অনপেখিত পর্ব-০৪

0
1822

#অনপেখিত
পর্ব_৪
লিখা: Sidratul Muntaz

মেহেক ডাইনিং রুমে আসতেই তিশা জিজ্ঞেস করল,” ফারদিন কই?”
হাসি হাসি কণ্ঠে মেহেক ‘আসছে’ বলল। কিন্তু অনেক সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরেও ফারদিনের আসার কোনো নাম নেই। আরশাদ সাহেব বললেন,” কি ব্যাপার মেহেক? এখনও তো আসলো না ফারদিন।”
মেহেক শুকনো মুখে বলল,” আমিও বুঝতে পারছি না দাদু। মনে হয় আমি চলে আসার পর উনি আবার ঘুমিয়ে গেছেন।”
” আমি ডাকছি এই কথা বলোনি তুমি?”
” বলেছি তো।”
” তবুও এলো না? ছেলেটার সমস্যা কি? এই লিয়া, যাও তো। ফারদিনকে ডেকে নিয়ে এসো।”
লিয়া ডাকতে গেল। একটু পরেই ফারদিন হাতমুখ ধুয়ে টেবিলে বসলো। সবাইকে হাসি মুখে বলল,” গুড মর্ণিং দাদু, গুড মর্ণিং ভাইয়া, গুড মর্ণিং ভাবী।”
ফারদিনের চাচাতো বড়ভাই ফাহিম উত্তর দিল,” গুড মর্ণিং। এতো দেরি লাগলো কেন তোর?”
ফারদিন ভারী অবাক হয়ে বলল,” দেরী কোথায়? লিয়া ডাকার সাথে সাথেই তো চলে আসলাম।”
আরশাদ সাহেব গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,” মেহেক যখন ডাকতে গেল তখন আসিসনি কেন?”
ফারদিন ভ্রু কুচকে বিস্মিত হওয়ার ভাণ করে বলল,” মেহেক আবার আমাকে কখন ডাকতে গেল?”
” যায়নি?”
” না তো।”
আরশাদ সাহেব মেহেকের দিকে তাকালেন। মেহেক হতবাক দৃষ্টিতে মুখ হা করে ফারদিনের দিকে চেয়ে প্রতিবাদ করল,” মিথ্যে বলছেন কেন? আমি আপনাকে ডাকিনি?”
” কখন ডাকলে? আর ডাকলে আমি আসতাম না? আমার ঘুম এতো গভীর না যে কেউ ডাকবে আর আমি শুনতে পাবো না।”
মেহেকের চেহারায় অসীম বিস্ময়। তিশা বলল,” আচ্ছা বুঝেছি। দাদু, ও আসলে ফারদিনকে একটু ভয় পায়৷ তাই বোধহয় না ডেকেই চলে এসেছে।আমারই ওকে পাঠানো উচিৎ হয়নি। নিজের যাওয়া উচিৎ ছিল।”
আরশাদ সাহেব অসন্তোষ প্রকাশ করলেন,” তাই বলে ও মিথ্যে কথা বলবে কেন? ও প্রথমে এসে কেনো বললো ফারদিন আসছে? শুধু শুধু এতোক্ষণ অপেক্ষা করলাম। প্রথমেই লিয়াকে পাঠিয়ে দিলে হতো।”
মেহেক ফারদিনের পেছনে এসে ফিসফিস করে বলল,
” এভাবে মিথ্যে বললে একদিন আপনার সব দাঁত পড়ে যাবে। তখন দেখবেন।”
” তাই নাকি? আমি মিথ্যে বলেছি? তাহলে সত্যিটা তুমি বলো। আমাকে কিভাবে ডেকেছিলে সবার সামনে বলো। আবার মিথ্যে বলো না যেনো। তাহলে কিন্তু তোমারও সব দাঁত পড়ে যাবে।”
ফারদিন কথা শেষ করে মুচকি হেসে ব্রেডে কামড় দিল। মেহেকের মুখ এতোটুকু হয়ে গেল। রাগে, জেদে ইচ্ছে করলো ফারদিনের চুলগুলো খামচে ধরতে। প্রথমদিনেই সে দাদুর কাছে মিথ্যুক হয়ে গেল। এভাবে চলতে থাকলে দাদুকে হাতে রাখবে কি করে?
বিকালে ফারদিন দাদুর ঘরে উঁকি দিয়ে বলল,
” দাদু আসবো?”
” ফারদিন, আয়।”
ফারদিন দাদুর খাটের কাছে দাঁড়িয়ে মাথা নত করে বলল,” দাদু, তোমাকে যে বলেছিলাম সেই কাজটা কি হয়েছে?”
” হুম, হুম, সব হয়ে গেছে। তোর শ্বশুরমশাই বিয়ের দিনই আমার হাতে দলিল দিয়ে গেছিলেন। কোটি কোটি টাকার প্রোপার্টি তুই ফ্রীতে পেয়ে গেলি। নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে কর।”
” ফ্রীতে কেন? আমি তো জায়গাটা কিনতে চেয়েছিলাম।”
” আরে, তুই উনার মেয়েকে বিয়ে করেছিস না? একটা ভালো গিফট তো তোর এমনিই পাওনা ছিল।”
” তুমি কি আমাকে কঠিন মামলায় ফাসিয়ে জেল খাটানোর প্ল্যান করছো দাদু? প্রথমে বাল্যবিবাহ।এখন আবার যৌতুক। মানে কি হচ্ছে আমার সাথে এইসব? যে কাজগুলো আমি সবচেয়ে ঘৃণা করি সেগুলোই কেন আমাকে করতে হচ্ছে?”
” যৌতুকের প্রসঙ্গ আসলো কিভাবে? আরে এইটাকে যৌতুক বলে না গাঁধা। আমরা কি চাপ দিয়ে জোর করে মোজাম্মেল শাহের কাছ থেকে এই জমি হাতিয়ে নিয়েছি? উনি খুশি মনে তোকে এটা গিফট করেছে।”
” আমি তো গিফট চাইনি।।”
” তুই চাইবি কেন? বললাম তো উনি নিজের ইচ্ছায় দিয়েছে।”
” কেন নিজের ইচ্ছায় দিবেন? তুমি উনাকে ফোন করে বলে দাও আমার কোনো গিফট চাই না। আমি জায়গার দাম দিতে চাই।”
” আরশাদ সাহেব কঠোর ভঙ্গিতে বললেন,” এইটা কিন্তু বেয়াদবি হবে। উনি তোকে খুশি মনে দিয়েছেন। আর তুই ফিরিয়ে দিবি?”
” আমার কারো দান চাই না। এই জায়গা আমার নিজের। আমি নিজের টাকায় কিনতে চাই দাদু। তাছাড়া ওই লোকটাকে আমার একদম পছন্দ হয়নি। তার থেকে আমি কোনো উপহার নিতে চাই না।”
” পছন্দ হয়নি কেন?”
” উনার চিন্তাভাবনা অত্যন্ত বাজে। নাহলে পিচ্চি মেয়েটিকে আমার সাথে বিয়ে দিতে চাইতেন না।”
” তোর কথা বার্তা আমার মাথায় ঢুকছে না। এখানে বাজে মানসিকতার প্রসঙ্গ আসলো কিভাবে?”
” অবশ্যই প্রসঙ্গ আসে দাদু। তুমিই বলো এই মেয়ে সংসারের কিছু বোঝে? ওর এখন লেখাপড়ার সময়। স্কুল কলেজে দাপাদাপি করার সময়। ওর বয়সে আমি বিয়ের কথা চিন্তাও করতে পারিনি।”
” আরে, তুই আর ও কি এক হলি? মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে দ্রুত বড় হয়। জানিস না? আর গ্রামের মেয়েরা তো শহরের মেয়েদের তুলনায় ম্যাচিউরও বেশি হয়। তুই মেহেকের সাথে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা কর। মেয়েটা কিন্তু খারাপ না। আর ওর এখন যেই বয়স, তুই চাইলেই ওকে নিজের মতো গড়ে ফেলতে পারিস। প্রয়োজনে ওকে আমেরিকা নিয়ে যা। তোর মনের মতো তৈরী করে নে।”
দাদু কথা বলেই যাচ্ছেন। ফারদিন এসবে কর্ণপাত করছে না। তার মনোযোগ ল্যাপটপ স্ক্রিনে। মেহেকের উপর তার কখনও ইন্টারেস্ট জন্মাবে না। এটা সে ভালো করেই জানে। মেহেককে সে শুধুই বিয়ে করেছে এই জায়গাটা পাওয়ার জন্য। জায়গাটির ছবি এখন ফারদিন ল্যাপটপে দেখছে। প্রায় পনেরোশো বর্গফিটের একটি বাগানবাড়ী। এই জায়গার সাথে ফারদিনের অনেক স্মৃতি জড়িত। এইখানেই তার শৈশব কেটেছে। দিনগুলো স্মৃতিপটে ভেসে উঠছে। ফারদিনের চোখ ভিজে যাচ্ছে। আহ দিনগুলো! কোথায় হারিয়ে গেল সেই সোনালী শৈশব। এখন এই সবুজ মাঠজুড়ে শুধুই খা খা। বুকের ভেতরেও শূন্যতা খুব করে টের পায় ফারদিন। তার মা-বাবা আমেরিকা যাওয়ার সময় এই সবকিছু মোজাম্মেল শাহের কাছে বিক্রি করে গিয়েছিলেন। প্রায় পনেরো বছর পর ফারদিন আমেরিকা থেকে এসে জানতে পারল তার শৈশবের সবচেয়ে প্রিয় জায়গাটি এখন একটি বিদেশী কোম্পানির দখলে। সেখানে বড় বড় দালান উঠবে। গাছ-পালা কেটে ফেলা হবে। ফারদিনের পছন্দের বকুল গাছ, আমতলা, তেতুলতলা,হাজার-হাজার শৈশব স্মৃতি সব হারিয়ে যাবে৷ এটা ফারদিন মেনে নিতে পারছিল না। সে এই জায়গাটা কিনে নেওয়ার জন্য উঠে-পরে লাগলো। কিন্তু মোজাম্মেল শাহ জায়গা বিক্রি করবেন না। ফারদিন যখন বিশেষভাবে অনুরোধ করল তখন তিনি শর্ত দিলেন তার একমাত্র মেয়েকে বিয়ে করতে হবে। ফারদিন এক কথায় রাজি হয়ে গেছিল। এই জায়গার জন্য সে জীবন দিতে প্রস্তুত। আর বিয়ে তো অতি সামান্য বিষয়। কিন্তু বিয়ের আগে ফারদিন জানতো না, তার হবু বউয়ের বয়স মাত্র ষোল এবং সে মাত্র সেভেন পাশ। ফারদিনকে জানানো হয়েছিল, মেহেক আঠারো বছরের এইচএসসি পাশ করা মেয়ে। এখনও ফারদিন সেটাই জানে। শুধু বিয়ের রাতে মেহেককে জিজ্ঞেস করার পর জানতে পেরেছিল তার বয়স আঠারো নয়, ষোল। লেখাপড়ার ব্যাপারটা এখনও ফারদিন ধরতে পারেনি।

মেহেক বিছানার চাদর ঠিক করছিল। ফারদিন ঘরে ঢুকতেই মেহেক দুইহাত কোমড়ে ঠেকিয়ে বলল,
” আপনি দাদুর সামনে আমাকে মিথ্যুক বানালেন কেন?”
” তুমি আমাকে রাগালে কেন?”
বেশ ভারী কণ্ঠ ফারদিনের। মেহেক একটু থতমত খেল। তারপর পুনরায় তর্ক করার ভঙ্গিতে বলল,” একশোবার রাগাবো। আরও বেশি করে রাগাবো। দেখি আপনি কি করেন।”
ফারদিন আচমকা মেহেকের দিকে এগিয়ে আসল। মেহেক দ্রুত সরে যেতে চাইল কিন্তু একেবারে দেয়ালের সঙ্গে তার পিঠ লেগে গেল। ফারদিন কটমট করে বলল,” খবরদার আমাকে রাগানোর চেষ্টা করো না। এমন উত্তর মধ্যম দিবো যে বাপ ডেকেও পার পাবে না।”
মেহেক জোর করে হাসার চেষ্টা করল। বলল,” বাপ ডাকবো কেন? আপনি তো আমার বর। বরকে কেউ বাপ ডাকে?”
” কালরাতে তো ভাই ডাকছিলে।”
মেহেক এইবার ফিক করে হেসে দিল।
” সে তো আপনাকে রাগানোর জন্য। ”
” আমাকে রাগানোর খুব শখ তোমার?”
” হুম। অনেক শখ। রাগলে আপনাকে লাল টমেটো লাগে।”
ফারদিন কিড়মিড় করে তাকিয়ে রইল মেহেকের দিকে। এই মেয়েকে সে ভয় দেখানোর এতো চেষ্টা করছে। কিন্তু মেয়েটা তাকে কিছুতেই ভয় পাচ্ছে না। আশ্চর্য!

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে