অনুরক্তি অন্তরিক্ষ পর্ব-১৯+২০

0
1176

#অনুরক্তি_অন্তরিক্ষ [১৯ পর্ব]
তাসনিম তামান্না

আজকের দিনটা অদ্ভুত কখনো আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে বৃষ্টি তো কখনো বা আকাশে মিষ্টি রোদ সাথে শীতল মন মাতাল ছুঁয়ে যাওয়া বাতাস তো আছে। সেই আকাশ পানে গভীর উদাসীন চোখে তাকিয়ে আছে জারা। মনটা তার বিক্ষিপ্ত, অগোছালো, বিরক্তিতে ভরপুর। সেদিনের পর কয়েকদিন কেটে গেছে জারা নিজেকে শান্ত করতে পারি নাই উতলা মনে নিজেকেই বার বার দোসারোপ করছে আগের চেয়ে এখন একেবারে শান্ত হয়ে গেছে শান ঝগড়া করতে আসলেও জারা চুপ থাকে কিছু বলে না প্রয়োজনীয় কথা একটা কথাও তার মুখ দিয়ে বের হয় না।

ইশার বিয়ের আর বেশিদিন বাকি নেই। বাড়ির সবাই হুলুস্থুল বাধিয়ে দিয়েছে। আজ সকলে মিলে ইশার বিয়ের শপিং করতে যাবে। তাতে জারা বাঁধ সাধলেও শান্তির ধমক খেয়ে আর কিছু বলে নি এখন সাদামাটা হয়ে রেডি হয়ে সবার আগে ড্রাইংরুমে এসে বসে আছে। এক এক করে সকলে আসলো। জারা চুপচাপ বসে আছে গাড়ির ফ্রন্ট সিটে শান ড্রাইভিং সিটে বসে জারার দিকে আড় চোখে তাকাছে বার বার পিছনে বসে কাজিনরা গল্পের আড্ডা জমিয়েছে হাসাহাসির রোল পড়ে গেছে। জারার খুব বিরক্ত লাগছে। কিছু বলতেও পারছে না। চোখ মুখ কুঁচকে বসে রইল। শপিং মলে এসে জারা এককোনায় চুপ করে ঘাপটি মেরে বসে রইল। শপিংয়ে শেষ পর্যায়ে চলে এসেছে ওরা। জারা একটা কিছু ও কিনে নাই শুধু চুপচাপ বসপ সব দেখছে। শান এগুলো দেখতে দেখতে নিজেও বিরক্ত হয়ে গেছে জারার ওপর। শান বিরক্তি নিয়ে জারার কাছে গিয়ে জারাকে হ্যাচকা টানে উঠিয়ে দাঁড় করালো জারা বড়বড় চোখ করে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো শান কি করতে চাইছে। কিন্তু শান কিছু না বলে জারার হাত ধরে টেনে সকলের চোখের আড়ালে নিয়ে গেলো জারা হাত ছাড়াতে চাইলেও পারল না পুরুষালীর শক্তির সাথে।

-‘ কি সমস্যা তোর?

জারা কিছু বলল না শান্ত চোখে তাকিয়ে রইলো শানের দিকে। শানের রাগের মাত্রা তিরতির করে বাড়তে লাগলো। দাঁতে দাঁত চেপে বলল

-‘ কি হলো কথা বলছিস না কেনো বোবা তুই? কথা বলতে পারিস না? ‘

জারা কিছু বলতে যাবে তখনি জিহানের বোন জিয়া এসে বলল

-‘ তোমরা এখানে কি করছ সকলে খুঁজছে জারাপু তোমাদের ‘

শান বলল

-‘ জিয়া আপনি গিয়ে বলুন জারার মাথা ব্যথা করছে সেজন্য আমি ওকে বাসায় নিয়ে যাচ্ছি ‘

-‘ কিন্তু…. ‘

-‘ আপনি প্লিজ কষ্ট করে বলে দিবেন ‘

জারা মুখ খুলে বলল

-‘ না না আমি কখন….’

শান ধমক দিয়ে বলল

-‘ শাট আপ এতোক্ষণ যখন কথা বলিস নি তখন এখনো কথা বলবি না ‘

কথাটা বলে জারাকে টানতে টানতে নিয়ে গেলো জিয়া হা করে তাকিয়ে দেখলো। জারা মনে মনে ভয়ে শেষ এখন না জানি শান আবার কি করে বসে। একপ্রকার জোরজবরদস্তি করে জারাকে বাসায় আনল শান। বাসা এখন ফুল ফাঁকা সুমি ও নাই। জারাকে সোফায় বসিয়ে শান গ্লাসে পানি এনে জারাকে দিলে জারা একচুমুকে শেষ করে বলল

-‘ বাসায় আনলেন কেনো? মনি জানলে কষ্ট পাবে ‘

-‘ ওহ রেলি। মনি কষ্ট পাবে? মনি যে তোর এই চুপচাপ বসে থাকা দেখে যে কষ্ট পাচ্ছে সেটা তোর চোখে পড়ে না? ‘

জারা চুপ করে থাকলো। শান আবারও বলল

-‘ তুই কিছু বুঝিস বা এতো অবুঝ কেনো তুই? তোর চুপ করে থাকায় একজনের বুকটা জ্বলে পুড়ে শেষ হয়ে যায়। হৃদয় দহনটা তুই একমাত্র নেভাতে পারবি বুঝিস না তুই কিছু বুঝিস না অবুঝ রয়ে যাবি সারাজীবন। একজন যে তোকে দিনের পর দিন ভালোবাসে সেটা তুই বুঝিস না তার খারাপ গুলোই শুধু দেখে গেলি ভালো গুলো তোর চোখে পড়ে না তার কষ্ট তোর চোখে পড়ে না তার কষ্টে তোর কষ্ট হয় না? ‘

শানের এমন প্যাচানো কথায় জারা স্তব্ধ হয়ে গেলো বুঝতে অসুবিধা হলো না শান কি বলছে। অজান্তেই মনটা পুলকিত হয়ে গেলো চোখে পানি ভির জমলো। কিছু বলার আগেই বাসার সবাই চলে আসলো। অতি সাবধানে লুকিয়ে চোখের অশ্রু কণাগুলো মুছে নিলো।

জারা শান চলে আসায় কেউ কোনো কথা জিজ্ঞেসা করলো না একটু এসপ্সেচ দেওয়া উচিত তাদের সম্পর্কটা স্বাভাবিক হওয়া দরকার আর কতদিন তারা এমন দূরে দূরে থাকবে? আব্দেও কি তাদের ভালোবাসা, প্রেম নামক শব্দ গুলো দুজন দুজনকে বলতে পারবে?

সকলে ক্লান্ত হয়ে যার যার রুমে চলে গেলো জারা নিজেও চলে গেলো। শানের সামনে কেনো জানি হঠাৎ লজ্জা লাগতে শুরু করছে।

সন্ধ্যার দিকে সকলে মিলে ইশার বিয়ের শপিং গুলো দেখতে লাগলো। জারা নিজেও সেখানে ছিল। যতসম্ভব নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে। সকলের সাথে থেকে ডিপ্রেশন থেকে বের হবার চেষ্টা করছে। ইশা বলল

-‘ জারা আপু তুমি তো কিছুই নেও নি তাহলে? ‘

-‘ আমার যা আছে তাতে হয়ে যাবে কেনা লাগবে না কিছু ‘

শান্তি বেগম বাঁধ সাধলেন বলল

-‘ না কাল তুই আর শান গিয়ে নিজের পছন্দ মতো কিনে আনিস শানও কিছু কিনে নি ‘

-‘ লাগবে না মনি ‘

-‘ আমি বলছি মানে লাগবে ‘

জারা চুপ হয়ে গেলো। মনি কষ্ট পাই এমন কিছু করতে চাইছে না তাছাড়া শানের সাথে কিছু কথাও আছে। শান কি সত্যি তাকে ভালোবাসে নাকি সেটা তার মনের ভুল? না-কি সে শুনতে ভুল করলো।

রাতে খাবার টেবিলে সকলে থাকলেও শান ছিল না। জারার অদ্ভুত লাগলো গেলো কোথায় মানুষ টা?
কথায় কথায় জানতে পারলো শান আজ ফেন্ডদের সাথে রাতে বাইরে বারবিকিউ পার্টি করবে। জারা আকাশ থেকে পড়ল এই বৃষ্টির সময় রাতে পার্টি তাও আবার বারবিকিউ। জারা নিজে নিজে ভাবলো জারা নিজে পাগল নাকি শান আর শানের ফেন্ডরা পাগল।

এটা নিয়ে সকলে হাসাহাসি করলো অনেক।

চলবে ইনশাআল্লাহ

#অনুরক্তি_অন্তরিক্ষ [২০ পর্ব]
তাসনিম তামান্না

লাল র-ক্তে চারিদিকে ভেসে যাচ্ছে মানুষজন ব্যথায় কাতরাচ্ছে। রক্তের বিঘুটে গন্ধে জারা চোখ মুখ কুচকে মুখ ওড়না দিয়ে চেপে ধরে ভয়ে তার সারা শরীর কাটা দিচ্ছে যেনো কোনো এক মৃত্যু পুরী। জারা এই অদ্ভুতদেশ থেকে বের হবার জন্য এদিক ওদিক দৌড়ে পথ খুঁজতে লাগল কিন্তু ও যেদিকেই যাচ্ছে সেদিকেই ব্যথায় কাতরানোর শব্দ জারা নিজের মাথা দু-হাত দিয়ে চেপে ধরল। হঠাৎ জারার কাঁধে কেউ হাত রাখলো জারা চমকে কিছু না ভেবেই পিছনে ফিরে তাকালো। শানকে দেখে জাপটে ধরে কাঁদতে লাগলো। আর বলতে লাগল

-‘ কোথায় ছিলেন হ্যাঁ কোথায় ছিলেন আপনি? জানেন আপনি আমি কতটা ভয় পাইছিলাম। ‘

পেটের তীব্র ব্যথায় জারা পেটে হাত দিয়ে পিছিয়ে এলো শানের থেকে পেট থেকে র-ক্ত গড়িয়ে পড়ছে। জারার মাথা ঘুরে গেলো। শরীরে শক্তি ফুড়িয়ে এলো। ছলছল চোখে শানের দিকে তাকিয়ে মাটিতে শুয়ে পড়ল। শানের হাতে র-ক্ত মাখা ধারালো ছু-রি। জারা থমকে গেলো ঝাপসা চোখে শানের অধরে লেগে থাকা অদ্ভুত সুন্দর হাসিটা যেটাতে বার বার ম/রে যেতে ইচ্ছে হত। আজ সেই হাসিতেই খু/ন হলো!

জারা চিৎকার দিয়ে উঠে বসল। দরদর করে ঘাম কপাল বেয়ে পরতে লাগল। জারা চারিদিক দেখল ড্রিম লাইটের আলো বাইরে ভোরের আলো ফুটছে থাই খোলা থাকাই স্পষ্ট সবকিছু। না সে রুমেই আছে জারা পাশের টেবিল থেকে গ্লাসে পানি ডেলে ঢকঢক করে পানি খেলো নিজ মুখেই বলল

-‘ কি ভ-য়ং-কর স্বপ্ন! তাও আবার শান আমাকে খু-ন! না না শান ভাইয়া আর যায় করুক এটা করতে পারে না এটা আমার বিশ্বাস করি না। ‘

জারা এপাশ ওপাশ ফিরে আর ঘুম হলো না উঠে নামাজ আদায় করে মন স্থির হলো। ছাদে কিছুক্ষণ পায়চারি করে রুমে এসে একটা গল্পের বই নিয়ে বসলো। ৮টার দিকে নিচে নামলো জারা অনেকে তখনো ঘুমাচ্ছে আবার অনেকে ঘুম থেকে উঠে নাস্তা করছে। নিচে এসে দাঁড়াতেই শানের ফুফু বলে উঠলো

-‘ কি রে শান্তি বউকে এতো ছাড় দিস কেনো? বোনের মেয়ে বলে? দেখিস একদিন মাথায় উঠে নাচবে এতো লায় দিস না পড়াশোনা করছে এবার স্বামী সংসারের হাল ধরুক তা না আবার কি না-কি করে রাতের বেলায় ও বাসার বাইরে থাকে এগুলো কিভাবে মানিস? রাতবিরেতে বাইরে থেকে কি করে খোঁজ খবর রাখিস তো না-কি সেটাও করিস না? ‘

শানের আরেক ফুফু বলে উঠলো

-‘ শান্তি তোমার ছেলে আর ছেলের বউ আলাদা থাকে না-কি? তেমন টাই তো দেখলাম বাবা তোমাদের ব্যাপার স্যাপারই তো আলাদা তা কি সমস্যা বউয়ের…..’

পরের কথাটা কি সেটা জারা বুঝতে পারলো। এমনিতেই সকালের স্বপ্নটার জন্য মন খারাপ ছিল। তার ওপরে বিষবাক্য শুনে বড্ড কান্না পেলো মন বিষিয়ে উঠলো জারার কিন্তু কাদলো না পাথরের ন্যায় দাড়িয়ে থাকলো মাথা নিচু করে। কষ্টে কান্নায় চোখ মুখ লাল হয়ে উঠল। জারা জানে শানের বড় ফুফু মেয়েকে শানের সাথে বিয়ে দেওয়ার ইচ্ছে ছিল তাই তো যতবারই আসে ততবারই জারাকে বিভিন্ন ভাবে অপমান করে উল্টো পাল্টা কথা বলে জারাকে ছোট করে দেয়।

শান্তি মুচকি হেসে বলল

-‘ আমার সংসারে তোমরা হস্তক্ষেপ না করলেই খুশি হবো আর কি বললে ও আমার বউমা নয় ও আমার মেয়ে আর ও কি হবে ওরা এখনো সংসার শুরু করে নি আর না ওরা সংসার ব্যাপারে কিছু বোঝে এখনো তো ওদের পুরো জীবন পড়ে আছে আস্তে আস্তে শুরু করুন ডিসিশন নিক ওরা কি করবে তোমরা আমি বললেই কি ওরা শুরু করতে পারবে? না তার জন্য ওদের প্রিপারেশনেও দরকার তাই ওদের ব্যাপার ওদের বুঝতে দাও ‘

জারার ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠলো । অপমানে তাদের মুখ থমথমে হয়ে আঁধার নেমে আসল। জারা এগিয়ে এসে বলল

-‘ মনি কিছু লাগবে করে দিবো? ‘

-‘ না তুই চা খাবি চা করে দিবো? ‘

-‘ না মনি ইচ্ছে করছে না আমি রুমে গেলাম দরকার পরলে ডেকো। ‘

জারা রুমে এসে চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়লো। জারার চোখের কোণ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো জারা মুছল না ওভাবেই ঘুমিয়ে পড়ল কখন জারা নিজেও জানে না। ঘুম ভাংগলো শান্তির ডাকে। আড়মোড়া ভেঙে ঘুম ঘুম কন্ঠে বলল

-‘ হ্যাঁ মনি বলো’

-‘ কি বলবো তোর এতো ঘুম কোথা থেকে আসলো? রাতে ঘুম হয় নি তোর? ‘

-‘ হ্যাঁ রাতে ঘুমাইছি তো এখন একটু আগেই ঘুমালাম ‘

-‘ একটু আগে? আমি তোকে দু-বার এসে দেখে গেছি ডাকি নাই সকালপ খাস নি এখন দুপুর দুইটা বাজে দুপুরেও কি খাবি না? না-কি ঘুমাবি? ‘

জারা আকাশ থেকে পড়ল লাফ দিয়ে উঠে বসে বলল

-‘ মানে এখন দুপুর? ‘

শান্তি বেগম হেসে বলল

-‘ জি হ্যা ম্যাডাম উঠে খেয়ে সাওয়ার নিয়ে রেডি হন শপিংয়ে যাবেন না? উঠেন ‘

জারা মুখটা প্যাচার মতো করে বসে রইলো। শান্তি তারা দিয়ে চলে গেলো।

জারা উঠে অগোছালো চুলগুলো খোলা হাতে খোপা করে নিজেকে বকতে বকতে বলল

-‘ সত্যি আজ এতো ঘুম কোথা থেকে আসলো এখনো ঘুম পাচ্ছে আমার দূর ‘

জারা ঝটপট সাওয়ার নিয়ে নিচে চলে আসলো তখন নিচে কেউ ছিল না। শান্তি রান্নাঘরে কি যেনো করছিল জারা যেতেই বলল

-‘ এতো দেরি হলো কেনো আয় বস খেয়ে নে। ‘

-‘ সাওয়ার নিয়ে আসলাম আসো বসো তুমি ও তো খাও নি’

-‘ কেমন করে বুঝলি? ‘

-‘ আমি জানি তুমি আমাকে ছাড়া খাও না’

-‘ পাকা বুড়ি তো তুমি ‘

জারা হাসল।

——–

দুপুর গড়িয়ে বিকাল হতে চলল সূর্যের রক্তিম আভা ছড়ানো চারিদিকে। গাড়িতে বসে আছে শান আর জারা দুজনেই চুপ নিরবতা ভেঙে জারা বলল

-‘ আপনি জানি কাল কি বলছিলেন? ‘

শান কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল

-‘ কখন? ‘

জারা বলতে নিয়েও মনে মনে বলল

-‘ আচ্ছা আমি যদি ওনাকে সরাসরি জিজ্ঞেসা করি ওনি আমাকে ভালোবাসে কি না আর ওনি যদি আমাকে অপমান করে তখন। না থাক কিছু জিজ্ঞাসা করে মুখ নষ্ট না করায় ভালো ‘,

জারা ছোট করে উত্তর দিলো

-‘ কিছু না ‘

শানও আর কিছু না বলে চুপচাপ গাড়ি চালাতে লাগলো। আর ওদের মাঝে কথা হলো না। টুকটাক যাও হলো শপিংয়ের বিষয় এ।

শপিংয়ের মাঝে হুট করে কোথা থেকে একটা মেয়ে এসে শানকে জড়িয়ে ধরলো। শানও হাসি মুখে মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরলো। জারার পৃথিবী যেনো উল্টে গেলো।

চলবে ইনশাআল্লাহ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে