অনুভূতি পর্ব ৩৪

0
1717

অনুভূতি
পর্ব ৩৪
মিশু মনি
.
৫২.
ঢাকায় পৌছে নিখিল ও দুপুর সরাসরি মেঘালয়ের বাসায় চলে এলো। আকাশ আহমেদ চাবি পাঠিয়ে দিয়েছেন। বাড়ির ভেতরে ঢুকে দুপুর চোখ বড়বড় করে বললো, “ওমা! এত সুন্দর বাড়ি! রীতিমত প্যালেস!”
নিখিল ওকে নিয়ে ভেতরে ঢুকেই মেইন দরজা লক করে দিলো। ওরা বাইরে থেকে খেয়েই এসেছে। ফ্রেশ হয়ে দুপুর রুমে আসার পর নিখিল বাথরুমে চলে গেলো।
নিখিল বাথরুম থেকে বেড়িয়ে এসে দেখলো দুপুর বিছানায় শুয়ে আছে। ওর শাড়ি হাঁটু অব্দি উঠে থাকার কারণে ফর্সা পা দেখা যাচ্ছে। ও এসে বললো, “শাড়ি ঠিক করে নাও।”
দুপুর শাড়ি ঠিক করতে করতে বললো, “তো কি হয়েছে? তুমি আর আমি ই তো। আর কে বা আছে এই বাড়িতে?”
– “এখনো আমাদের বিয়ে হয়নি দুপুর। এমন কোনো কিছু করোনা যাতে আমি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলি।”
দুপুর এসে নিখিলের গলা জড়িয়ে ধরে বললো, “উম, কবে বিয়ে করবো আমরা?”
নিখিল দুপুরের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে পাশে বসলো। ওর হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো, “আরো অনেক সময় লাগবে। এটা সিনেমা নয় যে আজকে বিয়ে করলা, কালকে ডিভোর্স দিয়ে আবার পরশু আরেকজন কে বিয়ে করলা।”
দুপুর বাচ্চাদের মতন মুখ করে বললো, “এভাবে বলছো কেন?”
নিখিল হেসে বললো, “সরি লক্ষিটি। আমি ভাবছি সবকিছু নিয়ে। আরো অনেক সময় লাগবে সবকিছু সামলে নিতে। প্রথম কাজ হচ্ছে তোমার বাবা আর অরণ্য’র বাবাকে ডেকে নিয়ে এসে সবকিছু বুঝিয়ে বলা। এজন্য ও কিছুদিন সময় দরকার। আমরা এখানে কিছুদিন থাকার পর ওনাদেরকে ডেকে এনে সবকিছু বুঝিয়ে বলবো। আমি কোনো ঝামেলা পছন্দ করিনা। সবকিছু সুন্দর ভাবে গুছিয়ে যাক সেটাই চাই। সেজন্য সময় আর ধৈর্য দরকার।”
দুপুর জিজ্ঞেস করলো, “তারপর কি হবে?”
নিখিল বললো, “ওনারা নিজে থেকে তোমার আর অরণ্য’র তালাকের ব্যবস্থা করবে। আমাদেরকে কিছুই করতে হবেনা। আমাদের একটাই কাজ সেটা হচ্ছে ওনাদেরকে ভালোমতো বুঝিয়ে বলা। আর আমার দ্বিতীয় দায়িত্ব, এর মধ্যে একটা চাকরী জুটিয়ে ফেলা। আমি চাকরী পেয়ে গেলে বাসায় জানাবো তোমার কথা। ততদিনে সবকিছু আশাকরি ঠিকঠাক হয়ে যাবে, আমি পালিয়ে বিয়ে করতে চাইনা দুপুর। বাবা মা তোমাকে সম্মানের সাথে আমাদের বাসায় নিয়ে যাক সেটা চাই।”
দুপুর নিখিলের গলা জড়িয়ে ধরে বললো, “তুমি এত ব্রিলিয়ান্ট কেন শুনি? এরই মধ্যে এতকিছু ভেবেও ফেলেছো? এজন্যই এত ভালোবাসি তোমায়।”
– “ভালোবাসো ভালো কথা। গলায় বাঁদরের মত ঝোলাঝুলি করছো কেন?”
– “ইস! এরকম করছো? যাও,আমি অরণ্য’র কাছেই চলে যাবো। তুমি খারাপ। আমাকে একটুও ভালোবাসো না।”
নিখিল দুপুরকে বুকে নিয়ে বললো, “এখানে কান পেতে শোন তো ভেতরে কি বলে? এই কটা দিন আমার কি অবস্থায় গেছে জানিস?”
– “হুম জানি। আমি না জানলে আর কে জানবে?”
– “এবার লক্ষী মেয়ের মত ঘুমাও তো তুমি।”
দুপুর ঠোঁট বাঁকিয়ে বললো, “ঘুমাবো? সারারাত জেগে জেগে গল্প করবো ভাবলাম।”
– “মাইর দিবো তাহলে। এমনিতেই এই কদিনে চেহারার অবস্থা বারোটা বাজিয়ে ফেলেছো। এখন তুমি শুয়ে একটা ঘুম দিবা। আমার বুকে মাথা রেখে ঘুমাবা।”
– “আর কিচ্ছু করবো না?”
– “না, আর কিচ্ছু করবো না।”
– “সিরিয়াসলি? থাকতে পারবা তুমি?”
নিখিল হেসে বললো, “আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা রাখি। একদিন তোমার আপুকে বিয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়ে সারারাত তোমার বিছানায় ছিলাম মনে পড়ে? সারাটা রাত তুমিই ছটফট করেছো, আমি স্বাভাবিক ছিলাম। তোমাকে শুধু বুকে জড়িয়ে ঘুমিয়েছি। আর কিচ্ছু করিনি।”
– “এত ভালো হলে চলে?”
– “বারে, খারাপ হলেও দোষ আবার ভালো হলেও দোষ?”
দুপুর হেসে ফেললো। বললো, “নাহ ঠিকাছে। এতকিছুর পরেও তোমাকে পাচ্ছি সেটাই অনেক। এখন আমি তোমার জন্য এক যুগ অপেক্ষা করতে পারবো। শুধু আমার সামনে বসে থাকো। আমি শুধু দেখবো আর থাকবো।”
নিখিলের বুকে মাথা রেখে মাথাটা উপরে তুলে ফ্যালফ্যাল করে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো দুপুর। আর কোনোকিছুর প্রয়োজন ই তো নেই, এই মানুষ টা সারাক্ষণ চোখের সামনে বসে থাকলেই যথেষ্ট। আর কি ই বা চাই? একটা জীবন এভাবে দেখে দেখেই পার করে দেয়া যাবে।
৫৩.
সকালে মিশুর ঘুম ভাংলেও শুয়েই রইলো ও। মেঘালয় বলে দিয়েছে যেন ওকে ফেলে না ওঠা হয়। আগে ঘুম ভাংলেও শুয়ে থাকতে হবে। মিশু মাথাটা তুলে মেঘালয়ের মুখের দিকে তাকালো। জানালার ফাঁক দিয়ে হালকা রোদের ঝিলিক এসে মেঘের মুখের উপর পড়েছে। কি দারুণ দেখতে লাগছে মেঘালয়কে! ফর্সা মুখে লাল রোদ পড়ে কেমন রাঙা হয়ে উঠেছে চেহারাটা। ঘন ঘন দুটো ভ্রুয়ের নিচে দুটো টানা চোখ, চোখের পাপড়ি গুলোও খুব ঘন আর সুন্দর। গালে খোঁচা খোঁচা দাড়িগুলো একটু বড় হয়ে গেছে। শুভ্রতা ছেয়ে আছে গালে, নাকে মুখে। কি সুন্দর গোলাপের পাপড়ির মতন ঠোঁট! নাকটা লম্বা, গলাটা একটু বেশিই ফর্সা। গলা থেকে বুকের দিকে নামলে পাঞ্জাবির উপরের বোতাম টা খোলা রাখলে যতটুকু জায়গা দেখা যায়, মেঘালয়ের ওই জায়গা টুকু পৃথিবীর সেরা সৌন্দর্য মনেহয়। ফর্সা বুকে দু একটা লোম উঁকি দেয়, কি যে মায়া লাগে!
মিশু অনেক্ষণ এভাবে চেয়ে চেয়ে এসব ভাবতে লাগলো। মেঘালয় চোখ মেলে তাকালো। মিশুকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে মিশুর কপালে আলতো চুমু এঁকে দিয়ে বললো, “সুপ্রভাত মিষ্টি মিশু।”
মেঘালয়ের উষ্ণ স্পর্শে মিশু আবেশে চোখ বুজে ওর বুকে মাথা রেখে বুকের ঢিপঢিপ আওয়াজ শুনতে লাগলো। যেন ওর হার্টবিট প্রতি স্পন্দনে বলছে, “মিশু ভালোবাসি তোমাকে, ভালোবাসি মিশু।”
মিশু আলগা হাতের আলতো বাঁধনে আঁকড়ে ধরে রইলো ওর প্রিয় মানুষ টাকে।
বাংলোর পাহারাদার সকালে গরম গরম ফুলকো লুচির সাথে তরকারী রান্না করেছেন। সাথে গরম চা ও। মেঘালয় ও ওর বন্ধুরা একসাথে বসে নাস্তা করে নিলো। এরপর বেড়িয়ে পড়া হলো ঘুরতে যাওয়ার জন্য। আজকের গন্তব্যস্থান জাফলং। জাফলং এর রাস্তাও খুব খারাপ। লেগুনায় ওঠার সময় পূর্ব ও রোদ পাশাপাশি বসলো। তাই দেখে মিশু বললো, “আজকে পূর্বে দারুণ রোদ উঠবে।”
সবাই মুচকি হাসলো। মিশু ও মেঘালয় পাশাপাশি বসে মিশুকে সবার শেষে বসতে দেয়া হলো যাতে রাস্তা দেখতে দেখতে যেতে পারে। জাফলং এর রাস্তাটা খারাপ হলেও দেখতে সুন্দর। মেইন রোড ধরে যাওয়ার সময় অনেক সুন্দর চা বাগান, পাহাড় আর এক সাড়িতে তিনটা ঝরনাও দেখতে পাওয়া যায়। মিশুর আবার ঝরনার প্রতি খুবই দূর্বলতা। কিন্তু একটাই সমস্যা, রাস্তায় প্রচণ্ড ধূলা। আজকে মিশু একটা রাউন্ড ফ্রক জাতীয় ড্রেস পড়ায় ওকে একদম পুতুলের মত লাগছে। ওদের সবাইকে একসাথে দেখলে সবার আগে মিশুর দিকে নজর যাচ্ছে, নিতান্তই ছোট্ট বাচ্চা মনেহচ্ছে ওকে। মেঘালয় সিটে বসে একহাতে ওকে ধরে রইলো।
গতকালের লেগুনা টাই আজকেও নেয়া হয়েছে। ড্রাইভারের সাথে বেশ খাতির জমে গেছে। উনি বললেন,”মামারা আজকেও গান ধরেন।”
পূর্ব দুষ্টুমি করে বললো, “অবশ্যই মামা। আপনাকে খুশি করার জন্য আজকে আমি পেট ভর্তি করে খায়া এনার্জি বাড়াইয়া আনছি। আজকেও ফাটাইয়া দিবো মামা।”
ড্রাইভার দাঁত বের করে হাসলেন। পূর্ব সবার উদ্দেশ্যে বললো, “গান শুরু করা যাক তবে। মেঘ দোস্ত, সাব তেরা গানটা ধর। ওকে ফ্রেন্ডস, লেটস স্টার্ট।”
“Na jiya zindagi ek pal bhi
tujshe hoke judaa sun zara
bin tere mujshe naaraaz tha dil
tu mila hai toh hai keh raha…”
“Main toh tere rang mein
rang chuka hoon
bas tera ban chuka hoon
mera mujhme kuch nehi sab tera…”
গানের মাঝখানে মিশু সবাইকে থামিয়ে দিয়ে বললো, “ধেৎ একদম মজা হচ্ছেনা। মজা হচ্ছেনা, মজাই হচ্ছেনা। ঝাকানাকা গান ধরো। কালকের মত মজার গান শুরু করোনা কেন?”
পূর্ব বললো, “লুঙি কো উঠানা পাড়েকা?”
সবাই হেসে উঠলো। মিশু বললো, “না, সানি রকস। মেরে পিছে হিন্দুস্থান হ্যায়। নয়ত আজ ব্লু হ্যায় পানি পানি সানি সানি।”
সবাই একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলো। তারপর হো হো করে হেসে উঠলো। মেঘালয় মিশুর চোখের দিকে তাকিয়ে দুষ্টুমি ভরা হাসি দিলো। মিশু চোখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকালো। ওর ও হাসি পাচ্ছে। ও সরল মনে বললেও সবাই হাসবে এটাই স্বাভাবিক। বলার আগে কি আর বুঝতে পেরেছে সবাই হাসবে, বুঝলে তো আর বলতো না। গান তো গানই,এখানে এভাবে হাসার কি আছে?
মেঘালয় কণ্ঠে যথাসম্ভব আবেগ ঢেলে দিয়ে গেয়ে উঠলো,
“এক্সকিউজ মি ওয়ান্না লাভ ইউ লাভ ইউ,
এক্সকিউজ মি ওয়ান্না টাচ ইউ টাচ ইউ”
পুরো লেগুনা জুড়ে সবাই হেসে উঠলো। মিশুর ইচ্ছে করছিলো লজ্জায় মেঘালয়ের বুকের ভেতর গিয়ে লুকায়। সবাই হাসছে কেন অযথা? সবাই খুব খারাপ। ও লজ্জায় মাথা ঘুরিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলো। পিংক কালার পুতুলের মত ড্রেস পড়ে এমনিতেই চেহারায় একটা গোলাপি আভা চলে এসেছে। এবার লজ্জায় আরো গোলাপি হয়ে গেলো।
রোদ মাথা নিচু করে হাসছে। তাকিয়ে আছে নিচের দিকে। পূর্ব গান গাওয়ার সাথে সাথে পা নাচাচ্ছে। ওর পা দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলো রোদ। ফর্সা আর পায়ের নখগুলো বেশ সুন্দর, পরিষ্কার। ওর পা নাচানোর মাঝেও একটা আর্ট ফুটে উঠছে, দারুণ লাগছে দেখতে। ওরা এখন সানি সানি গানটা গাইছে। সবাই মিলে একসাথে রিমিক্স দিয়ে গাইছে আর হাতে তালি বাজাচ্ছে। সবার মুখে হাসি লেগে থাকলেও গানটা দারুণ হচ্ছে।
গানের ফাঁকেফাঁকে মেঘালয় মিশুর দিকে তাকাচ্ছিলো। মিশু হাত তালি দিচ্ছে কিন্তু চেয়ে আছে বাইরের দিকে। ওর মুখে হাসি। মেঘালয় যতটা ভালো, ঠিক ততটাই দুষ্টু। এমন ভাবে গাইছে যে মুখে আপনা আপনি দুষ্টুমি হাসি চলেই আসে।
মেঘালয় গেয়ে উঠলো,
“আমি ফাইসা গেছি, আমি ফাইসা গেছি,
আমি ফাইসা গেছি মাইনকার চিপায়…
আমার দিলের চোট বোঝেনা কোনো হালায়..”
সবাই হেসে উঠলো। মিশু এবার মেঘালয়ের দিকে তাকিয়ে বললো, “এটা আবার কেমন গান? এ জন্মেও এমন গান শুনিনি।”
মেঘালয় আবারো গাইলো,
” সকাল বিকাল রাইত দুপুর বউয়ে দেয় ঠেলা
কয়, ‘বউ পুষার মুরদ নাই তয় বিয়া করছোস ক্যালা?”
আবারো হাসতে লাগলো সবাই। মেঘালয় সত্যিই খুব দুষ্টু। পাজির পা ঝাড়া, সারারাত মিশুকে জ্বালিয়ে মারে আবার এখনো শুরু করেছে। খুব পাজি একটা।
লেগুনার ড্রাইভার বললো, “মামা ঠিকই কইছেন। বউয়ের এই ঠেলা প্রত্যেকদিন। বউ পোষার মুরদ না থাকলে বিয়ে করছ ক্যান? জীবনটা বরবাদ হয়া গ্যালো।”
পূর্ব বললো, “গেবন শ্যাষ। আহারে গেবন, আহা গেবন,জলে ভাসা মরা মাছ যেমন।”
মিশু বলল, “ঠিকই বলছো। মরা মাছ জলের উপর ভাসতে ভাসতে গন্ধ ছড়ায়। সেই একই দশা হয়েছে জীবনের।”
আরাফ বলল,”কে বলছে জীবন কঠিন? জীবন অনেক সহজ। পানির অপর নাম জীবন, তাহলে জীবনের আরেক নাম পানি। জীবন পানির মত সহজ ”
সবাই হাসলো। মেঘালয় অবাক হয়ে খেয়াল করলো আরাফের রাগ আগের তুলনায় অনেক কমে এসেছে। ছেলেটা মিশুর সংস্পর্শে আসার পর থেকে অনেক সহজ হতে শুরু করেছে। মিশুকে বলতে হবে সবসময় ওর সাথে থাকতে আর বেশি বেশি বকবক করতে। তাহলে ছেলেটা একদম আগের মত হয়ে যাবে। মেঘালয় মিশুর কানে কানে বুঝিয়ে বললো ব্যাপার টা। মিশু হেসে ফিসফিস করে বলল, “আচ্ছা হয়ে যাবে। তুমি টেনশন করোনা।”
রাস্তা দিয়ে আসার সময় দূর থেকে মেঘালয় মিশুকে একটা ঝরনা দেখিয়ে দিলো। গাঢ় সবুজের মাঝখানে একটু সাদা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে,সেটাই ঝরনা। এতদূর থেকে দেখার মাঝেও অন্যরকম ভালো লাগা আছে। মিশু অবাক হয়ে চেয়ে রইলো ঝরনার দিকে। এরপর আরো একটা ঝরনা দেখতে পাওয়া গেলে মেঘালয় সেটাও দেখালো ওকে। তিনটা ঝরনাই যখন একসাথে দেখতে পেয়ে মিশু আনন্দে হাত তালি দিয়ে উঠলো। এইতো বাচ্চাটার পাগলামি শুরু হয়ে গেলো। নানান প্রশ্নে মাতিয়ে তুললো মেঘালয়কে।
রাস্তায় একবার লেগুনা দাড় করিয়ে সবাই নেমে প্রাণভরে শ্বাস নিতে লাগলো। জায়গাটা অনেক সুন্দর। চারদিকে শুধু ঘন গাছ,জংগল,চা বাগান,পাহাড় এসবই চোখে পড়ছে। মিশু মুগ্ধতার ঠেলায় কথাই বলতে পারছে না। বারবার মেঘালয়ের হাত চেপে ধরছে ও। কিছুক্ষণ রাস্তায় দাঁড়িয়ে চারিদিক দেখা, ছবি তোলাতুলি, চা খাওয়ার পর আবারো লেগুনা ছেড়ে দেয়া হলো।
কিন্তু একদম জাফলং এর কাছাকাছি এসে শুরু হয়ে গেলো ঝাঁকুনি। রাস্তার অবস্থা মারাত্মক রকমের খারাপ। ধূলা, ভাঙা চূড়া রাস্তায় লেগুনা রীতিমত হেলেদুলে যাচ্ছে। সবাই টুকটাক গল্প করছে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে। আড্ডা বেশ জমে গেছে। এভাবে ঝাঁকুনি খেতে খেতে ওরা পৌছে গেলো। লেগুনা থেকে নেমে দুপুরের খাবার খেয়ে নিয়ে হাঁটা ধরলো জাফলং এর পথে। পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে থেকে ডাউকি আর মেঘালয়ের সৌন্দর্য দেখলো ওরা। ডাউকির সাদা সাদা ছোট ছোট ঘরগুলো দূর থেকে দেখতে দারুণ লাগছে। মিশুর ইচ্ছে করছে সেখানে ছুটে চলে যায়।
ডাউকির দিকে বারবার তাকাতে তাকাতে ও মেঘালয়ের হাত ধরে হাঁটছিলো। নূড়ি পাথর, কাচ, গুড়ি বালি, উঁচু নিচু টিলা, পাহাড় সব পেড়িয়ে ওরা এসে নদীর তীরে দাঁড়ালো। চারপাশের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে মিশু অন্য এক জগতে ডুবে গেছে। নৌকায় করে জাফলং এ এসে কিছুক্ষণ সময় কাটালো ওরা। নেমে হেঁটে হেঁটে মায়াবী ঝরনায় যাওয়ার জন্য আবারো হাঁটা ধরলো। জাফলং এ আর আগের মত পাথর নেই। শুধু পানি ই চোখে পড়ছে। মেঘালয়ের হাত ধরে মায়াবী ঝরনায় যাওয়ার সময় মিশু পাশের পাহাড় আর ঝাউ জংগল দের সাথে কথা বলছে। পাহাড়ের সাথে কথা বলতে দেখে সবাই হাসছিলো। কিন্তু মিশুর অন্যদিকে মনোযোগ নেই। ও পাহাড় দেখছিলো আর কথা বলছিলো। নিচু হয়ে গুড়ি গুড়ি বালির সাথে কথা বলছিলো। পাথরের সাথে, আকাশের সাথেও কথা বলছিলো। মেঘালয় শুধু অবাক হয়ে এই পাগলির পাগলামি দেখছিলো। মায়াবী ঝরনায় পৌছে ওরা ঝরনা স্নান করে নিলো। মিশু ঝরনার পানি গুলোর সাথেও কথা বলছিলো।
জাফলং ছেড়ে বের হলো রাত্রিবেলা। আকাশে তখন পূর্ণিমার চাঁদ। মৃদু কুয়াশা পড়েছে। শীত শীত লাগছে সবার। জাফলং এ পূর্ণিমা দেখার সৌভাগ্য হয়েছে এসব নিয়ে গল্প করতে করতে লেগুনা দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছিলো শহরের দিকে। রাত নেমেছে অনেক আগেই। মেঘালয় তিনটা চাদর এনেছিলো। একটা ও আর মিশু গায়ে দিলো, একটা আরাফ ও সায়ান আর অন্য চাদরটা রোদকে একাই দেয়া হয়েছিলো। কিন্তু রোদ চাদর টা সায়ানের গায়ের উপরেও ফেলে দিলো। একে অপরের শরীরের উষ্ণতা অনুভব করছিলো।
মেঘালয় চাদরের ভেতর দিয়েই মিশুকে শক্ত করে বুকের সাথে চেপে ধরে রাখায় মিশুর একটু ও ঠাণ্ডা লাগছে না। এরকম একজনকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পাওয়ায় নিজেকে বড্ড ভাগ্যবতী মনে হচ্ছিলো ওর। হঠাৎ রাস্তার মাঝখানে লেগুনা দাঁড়িয়ে পড়লো। ওরা জিজ্ঞেস করলো, “মামা কি হলো? গাড়ি থামালেন কেন?”
ড্রাইভার উত্তর দিলো, “সামনে দেখেন ওইটা কি?”
সবাই উঁকি ঝুঁকি মেরে বাইরে দেখার চেষ্টা করলো। রাস্তার দিকে তাকানো মাত্রই বুকটা ছ্যাত করে উঠলো সবার। রৌদ্রময়ী শিউড়ে উঠলো। মিশু ভয়েই মেঘালয়কে জড়িয়ে ধরলো।
চলবে..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে