম ভাবে দোটানায় ফাঁসিয়ে দিলো? ইশ! যদি সামনে আসত একবার, ট্রাস্ট মি, খুন করে ফেলতাম আমাকে এভাবে শাস্তি দেওয়ার অপরাধে। যেখানে আমার কোনো দোষই ছিল না!”

শুদ্ধর কেন যেন এই সিদ্দিককে আর ঘৃণ্য লাগছে না, নিজের মতোই অসহায় লাগছে। হয়তো সিদ্দিকের অসহায়ত্ব শুদ্ধর চেয়েও কয়েক হাজার গুন বেশি!

সিদ্দিক এত বছরে এই প্রথম কারো সামনে নিজেকে এতটা খোলামেলাভাবে উপস্থাপন করেছে। পুরোটা বলা শেষে সে বলল, “তবুও তনুজার খোঁজ আমার কাছে প্রতিদিনই আসতে থাকে। তোমার ব্যাপারটাও জানি, শুধু চিনতে পারিনি প্রথমে। তুমি বললাম, কিছু মনে কোরো না। আমার অনেক ছোটো তুমি.. ২০ বছরের ছোটো! আ’ম ফোর্টি টু নাও..”

শুদ্ধ কেশে উঠল! পরিস্থিতি বেশ স্বাভাবিক হলেও শুদ্ধ অপ্রস্তুতভাবে বলে উঠল, “এতটাও লাগেন না! বড়ো জানতাম, কিন্তু এতটা!”

সিদ্দিক হেসে উঠল। শুদ্ধ নিজেও হাসল, সময় নিয়ে শুধাল, “তনুজার জন্য আপনার মনে এখনও অনুভূতি আছে?”

সিদ্দিক না ভেবে বলে বসল, “অনুভূতিহীন হৃদয় আমার। ওর জন্য ঘৃণাটাও যোগ্য নয়। যদি এর উর্ধ্বে কিছু থাকত, তবে তা-ই বরাদ্দ হতো।”

“যদি সুযোগ আসে ওনার কাছে ফেরার?”

“আমি সেই সুযোগকে নিজ হাতে ফিরিয়ে দিতে কার্পণ্য করব না।”

“কেন?”

“সে অতীত!”

“যদি বর্তমানে ফিরতে চায়?”

“আমি দূরে থাকব। আমার স্ত্রী-সন্তান আছে। তার চেয়েও বড়ো হচ্ছে শাস্তি। ও বলেছিল, ভুল বুঝবে না। ও বলেছিল, আমাকে ছাড়বে না। অথচ কী করল?”

শুদ্ধ বলার ভাষা পেল না, নীরব রইল। সিদ্দিক আবার বলল, “জানো, ও বলেছিল আমাদের বিয়ের রাতে—বিশ্বাসঘাতকদের ও নিজের জীবনে জায়গা দেয় না। তাই আমিও ওকে আমার জীবনে জায়গা দেবো না।”

“বিশ্বাসঘাতকতার কী করেছেন উনি?”

“নিজেকে ভেঙে-চূরে ওর কাছে উপস্থাপন করেছিলাম, বিনিময়ে আমার মনটাকেই ভেঙে দিলো।”

“তাঁকে এখনও ভালোবাসেন?”

“ভালোবাসা ফুরোয় না। যাকে একবার মনে জায়গা দেওয়া হয়, তাকে মন থেকে বের করা যায় না। কিন্তু আমরা সেই মানুষটাকে ছাড়া থাকতে অবশ্যই পারি। বেশ ভালোভাবেই থাকতে পারি। শুধু মাঝে মধ্যে একাকী অবস্থায় বুক ফেটে কান্না পায়, এই আর কী!”

শুদ্ধ তাকাল সিদ্দিকের দিকে, “আপনাকে দেখে খুব স্ট্রং লাগে!”

সিদ্দিক কেবল হাসল, “ইয়েস, আই অ্যাম স্ট্রং!”

শুদ্ধ নিজেও হেসে উঠল, “এতটাই স্ট্রং যে এতগুলো কথার মাঝে দ্বিতীয়বার তনুজার নামটা উচ্চারণ করেনি। আমি স্পষ্ট খেয়াল করেছি, প্রথমবারের উচ্চারণে আপনার গলা কেঁপেছিল!”

“সবদিকে এত খেয়াল রাখা ভালো নয়, বুঝলে? পরে নিজেকেই ভুগতে হয়।”

“ভুগছিই তো।”

“আরও ভুগবে। সে পোড়াতে ভালোবাসে।”

“প্রতিনিয়ত পুড়ছি।”

সিদ্দিক বলল, “সে পাষাণ!”

শুদ্ধ মুচকি হেসে বলল, “আমিও তাই বলি।”

পরপরই শুদ্ধ আবার বলল, “আচ্ছা, আপনি তনুজার এত খবর কোত্থেকে পেয়েছেন?”

“ওটা সিক্রেট! তবে তোমাকে বলা যায়!”

“বলুন তবে।”

“শিফার থেকে।”

“শিফা কে?”

“তনুজার মামাতো বোন।”

“আপনি না তনুজার মামার ব্যাপারে কিছুই জানতেন না!”

“জানতাম না। পরে জেনে গিয়েছিলাম। ডিভোর্সের ৩ বছর পর শিফা অনেক খুঁজে নিজ থেকে আমার সাথে কন্ট্যাক্ট করে, আমাকে সব জানায়। ওর কাছেই সব জানতে পারি।”

“কল দিয়েছিল কেন?”

“তার বোনের পেইন নাকি সহ্য করতে পারছিল না। এরপর থেকে আমি না চাইতেও ওর সব ডিটেইলস আমাকে দেয়। আমি আমার মায়ের ব্যাপারটা আগে থেকে আন্দাজ করলেও, কিছু বলিনি। এতটা নিচুতে নেমেছিল, ভাবতে পারিনি। মা তো, তাই! নিজের মায়ের এত অধঃপতন যখন পুরোপুরি শিফার মাধ্যমে জানতে পারি, আমি অর্ষা আর আশাকে নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে আসি। অর্ষা তখন কোলের বাচ্চা ছিল, মাস ছয়েকের। এরপর থেকে আলাদা থাকি। মায়ের সাথে মাঝে মাঝেই কথা হয়, তাদের খরচ বহন করি। কিন্তু অর্ষার সাথে দেখা করতে দিইনি আর। আশা কখনই চায়নি আমাদেরকে আলাদা করতে। কিন্তু যখন একা হয়ে যাই, তখন ও চেয়েছে আমার জীবনে ফিরতে। অর্ষাকে আশা একদম তনুজার মতো করেই তৈরি করেছে, দুজনের অনেক মিল—বুঝলে? মাঝে মাঝে শিফা আশার সাথেও যোগাযোগ করে! এগুলো তনুজা জানে না কেবল।”

“আচ্ছা, ওয়েট! এর মানে এখন তনুজা কোথায় আছেন—জানেন?”

সিদ্দিক ছোট্টো করে বলল, “হুম!”

উদ্দীপিত হয়ে শুদ্ধ শুধাল, “কোথায়?”

“সিলেটে!”

“সিলেট?”

“হুম! লোকেশন আমি সেন্ড করে দিচ্ছি তোমাকে।”

অতঃপর অনেকক্ষণের নিরবতা। শুদ্ধর কেন যেন খুব অস্বস্তি লাগছে, অসহনীয় অনুভূতি লাগছে। বুকের মধ্যেখানেতে দলা পাকানো কষ্টেরা ভারি পীড়া দিচ্ছে। নিঃশ্বাসের সাথে যেন শোক প্রবেশ করছে।
সিদ্দিক তাকে দেখে বলল, “তোমার কাছে ভালোবাসা মানে কী?”

শুদ্ধ হালকা হাসল এবার। গভীর দুটো নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে উঠল, “উনি নিজেই।”

“কেন?”

“ভালোবাসা বলতে আমি ওনাকেই বুঝি, কারণ জীবনে প্রথমবার এমন অনুভূতি আমি তাঁর প্রতিই অনুভব করেছি। এর আগে এটা ছিল আমার জন্য সবচেয়ে আলাদা, সবচেয়ে অজানা।”

“আর আমার জীবনের দ্বিতীয় প্রেম হয়েও কেন একমাত্র ভালোবাসা ও হলো—বলতে পারো?”

শুদ্ধ তাকাল। সিদ্দিক বলতে লাগল, “আমার জীবনে প্রেম একবার না, বহুবার এসেছিল। কিন্তু প্রেমসন্ধি ঘটেছিল কেবল ওর সাথেই। তারপর আবার প্রেম এলো, তবে সেভাবে জড়াল না আমায় নিজের রঙ্গমঞ্চে। সবগুলোই ক্ষণিকের ছিল.. প্রেম তো তাই—যা ধীরে ধীরে আসে, অতি গোপনেতে থাকে, আবার হুট করে মুছে যায়। যেমনটা আমার থেকে মুছে গেল।”

“মুছে যায়?”

“হুম, যায় তো!”

“তবে, স্যার! আমি প্রেমে পড়িনি। পড়েছি মায়ায়। অ্যান্ড আই প্রমিস ইউ, মুছবে না এটা। না আমার দিক থেকে, তা তাঁর দিক থেকে। ইট উইল বি অ্যা মিউচুয়াল আন্ডারস্ট্যান্ডিং!”

“বাজে ভাবে হেরে যাবে, ছেলে!”

“গোটা মনটাই তো তার তরে হেরে বসে আছি!”

“এত জড়িয়ে যেয়ো না। বের হতে না পারলে কিন্তু এই প্রেমটাই, ফাঁসির দড়ি হয়ে তোমার গলায় পেঁচিয়ে যাবে। বাঁচতেও পারবে না।”

“চাই না এমন জীবন, যে জীবনে তিনি থাকবেন না।”

“তবে ভেঙে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে যাও। কেননা সৃষ্টিকর্তা তোমাকে এমনই এক জীবন দেবেন।”

“স্রষ্টা চাইলে তাই হোক!”

সিদ্দিক মলিন হাসল। উঠে দাঁড়িয়ে শুদ্ধর কাছে গেল। শুদ্ধও দাঁড়াল। সিদ্দিক তার হাতটি শুদ্ধর কাঁধে রেখে নয়নে দৃষ্টিবদ্ধ করল। বলে উঠল, “আমি তো পারলাম না, তুমি তার সাথে থেকো।”

শুদ্ধ সেই হাতটি দু-হাতে সংশ্লেষ করে নজর না সরিয়ে বলল, “আমৃত্যু থাকব।”

সেই এক কথায় সিদ্দিক ভরসা পেল। আবার বলল, “তোমাকে বিশ্বাস করলাম। ম্যাচিউর তুমি। বয়সটা কম হলেও, স্টেবল হবার চেষ্টা করো। বাকিপথ তোমার জন্য সহজ নয়।”

“কঠিনও নয়।”

“জীবন দেখোনি।”

“মরণ দেখেছি। তাকে ছাড়া নিজেকে অস্তিত্বহীন হতে দেখেছি।”

সিদ্দিক হেসে দিলো, “কখনও ভরা আসরে হাসতে হাসতে বুকে চিনচিনে ব্যাথা হয়েছে? আচ্ছা, বেদনার অশ্রুকে হাসির ফল হিসেবে বহিঃপ্রকাশ করেছ? কিংবা কখনও এমন সিচুয়েশনে পড়েছ, যেখানে কান্না করার স্কোপটাও তোমার নেই।”

“না।”

“আমি অনুভব করেছি এসব। জীবন ছোটো, খুব শিগগিরই একই অনুভূতি তোমার নিজস্ব হবে। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আর কী!”

“কী করে বলতে পারছেন?”

“তোমার মাঝে আমি নিজেকে দেখতে পারছি।”

শুদ্ধ নতমুখী হয়ে বলল, “আপনার ভাগ্য আমার না হোক!”

সিদ্দিক হাসল, “আমার না-রওয়া মানুষটা তোমার হোক।”

শুদ্ধ দু-ধারে মাথা নাড়ল, ইতিবাচক জবাবটা এ-ই ছিল, “তবে তাই হোক!”

চলবে…
#অপ্রেমের_প্রিয়_অধ্যায়
#পর্ব_২৩ (মৃত্যুতেও পিছু নেব)
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ

দুদিন পর, সকাল সকাল শুদ্ধ পৌঁছে গেল সিলেটের একটা রিসোর্টে। এখান থেকে তনুজার এপার্টমেন্টটা খুব একটা দূরে নয়। শুদ্ধ নিশ্চিন্ত হয়ে সকালটা কাটাল। সে চাইছে না, তনুজার বাসার ভেতরে ঢুকতে। তাই আপাতত তার বের হবার অপেক্ষায়।
একটা কফির কাপ হাতে নিয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। বাঁ হাতটিতে ফোন, ওপেন করা আছে সিদ্দিকের ইনবক্স। একটু পর পর তার সাথে কথা হচ্ছে। মূল বিষয়বস্তু—তনুজা।

অনেকক্ষণ যাবত শুদ্ধর মনের মাঝে একটা প্রশ্ন কিলবিল করছে, সিদ্দিককে তা শুধানোর আগে নিজ থেকে উত্তর মেলানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। অবশেষে পারল না আর। কৌতুহলী মন নিয়ে সিদ্দিককে একটা টেক্সট পাঠাল, “উনি চরিত্রহীনা কী করে হলেন?”

সিদ্দিক দেখল ম্যাসেজটি। রিপ্লাই দিতে সময় নিল। অ-নে-ক-টা সময় পর সিদ্দিক রিপ্লাই লেখা শুরু করল। শুদ্ধর কফি শেষ। কাপটি ব্যালকনি টেবিলের উপর রেখে আবার ফোনের দিকে তাকাল। একটা বিশাল আকারের ম্যাসেজ মাত্রই সেন্ড হওয়ায় নোটিফিকেশনের সাউন্ডটা এলো!

“ওটা রাগের তেজে, মস্তিষ্কের ভারসাম্য হারিয়ে বলে ফেলেছিলাম; অ্যা কাইন্ড অব্ গালি। চরিত্র শব্দের অর্থ হচ্ছে—বৈশিষ্ট্য, স্বভাব, আচরণ, ধর্ম! বলো—কার নেই এগুলো?”

শুদ্ধ রিপ্লাই করল, “ওই শব্দটা খুব বাজে, স্যার!”

“আমি নিজেও বাজে মানুষ। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে দিব্যি আছি। ওদিকে একটা মানুষ আমার থেকে আলাদা হয়েও সম্পূর্ণ আমার হয়ে আছে।”

“তনুজাকে নিয়ে আমি কথা বললে, আপনার খারাপ লাগে না?”

“লাগে না বলছ?”

“লাগে বোধহয়!”

“লাগে অবশ্যই। ওর সাথে আমার অন্তরাত্মার প্রেম হয়েছে। একসময় যার পাশে নিজের ছায়াকেও সহ্য হতো না, আজ নিজ হাতে তাকে তোমার করে দেওয়ার পাঁয়তারায় মেতেছি।”

“প্রেম ভয়ঙ্কর!”

“প্রেম মৃত্যুতুল্য ভয়ঙ্কর সুন্দর।”

______
বিকেলের দিকে তনুজা শিফাকে নিয়ে বেরোল। শুদ্ধ সিদ্দিকের মাধ্যমে তা জানতে পারল। সে নিজেও তৈরি হয়ে বেরোল। তনুজার থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে শুদ্ধ পিছু পিছু হাঁটতে লাগল। কিছুক্ষণের ঘোরাঘুরির পর তনুজা গিয়ে একটা কফিশপে ঢুকল। শুদ্ধও গেল।

শিফা আর তনুজা মিলে একটা টেবিলে বসতেই শুদ্ধ তাদের পাশের চেয়ারে দুম করে এসে বসে পড়ল। তনুজা চকিতে চাইল। চোখ-মুখ প্রবল উৎকণ্ঠিত। মুখ দিয়ে বেরোল একটাই শব্দ, “তুমি!”

শুদ্ধ নতমুখী হয়ে চুলে হাত দিয়ে চুলকে হাসল। সেই হাসিতে ঘায়েল হলো তনুজা। রাগে শরীর কাঁপছে তার, কণ্ঠে অস্বাভাবিকতা প্রকাশ পেল, “এখানে কী করছ তুমি?”

শুদ্ধ একবার পাশ ফিরে শিফার দিকে তাকাল। তাতে শিফা নিজের ফোন হাতে নিয়ে, ফোনের দিকে দৃষ্টিবদ্ধ রেখেই ওখান থেকে প্রস্থান ঘটাল। শুদ্ধ আনমনে হেসে উঠল। তনুজা শিফার এভাবে উঠে যাওয়া দেখে তেতে উঠল, “এই, এই তুমি কী করলে এটা? ও চলে গেল কেন? হ্যাঁ?”

জবাবে শুদ্ধ বলল, “আব্! হিপনোটিজম ছিল, ম্যাম!”

“মজা নিচ্ছ আমার সাথে?”

শুদ্ধ চোখ মেরে বলল, “খানিকটা!”

“তুমি আমার এড্রেস পেলে কোথায়?”

“আসলে, সেদিন স্বপ্নে আপনি এসেছিলেন। উফফ! কী সুন্দর ওয়েদার, কী সুন্দর সিচুয়েশন, কী সুন্দর আপনি! এরপর কানে কানে এসে বললেন, ‘শুদ্ধ, আমি এখানে থাকি। জলদি এসো তো! এসে আমার মনটা চুরি করে নিয়ে যাও’। তারপর আমি চলে এলাম এখানটায়।”

“অসহ্য কথাবার্তা না বললে, চলছে না?”

“কী অসহ্য কথাবার্তা বললাম? আপনিই তো আপনার এড্রেস জানালেন আমাকে। হুহ! সব দোষ এখন আমার, তাই-না?”

অতিষ্ট হয়ে তনুজা বলল, “তোমার কোনো দোষ নেই, তুমি আগা টু গোড়া একটা দোষ! আমার কপালে এসেছে জুটেছে এই দোষ। শান্তিতে থাকতে দেবে না, তাই-না?”

“আমি-হীনা শান্তি আপনার না হোক। অশান্তিও যদি আমি হয়ে থাকি, তবে তাই আপনার হোক।”

তনুজা গভীর নিঃশ্বাস ফেলল। হালকা ঝুঁকে টেবিলের উপর দু-হাত ঠাস করে ফেলল। অধৈর্য স্বরে বলে উঠল, “তুমি কি সত্যিই বুঝতে পারছ না—আমি তোমায় চাইছি না?”

“আপনি আমায় চাইতে ভয় পাচ্ছেন।”

“কীসের ভয়?”

“আছে না কিছু.. বলা বারণ!”

“আমার কোনো ভয় নেই। তোমার জন্য আমার হাজারটা সমস্যা হচ্ছে, সে-কারণে জায়গা পরিবর্তন করলাম। আর তুমি এখানটাতেও চলে এলে!”

“আপনাকে ছাড়া থাকতে পারছিলাম না তো!”

“এদিকে আমি তোমার সামনে থাকতে পারছি না। আমার প্রবলেমেটিক লাইফে তুমি আগুন হয়ে এসেছ। প্রবলেমের সাথে আমাকেও জ্বালিয়ে ছাড়ছ। বেঁচে থাকা যেন দিনকে দিন দুষ্কর হয়ে উঠছে আমার জন্য।”

“ম্যাম, আপনি বুঝলেন না—আপনাকে ছাড়া আমি কতটা অসহায়!”

“আর তুমি আমায় বুঝলে না—তোমার সামনে হেসে-খেলে মায়া না বাড়িয়ে কেন আমি দূরে থাকার সিদ্ধান্তে এলাম। এতটাও ইজি ছিল না আমার জন্য।”

শুদ্ধ চুপ রইল। তনুজা আবার বলা শুরু করল, “নতুন জায়গা, নতুন মানুষ.. শুধু এক পুরোনো কথাগুলো, সদৃশ আঘাতগুলো। অ্যা ডিভোর্সি’স লাইফ ইজ নট সিম্পল! অনেক কম্পলিকেশন ফেইস করতে হয়, শুদ্ধ! অ-নে-ক! আর আমি জেনে-বুঝেই এই লাইফটা চুজ করেছি।”

“আপনি চাইলেই কিন্তু লাইফটা আরও বেটার হতে পারে!”

“অথচ, আমি এই লাইফেই থাকতে চাই। এখানটায় আমার সিদ্দিকের স্মৃতি আছে।”

“উনি তো অন্য কারো বর!”

“ছিল তো একসময় আমারও!”

“আজ নেই।”

“ছাড়েনি।”

“একসাথে নেই আপনারা।”

“আলাদাও হইনি।”

“আর ডিভোর্স?”

“একপাক্ষিক.. সিদ্দিক সাইন করেনি।”

শুদ্ধর জন্য গত দুদিনের এতগুলো চমকের মাঝে এটা ছিল সর্বোর্ধ্বস্থ। চমকের রেশ যায় না, কথা বলতে পারে না। তনুজা শুদ্ধর এই অবস্থা দেখে শান্ত হলো। চেয়ারে হেলান দিয়ে গা ছেঁড়ে বসে বলল, “তুমি যে আমার ব্যাপারে কতটুকু জানো—শিখা আমাকে বলেছে, এ-নিয়ে বেশি ভাবতে হবে না। আর, সিদ্দিক সাইন করেনি—কী করে জানলাম জানো?”

শুদ্ধ তাকাল তনুজার চোখের মণি পানে। তার জিজ্ঞাসু দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে তনুজা বলল, “আশা বলেছে। আশার সাথে আমার যোগাযোগ হয় বছর কয়েক আগে। ওর সাথে হঠাৎ দেখা। তখন আমি খুব অপ্রস্তুত হলেও, ও স্বাভাবিক ছিল। একটা কফিশপে বসি। ও আমাকে সব জানায়। তারপর থেকে আর অন্যত্র জড়ানোর সাহস পাইনি, বুঝলে?”

শুদ্ধ ছলছল চোখে তাকাল, “কোনো ওয়ে নেই?”

তনুজা ডানে-বাঁয়ে বড্ড আস্তে-ধীরে মাথা নেড়ে বলল, “উঁহু! নেই..”

“সিদ্দিক স্যার যদি ডিভোর্স পেপারে সাইন করে দেন?”

“করবে না ও।”

“কেন?”

“আমাদের ডিভোর্স হয়ে গেলে আমি ওর সাথে কনট্যাক্ট করতে পারব না আর। ওকে দেখতে পারব না। অল্প ক-বার হলেও, আমি লুকিয়ে ওকে দেখেছি, দেখতে গিয়েছি আর যাই, যাব। এ-ই নিয়েই বেঁচে আছি। ও আমার এটুকু চাওয়া অপূর্ণ রাখবে না। ও আমাকে শাস্তি দিতে চায়। মরে গেলেই তো সব থেকে মুক্ত হয়ে যাই। ও আমাকে মরতে দেবে না। ও আমাকে বাঁচিয়ে রাখবে, আস্তে-ধীরে তীব্র ভাবে মরণ যন্ত্রণা অনুভবের জন্য।”

“বেঁচে থাকার অবলম্বনটা কি আমি হতে পারি না?”

তনুজা হাসল, “তুমি আমার প্রেম নও, শুদ্ধ। তুমি আমার প্রিয়তম নও।”

“চাইলেই হতে পারি।”

“অথচ, ও না চাইতেও অনেকটা হয়ে গিয়েছিল। তারপর.. আর কাউকে দেওয়ার মতো বুকের গভীরে অনুভূতি নেই।”

“ট্রাস্ট মি, ম্যাম! আমার কিচ্ছু লাগবে না। শুধু আপনি হলেই চলবে।”

এই পর্যায়ে শুদ্ধর গলা কেঁপে উঠল। তনুজার খুব খারাপ লাগল। মনের গভীরে কোথাও একটা খুবই সূক্ষ্ম পীড়া অনুভব হলো। ঠিক এটা চাইছিল না বলেই তো ট্রান্সফার নিল। অথচ তাই হলো! খুব জলদি হলো, খুব সুন্দর মতো হলো।

মলিন হেসে তনুজা শুদ্ধকে বলল, “সবার কিছু একান্ত ব্যক্তিগত ইচ্ছে থাকে। এবং পুরণের সম্ভাবনা তলানিতে ঠেকে থাকে। সেই ইচ্ছেগুলো কখনই মুখ ফুঁটে উচ্চারণ করা হয় না, পাছে না আমাদের নিজেদেরই কান তা শুনে ফেলে! সেই ইচ্ছেগুলো সর্বসম্মুখে কৌতুক হয়ে আর গোপনে আমাদের বুকফাটা আর্তনাদ রূপে প্রকাশ পায়। সেই ইচ্ছেগুলোর নামে এক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলাও পাপ।”

অন্যমনস্ক হয়ে শুদ্ধ বলে উঠল, “অপূর্ণ সেই ইচ্ছেগুলো আমার জীবনে একটিই আছে। তার নাম আপনি। আপনি আখ্যাত সেই ইচ্ছেটির জন্য আমার কেবল অনুশোচনাই হয়, অলকানন্দা!”

“অনুশোচনা ভালো।”

“আপনার বেলায় আমি প্রাপ্তি চাইছিলাম।”

“জীবন মানেই না-পাওয়া। সব পেয়ে গেলে কি জীবনের স্বাদ পাওয়া যায়? কিছু থাকে অপূর্ণতার অভিমুখে। যাকে পাওয়ার আশায় মনটা আঁকু-পাঁকু করে সারাটাক্ষণ। এটা জেনেই যে, তাকে আমাদের আর এজনমে পাওয়া হবে না। অথচ, মন চেয়ে যায়। তাদেরকে আমার ভাষ্যমতে কী বলি—জানো?”

“কী?”

“প্রিয় প্রতীক্ষা। যেমনটা আমার সিদ্দিক!”

“আমার জন্য কি তবে আপনি?”

“হয়তো তাই!”

“আমি তো তা চাইনি!”

“আমিও তো তোমায় চাইনি।”

“তবুও কি জড়িয়েছেন?”

“বোধ করি—হ্যাঁ।”

“কতটা?”

“খানিকটা।”

“পরিমাপে?”

“অনুভূতির পাল্লায় মাপতে গেলে, মায়া নামক বাটখারাটা বেশ ভারি হয়ে পড়বে।”

“প্রেম?”

“কেবল সিদ্দিক।”

“আর আমি?”

“আমার মায়া।”

“আপনার?”

“নয় কি?”

ছলছলে দৃষ্টিতে শুদ্ধ ঠোঁট কামড়ে কোনো এক প্রাপ্তি পেয়ে হাসল। ক্রমাগত মাথা উপর-নিচ করে বলল, “আমি গোটাটাই আপনার, ম্যাম।”

জবাবে তনুজা বলল, “আর আমি আংশিক নিজের।”

“বাকিটা?”

“সিদ্দিকের।”

“আমার জন্য কি কিছুই নেই তবে?”

“আছে না!”

“কী?”

“আফসোস! তুমি আমাতে না জড়ালে বেশ স্বাভাবিক একটা জীবন পেতে।”

“অস্বাভাবিকত্ব সুন্দর! একদম আপনার মতোই।”

“আচ্ছা, আজ যেভাবে খুঁজে পেলে..”

“হুম?”

“এভাবে যদি আবার হারিয়ে যাই?”

“আবার খুঁজব, আবার পাব..”

“চিরতরে গেলে?”

“আমিও পিছু নেব।”

“মরনেও?”

“পরকালেও।”

শুদ্ধ একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তনুজা মাথা নিচু করে ফেলল। বিরবির করে কেবল বলল, “আল্লাহ তোমায় সুখী করুক, শুদ্ধ। খুব সুখী করুক। আমাকে ছাড়াই..”

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে