অন্তর্দহন প্রণয় ২ পর্ব-০৮

0
1915

#অন্তর্দহন_প্রণয়
#দ্বিতীয় খন্ড
#পর্ব-৮
#সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি
মেহজাব আর কুয়াশার সাথে নেমে এলো জয়নব গাড়ি থেকে। সময়টা দুপুর ১২ টা। চারিদিকে আলোর ছিঁটেফোঁটা শুধু। গা ছমছম পরিবেশ। অথচ এই বাড়িটিতে গত একটা সপ্তাহ আগেই জয়নব এসেছিলো আদরের সাথে। সব কিছু এখন কেমন ধোঁয়াশা মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে এক অফুরন্ত পথে হাটছে জয়নব। এর শেষ কই?

জয়নব তার ভাবনার মাঝেই একটি চিৎকার শুনতে পেলো। ওঁরা বাড়ির সামনে গহিন জঙ্গল ধরে হেটে আসচ্ছিলো। অথচ এই জঙ্গল সে সেদিন দেখেনি। অবশ্যই কিভাবে দেখবে? তাদের তো রাতে আনা হয়েছিলো কিনা? জয়নব আর মেহজাব পিছনে ফিরলো। কুয়াশা নেই। কঁপালে দুটো ভাজ পড়লো জয়নবের। এদিক- সেদিক তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

” কুয়াশা? কুয়াশা কোথায় গেলো?”

” আমার পিছনেই তো ছিলো!”

মেহজাব নিজেও চিন্তায় পড়ে গেলো। ঠিক সেই মুহূর্তে আবারো চিৎকার শোনা গেলো। জয়নবের বুঝতে বাকি নেই এটি কুয়াশার গলা। জয়নব দৌঁড়ে ছুটে গেলো সেই জায়গায়…. কিন্তু বড় বড় গাছ-পালা আর পোঁকামাকরের ডাক শোনা ছাড়া আর কিছুই নেই। জয়নব মুখে হাত দিয়ে ফুপিয়ে উঠলো। পিছনে তাকিয়ে মেহজাবকে উদ্দেশ্য করে বলল,

” ভাইয়া… কুয়াশা… ভাইয়া… ভাইয়া.. তুমি কই?”

জয়নব আত্মাকে উঠলো। মেহজাব কোথায় চলে গেলো? সে এদিক সেদিক ছুটতে লাগলো। গহীন জঙ্গলের ভিতর দৌঁড়াতে লাগলো জয়নব। পায়ের নিচে পিশে যাও মরা পাতার মর্মর শব্দ কি বিকট। জয়নব খুঁজতে লাগলো তাদের. ঝড়ে বেঁকে যাওয়া গাছটার সামনে এসে দাঁড়ালো সে,

” কুয়াশা… ভাইয়া… তোমরা কই? ভাইয়া……”

জয়নবের কণ্ঠস্বর ফিরে ফিরে আসচ্ছে। জয়নব সেখানেই হাটু গুঁজে বসে পড়লো। বিলাপ করতে লাগলো। কি হচ্ছে তার সাথে? জয়নব নিজেকে সামলাতে চেষ্টা করলো। নাহ্… তাকে ভেঙে পড়লে চলবে না… তাকে তার গন্তব্যে পৌঁছাতেই হবে। এসব ভেবেই নিজেকে শক্ত করে উঠে দাঁড়ালো জয়নব। মেহজাব আসার আগে তাকে একটি ছোট রিভলবার ধরিয়ে দিয়েছিলো। বলেছিলো,

” সাহায্য করবে তোকে!”

দোনোমোনো করেও নিয়েছিলো। কাছে রেখেছিলো। জয়নব এবার হাঁটা ধরলো পরিত্যক্ত বাড়িটির ভিতরের দিকে। ভিতরে ঢুকতে চোখ দুটি ছানাবড়া জয়নব এর। এই বাড়িটি সেদিন কত সুসজ্জিত ছিলো… আর আজ? ঘুটঘুটে অন্ধকার। আলো যতটুকু আছে তাতে কোনো ভুতুড়ে বাড়ি মনে হচ্ছে। কখনো কখনো ঝাঁপটা মেরে উড়ে যাওয়া পাখির আওয়াজ ভেসে আসচ্ছে। জয়নব তার পকেট থেকে একটি লাইট বের পথে আর চারপাশের দেয়ালে মারলো। যদি কোনো ক্লু পাওয়া যায়? জয়নবের ভাবনার মতো কোনো কিছু পেলো না জয়নব। সব পুড়ে ছাই। জয়নবে যেন কি মনে হলো? সে যেই রুমটি থেকে গায়েব হয়েছিলো? চলে এলো সিঁড়ি বেয়ে রুমটির কাছে। ধাক্কা দিয়ে খুলে দিলো। অন্ধকার রুমটির ভিতরে লাইটের আলো পড়তেই ধমকে গেলো জয়নব। এই ঘরটিতে ছবিতে ভরপুর। এখানে এসব কিসের ছবি? জয়নব এগিয়ে গেলো। এই জীর্ণ শীর্ণ বাড়িটির ভিতরে এই রুমটি এতো পরিপাটি? কিভাবে? জয়নব ভিতরে পা বাড়ালো। প্রথম যে ছবিটিতে আলো পড়লো তা একটি ফ্যামেলি পিকচার। যেখনে দুটো ছেলে আর দুজন মধ্যে বয়স্ক মহিলা পুরুষ। বাচ্চা দুটোর একটির চোখ জোড়া আদরের চোখের মতো ফ্যাকাসে। জয়নব দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। এই বাড়িতে ঢুকে যেই ছবিটি সে আগে দেখেছিলো সেখানে আর এখানের মাঝে বড্ড ফারাক… আর তা হচ্ছে এদের বাবা-মা। জয়নব বুঝে গেছে… সেদিন যে মহিলাকে আদর মা ডাকছিলো সে আসলে তার মা নয় অন্য কেউ। তাহলে তাকে কেন মিথ্যা কথা বলল আদর? তাহলে কি আদর তাকে ঠকিয়েছে? জয়নব এবার আরেকটি ছবির দিকে আলো ফেলতেই বিস্ময়ে চোখ বড় বড় করে ফেললো। এ যে আর কেউ না? এই ছবিটি তার বাবা সাইফের যার উপর বড় করে রেড মার্ক করা। এভাবেই প্রতিটা ছবিতে লাইট ফেলতে জয়নবের ভয়ে হাত পা জমে যেতে লাগলো। চোখ দিয়ে পড়তে লাগলো অনর্গল নোনা জল। সাইফ, ডাক্তার সাহিল, এমন কি এখন পর্যন্ত জয়নব যাদের মেরেছে তাদের ছবিও এখানে? জয়নব শুকনো ঢুক গিললো। গলার ভিতরে তিক্ত কিছু অনুভব করলো। এসব কি? জয়নব লাষ্ট যে ছবিটিতে লাইট মারলো? তা আর কেউ না…. মেহজাব। জয়নব এবার ঘাবড়ে গেলো। দু কদম পিছিয়ে গেলো ভয়ে। পিছনে কিছু একটার সাথে ধাম করে ধাক্কা খেতেই ফ্লোর দু ভাগ হয়ে যেতেই জয়নব নিচে পড়ে গর্তের ভিতর পরে গেলো।জয়নব মাটিতে পড়তেই ধাম করে শব্দ হলো। হাত-পা এবং কি কঁপাল ফেঁটে গিয়ে রক্ত বের হয়ে গেলো। জয়নব ‘আহ্’ করে চেচিয়ে উঠলো। ধীরে ধীরে নিজেকে হুঁশে আনলো জয়নব। এই অন্ধকার গর্তের মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেললে চলবে না। জয়নব অন্ধকারের মাঝেই হাতরাতে লাগলো। পরে যাওয়ার সময় লাইটটা যেন কোথা পরে গেছে…।
জয়নব অন্ধকারের মাঝেই গর্তের মধ্য হাঁটতে লাগলো। কালো কুচকুচে অন্ধকার। ভেসে আসছে ভ্যাপসা গন্ধ। জয়নব যেন হারিয়ে যেতে লাগলো অন্ধকারের মাঝে। সেই মুহূর্তেই একটি লাইটার জ্বলে উঠলো। লাইটারের আলোতে ভেসে উঠলো ফ্যাকাসে সেই পরিচিত চোখ জোড়া। জয়নব সেদিকে তাকাতেই থমকে গেলো। চিনা পরিচিত গলা শোনা,

” শেষ পর্যন্ত তুমি আমাকে খুঁজে বের করলেই জান?”

আদরের ভাবলেশহীন কন্ঠে চোখ জোড়া ভড়ে এলো জয়নবের। এই ব্যক্তিটির জন্যই বুঝ দগ্ধ হচ্ছে। জ্বলে পুরে ছাই হচ্ছে। হচ্ছে প্রয়ণে প্রণয়ে অন্তর্দহন! জয়নবের বুকের উপর যেন কেউ পাথর চাপা দিয়ে রেখেছে। নিজের কষ্ট টুকু লুকিয়ে ফেলতে বৃথা চেষ্টা করলো, ধরে আসা কন্ঠে বলল,

” এমন কেন করলেন আপনি? এভাবে ধোঁকা দিলেন আমায়? কি দোষ ছিলো আমার??”

জয়নবের চোখ বার বার ঝাপসা হয়ে আসতে লাগলো। মাথায় চোট পাওয়ার ফলে ঘুরছে সব। তবুও বহু কষ্টে দাঁড়িয়ে আছে সে। ডা. আদর লাইটারের আলোর মাঝেই চোখ রেখে আছে। জয়নবের প্রশ্নবিদ্ধ চেয়ে থাকা জয়নবের উদ্দেশ্যে ভাবলেশহীন ভাবে তাকিয়ে বলল,

” তোমার বাবার জন্য জান…!”

জয়নব চকিতে তাকালো….

” বাবা.. বাবার জন্য মানে? আরে আমার বাবা তো আপনাদের জন্য মারা গেছে। তার সন্তানকে যে কেড়ে নিয়েছেন!”

আদর হাসলো। বাম হাতে চুটকি বাঁজাতেই ফকে ফকে হয়ে গেলো সব। তীব্র আলো চোখে বাঁজতেই নিচে বসে পড়লো জয়নব। চোখ দুটি জ্বলছে খুব। আদর তখন স্থীর। ওকে ঘিরে যেন আছে অন্ধকার গোলোক। জয়নব ধীরে ধীরে চোখ খুললো। চোখ দুটি লাল হয়ে গেছে জয়নবের। মাথা গড়িয়ে পড়া রক্তের ফোঁটা গুলো টপ টপ করে পড়ছে এবার মাটিতে। আদর এবার উঠে এলো। মাটিতে পড়ে থাকা জয়নবের মাথাটা তুলে নিজের বুকের মাঝে রাখলো। পরম যত্নে আদরে জয়নবের মুখের আদল খানি হাত দুটোর মাঝে ভড়ে নিয়ে ফিসফিস করে বলল,

” জান…রুফাইদা আমাদের টার্গেট ছিলো না… ছিলে তো তুমি!”

জয়নবের চোখ জোড়া বড় বড় হয়ে গেলো। আদর কথা আগে বাড়ালো,

” সাইফ আঙ্কেলের পালক মেয়ে রুফাইদা ভেবেই আমরা ওকে উঠিয়ে ছিলাম। কিন্তু যখন জানতে পারি সেই মানুষটা যাকে আমরা খুঁজছি? সে আর কেও না… তুমি! তখনি বড় ধরনের গেইম খেলে ফেললাম আমরা!”

জয়নবের চোখ জোড়া এবার বুঁজে আসতে চাইছে, আধো খোলা চোখ জোড়া নিয়ে দেখছে এই মানুষটাকে এই মানুষটা কি সত্যি সেই? জয়নব তার ভাড়ি পল্লব গুলো শক্ত করে বুঝে নিলো। তা দেখে আদর হাসলো চোখের কোনের জল টুকু মুছে দিয়ে বলল,

” জান.. টুইস্ট তো এখনো বাকি!”

জয়নব আবার চোখ মেললো। গায়ের সব শক্তি শুসে নিয়েছে যেন কেউ। তখনি আদরের গম্ভীর কন্ঠে শোনা গেলো,

” সারপ্রাইজ! ”

জয়নব আদরের চোখের দৃষ্টি অনুযায়ী তাকাতে এবার ভেঙ্গে পড়লো আরো। বলল,

” তোমরা… তোমরা তো…!”

” আমরা আদরের কাজিন জয়নব! আর আমি তোমার দেবর!”
সাজিয়া, ইউয়ান আর কুয়াশা এক সাথে কথা বলতেই জয়নবে পুরো পৃথিবী ঘুরতে লাগলো। জয়নব অনেক কষ্টে বলল,

” সাজিয়া আপু তুমি… তুমি তো মারা গেছো? আর কুয়াশা তুই তো….!”

” তোর বন্ধু তাই তো? ”

জয়নব জিন্দালাশের মতো শুধু চেয়ে রইলো। সবাই… সবাই তার সাথে এভাবে গেইম খেললো? তাহলে মেহজাব? মেহজাব কই? কিছু সময় অতিবাহিত হতেই জয়নব জিজ্ঞেস করলো,

” মেহজাব ভাইয়া…!”

এবার আদরের মুখ শক্ত হয়ে গেলো। জয়নবের দিকে তাকিয়ে বলল,

” শালা বাবুকে আপ্যায়ন করা হচ্ছে। ”

জয়নব বুঝতে পেরে আদরের হাত শক্ত করে ধরে বলল,

” তাকে ছেঁড়ে দিন!”

আদরের ঠোঁটের কোনে ভয়ানক হাসি। বলল,

” এর জন্য তোমাকে অনেক বড় বলিদান দিতে হবে জান!”

ইউয়ান এতক্ষণে মুখ খুললো,

” ভাইয়া… ভাবিকে এভাবে কেন কষ্ট দিচ্ছো? ছোট প্রাণ। ”

বলেই বাঁকা হাসলো। জয়নব এসব ঠাট্টা বুঝতে পেরে আদরকে ধাঁকিয়ে উঠে পড়লো। মেহজাবের দেয়া বন্দুকটা পকেট থেকে বের করে পয়েন্ট করে বসলো আদরের দিক। আদর মুচকি হাসলো,

” জান … তুমি কি আমাকে মারতে পারবে?”

জয়নবের এত দিনের রাগ, ক্ষোভ, ধোঁকায় সব কিছু মিলিয়ে হিংস্র করে তুলেছে। জয়নব চেঁচালো,

” মেহজাব ভাইয়া কোথায়??? নয়তো আমি আপনাকে মারতে এক মিনিটও ভাববো না!”

আদর হাসলো। বন্ধুকে খুব কাছে এসে দাঁড়িয়ে বলল,

” আমি প্রতিনিযত মরছি জান… তুমি আমাকে কি মারবে? তুমি আমাকে কখনো মারতে পারবে না জান।”

জয়নবের মাথা জেনো ভুত চেপে বসেছে। সে কিছু না ভেবেই বন্দুকের টিগার চাপ দিলো। সঙ্গে সঙ্গে গুলি এসে লাগলো আদরের বুকে। আদর একেবারে থম মেরে গেলো। বুকের মাঝে হাত রেখে জয়নবের দিকে তাঁকালো। জয়নব তখন কাঁপছে। হাতে বন্দুক টা-ও ছুটে পড়ে গেছে দূরে। আদর জয়নবের সামনে হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসে পড়লো। হাসতে হাসতে বলল,

” জান… ইউ আর ব্রেভ গার্ল। ভালোবাসার মানুষটিকে নিজের হাতে মারতে সত্যি সাহস লাগে।”

মুখ থুবড়ে এবার মাটিতে পড়ে গেলো আদর। রক্তে ভেসে যেতে লাগলো পুরো ফ্লোর। ইউয়ান, সাজিয়া, কুয়াশা ছুটে এসলো আদরের কাছে। কুয়াশা তীব্র ঘৃণা নিয়ে জয়নবকে বলল,

” এ কি করলি জয়নব? তুই কি জানিস ভাই তোকে কতটা ভালোবাসে। তুই কি জানিস? আজ তোদের জন্য আমাদের এই অবস্থা! ”

জয়নব নিজেও আর এসব সইতে পারলো না… সে-ও জ্ঞান হারালো….

চলবে,

(ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে