অন্ধকারে এক চিলতে আলো পর্ব-১০

0
1231

#অন্ধকারে_এক_চিলতে_আলো
#লেখিকা-শারমিন আঁচল নিপা।
#পর্ব-১০

তানভীর তাড়াহুড়ো করে দরজাটা খুলল। দরজা খুলার সাথে সাথে আলোর ভয়টা বেড়ে গেল। কারণ একটা ২১-২ ৩ বছর বয়সী মেয়ে দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে। তানভীরকে দেখেই ভয়ে কুঁকড়ে খাটের উপরে থাকা কাঁথা মুড়ি দিয়ে তানভীরকে লক্ষ্য করে বলল

– যাও আমার কাছ থেকে চলে যাও। একদম কাছে আসবে না আমার। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। প্লিজ যাও।

তানভীর মেয়েটার কথা শুনে হালকা গলায় বলল

– ফাবিহা আস্তে চিল্লাও। আমি তানভীর।এত জোরে চিল্লাচিল্লি করো না।আমি তোমার কিছু করব না।মা বাইরে গেছে। মা আসলে তুমি যা চাও তাই দিবে। তুমি এখন এভাবে চিল্লাচ্ছিলে কেন?

তানভীরের কথা শুনে আলো বুঝতে পারলো মেয়েটার নাম ফাবিহা। কিন্তু মেয়েটা তানভীরের কথায় শান্ত হয়নি উল্টো ভয়ে চুপস যেতে লাগল।পাশে থাকা জিনিস পত্র তানভীরের দিকে ছুরতে লাগল। আর বলতে লাগল

– আমার কাছে আসবে না একদম। আমার অনেক কষ্ট হয়। যাও বলছি।

আলো বুঝতে পারছে না ফাবিহা কেন তানভীরকে এত ভয় পাচ্ছে। তাহলে কী তানভীর ওর সাথে এমন কিছু করেছে যাতে করে ফাবিহা তানভীরকে সহ্যই করতে পারছে না।এসব ভেবে আলোর মাথা ঘুরপাক খেতে লাগল। এদিকে তানভীর ফাবিহাকে কিছু না বলে আলোর দিকে তাকিয়ে বলল

– এখানে এসেছেন কেন? ঘর থেকে বের হোন। ঘরের দরজা লাগাব। সবকিছুতে এত কৌতুহল ভালো না।

আলো তানভীরের কথার কোনো জবাব না দিয়ে ঘরটা থেকে বের হয়ে ঘরের বাইরে দাঁড়াল। তানভীরও ঘর থেকে বের হয়ে ঘরের দরজাটা লাগিয়ে হনহন করে নিজের ঘরের দিকে যেতে লাগল। আলোর ভেতরে থাকা প্রশ্নগুলো আলোকে দুমরে মুচরে খাচ্ছে। তাহলে কী তানভীর ঐ মেয়েটাকে অত্যাচার করছে। এসব ভাবতে ভাবতেই সবটা সাহস সঞ্চয় করে তানভীরের পথ আটকে দিয়ে ঠিক সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল

– আপনি আমাকে বলুন মেয়েটা কে? আর কেনই বা চিৎকার করলো এভাবে? আর আপনাকে কেন এত ভয় পাচ্ছে? এর পেছনে কারণ কী?

তানভীর আলোর দিকে এগিয়ে গেল। আলো দু পা পেছালো।তানভীর আলোর বাহু ধরে তাকে পাশ কাটিয়ে যেতে নিলে আলো আরও কিছুটা সামনে এসে তানভীরের পথ রুখে দাঁড়িয়ে বলল

– কী হলো? না বলে কোথায় যাচ্ছেন? বলুন ঐ মেয়েটা কে? আপনাকে কেন ভয় পাচ্ছে? তার মানে ঐ মেয়েটার সাথে খারাপ কিছু হয়েছে যার সাথে আপনি জড়িত।

তানভীর আলোর কথায় আলোর দিকে গর্জে তাকাল। আলো তানভীরের এমন রাগী চাহুনি দেখে খানিকটা পেছনের দিকে গেল।তানভীর আলোর দিকে তাকিয়ে বলল

– ঘরে থাকা যে মেয়েটাকে দেখেছেন সে আমার আপন বোনের মতো।আমার খালাত বোন ফাবিহা। পিঠাপিঠি ছিলাম দুজন। তাই দুজনের খুনসুঁটিও ছিল প্রচুর। মেয়েটা মানসিক ভারসাম্যহীন দীর্ঘ তিন বছর যাবত। আর আপনি কী না তাকে নিয়েই আমাকে যা’তা বলছেন।

তানভীরের কথায় আলো চুপ হয়ে গেল। না জেনে কাউকে সত্যিই কিছু বলা উচিত না। আলো ভয়ে ভয়ে বলল

– আমি বুঝতে পারে নি।দয়াকরে কষ্ট নিবেন না। তবে উনি মানসিক ভারসাম্যহীন হলেন কী করে?

-কিছু জানোয়ারের জন্য।

আলো বিস্মিত হয়ে বলল

– মানে?

– ফাবিহা একটা ছেলেকে প্রচন্ড রকম ভালোবাসত। তখন ফাবিহা ইন্টার ১ম বর্ষে পড়ত। আমার কাছে সবকিছুই বলত। নিজের ভালোবাসার কথা, নিজের কথা সব। একটা সময় পর ফাবিহা আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেয়। জিজ্ঞেস করলে বলে তার প্রেমিক চায় না আমার সাথে সে কথা বলুক তাই কথা বলবে না। আমিও আর তার সিদ্ধান্তে দ্বিমত করেনি। চেয়েছি সে তার জায়গায় ভালো থাকুক। এরকম করে ফাবিহার সাথে আমার যোগাযোগ নেই অনেকদিন যাবত।প্রায় একবছর তো হয়ে যাবে। সে সময়টাতে রুশির সাথে দেখা। রুশির ঘটনাকে কেন্দ্র করে এত খারাপ সময় পার করি যে কীভাবে এক বছর ফাবিহার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিলাম বলতে পারব না। এক বছর পর হুট করে জানতে পারি ফাবিহা অসুস্থ। আমি আর মা তাড়াতাড়ি হাসপাতালে যাই। সেখানে গিয়ে জানতে পারি ফাবিহা রেইপ হয়েছে। সেটা খালা জানতে পেরে খালা স্ট্রোক করে। সে ঘটনার পর খালা আর সুস্থ হয়নি পরপারে চলে যায়। আর ফাবিহার তখন জ্ঞান ছিল না। জ্ঞান ফেরার পর ফাবিহা জানায় যে তার প্রেমিক তাকে ঘুরতে নিতে গিয়ে এক বাসায় নিয়ে যায়। সেখানে তার প্রেমিক সহ তাকে সাতজন মিলে রেইপ করে। কথাগুলো বলার পর ফাবিহা আরও জোরে চিৎকার দিয়ে অজ্ঞান হয়ে যায়। পরবর্তীতে জ্ঞান ফেরার পর খালার খবর জেনে নিজেকে সে আর সামলাতে পারে নি।এক তো প্রিয়জন হারিয়েছে অন্যদিকে নিজের সব হারিয়েছে।সব মিলিয়ে সেদিনের পর থেকে সে আর স্বাভাবিক জীবনে আসতে পারে নি।মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। সে এখনও সে অতীতে ডুবে আছে। শুধু আমাকে না যেকোনো ছেলেকে দেখে সে চিৎকার করে উঠে। বাইরের আলো সহ্য করতে পারে না।

“মাঝে মাঝে মানুষ আঁধারে এমনভাবে ডুবে যায় তখন আলো তাদের সহ্য হয় না। তখন তারা আলোর কাছে আসার থেকে আঁধারের অতল সাগরে নিজেকে নিমজ্জিত করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে।”

ফাবিহার ক্ষেত্রটাও এমন সে চাইলেও সে অতীত থেকে বের হয়ে আসতে পারছে না।তার অতীত তাকে প্রতিনিয়ত কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। নিজের সবকিছু হারানোর প্রতিচ্ছবিটা তার চোখে দীর্ঘ তিন বছর যাবত প্রতিনিয়ত ভাসছে।

তানভীর কথা গুলো বলে আস্তে পায়ে আলোকে সরিয়ে ঘরের দিকে এগুতে লাগল। আলো ঠাঁই দাঁড়িয়ে চুপ হয়ে রইল। নিজের মধ্যে অপরাধবোধ কাজ করছে তার, তানভীরকে এত কিছু বলেছে তাই। সেই সাথে ফাবিহার করুণ পরিস্থিতির জন্য খুব কষ্ট পাচ্ছে। প্রতিটা মানুষেই নিজের জায়গায় কোনো না কোনো বিষয়ে কষ্টে আছে।

“মানুষের কষ্টের জায়গা ভিন্ন হলেও কষ্টের পরিমাণ সবার সমান। কষ্টের মাত্রাটা সবার কাছে তার জায়গা থেকে প্রখর।”

আলোর মনে হচ্ছে তানভীরের কাছে ক্ষমা চেয়ে নেওয়া উচিত। ভাবতে ভাবতেই মসজিদ থেকে আযানের ধ্বনি ভেসে আসছে। এমন সময় তানভীর আলোর কাছে এসে বলল

– মাগরিবের আযান পড়ে গেছে। কখন যে, দিন পেরিয়ে গেল বুঝতে পারেনি। মা আসবে কিছুক্ষণ পর। আমি নামাজে যাচ্ছি। আর রাবু নানুকে বলে আপনার খাবারের ব্যবস্থা করছি। খাবারটা খেয়ে নিয়েন। মা আসলে মাকে বুঝিয়ে আপনার থাকার ব্যবস্থাটা করে দিব। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।

বলেই তানভীর যেতে লাগল। আলো তানভীরকে পিছু ডেকে বলল

-শুনুন।

-বলুন কী বলবেন?

– আপনাকে ঐ সময় ঐভাবে বলাটা উচিত হয়নি। জীবনে এত নেতিবাচক বিষয় ঘটেছে যে ইতিবাচক কিছু আশা করতে ভয় হয়। আমাকে ক্ষমা করে দিবেন।

আলোর কথা শুনে তানভীর খানিকটা পিছিয়ে বলল

– কিছু মনে করে নি আমি। আশা করি এরপর থেকে আপনার জীবনে যা ঘটবে সব ইতিবাচক। নামাজে গেলাম আপনি থাকুন। আর খাবারটা পেলে খেয়ে নিবেন।

আলো হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল। তারপর নিজের ঘরে এসে অযু করে নামাজে দাঁড়াল। অনেকদিন যাবত আলো নামাজে দাঁড়ায়নি। জীবনের এত চরম পরিস্থিতিতে পরে স্বাভাবিক জীবন যাপনের নীতির বাইরে চলে গেছিল। রবের কাছে যে মন খুলে সব বলা যায় সেটাও ভুলে গেছিল। আজকে সে নামাজ আদায় করে হাত তুলে মনের মধ্যে জমে থাকা সব কষ্ট রবের কাছে বলল। তার খুব ভালো লাগছে এখন।বেশ শান্তি লাগছে এখন। মনে হচ্ছে বুকের ভেতরে জমে থাকা বড় পাথরটা নেমে গেছে।নামাজটা শেষ করে খাটের পাশে রাখা ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে বসতেই রাবু খাবার নিয়ে আসলো আলোর জন্য।খাবার টা আলোর দিকে বাড়িয়ে বলল

– কখন থেকে রান্না করে বসে আছি। মাত্র ছোট সাহেব বলল আপনারে খাবার দেওয়ার জন্য। আপনার হয়তো ক্ষুধা লাগছে অনেক তাই না?

আলো রাবুর হাত থেকে খাবারের প্লেটটা নিয়ে রাবুকে মৃদু গলায় বলল

– খাবাবের কথা আমিই ভুলে গেছিলাম। আমার ক্ষুধা লাগেনি। বরং এখনও খেতে মন চাচ্ছে না।

– খালি পেটে থাইকেন না। খাইয়া লন।

আলো মাথা নাড়াল। রাবু রুম থেকে চলে গেল। আলোর প্লেটের ভাতে হাত নাড়তে লাগল। খাবারটা মুখে তুলতে তার একদম ইচ্ছা হচ্ছে না। কিন্তু এ মুহূর্তে না খেলে তানভীরের মা এসে জানলে অনেক প্রশ্নের সম্মুখী হতে হবে। সে জন্য বেশ জোর করেই কয়েক লোকমা মুখে তুলে নিল।বাকিটা সে চাইলেও গিলতে পারছে না। আর যতটুকু খাবার ভেতরে গিয়েছে ততটুকু খাবার ও বের হয়ে আসতে চাচ্ছে। আলো আর বাকিগুলো না খেয়ে হাতটা ধুয়ে শুয়ে পড়ল। শরীরটা বেশ খারাপ লাগছে তার। কী করবে বুঝতে পারছে না। হুট করে শীত ও বেশি লাগছে।কম্বলটা মুড়ি দিয়ে মাথাটা কম্বলের ভতরে ঢুকিয়ে শুয়ে আছে। সারা শরীর কাপুঁনি দিচ্ছে তার। ভেতরটা জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে। কেন যে এমন লাগছে বুঝতে পারছে না।

এর মধ্যেই তানভীর কাশি দিয়ে আলোর রুমে প্রবেশ করল।আলোকে কাঁপতে দেখে আলোকে ধরে দেখল আলোর সারা শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। তানভীর তাড়াহুড়ো করে আলোর মাথায় জলপট্টি দিতে লাগল।প্রায় আধা ঘন্টা ক্রমাগত জলপট্টি দেওয়ার ফলে আলোর জ্বরটা একটু নামল। এর মধ্যে তানভীরের মা চলে আসলো। তিনি এসেই আলোর কাছে আসলেন। লক্ষ্য করলেন আলোর জ্বর হয়েছে।তিনি নিজে আলোর পাশে বসে জলপট্টি দিল কতক্ষণ । তারপর ডাক্তারকে কল দিল আসার জন্য। তানভীর এ সুযোগে তার মাকে বলল

– মা আলো আর শায়ান একটা সাবলেটে থাকত। কেনো এক কারণে সাবলেটটা ছাড়তে হচ্ছে।শায়ান কোনো একটা মেসে উঠে যাবে। তবে আলোর থাকা নিয়ে একটু সমস্যা হচ্ছে। শায়ান বলছিল আমাদের বাসায় আলোকে কিছুদিন রাখতে।তুমি সম্মতি দিলে আমি শায়ানকে জানাব।

জাহানারা সুফিয়া আলোর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল নিষ্পাপ চেহারার, মলিন মুখটা চোখ বন্ধ করে জ্বরের তীব্রতায় ভুগছে। আলোর প্রতি খানিক মায়া জন্মালো তার। সে তানভীরকে হালকা গলায় জবাব দিল

– থাকতে চেয়েছে থাকুক।বাসায় তো আর জায়গার অভাব নেই। কিছুদিনের জন্য সমস্যা হবে না আশাকরি। আর আলো কী খেয়েছে?

– হ্যাঁ মা খেয়েছে।

– আচ্ছা শায়ানকে একটা কল দাও তো। আলোর সম্পর্কে না জেনে তো চিকিৎসা করা যাবে না।ডাক্তার তো আলোর সম্পর্কে জানতে চাইবে।

তানভীর কোনো কথা না বলে শায়ানকে কল দিল।অবশ্য তানভীর আগে থেকেই শায়ানকে বুঝিয়ে রেখেছিল।তানভীরের কল পেয়ে শায়ানও বেশ নাটক করল। ঠিক তানভীর যেমনটা শিখিয়ে দিয়েছিল তেমনটা। জাহানারা সুফিয়া শায়ানের সাথে কথা শেষ করতেই ডাক্তার আসলো। ডাক্তার আলোকে দেখে বলল

– হুট করে আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে জ্বরটা হয়েছে।এটা একটু যত্নেই সেরে যাবে। আমি ঔষধ লিখে দিয়ে যাচ্ছি নিয়ম করে খাওয়াবেন।

তানভীরের মা মাথা নাড়ল।ডাক্তারকে বিদায় দিয়ে আলোকে নিজ হাতে খাইয়ে ঔষধ খাওয়ায়ে দিল। রাবুকে বলল আলোর সাথে থাকার জন্য। আর তানভীরকে বলল নিজের ঘরে যাওয়ার জন্য।তানভীরও কোনো কথা না বলে নিজের ঘরে চলে গেল।

পরদিন সকালে আলো ঘুম থেকে উঠে খাট থেকে নামতে নিবে ঠিক এমন সময় তানভীর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য নিয়ে হাজির হলো।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে