অনুভূতির সুপ্ত কোণে পর্ব-১৫

0
1971

#অনুভূতির_সুপ্ত_কোণে🍂
#কায়ানাত_আফরিন (মাইশা)
#পর্ব :১৫
.
সারাঘরে বিরাজ করছে কেমন যেন এক নিস্তব্দ্ধতা। দুজনের নিঃশ্বাস একে অপরের সাথে খেলা করতে মগ্ন। আদ্রাফ চোখ বন্ধ করে উদাসীন গলায় বলে ওঠে………
.
—–আজ তুমি হারিয়ে গেলে আমি নিজেও হারিয়ে যেতাম মেহু। এই মেহেরহীন আদ্রাফ একেবারে বিলীন হয়ে যেতাম। I can’t live anymore Mehu without you……Because you are my lifeline……
.
.
আদ্রাফের কথা শুনে মেহেরের শ্বাস ক্রমাগতই ঘন থেকে ঘন হয়ে আসছে। বুকে চলছে অজানা এক ঝড়। আদ্রাফ তাকে ভালোবাসে এটা ভাবতেই প্রশান্তির হাসি ফুটে ওঠে ঠোঁটের কোলে। আবেশে স্যালাইনের ক্যানোলা লাগানো হাতটি দিয়েই খামচে ধরে সে আদ্রাফের বাহু। আদ্রাফ এখন শুধু পারছে না তার মেহুকে একেবারে বুকের সাথে মিশিয়ে ফেলতে। তবেই তো তার অস্তিত্বটা মেহের ক্ষণে ক্ষণে অনুভব করতে পারবে।
মেহেরের শুষ্ক ঠোঁটে আলতো করে নিজের ঠোঁটের স্পর্শ দিয়েই আদ্রাফ সরে আসে মেহেরের কাছ থেকে। মেহেরকে বেডে আধশোয়া অবস্থায় রেখে নরম কন্ঠে বলে ওঠে……….
.
——এখন সম্পূর্ণ রেস্টের প্রয়োজন তোমার। ক্যানোলা লাগানো হাতটি বেশি নাড়াচাড়া করবে না। আমি নাদিয়াকে পাঠিয়ে দিচ্ছি । কোনো প্রয়োজন হলে ওকে বলবে। আমি একটু রিসিপশন থেকে চেক করে আছি তোমার সবকিছু ঠিকঠাক আছে কি-না। ঠিকাছে?
.
—-হুম।
মেহের মলিন কন্ঠে প্রতিউত্তর দেয়। আদ্রাফ তা দেখে মেহেরের কাছে গিয়ে বসে। মেহেরের গালে আলতো করে হাত রেখে বলে……
.
—-কিছু বলবে মেহু?
.
—-এখনও রাগ করে থাকবে আমার ওপর?
.
মেহের ঠোঁট উল্টে বলে ওঠে। আদ্রাফ এটা শুনে একটা মুচকি হাসি দেয়। মেহেরের কপালে দীর্ঘক্ষণ একটা চুমু দিয়ে প্রতিউত্তর দেয়…….
.
—–রাগ না ; অভিমান হয়েছিলো তোমার ওপর। যেদিকে একদিন তোমায় না দেখে আমার দমবন্ধ হয়ে আসতো সেদিকে তিনদিন আমি তোমাকে ছাড়া ছিলাম। তবে এখন আর অভিমান নেই। কারন তোমাকে next time নিজের থেকে দূরে থাকার আর সুযোগই দেবো না !
এখন এসব কথা থাক । তুমি rest নাও। আমি নাদিয়াকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।
.
আদ্রাফের প্রতিটা কথার জালেই মেহেরের মনে হয় সে যেন অন্য কোনো এক জগতে চলে গিয়েছে। একটা মানুষ কিভাবে তার কথার মায়ায় মানুষকে নিঃস্ব করতে পারে এর উত্তরটা মেহেরের কাছে সবসময়ই যেন অজানা রয়ে গেলো। আদ্রাফ কেবিনের বাইরে চলে যাওয়ার পর আধশোয়া হয়ে বাইরের মেঘাচ্ছন্ন আকাশে মনোনিবেশ করায় নিজেকে। আদ্রাফকে একটা প্রশ্ন বারবার করতে চেয়েও করতে পারেনি যে, শাওন কোথায়?
.
.
.
.
হসপিটালের পাশেই রয়েছে একটা পার্ক। সন্ধ্যা হওয়ার সুবাদে এখানে এখন মানুষজন নেই বললেই চলে। আর এই পার্কের কোণে ছোট এক বেঞ্চে বসে একের পর এক সিগারেটের ধোয়া উড়িয়ে চলছে শাওন। নিজেক এই সিগারেটের অনুভূতিহীন ধোঁয়ার মতোই মনে করে সে। নিশা , রাতুল সবাই ওর সাথে থাকতে চেয়েছিলো কিন্ত শাওন রাজি হয়নি। কিছুক্ষণ সে একা থাকতে চেয়েছিলো তাই বৃষ্টিময় হাওয়ার সাথেই আনমনে সিগারেটের ধোঁয়ার খেলা চালিয়ে যাচ্ছে সে।
.
—-অন্যের জীবন বাঁচালে বাট নিজের জীবনেরই খেয়াল রাখো না ; মিঃ শাওন চৌধুরি?
.
কারও পুরুষালি কন্ঠ শুনে সিগারেটেটটা ঠোঁটের ভাঁজ থেকে হাতে নিয়ে নেয়। তার চোখের সামনে আদ্রাফ স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে আছে।শাওন সেদিকে পরোক্ষ না করে আবার সিগারেটের ধোয়া উড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
.
—–বড্ড আজব মানুষ তুমি , যেদিকে তোমার জন্যই আজ মেহের বেঁচে আছে সেদিকে তুমিই কাউকে না বলে সেখান থেকে চলে গেলে without any reaction? এখনও সেম অবস্থা। আমায় দেখে তোমায় react করা উচিত ছিলো আর তুমি বরাবরই তোমার কাজে মগ্ন।
.
শাওন তা শুনে তাচ্ছিলের হাসি হাসে। প্রতিউত্তরে সে বলে ওঠে…….
.
—–এই শাওন চৌধুরি মানুষটাই এমন। তবুও formality’র জন্য জিজ্ঞেস করছি……তুমি এখানে কেন?
.
—–ধন্যবাদ জানাতে।
.
শাওনের কাছে বিষয়টি যেন বোধগম্যে এলো না। আবারো প্রশ্ন করে ওঠে…….
.
—-What?
.
—-বললাম তো ! ধন্যবাদ জানাতে।
.
—-কিসের জন্য?
.
—-মেহেরকে বাঁচানোর জন্য ।
.
শাওনের কাছে এবার বিষয়টা কৌতুকের মতো লাগছে। এই প্রথম হয়তো কেউ ওকে ধন্যবাদ জানাচ্ছে যেখানে সবাই ওকে ঘৃণা করে। সিগারেটটা পায়ের নিচে পিষে দিয়ে বলে ওঠে…….
.
—–ধন্যবাদ দেয়ার মতো তেমন কোনো মহান কাজ করিনি আমি। ওকে বাঁচানো আমি প্রয়োজন মনে করেছি তাই আমি……..
.
এতটুকু বলেই শাওন থামে। আসলেই তো? মেহেরের কাছ থেকে তো সে revenge নিতে চেয়েছিলো। তাহলে মেহেরকে বাঁচালো কেন?
.
আদ্রাফ এবার শাওনের পাশে বসে। শাওনের দৃষ্টি তখন নিচে পড়ে থাকা নিভু নিভু সিগারেটটার দিকে।
.
—–নিজেকে যতটাই খারাপই তুমি প্রমাণ করতে চাও না কেন………ততটা খারাপ প্রমাণ করতে তুমি ব্যর্থ। জানিনা কোন বিভৎস কারনের জন্য তুমি এত নির্দয় তবে আমার কথা শুনো………নিজেকে এত খারাপ বানিও না।
.
শাওন নিশ্চুপ।
.
—–আর এই সিগারেটের নেশাটাও কমিয়ে আনো। এটাই তোমার জন্য ভালো।
.
—-Who the hell are you? এতক্ষণ কিছু বলছিনা বলে এটা মনে করো না যে আমায় উপদেশ দেয়া শুরু করবে। Thanks বলেছো না , এবার চলে যাও। আর কি যেন বললে?
হ্যাঁ , আমি নাকি নিজেকে খারাপ প্রমাণ করতে ব্যর্থ । You’re absolutely right………কারন এর থেকেও বেশি জঘণ্য আমি। এমনকি আমার so called dad হায়াৎ চৌধুরী থেকেও।
.
শাওনের এমন বিষাক্ত কথাগুলো আদ্রাফের মুখে বিন্দুমাত্র প্রভাব ফেললো না। আদ্রাফের ধারনাই ছিলো যে শাওন এমন কিছু করবে। আর কিছু না বলে শাওনকে একা রেখে নীরবে চলে যায় সে।
.
.
শাওন একটা লম্বা নিঃশ্বাস ত্যাগ করে আধশোয়া হয়ে পড়ে বেঞ্চটিতে। না চাওয়া সত্বেও আদ্রাফের কথাগুলো বারবার কানে বেজে উঠছে । তার জীবনটাতো এমন নাও হতে পারতো। কেন এমন হলো? এর উত্তর শাওনের কাছে নেই।
.
.
.
.
আদ্রাফের অপেক্ষার অঙ্ক যেন আর পারই হচ্ছে না মেহেরের কাছে এখন এমন মনে হচ্ছে। প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে বারবার দরজার দিকে তাকাচ্ছে অথচ সবাই দেখা সাক্ষাত করে গেল কিন্ত আদ্রাফের আসার কোনো নামগন্ধ নেই। এদিকে নাদিয়াও সোফায় হেলান দিয়ে পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে।
অবসর জিনিসটা মেহেরের কাছে বড়ই বিষাক্ত। একজন চঞ্চল মেয়ের কাছে দীর্ঘক্ষণ স্থির থাকা যেন আগুনে ভস্ম হয়ে যাওয়ার সমান। আনমনে ঠোঁট কামড়াতে কামড়াতে সে বলে……
.
—-সবাই আমারে ভুলে গেসে।
.
তখনই আগমন ঘটে আদ্রাফের। হাতে নানারকম ফলফলাদির বাহার। মেহের বিরক্ত হয়ে বলে ওঠে,
,
—-এই তোমার কাউন্টারে যাওয়া? সেখানে ফল বিক্রি করছিলো বুঝি?
.
—–মোটেও না। তোমার জন্যই ফল আনতে গিয়েছিলাম। ডাক্তার বলেছে তোমায় বেশি করে ভিটামিন খাওয়াতে।
.
—-ফফফল? মোটেও না। আমি ফল খাবো না।
.
—-আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করেছি যে তুমি খাবে নাকি খাবে না? আমি জাস্ট বলেছি ডাক্তার তোমায় ভিটামিন খাওয়াতে বলেছে। আমি এগুলো কাটবো আর আমার লক্ষী বউয়ের মতো তুমি খাবে।
.
নির্লিপ্ত গলায় প্রতিউত্তর দেয় আদ্রাফ। মেহেরের মুখ যেন শুকিয়ে গিয়েছে এত্তগুলো প্যাকেট দেখে। আদ্রাফ একে একে আপেল, কমলা, আঙ্গুর সব ধুয়ে কেটে মেহেরের সামনে রাখে। মেহের তবুও শেষ প্রচেষ্টা চালিয়ে প্রশ্ন করে……..
.
——না খেলে হবেনা?
.
—–মোটেও না।
.
অগত্যাই চোখ-মুখ খিচে মেহের বাধ্য মেয়ের মতো পুরো প্লেট সাফ করতে হয়।আদ্রাফ প্রশ্ন করে……
.
—–আরও নিয়ে আসবো?
.
মেহেরের এবার যেন কাদো কাদো অবস্থা। এমনিতেও এই আদ্রাফ তাকে ফল জোড়া করে খাওয়ালো আবার কি সুন্দর করে প্রশ্ন করছে আরও খাবে নাকি।
.
—–ফল খাইয়ে আমায় শহিদ করার পরিকল্পনা আছে নাকি তোমার ?এমনিতেও এতটুকু খেয়ে নিলাম কত্ত কষ্ট করে।
.
—–বেশি কথা বলো না। আগে কিছু বলিনাই বলে এমন মনে করো না আজীবন তোমার পকর পকর শুনে যাবো। আমার কথার একটু হেলফেল করলে তার পরিণাম কিন্ত মোটেও ভালো হবে না। So আমি যা বলবো সবসময় তা মেনে চলবে।
আদ্রাফের কড়া গলা শুনে মেহের চুপসে যায়। মেহের বুঝে গিয়েছে যে সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত আদ্রআফের এই কেয়ারিং নামক যন্ত্রণা তাকে সইতে হবে।
.
.
.
.
.
~চলবে
ভ্রুলক্রুটি ক্ষমার চোখে দেখবেন।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে