অন্ধকারে এক চিলতে আলো পর্ব-০২

0
2130

#অন্ধকারে_এক_চিলতে_আলো
#লেখিকা- শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-২

কারণ মা বলল-

– আজকে রাতে তোমার বিয়ে। রাতে প্রস্তুত থেকো।

মায়ের কথা শুনে আমি আকাশ থেকে পড়লাম। মনে হলো এটা আমার মা না ডাইনি। একে তো এত নোংরা একটা কাজ করেছে তার উপর এমন কথা বলতে উনার বিবেকে বাঁধল না। আমি মায়ের কথার জবাবে চিৎকার করে বলে উঠলাম

– তুমি কী আমার মা? কোনো মা তো তার সন্তানকে এত কষ্টের মধ্যে ফেলে না। আমাকে দয়া করো মা। আমি তোমার মেয়ে। এ বয়সে তুমি আমাকে কার সাথে বিয়ে দিবে? অল্প বয়স আমার। মা গো এ কষ্টে আমাকে ফেলো না।

– আমি যা বলব তাই হবে। আর শুন এতদিন তোকে বলেনি কারণ বলার প্রয়োজন মনে করিনি। আজকে বলছি আমি তোর মা না। তোর মা অন্যজন ছিল। আমার তো কোনো সন্তানেই নেই। সন্তান দেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই।

আমি উনার মেয়ে না? মা এটা কী বলল। মায়ের কথাটা শুনে আমার বুকটা কম্পন দিয়ে উঠল। আমি কাঁদতে কাঁদতে বললাম

– এসব কী বলছো মা? তুমি আমার মা না হলে কে আমার মা?

– আমার আগে তোর বাবার আরেক বউ ছিল। তোর জন্মের পর মারা গেছে। তুই আমার সৎ মেয়ে। আমি তোর সৎ মা। এতদিন বলেনি কারণ বলার মতো কোনো কারণ ছিল না। তুই ও কোনো ঝামেলা করিসনি তাই দয়া দেখিয়ে এসেছি। এখন আজকে তোর বিয়ে সেটা মাথায় রাখ। বয়স অল্প তো কী হয়েছে। তোর শরীর ঠিক থাকলেই হবে। বিয়ে কী আর বয়স দিয়ে হয় না। বিয়ে হয় শরীর দিয়ে। একদম চুপচাপ থাকবি। যা বলব তাই করবি।

– এতদিন তোমার কাজে মনে হত তুমি আমার মা না। আজকে তোমার কথায় তা প্রমাণ হলো। মা আমার বয়সটা অল্প। তবে ছোট থেকে তোমার নোংরামো দেখে বড় হতে হতে অনেক কিছু শিখেছি। আমি তোমার মেয়ে না তবে একটা মানুষ। মানবিক দিক ভেবে হলেও আমার সাথে এমন করো না। আর আমার মতো পিচ্চি মেয়েকে কে বা বিয়ে করবে।

– কেন কাল যে আংকেলটা তোর কাছে ছিল। সে তোকে পছন্দ করেছে। তোকে বিয়ে করলে আমাকে পাঁচ লাখ টাকা দিবে৷ সুতরাং আমার কথার নড়চড় হবে না।

মায়ের কথা শুনে… মা না ডাইনি হবে সে। তার কথা শুনে আমার বুকটা কেঁপে উঠল। সে নোংরা লোকটা নাকি আমার স্বামী হবে। অন্য কেউ হলে হয়তো মানতে পারতাম। মনে আশা নিয়ে থাকতে পারতাম যে ভালো কিছু ও হতে পারে জীবনে। এ নরক থেকে বের হতে পারব। কিন্তু সে আশার আলোও নিভে গেল। সামান্য পাঁচ লাখ টাকার জন্য আমার সাথে নোংরামো করল। আমার বুক ফেটে কান্না আসলো। কান্না জড়িত কন্ঠে অসহায় সুরে বললাম

– দয়াকরে এমন কাজ করো না। ঐ লোকটা একটা বাজে লোক। আমি পারব না উনাকে বিয়ে করতে। তার উপর তোমার সাথে ঐ লোকটার বাজে সম্পর্ক। আপন মা হও বা সৎ মা। মা তো তুমি। নিজের মায়ের যে লোকের সাথে বাজে সম্পর্ক তাকে বিয়ে করতে কীভাবে বলছো?বিয়ে করাতে চাচ্ছ বিয়ে করাও তবে অন্য কারও সাথে।

মা আমার চুলের মুঠি ধরে বলল

– বেশি বেড়ে গেছিস তাই না? তোকে যা বলব তাই করতে হবে। যা এবার গোসল করে নে।

বলেই মা চুলের মুঠিটা টেনে আমাকে আঁচরে ফেলে রুম থেকে চলে গেল।
আমি বসে বসে কাঁদতে লাগলাম। সারা শরীর ব্যথায় নীল হয়ে গেছে। শুয়া থেকে উঠতেই পারছিলাম না। নিজেকে সামলে নিয়ে গোসল করে নিলাম। তারপর নিজেই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখে কাঁদতে লাগলাম । আমার নাম আলো হলেও আমার জীবনটা আধাঁরে ডুবে রয়েছে। আমি জানি না কবে সে আধাঁর গুচিয়ে এক চিলতে আলোর খুঁজ পাব। আয়নার সামনে দাঁড়িয়েই আমি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলাম। ঠিক তখন আমার মা এসে আমার দিকে খাবার বাড়িয়ে দিয়ে বলল

– খেয়ে নে। আর এসব ন্যাকামি কান্না বাদ দে।

আমি মায়ের কথা শুনে মায়ের পায়ে ঝাঁপটে ধরলাম। নিজেকে এত অসহায় এর আগে আমার কখনও লাগে নি। বাচ্চা একটা মেয়ে যার স্কুলের গন্ডি পার হওয়ার কথা ছিল সে আজকে নিজেকে হায়ানার হাত থেকে বাঁচাতে মায়ের পায়ে ঝাঁপটে ধরেছে। আমার মা আমার হাত থেকে নিজের পা ছাড়িয়ে নিয়ে বুক বরাবর একটা লাথি দিয়ে বলল

– বলেছি তো একদম ন্যাকা কান্না করবি না। খাবার দিয়ে গেলাম খেয়ে নে।

বলেই আমার মা চলে গেল। আমি মেঝেতে পরে কাঁদতে লাগলাম। কিছুক্ষণ কেঁদে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আবারও নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে লাগলাম। নিজের প্রতিচ্ছবি দেখে আবার বিড়বিড় করে বললাম আমি বাঁচতে চাই বলেই কাঁদতে লাগলাম। কাঁদতে কাঁদতে আমার শরীর নেতিয়ে পড়ল। শ্বাস প্রশ্বাস যেন বন্ধ হয়ে আসতে লাগল। এসময় মরে গেলে হয়তো আমার জন্য সবচেয়ে ভালো হত। তবে আমি সেটাও পারছি না। কারণ এত সাহস আমার নেই। শরীরটা বেশ ক্লান্ত। সারা রাত অনেক কষ্ট হয়েছে। নিজের মনের মৃত্যু তো সে সাত বছর বয়সেই হয়েছে। এখন শুধু শরীরটা পড়ে রয়েছে। এ শরীরটার জন্য খেয়ে পড়ে বেঁচে আছি। পুরোপুরি শেষ করার সাহস ও পাচ্ছি না। ক্লান্ত শরীর নিয়ে বসে খাবারটা হাতে নিয়ে মুখে দিলাম। এ নরকের খাবার আমার গলা দিয়ে নামছে না। এখান থেকে পালাবার ও কোনো উপায় নেই। আর পালিয়ে যাবই বা কোথায়।

সারাটাদিন কাঁদতে কাঁদতে পার করলাম। সন্ধ্যায় ঐ লোকটা আসলো। এসে আমার কাছে বসে মাকে বলল

– ওকে শাড়ি পড়াও নি কেন? শাড়ি পড়িয়ে নিয়ে এসো। আর কাজী আসছে। কাজীকে অনেক টাকা দিতে হয়েছে বিয়ের জন্য। আগে থেকে সব স্যাটেল করে রেখেছি। কাজী আসতে আসতে শাড়ি পড়িয়ে নিয়ে এসো।

আরে ডার্লিং চিন্তা করো না এখনি নিয়ে আসছি। মায়ের কথাটা শুনে ঘৃনায় বমি আসতে লাগল। যতই হোক আমি উনার মেয়ে আর আমাকেই বিয়ে দিচ্ছে তার প্রেমিকের সঙ্গে আবার আমার সামনেই বলা হচ্ছে ডার্লিং। কতটা নোংরা সম্পর্কে আমি জড়াচ্ছি। মনে মনে বলতে লাগলাম আল্লাহ গো এ নরক থেকে কবে মুক্তি পাব। আমার সহায় হও। মা আমার পাশে এসে আমার হাতটা টেনে ধরে ঘরে নিয়ে গেল। জোর করে শাড়ি পড়িয়ে দিল। কিছুক্ষণ পর কাজী আসলো। সাথে আরও দুজন লোক।বুঝতে পারলাম তারা বিয়ের সাক্ষী। তাদেরও ভাড়া করে এনেছে। কাজীও কেমন সামান্য টাকার জন্য আমার মতো মেয়েকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে পড়াচ্ছে। কাজী যখন বিয়ে পড়ানো শুরু করলো তখন বুকটা আমার ফেটে যেতে লাগল। কলিজা দুভাগ হয়ে যেতে লাগল। কাজী হুট করে বলল

– কবুল বলো।

আমি কাজীর কথার কোনো উত্তর দিলাম না। চুপ হয়ে রইলাম। বারবার কাজী বলারও পরও আমি নিশ্চুপ। আমার নীরবতা দেখে মা চুল টেনে ধরল। বেদরম মার মারতে লাগল। শরীরের যন্ত্রণা এত প্রখর হলো যে আমি কবুল বলতে বাধ্য হলাম। ঘৃনিত হলেও সত্য যে সেদিন আমার মায়ের প্রেমিকের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়।

বিয়ের পর লোকটা আমাকে নিয়ে আসে তার বাসায়। বড় একটা বাসা। দুতলা করা। বাসায় কেউ নেই আমি আর লোকটা ছাড়া। বাসায় এনেই আমার উপর হামলে পড়ে। অসহ্য যন্ত্রণার চিৎকার যেন তার কানে পৌঁছাল ও না। দিনের পর দিন এরকম যন্ত্রণা সহ্য করতে হচ্ছে৷ প্রতিনিয়ত কষ্ট পেতে হচ্ছে। মাঝে মাঝে মা আসে এ বাসায়, এসে ঐ লেকটার সাথে বেশ অন্তরঙ্গ হয়ে থাকে। কতটা ঘৃনিত সম্পর্কে আমি আছি যেখানে মেয়ের স্বামীর সাথে মা থাকে। ভাবতেই গা টা ঘিনঘিন করতে থাকে। এরকম ঘৃনিত সম্পর্কের এক বছর পর মাত্র তের বছর বয়সে আমি মা হতে চলি। কিন্তু আমার বাচ্চাটাকে খুন করে আমাকে চিরতরে মা হওয়ার পথ বন্ধ করে দেয় আমার ডাইনি মা আর ঐ লোকটা। কারণ তারা তো আমাকে ভোগের পন্য ভাবে। মাতৃত্ব হারানোর কষ্ট একটা মেয়ের জন্য কতটা প্রখর সেটা আমি জানি। তাও সেটা উপলব্ধি করেছিলাম মাত্র তের বছর বয়সে। আমার বয়সী মেয়েরা হেসে খেলে জীবন যাপন করে। আর আমি বাস্তবতার কষাঘাতে পড়ে মরছি৷ সারাদিন শুধু কষ্ট হয় আমার। আমার এ নরক জীবন থেকে হয়তো কখনো মুক্তি মিলবে না। কবে আমি মুক্ত আকাশে ডানা মেলে উড়তে পারব জানি না। এ নরক যন্ত্রণা সহ্য করতে পারছি না। কিন্তু প্রতিনিয়তই আমাকে এ নরক যন্ত্রণা সহ্য করতে হচ্ছে।

যন্ত্রণার আগুনে আরও এক বছর পুড়ে ১৪ তে পা রাখলাম। এ অল্প বয়সে কতটুকু কষ্ট সহ্য করেছি সেটা ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। রোজ রোজ লেকটার অত্যাচার শারীরিক যন্ত্রণা পাওয়া ছিল রোজকার রুটিন। জানি না এ জীবন থেকে আমি মুক্তি পাব কিনা। অন্ধকারে এ চিলতে আলোর দেখা কী আমার জীবনে মিলবে? কি হলো মিলবে বলো?

কথাগুলে আলো আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের প্রতিচ্ছবিকে বলছিল। আলোর কথা বলার কোনো সঙ্গী নেই। এ বাসায় একা একাই থাকে। মাঝে মাঝে লোকটা আসে বাজার করে দিয়ে যায় আর নিজের মতো করে ভোগ করে চলে যায়। বাকিটা সময় আলো একাই থাকে। আর বেশির ভাগ সময় আয়নায় দাঁড়িয়ে নিজের প্রতিচ্ছবির সাথে কথা বলে। আজকেও তার ব্যতিক্রম হলো না। আজকে তার ১৪ তম জন্মদিনে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া কালো অধ্যায়ের বর্ণণা করছিল আলো। আর জিজ্ঞেস করছিল নিজের প্রতিচ্ছবিকে এটা যে, অন্ধকারে এক চিলতে আলোর দেখা কী তার জীবনে মিলবে না? প্রশ্নটা বেশ কয়েকবার আয়নাকে করলো।এমন সময় আলো দরজা খোলার আওয়াজ পেল। আলোর আর বুঝতে বাকি রইল না ঐ লোকটা এসেছে৷ আলো ভয়ে কুকড়ে যেতে লাগল। কারণ আজকের দিনে অন্তত যন্ত্রণা সহ্য করতে সে চায় না। তাই নিজেকে সামলে নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে অবাক হয়ে গেল।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে