অনুভূতি পর্ব ১৩

0
2059

অনুভূতি
পর্ব ১৩
মিশু মনি
.
২১.
আজকে খুব ভোরেই দুপুরের ঘুম ভেঙে গেলো। ঘুম থেকে উঠতে গিয়ে শাড়ির আঁচলে টান পড়তেই পিছন ফিরে দেখলো অরণ্য’র গায়ের নিচে পুরোটা আঁচল। সেটা টেনে বের করা এখন কিছুতেই সম্ভব না। ঘুম ভেঙে যাবে অরণ্য ‘র। আবারো শুয়ে পড়লো দুপুর। বালিশে মাথা রেখে অরণ্য ‘র দিকে তাকিয়ে রইলো অনেক্ষণ। অন্ধকার ঘরে আবছা আবছা দেখা যাচ্ছে ওর মুখটা। কিন্তু তাতেই কেমন যেন লাগছে ওর। সত্যিই খুন হয়ে যাওয়ার মত মায়া ওর চেহারায়।বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায়না।
চোখ বন্ধ করে চুপচাপ শুয়ে রইলো অনেক্ষণ। অরণ্য ঘুমের মাঝেই একটা হাত রাখলো দুপুরের গায়ের উপর। কেমন যেন ছ্যাত করে উঠলো বুকটা। তার স্পর্শ অসহ্য লাগে কিন্তু কিছুই করার নেই। সে তো এখন দুপুরের স্বামী, মেনে নিতেই হবে। স্বামীর সবটুকু অধিকার সে নেবেই। ভাগ্যিস অরণ্য আর সব ছেলের মত নয়। দুপুরকে রাতে কোনোরকম বিরক্ত করেনা বরং মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয়।
নিখিলের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে হঠাৎ। একদিন ফোনে চার্জ ছিলোনা বলে নিখিলকে ফোন দিতে পারেনি দুপুর। এদিকে ইলেকট্রিক লাইনে সমস্যার কারণে ফোনে চার্জও দেয়া সম্ভব হচ্ছিলো না। সারাদিন কথা হয়নি, রাতেও কথা হয়নি। বাড়ির কারো ফোন দিয়ে ওকে জানায় ও নি দুপুর। নিজে দিব্যি আরামে ঘুমিয়ে পড়েছিলো। রাত সাড়ে এগারো টার দিকে হঠাৎ এভাবেই গায়ের উপর একটা হাত পড়লে চমকে ঘুম ভেঙে যায় দুপুরের। ও পাশ ফিরে শুতে যাচ্ছিলো। ফিসফিস করে কেউ একজন ডাকলো, “দুপুর, এই দুপুর…”
দুপুর চমকে উঠলো নিখিলের গলা শুনে। এতরাতে নিখিল কোথ থেকে এলো? তাছাড়া রৌদ্রময়ী তো ওর পাশেই ঘুমিয়েছিলো। আপুই বা গেলো কোথায়? লাফিয়ে উঠে বিছানার উপর বসলো দুপুর। নিখিল ফিসফিস করে বললো, “তোমার ফোন বন্ধ পেয়ে টেনশন হচ্ছিলো। তাই চলে আসলাম।”
– “সেকি! আপু কোথায় গেলো?”
– “আপু তো বাসায় নেই। পাশের বাড়িতে তামিমার বিয়ে হচ্ছেনা? তামিমা আপুকে এসে নিয়ে গেছে, আপু তামিমার সাথে ওর শ্বশুরবাড়ি যাবে।”
– “তুমি কিভাবে জানলা?”
– “আমিই তো তামিমাকে বলেছি যাতে আপুকে নিয়ে যায়। আমি নিজেই বিদায় দিয়ে আসলাম।”
– “আপু কিছু বুঝতে পারেনি তো?”
– “না। ফোন বন্ধ থাকলে টেনশন হয়না বলো?”
দুপুর খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছিলো নিখিলকে। সে রাতে পুরোটা রাত নিখিল আর ও একই বিছানায় ঘুমিয়েছে। কিন্তু নিখিল একবার ও দুপুরকে অন্য কোনো মতলবে স্পর্শও করেনি। পুরোটা রাত দুপুর শুধুমাত্র নিখিলের বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়েছে। এতটাও দায়িত্ববোধ সম্পন্ন ও সত্যিকার একজন মানুষ ছিলো নিখিল। ভোরবেলা চলে যাওয়ার সময় দুপুর একবার জিজ্ঞেস করেছিলো, “তুমি আমাকে নিজে থেকে একবার টাচ ও করলা না। ভেবেছো আমি কষ্ট পাবো? তুমি টাচ করলে আমি বাধা দিতাম না।”
নিখিল দুপুরের হাত শক্ত করে ধরে বলেছে, “আমি তোমাকে পবিত্র ভাবে ভালোবাসি দুপুর। আর স্পর্শটা একান্তই তোমার স্বামীর হক। যেদিন আমাদের বিয়ে হবে,সেদিন থেকে সবরকমের স্পর্শের অধিকার আমার। আর যদি কোনো কারণে আমাদের বিয়ে না হয়, আজীবন এই অপরাধবোধ আমাকে তাড়া করে বেড়াবে।”
সেদিন নিখিলের কথা শুনে খুব বেশি অবাক হয়ে গিয়েছিলো দুপুর। তামিমা রোদের বান্ধবী, নিখিলের ও বান্ধবী। সেই মেয়েটাকে রাজি করিয়ে আপুকে বাড়ি থেকে পাঠিয়ে দিয়ে তারপর সে কিভাবে যেন দুপুরের ঘরে ঢুকেছে। অথচ সারাটা রাত দুপুরকে একবার স্পর্শ ও করলো না, এরকম মানুষ ও আছে দুনিয়ায়! এই আলাদা বৈশিষ্ট্যের জন্যই নিখিলকে প্রচণ্ড ভালোবাসতো দুপুর। এখনো বাসে, কিন্তু এখন…. শুধুই একটা দীর্ঘশ্বাস!
গাল ভিজে চোখের জল বালিশে গিয়ে পড়েছে। চোখ মুছলো দুপুর। নিরব কান্না, এই কান্না কেউ দেখেনা, কেউ জানেনা। কিন্তু অরণ্য হঠাৎ জিজ্ঞেস করলো, “তুমি কি কাঁদছ দুপুর?”
দুপুর চমকে উঠে বললো, “কই না তো।”
চোখের জল মুছতে যেতেই অরণ্য নিজেই আলতো করে দুপুরের মুখটা স্পর্শ করলো। তারপর গালে হাত বুলিয়ে দিয়ে চোখ মুছে দিয়ে বললো, “কাঁদছ কেন?”
দুপুর নিজের হাত দিয়ে অরণ্য ‘র হাত ধরে ফেলে বললো, “এমনি।”
– “এমনি কেউ কখনো কাঁদেনা, আর কাঁদলেও সেটা অন্তত সারাক্ষন স্থায়ী হয়না।”
দুপুর কোনো কথা বললো না। অরণ্য ওকে জড়িয়ে নিলো নিজের বুকে। তারপর বললো, “কাঁদছ কেন বলবা না? আমি ঘুম ভাঙার পরই তোমার নাক টানার শব্দ শুনেই টের পেয়েছি তুমি কাঁদছ।”
– “আমি নাক টেনে কাঁদি?”
– “না, তবে একটা ফ্লেভার আছে কান্নার। বোঝা যায়।”
– “কান্নার কখনো ফ্লেভার থাকে?”
– “তোমার কান্নার আছে। তুমি অনেক দূরে থাকলেও কাঁদলে আমি বুঝতে পারবো। বুঝেছো?”
দুপুর কিছু বললো না। অরণ্য ওকে জাপটে ধরে রইলো। সকালের পাখির কিচিরমিচির কানে আসছে। এখন উঠতে হবে। অরণ্য বললো, “নাস্তা করে এসে দুজন মিলে ব্যাগ গোছাবো। আজ আমাদের সিলেট যাওয়ার কথা।”
দুপুর কিছুই বললো না। চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলো। অরণ্য’র শরীরে একটা গন্ধ আছে, সেটা অনুভূতি ইন্দ্রিয়েরা জানিয়ে দিচ্ছে ওকে। ধীরেধীরে এই গন্ধটাই সবচেয়ে চেনা আর প্রিয় হয়ে উঠবে।
২২.
ট্রেন থেকে নেমে আবারো ঢাকার ট্রেনে উঠে পড়েছে মিশু ও মেঘালয়। কাউন্টারে কথা বলে জেনেছে কোনো সিট ফাঁকা নেই, কিন্তু একটা কেবিন ফাঁকা আছে। মেঘালয়ের কাছে অতবেশি টাকা ছিলো না। বাসায় ফোন দিয়ে টাকা নিয়ে পুরো কেবিনটাই বুক করে ফেলেছে।
মিশু একদম অবাক! এতবড় কেবিন বুক করে হবেটা কি? আর দুজন মানুষের জন্য একটা কেবিন নিতে হয়? ছেলেটা সত্যিই অদ্ভুত রকমের। বিশাল সাইজের একটা মন আছে বলতে হবে। তবে অযথা টাকা খরচ করার অভ্যাস টা ভালো লাগেনা মিশুর।
কথাটা বলতেই হেসে ফেললো মেঘালয়। জবাব দিলো, “অযথা খরচ করলাম কোথায়?”
– “এত টাকা দিয়ে একটা কেবিন পুরোটাই বুক করার কি দরকার ছিলো? সিট না পেলে আমরা দাঁড়িয়ে থেকে যেতাম।”
– “প্রথমত এখনো রাত বাকি আছে, আর দ্বিতীয়ত আমি সজ্ঞানে তোমাকে কষ্ট দিয়ে দাঁড়িয়ে নিয়ে যেতে পারবো না।”
মিশু বেশ অবাক হয়ে বললো, “একটা অচেনা মেয়ের জন্য এত দরদ কেন আপনার শুনি?”
– “যার মনে দরদ আছে তার চেনা অচেনা সবার জন্যই আছে।”
এর কোনো জবাব খুঁজে পেলো না মিশু। ট্রেনের কেবিন খুঁজে সেখানে ঢুকে পড়লো। মেঘালয় কেবিনে ঢুকেই দরজা লাগিয়ে দিলো। মিশু আঁৎকে উঠে বললো, “খোলা থাক, খোলা থাক।”
– “সেকি! খোলা থাকবে কেন?”
– “আমার ভয় করে।”
– “আমাকে?”
মেঘালয় জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে আছে মিশুর দিকে। মিশু কি বলবে ভেবে পাচ্ছেনা। মেঘালয়কে ভয় লাগছে বললে অন্যায় হয়ে যাবে। যে ছেলেটার সাথে বারবার দেখা হওয়ার পরও কখনো বদ নজরে তাকায় নি, তাকে তো ভয় পাওয়ার কোনো কারণ ই নেই। তাছাড়া মেঘালয় কতটা মহান সেটা মিশু ভালোভাবেই জানে। তবুও কেন যে কথাটা বললো নিজেও বুঝতে পারছে না। অবশ্য হঠাৎ একজনের সাথে বদ্ধ কেবিনে থাকতে একটু ভয় তো লাগবেই।
মিশুকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে মেঘালয় বললো, “কি ভাবছো?”
– “কিছু না। লাগিয়ে দিন।”
মেঘালয় দরজা লাগিয়ে দিয়ে এসে সিটে বসতে বসতে বললো, “আমি কোনো সুযোগ নিবো কিনা সেটা ভয় পাচ্ছো?”
মিশু তাকালো মেঘালয়ের দিকে। কিছু বললো না মুখে। মেঘালয় বললো, “ট্রেনে যখন আমার বুকে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছিলে, তখন চাইলে অনেক সুযোগ নিতে পারতাম। সেটা যখন করিনি, এখন ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। তাছাড়া একটা মেয়ে যখন আমার সাথে থাকে, তাকে সেফলি বাসায় পৌছে দেয়াটাকে আমি আমার দায়িত্ব মনে করি। সেখানে তুমি তো মিশু…”
মিশু আগ্রহ ভরা চোখে জিজ্ঞেস করলো, “আমি মিশু তো?”
মেঘালয় থতমত খেয়ে বললো, “না মানে খুবই ইনোসেন্ট একটা মেয়ে।”
কিন্তু মনে মনে বললো, “আমার মনের ঘন্টা বাজিয়ে দিয়েছো সেটা কিভাবে বলি বলো? এত তাড়াতাড়ি নিজের মনের কথা বুঝতে দিতে নেই। একটু সময় নিতে হয়। তুমি নিজে থেকেই বুঝবা এই মেঘ তোমার প্রতি কতটা আসক্ত হয়ে পড়েছে, তারপর নিজেও একটু একটু করে দূর্বল হতে শুরু করবা। তখন জানাবো মনের কথাটা।”
মিশু জিজ্ঞেস করলো, “কি ভাবছেন এভাবে আমার দিকে তাকিয়ে?”
– “তোমার দিকে তাকিয়ে আছি?”
– “তো? আপনার চোখ তো আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে।”
লজ্জা পেয়ে হাসলো মেঘালয়। মিশুও হাসলো। আর মনেমনে ভাবল, “কি চাইছে এই ছেলেটা? এত আপন মনেহচ্ছে কেন ওকে? কিন্তু ওকে তো আপন ভাবা যাবেনা। মিশু যে বড্ড গরীব আর অসহায় ঘরের মেয়ে। তাকে নিজেকেই রোজগার করে বাঁচতে হয়। আর মেঘালয়! সে তো অনেক উঁচুতে। মেঘ যাকে ছুঁয়ে চলে যায়, সেখানে শুধু মেঘেদের বসবাস। অত উঁচুতে ওঠার সাহস হবেনা মিশুর। আর মেঘালয় অনেক ভালো গান গাইতে পারে, একদিন নিশ্চয় ই অনেক বড় শিল্পী হয়ে যাবে।
এবার একই প্রশ্ন মেঘালয় করলো, “আমার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কি ভাবছো?”
মিশুও মেঘালয়ের মত লাজুক ভঙ্গিতে হাসলো। তারপর জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে রইলো। সুন্দর হাওয়া আসছে। বাইরে হাত বাড়িয়ে গুনগুন করে গান গাইতে লাগলো মিশু। তারপর মেঘালয়কে বললো, “এখন তো কেউ নেই। একটা গান শোনান না।”
বলামাত্রই মেঘালয় গান গাইতে আরম্ভ করলো। মিশু গান শুনছে আর বাইরে তাকিয়ে আছে। মেঘালয় ওর দিকে তাকিয়ে আছে। অনেক্ষণ ধরে গান গাওয়ার পর সিটে হেলান দিয়ে শুয়ে পড়লো মেঘালয়। মিশুকে বললো ঘুমিয়ে পড়তে। কিন্তু তখন অত যাত্রীর ভিড়ে ঘুম পেলেও এখন ফাঁকা কেবিনে ঘুম আসছে না ওর।
দুজন দুদিকের আসনে বসে মুখোমুখি বসে আছে। হঠাৎ চোখাচোখি হয়ে গেলো দুজনাতে। মিশুর বুকের ভেতর টা কেমন যেন করে উঠলো। ধুকধুক করে উঠলো। এদিকে মেঘালয়ের ও একই অবস্থা। এর আগে কখনো এমন হয়নি ওর। কেমন যেন মায়া কাজ করছে। অন্যরকম একটা মায়া যার কোনো নাম দেয়া যায়না। মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ও মিশুর দিকে। একদম নির্জনে এভাবে মিশুকে দেখলে মনটা কেমন যেন বিষণ্ণতায় ছেয়ে যায়। এত কাছে তবুও ধরা ছোঁয়ার বাইরে। বড্ড ছুতে ইচ্ছে করছে ওর লাজুক চিবুক, কিন্তু সেটা তো হয়না। সবকিছুর একটা নির্দিষ্ট সময় থাকে। সীমা লংঘন ব্যাপার টা ভালো লাগেনা মেঘালয়ের, তবুও আজ বড্ড ইচ্ছে করছে একটু সীমা অতিক্রম করতে। এতবেশি মিশুকে ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করছে যে নিজেকে শেষ পর্যন্ত কন্ট্রোল করতে পারবে কিনা সেটা নিয়েই ভয় হচ্ছে মেঘালয়ের।
চলবে..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে