অপ্রত্যাশিত বাসর ০৯

0
3144

অপ্রত্যাশিত বাসর

০৯.

আর্ভিন দূরে সরে গেলেও বিছানায়-ই আয়েশি ভঙ্গিতে বসে। থমথমে গলায় বলে,
– আচ্ছা, পূণম? তোমার কখনো আমার সম্পর্কে কৌতূহল জাগে নি? মানে আমি এমন কেন? আমার পরিবার, বাবা-মা কোথায়?’
আর্ভিনের কথায় পূণম বিস্মিত হলেও মাথা দুলায়। আগ্রহ হয় নি এমনটা নয়, পরিস্থিতির চাপে কখনো জিজ্ঞেস করা হয় নি। কিংবা আগ্রহ সে দেখাতে চায় নি। কিন্তু আজ যখন আর্ভিন নিজে বলতে চাইছে, তখন তাকে সুযোগ দেওয়া উচিত।

আর্ভিন স্মিত হাসে। শান্ত সুরে উত্তর দেয়,
– নিজের হাতে মেরে ফেলেছি আমি আমার বাবাকে। আমার হাতে প্রথম খুন হয়েছে আমার প্রথম প্রিয়জন, আমার বাবা। তখন আমার বয়স জানো কত? তেরো, মাত্র তেরো।’
পূণম এবার বিস্মিত-র চেয়েও অনেক বেশি বিস্মিত। কেউ কিভাবে নিজের হাতে নিজের বাবাকে মারতে পারে? তাও তেরো বছর বয়সে!

আর্ভিন ফের বলতে থাকে,
– এটাই ভাবছো তো, নিজের বাবাকে কেউ কেন, কিভাবে মারতে পারে? ভাবার তো কিছু নেই। কেউই মারতে পারে না। আমিও মারতে চাই নি। বেঁচে থাকতে চেয়েছিলাম সবার সাথে, আনন্দে। আনন্দে বাঁচতে চাওয়াটা নিশ্চয়ই পাপ নয়। তাই না, পূণম?’
তটস্থ পূণম সয়ংক্রিয় যন্ত্রের মতো মাথা নাড়ায়।
– আর জানো? রক্ত পানের মতো ভয়াবহ বিষয়টা সেখান থেকেই শুরু হয়। মৃত বাবার রক্ত পান করে যে মানসিক প্রশান্তি পেয়েছিলাম, তেরো বছর বয়সে এত শান্তি, এত আনন্দ আমি আর কিছুতে পাই নি।’

পূণম হতবিহ্বল দৃষ্টিতে তাকায় আর্ভিনের কথায়। আর্ভিন অপ্রস্তুতের হাসে, তীব্র অনিচ্ছার ফ্যাকাশে ঠোঁট প্রসারিত করা হাসি। শব্দহীন হাসি শেষ করে বলে,
– প্রশ্ন করো কেন মেরেছিলাম।’
পূণম জড়ানো কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,
– কেন মেরেছিলেন?’
– আরো একটা মানুষকে যেন আমার মতো স্যানগুইনারিয়ান বা এর থেকেও ভয়ংকর কিছু হতে না দেওয়ার জন্য মেরেছিলাম।’

পূণম কিছু বুঝলেও সব বুঝে ফেলেছে এমন ভঙ্গিতে তাকায়। আর আর্ভিন আগের সেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে। অতঃপর থমথমে গলায় বলে,
– আমি রক্ত পান করি, নিজের বাবা-মাকে মেরে ফেলেছি.. না দুঃখিত! নিজের বাবাকে মেরেছি। কত খারাপ আমি! তাই না?’
পূণম এবার করুণ চোখ করে তাকায়। প্রতিবারের মতো এবারও মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানাবে কি-না সে বুঝতে পারছে না।

ওর অসহায়ত্ব বোধ হয় আর্ভিন বুঝতে পেরেছে। তাই সে উত্তরের অপেক্ষা না করে বলতে লাগলো,
– তো খারাপ লোকের সাথে থাকা যায় না বলে কি চলে যাওয়ার প্ল্যান করছো? তাহলে কিন্তু সব থেকে বড় ভুল করবে, পূণম।’
পূণম ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালে আর্ভিন এদিক-ওদিক কিছু একটা খুঁজতে শুরু করে দেয়। নিজের ফোন পেতেই বিজয়ের হাসি হাসে। পূণমের চোখের সামনে একটা ছবি তুলে ধরে বলে,
– এই হলো সেই মেয়ে, যার জন্য হৃদম তোমায় ছেড়েছিল।’

ফোনের স্ক্রিনে একটা হাসোজ্জল মেয়ের ছবি ঝলঝল করছে। পূণম অবাক দৃষ্টিতে মেয়েটার দিকে তাকায়। অসম্ভব সুন্দর এই মেয়েটি নিঃসন্দেহে পূণমের থেকে অত্যাধিক রূপবতী। কিন্তু হৃদমকে ও চেনে। এতটা সস্তা সে নয় যে রূপের কাছে ভালোবাসাকে হারতে দেবে।

পূণমের চোখে-মুখে অবিশ্বাসের রেশ দেখে মুচকি হাসে আর্ভিন। প্রকাশ্যে না পারলেও মনে মনে টিপ্পনী কেটে ফেলে সে। ফোনটা পূণমের আরেকটু সামনে নিয়ে যায়। ঘাড় কাত করে গম্ভীর আওয়াজে বলে,
– নেক্সট ছবিগুলোও দেখো। অনেক ছবি আছে কিন্তু। একটা দেখে বাকিগুলো ফেলে রাখলে তারা মনঃক্ষুণ্ন হতে পারে।’

খুব যত্নে পূণম একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে। মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বলে,
– আমি দেখতে চাইছি না। আপনার ফোন সরান।’
আর্ভিন জীভ নাড়িয়ে বিরক্তিসূচক একটা শব্দ করে। ফোনটা পূণমের হাতে গুঁজে দেয়। চলে যেতে যেতে বলে,
– দেখোই না। দেখতে দেখতেই চট করে এখান থেকে পালানোর পরিকল্পনাটা মাথা থেকে দেখবে সরে গেছে।’

আর্ভিন চলে গেলে ছোট একটা নিঃশ্বাস ছাড়ে পূণম। আর্ভিনকে এখনো সে বুঝতে পারছে না। হয়তো, একটু ভাবনাচিন্তা করলেই তার রহস্য টা ধরতে পারবে। কিন্তু সে এবং তার মস্তিষ্ক ভীষণ ক্লান্ত। ভীষণ! অনেক প্রশ্ন থাকলেও কিছুই জানতে ইচ্ছে করছে না। তার মন ও মস্তিষ্কে এখন শুধু হৃদম হৃদম করছে। আরচোখে সে আর্ভিনের ফোনের দিকে তাকায়। কাঁপা কাঁপা হাতে ফোন চেপে বাকি ছবিগুলো দেখতে থাকে।

দেখা শেষ হতেই টুপ করে হাত থেকে পড়ে যায় ফোনটা। ডুকরে কেঁদে উঠে সে। চোখের সামনে ভাসতে থাকে হৃদমের সাথে এঁটে থাকা মেয়েটার ছবিগুলো। আর্ভিনকে সে বিশ্বাস করেনি। এখনো করছে। কিম্বা করলেও মানতে চাইছে না। আর্ভিন মিথ্যে বলতে পারে। কিন্তু হৃদমের সাথে ঐ মেয়ের ছবিগুলো তো দেখাচ্ছে তাকে, চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে। এগুলো কিভাবে অস্বীকার করবে সে? হৃদম কি সত্যিই তাকে ঠকিয়েছে?

প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য হলেও হৃদমের সাথে তাকে দেখা করতে হবে। আর দেখা করার সূক্ষ্ম একটা মাধ্যম আর্ভিন তার হাতে তুলে দিয়েছে। না, ঠিক একটা না, দুইটা। দুইটা মাধ্যম।

বিছানা ছেড়ে ড্রয়ারের কাছে যায় পূণম। ফাস্টএইড বক্স থেকে পোড়া হাতে একটু অয়েনমেন্ট লাগায়। প্লাস্টিক প্যাপারে মোড়ানো ফ্রিজিয়াম ট্যাবলেটের প্যাকেটটা হাতে নেয়। গুটিকয়েক ট্যাবলেট খুলে প্যালাজ্জোর পকেটে রাখে। অতঃপর স্মিতহাস্যে নিচে নামে।

আর্ভিন রান্না করছিল। পূণম মুখে অসহায়তা ছাপিয়ে তার কাছে যায়। ভাঙা ভাঙা গলায় বলে,
– আমি ভাবিনি হৃদম আমায় ঠকাবে।’
বলতে বলতেই কেঁদে ফেলে সে। আর্ভিন মুখ কুঁচকে বলে,
– অনেক কিছুই হয় যা আমরা ভাবি না। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। অযথা ফ্যাচফ্যাচ না করে ডাইনিং এ যাও। আমি খাবার আনছি।’

পূণম বিরক্ত হলেও কিছু বলে না। কিচেন ছেড়ে চলে যায় ডাইনিং এ। ছেলেটা অদ্ভুত। যতবার পূণম কান্না করেছে, ততবারই সে মুখের বিকৃত ভঙ্গি দেখিয়েছে। কখনো স্বান্তনা দেয় নি। বরং হামকি-ধামকি শুনিয়েছে। এমন কেন এই ছেলে? এত অদ্ভুত!

কিছুক্ষণ পর খাবার হাতে আর্ভিনও আসে। নিজেই সার্ভ করে। খাবার মুখে তুলে বলে,
– আজকের জন্য রান্না করলাম বলে ভেবোনা রোজ করবো। হ্যাঁ! মাঝে মাঝে অবশ্য করবো। বউকে বেশি লায় কিংবা কষ্ট, কোনোটাই দিতে নেই। বুঝলে? আশ্চর্য! খাচ্চো না কেন তুমি? আমি এতটা বাজে রান্না কিন্তু করি না। সেই ছোট থেকেই একা থাকছি আমি। তাই রান্না খারাপ করলে চলে না আমার।’
বলেই হু-হা করে হাসতে শুরু করে আর্ভিন।

কিন্তু কথাটা আসলে হাসির নয়। বরং অদ্ভুত। তার বাবাকে না-হয় সে মেরে ফেলেছে কিন্ত মা? তখন তো বলেনি মাকে মেরেছে। তাহলে তার মা কোথায় ছিল? যেখানেই হোক, সে এখন ভাববে না এসব। তাকে অন্য কিছু ভাবতে হবে। অবশ্য অন্যকিছুটা ভাবা আছে। স্মিত হাসে পূণম।

.
.
(চলবে)

#অপ্রত্যাশিত_বাসর
® নবনীতা নূর

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে