অনুভূতি পর্ব ১৮

0
1947

অনুভূতি
পর্ব ১৮
মিশু মনি
.
২৯.
বিয়ের আয়োজন দেখে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো মিশু -মেঘালয়!
বসার ঘরে কিছু ফুল আর বেলুন দিয়ে সাজানো হয়েছে আর বাসর ঘরের সাজসজ্জা একদম অবাক হওয়ার মত! আরাফ ডেকোরেশনের কাজটা খুব ভালোই পারে। কিন্তু তাই বলে মাত্র এইটুকু সময়ের মধ্যে এত সুন্দর আয়োজন সত্যিই বিস্ময়কর।।
ভোর সাড়ে তিনটায় ফোন দিয়ে বলেছে,অথচ সকাল দশটার মধ্যেই একেবারে সকল আয়োজন করে ফেলেছে! ওর বন্ধুরা যে এতবেশি কাজের সেটা এতদিন জানা ছিলোনা মেঘালয়ের। কাজীকেও খবর দেয়া হয়েছে, খাবার দাবার, কয়েক প্রকার মিষ্টি, সবই আনা হয়ে গেছে। মেঘালয় বন্ধুদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে জাপটে ধরলো ওদের।
মিশুর কাছে সবকিছু স্বপ্নের মত লাগছে। একজন সম্পূর্ণ অচেনা মানুষ অদ্ভুত ভাবে আপন হয়ে গেলো। রুমে বসে বসে এসব ভাবছিলো ও। সায়ান ও মিশুকে বাসায় রেখে মেঘালয় পূর্বকে নিয়ে বাইরে গেছে। একটা বিশেষ কাজে যাচ্ছি বলে বেড়িয়েছে মেঘালয়। বাইরে যাওয়ার আধ ঘন্টার মধ্যে দুইবার ফোন করে খোজ নিয়েছে মিশুর খারাপ লাগছে কিনা,টেনশন হচ্ছে কিনা? মিশু এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না এটা কি করতে চলেছে ও? মেঘালয়ের সম্পর্কে যতটুকু জানে, একজন মানুষকে চেনার জন্য সেটাই যথেষ্ট। কিন্তু বিয়ে করার জন্য এতটুকু জানাই কি যথেষ্ট?
হঠাৎ ই চিন্তা হচ্ছে মিশুর। যে মানুষটা রাস্তায় পড়ে থাকা বস্তির ময়লা কাপড় পড়া একটা বাচ্চাকে কোলে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরতে পারে, তার প্রতি ভরসা করা যায়। আর যেকোনো মেয়ের ভালোবাসা পাওয়ার মত যোগ্যতা মেঘালয়ের আছে। তবুও কেন যে এমন লাগছে বুঝতে পারছে না মিশু।
বাইরে এসে সায়ানের পাশে বসে পড়লো ও। সায়ান জিজ্ঞেস করলো, “ভাবি কিছু হইছে? আপসেট কেন?”
মিশু করুণ মুখে বললো, “সায়ান ভাইয়া, আমার না ভয় হচ্ছে খুব। এরকম পরিস্থিতিতে জীবনে প্রথমবার পড়লাম।”
– “বিয়ে তো জীবনে একবার ই করত হয়। এত টেনশনের কিছু নাই।”
– “আমার ব্যাপার টা আমি কাউকে বুঝাতে পারবো না ভাইয়া।”
মিশু মাথা নিচু করে ফেললো। সায়ান উঠে এসে মিশুর পাশে বসে বললো, “মেঘালয়ের মত ছেলে তুমি আজকাল খুঁজে পাবে না। ওর মত ফ্রেন্ড পেয়ে আমরা নিজেদের ভাগ্যবান মনে করি। সেজন্যই তো রাতে পূর্ব আমাকে কল দেয়ার পর ঘুম থেকে উঠে এতকিছুর ব্যবস্থা করে ফেলেছি। ভাবতে পারো তুমি? কেন ওর জন্য এতকিছু করলাম?”
মিশু মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, “হুম। সবাই ওকে অনেক ভালোবাসেন আমি জানি।”
সায়ান বললো, “তার গুনেই ভালোবাসি। আমার ফ্রেন্ড বলে বলছি না, ওর একটা আদর্শ আছে।”
– “ও যদি বিয়ের পরে আমাকে ছেড়ে দেয়? আমি কই যাবো? আপনার কি মনেহয় সে আমাকে ছেড়ে দেবে?”
যাকে বিয়ে করতে চলেছে তার বন্ধুকে এরকম প্রশ্ন করছে সেটা আবার সায়ানের বাসাতেই বসে। সায়ানকে ও চেনেও না আগে থেকে। কতটা সরল মনের হলে এভাবে নিজের উদ্বিগ্নতা নিয়ে অন্যকে প্রশ্ন করা যায়?
মিশুর ব্যাপার টা বুঝতে পেরে সায়ান ওর একদম কাছাকাছি এসে সুন্দর ভাবে বললো, “শুনলাম ট্রেনে তুমি নিজেই ওকে কাছে টানছিলে, দেখো ওর জায়গায় অন্য কেউ থাকলে কিন্তু তোমাকে আর এভাবে দেখতে পারতাম না। আর সবচেয়ে বড় কথা, সে যদি তোমাকে ছাড়ার জন্যই বিয়ে করার চিন্তা ভাবনা করে থাকে, তাহলে তো বিয়েটাই করতো না। ট্রেনেই যা দরকার সেরে ফেলতো, তার জন্য অযথা এত টাকা নষ্ট করে বিয়ে করার প্রয়োজন পড়েনা। তোমার সাথে তো ওর রিলেশন ও নাই। তুমি চাপ দিচ্ছো জন্য ও বিয়ে করতেছে এমনটাও তো না। মেঘালয় আমাকে বললো, ও বিয়ে করে প্রেম করবে। আর তোমার ফুল্লি দায়িত্ব নিতে চাচ্ছে সেজন্যই বিয়ে করবে। আরো নাকি অনেক কারণ আছে।”
মিশু চোখ তুলে সায়ানের দিকে তাকিয়ে বললো, “আপনারা সবাই অনেক ভালো।”
– “থ্যাংকস মহারাণী, শুনে কৃতার্থ হলাম। আপনার টেনশন কমেছে?”
– “হ্যা কমেছে।”
এমন সময় কলিং বেল বেজে উঠলো। সায়ান দরজা খোলার জন্য উঠে দাঁড়িয়ে আবার মিশুর দিকে ঝুঁকে বললো, “ভয় হওয়াটাই স্বাভাবিক। একজন সেলিব্রেটি দুম করেই বিয়ের প্রপোজাল দিলে আরো বেশি ভয় হওয়ার কথা। তুমি একটু সবকিছু কম বুঝো জন্য ভয়টা কম পাচ্ছো।”
– “আমার কি আরো বেশি ভয় পাওয়া উচিৎ? আপনি তো বললেন আপনার বন্ধু সবার চেয়ে আলাদা?”
– “হুম, তবে ও একদিন অনেক উপড়ে উঠে যাবে এটা বিশ্বাস করি। তখন কি হয় বলা যায় না। সো, সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ হবে নিজের ও একটা জায়গা পাকাপোক্ত করে নেয়া। সেলিব্রেটিদের জন্য ডিভোর্স দেয়া আর বিয়ে করা একটা কমন ব্যাপার।”
– “ও তো এরকম না। ও অনেক ভালো।”
সায়ান ফিসফিস করে বললো, “একটা সময় ওরকম হতেও পারে, কাজেই আমি বলবো তুমি যত দ্রুত পারো নিজের ক্যারিয়ার গুছাও। তুমি এখন ওকে যা বলবা, ও কিন্তু তাই শুনবে। তুমি যা হতে চাও, কিংবা যা করতে চাও ওর হাত ধরে দ্রুত সেখানে ওঠার চেষ্টা করো। দুজনেই সমানতালে ক্যারিয়ারে এগোতে থাকবা, সেটা হবে পৃথিবীর সবচেয়ে হ্যাপিয়েস্ট রিলেশনশিপ গুলার একটা। শুধুমাত্র রান্নাবান্না,প্রেম ভালোবাসা আর আদর সোহাগ নিয়ে পড়ে থেকো না।”
মিশু অবাক হয়ে বললো, “তাহলে? কি করবো?”
– “এখনো বুঝো নি আমার কথা? আচ্ছা আমি পরে সময় নিয়ে বিস্তারিত বুঝাবো তোমাকে। শুধু একটা কথা মাথায় রাখবা, কখনো কোনোসময়েই পুতুপুতু টাইপের হয়ে পড়বা না। যেমন আছো, সবসময় এরকম থাকবা। পুতুপুতু হলেই সমস্যা।”
– “পুতুপুতু আবার কি?”
– “এইযে সারাক্ষণ স্বামীর জন্য বসে থাকা, কান্নাকাটি করা, এটা করবা না। অধিকার খাটাবা, সবসময় আত্মমর্যাদা বোধ জাগ্রত রাখবা। সে যদি কখনো একবার অপমান করে, ক্ষমা না চাওয়া পর্যন্ত তাকে দ্বিতীয় অপমান করার সুযোগ দিবা না।”
মিশু অবাক হয়ে চেয়ে রইলো সায়ানের দিকে। কিছু কথা বুঝতে পেরেছে আর কিছু কথার আগাগোড়া কিছুই বুঝতে পারেনি। অনেক জ্ঞান দিলো ছেলেটা। নিজের বন্ধুর ব্যাপারে ভরসাও দিলো, আবার ভবিষ্যতের জন্য সতর্ক ও করে দিলো। এইসব কথাবার্তা মিশুকে বলার কোনো দরকারই ওর ছিলোনা, মিশুকে অনেক সরল মনে হয়েছ তাই একটু ব্যাপার গুলো বলে দিলো ওকে। মেয়েটি এমনিতেই অসহায়, যদি দূর্ভাগ্যবশত কখনো মেঘালয় চলে যায়, তখন খুবই খারাপ অবস্থা হবে মেয়েটার। এটা ভেবেই কথাগুলো বললো সায়ান।
অনেক্ষণ থেকেই কলিং বেল বাজছে। সায়ান একটু এগিয়ে গিয়ে দরজার কাছ থেকে ফিরে এসে আবারো বললো, “আর ডক্টরের সাথে কথা হলে ভালো একটা প্লান করে ফেলবা। শ্বশুরবাড়িতে ওঠার আগে কোনোভাবেই কনসিভ করে ফেলো না যেন।”
সায়ান গিয়ে দরজা খুলে দিলো। মিশু অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। আশেপাশের মানুষজন,পরিবেশ সবই অদ্ভুত লাগছে ওর কাছে। এত বেশি অদ্ভুত যে, বাস্তবে ঘটছে নাকি স্বপ্নে ঘটছে বুঝতে পারছে না।
মেঘালয়, পূর্ব ও আরাফ এসেছে। ওরা রুমে ঢুকেই সায়ানকে গালি দিতে লাগলো দেরিতে দরজা খোলার জন্য। পূর্ব ফাজলামো করে বললো, “দোস্ত তুমি মেঘালয়ের কচি বউটার সাথে কিছু করতেছিলা না তো?”
এসব নিয়ে ওদের কয়েকজনে মধ্যে বেশ হাসাহাসি হলো। মেঘালয় এসে মিশুর পাশে বসে বললো, “খারাপ লাগছিলো তাইনা?”
– “না, ভালো লাগছিলো।”
– “তাহলে আবার বাইরে যাই?”
মিশু মুখ বাঁকা করে বললো, “আপনার ইচ্ছে। সায়ান ভাইয়াকে রেখে যাবেন তাহলেই হবে।”
মেঘালয় সায়ানের দিকে তাকিয়ে বললো, “বন্ধুরে আমার বউ তোকে একা রেখে আবার বাইরে যেতে বলছে কেন? এবার তো মনেহচ্ছে পূর্ব’র কথাই ঠিক।”
সবাই আবারো হাসাহাসি শুরু করে দিলো। ছেলেরা যে কেন এত দুষ্টু হয় বুঝতে পারেনা মিশু। কয়েকজন ভালো বন্ধু একত্রিত হলেই শুধু অদ্ভুত রকমের ইয়ার্কি আর হাসাহাসি।
আরাফ এগিয়ে এসে একটা ছোট্ট লাগেজ মিশুর দিকে এগিয়ে দিলো। মিশু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কি এটা?”
মেঘালয় বললো, “বিয়ে করছি আর টুনিবউটা কনে সাজবে না তা কি করে হয়? দেখো তো পছন্দ হয় কিনা। সামান্য একটু কেনাকাটা করে আনলাম তোমার জন্য। দুটো দিন গেলে শপিং করিয়ে দিবো। মন খারাপ করোনা।”
মিশু একদম অবাক। ও বিস্ময় ভরা চোখে বললো, “আমিতো এইগুলাই আশা করিনি। শপিং করতে যাবেন আমাকে বলেন নি তো।”
– “সারপ্রাইজ”
– “আর কত সারপ্রাইজ দেবেন আমাকে?”
মেঘালয় হাসলো। পূর্ব ও আরাফ হা করে মিশুর দিকে চেয়ে আছে। ওরা এখন অপেক্ষা করছে মিশুর মুগ্ধ মুখটা দেখার জন্য। লাগেজ খুললেই শাড়ি দেখেই মেয়েটা খুশিতে কান্না করে ফেলবে এটা নিশ্চিত। ওর কল্পনার চেয়েও সুন্দর একটা শাড়ি কিনেছে মেঘালয়। আর টুকটাক কনে সাজের অনেক কিছুই কেনা হয়েছে। কিন্তু মিশুর আনন্দের কান্না আর কেউ না দেখুক, সেটাই চায় মেঘালয়। ও লাগেজটা রুমে দিয়ে এসে বললো, “ওখানে সবকিছু আছে। তুমি এখন গিয়ে একটু একা একাই সাজুগুজু করে নাও। আমরা এখানেই আছি। কিছু দরকার হলে ডেকো।”
মিশু মাথাটা নেড়ে রুমের দিকে পা বাড়ালো। রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে লাগেজ খুলতে বসলো।
৩০.
ঘুম ভাংতেই বেশ অবাক হলো রৌদ্রময়ী। এখানে সে কিভাবে এলো! রাতে রাস্তায় হাটছিলো তারপর তো আর কিছুই মনে নেই। চোখ কচলে বিছানার উপর উঠে বসলো ও। রুমের দরজা লাগানো। রুমটা দেখে তো ছেলের রুম মনেহচ্ছে, কাপড়ের তাকে ছেলেদের কাপড় চোপড় রাখা। কিন্তু কে এখানে নিয়ে এলো সেটা বুঝতে পারছে না ও।
বিছানার উপরেই ঠায় বসে রইল। প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে। রাতের কথা বারবার মনে পড়ে যাচ্ছে ওর। বাবা বোধহয় অনেক কষ্ট পেয়েছেন। একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো রোদ। একটু বাদেই দরজা খুলে নিখিল প্রবেশ করলো। ও রুমে এসে বিছানায় রোদকে বসে থাকতে দেখে একটুও অবাক হলোনা। ওর চেহারায় বিরক্তির ছাপ। সারারাত জেগে থাকার দরুন আর কান্না করায় চেহারা খারাপ হয়ে গেছে অনেক।
রোদ অবাক হয় বললো, “নিখিল, তুই!”
– “হুম আমি।”
বলেই দরজা টা লাগিয়ে দিলো।
রোদ একটু চমকালো। দরজা বন্ধ করছে কেন ও! নিখিল আর রোদ একই কলেজ থেকে এইচ.এস.সি পাশ করেছিলো। কলেজে মোটামুটি ভালো বন্ধুত্বই ছিলো, কিন্তু ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পর থেকে আর তেমন দেখা হয়নি। আজকে নিখিল কোথ থেকে এলো? আর যশোরে সে কি করছে! এরকম অনেক প্রশ্ন মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো রোদের মনে।
নিখিল এসে প্রচণ্ড রকম রাগ দেখিয়ে রোদকে বললো, “আমার লাইফটা এরকম করে দিলি ক্যান তুই? তোর বাপ মা তোকে এই শিক্ষা দিছে?”
ওর ভয়ংকর গলা শুনে অবাক হয়ে চেয়ে আছে রোদ। কিছুই বুঝতে পারছে না। নিখিলের লাইফ কি করে দিয়েছে সে সেটা তো বললো না,আর তার সাথে রোদের ই বা কি সম্পর্ক! কেমন অদ্ভুত লাগছে সবকিছু। নিখিল একদম রোদের মুখের কাছে এসে বললো, “ইচ্ছে করছে তোকে খুন করে বাইরে ফেলে দিয়ে আসি”
ওর রাগ দেখে ভয় পেয়ে গেলো রোদ। ভয়ে ভয়ে বললো, “আমি কি করেছি?”
– “দুপুরকে আমি আমার নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসছি। তুই ওরে কেড়ে নিলি ক্যান আমার কাছ থেকে?”
রোদ মাথা নিচু করে ফেললো। দুপুরের যে কারো সাথে সম্পর্ক ছিলো সেটা ও জানতো না। আর নিখিলের সাথেই ওর সম্পর্ক সেটা জানলে তো কখনোই ওকে এই অবস্থায় ফেলে আসতো না।
রোদ জিজ্ঞেস করলো, “দুপুরে সাথে অরণ্য’র বিয়ে হয়ে গেছে? ”
– “হ্যা। এখন আমি কি নিয়ে বাঁচি বলতো? কেন এরকম করলি তুই?”
রোদ বললো, “তোকে আমি সব বলবো। আর কাউকে বলতে পারবো না,তাই তোকেই বলবো। একটু সময় দে আমাকে প্লিজ। আমি তোকে সব বলবো কথা দিচ্ছি।”
চলবে..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে