অধিকার পর্ব-০৬

0
3055

#অধিকার #ষষ্ঠ_প্রহর
#লিখাঃ #Yasira_Abisha (#Fatha)

“আমি আবিশা সিকদার রুহি,, চিটাগং শহরে আমার জন্ম,, মা বাবার একমাত্র সন্তান ছিলাম তারা আমাকে অনেক অনেক বেশি ভালোবাসতেন,, কিন্তু এই সুখ বেশি দিন আমার সহ্য হয়নি,, আমার যখন ৯ বছর বয়স তখনই মা বাবা এক্সিডেন্টে মারা যায়,,
কিন্তু পুরো বংশে প্রথম মেয়ে আমি এবং শেষ পর্যন্ত আমার বাবা চাচাদের কারো ঘরেই আর কোনো মেয়ে সন্তান জন্ম হয়নি।
এইকারনে সবার অনেক আদরের ছিলাম।
দাদা দাদুর আর বড় চাচা-চাচির চোখের মণি ছিলাম সব সময়।
আমার দাদা সেই এলাকার চেয়ারম্যান ছিলেন আর জমিদার পরিবারের হওয়ার সুবাদে দাদা চাইতেন না আমরা কখনো আলাদা থাকি,, আমাদের সব ডিসিশন উনিই নিতেন,, এইজন্য সবার বাড়ি একদম পাশাপাশি ছিলো। আমার বয়স যখন ১২ বছর তখন বড় চাচার ছেলে সাকিব (ও আমার ৫ বছরের বড় ছিলো) ওকে চাচির বোনের কাছে লান্ডানে পড়তে পাঠিয়ে দিয়েছিলো,, ওর যাওয়ায় মত ছিলো না তাই ও অভিমানে বলেছিলো আর কখনো দেশে ফিরবে না। দাদু মারা যাওয়ার ১বছর পরে প্রায় ৬ মাস আগে,, সে হঠাৎ দেশে ফিরে আসে কারণ বড় চাচুর ও হার্টের অসুখ ধরা পরেছিলো,,

.

সেদিন মাত্র আমার ফাইনাল প্রফের লাস্ট এক্সাম শেষ হয়েছিলো,, আমি খুব খুশি ছিলাম,, এই এক্সামটা নিয়ে সব গুলো অনেক ভালো হয়েছিলো,
বাসায় ফিরে দাদুমনির খোঁজ করতেই কাজের মেয়েটা বলে দাদু নাকি বড় চাচার বাসায় গিয়েছে,, আমিও একপ্রকার দৌড়ে চাচুর বাসায় গিয়েছিলাম,,
তখনই বড় হওয়ার পর সাকিব প্রথম আমাকে দেখে ,, স্বাভাবিক ভাবেই কথা বার্তা হয় তার সাথে আমার সাথে তার। আমি বুঝতে পারিনি ওর মনে আমাকে নিয়ে কি রকম চিন্তা ভাবনা কাজ করছে?
সাকিব সবার বড় ছিলো আর দূরে থাকতো বিধায় আমাদের কারো সাথেই তার তেমন ভাব হয়নি। আমি অন্যান্য কাজিনদের সাথেই বড় হওয়ার ওদের সবার আদরের ছিলাম। আমি খুব সহজে সবার সাথে মিশতে পারতাম সাকিবের সাথেও ভাব করে নিয়েছিলাম। কয়েক দিনের মধ্যে সাকিবকে সবাই মিলে ঘুরিয়ে শহর দেখাই,, ও নিজে থেকেই আমাকে বলতো ঘুরতে নিয়ে যেতে আমি আর অন্যভাইরা মিলে নিতাম ওকে,,
একদিন নাস্তার টেবিলে সবাই বসা তখন দাদু আমাকে প্রতিদিনের মত খাইয়ে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করে
“সাকিব কেমন রুহি সবটা বলতো??”
“আগে তোমারা বলো চাচি কেন বলতো ভাইয়া কথা বলতে জানেনা বেশি,, তারপর উনি জেদি। উনি কত্ত ভালো জানো তোমরা?? নিজে থেকেই আমাকে বলে ঘুরতে নিয়ে যেতে,, কত কথা বলে আমার সাথে,, এমনকি আমাকে কাল ভাইয়া একটা শাড়ি ও কিনে দিয়েছে। ভাইয়া অনেক সুইট।”
আমি এই কথাটা স্বাভাবিক ভাবেই বলেছিলাম,, কারণ সাকিব আমার কাছে অন্য সব ভাইদের মতই ছিলো। তাকে আমি নিজের ভাই মনে করেছিলাম,, কিন্তু চাচু আমার সাথে সাকিবের বিয়ে ঠিক করে ফেলবে আমি তা ভাবতে পারিনি।
সাকিব নাকি চাচির কাছে বলেছিলো সে আমাকে বিয়ে করতে চায়। এইজন্য চাচা চাচি আর দাদি সবাই খুশি হয়েছিলো,, যে আমাকে অন্য কোনো ঘরে দিতে হবেনা তাদের কোনো টেনশন থাকলো না।
বিকেলে দাদুমণি মিষ্টি সহ আমাকে এসে এই খবর শুনায় আমি হতবাক হয়ে যাই।
এমন কিছু আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি,, তখন অনেক কষ্ট হয়।

আমি সাথে সাথে চাচুর বাসায় যাই দেখি সবাই অনেক চিন্তিত, চাচু বসে আছে ডাক্তার তাকে চেক করছেন,
ডাক্তার- উনাকে কোনো রকম টেনশন দিবেন না। উনার অবস্থা ওত ভালোনা,, তাই বেশি এক্সাইটেড হওয়া উনার জন্য সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে সবাই খেয়াল রাখবেন।
ডাক্তার যাওয়ার পরে শুনলাম চাচু বিয়ের প্রিপারেশন নিয়ে ভাবছিলেন কিভাবে কি করবেন এসব নিয়ে সে অসুস্থ হয়ে পরেছেন।

আমি কিছু না বলে বাসায় চলে আসি,, সেদিন অনেক কান্না করেছিলাম,, যারা এতো ভালোবেসে বড় করেছে তারা সবাই আজকে অনেক খুশি কিন্তু আমি তো মন থেকে সাকিব কে নিয়ে কিছু ভাবতে পারছিনা। তখন মা কে অনেক বেশি মিস করেছিলাম,, এত জীবনে চাচা চাচি দাদা দাদি কেউ মা বাবার অভাব বুঝতে দেন নি। কিন্তু সে রাত টা আমার জন্য পাহাড়ের মত কঠিন লাগছিলো।
পরদিন থেকেই বাসায় বিয়ে বিয়ে একটা আমেজ তৈরি হয়ে গিয়েছিলো,, আমি চুপচাপ সবার সব দেখছিলাম। দাদা আমাকে অনেক ভালোবাসতো উনি চাইতেন আমি উকিল হই কিন্তু ডাক্তার হওয়া আমার স্বপ্ন ছিলো বিধায় আমাকে মেডিকেলে পড়িয়েছিলেন। আজকে উনি যদি বেচে থাকতেন তাহলে হয়তো আমাকে সাকিবের সাথে বিয়ে দিতেন না। কিন্তু আজকে কাউকেই বলতে পারছিনা। এদিকে মুটামুটি সাকিবের ফ্রেন্ড অফিসের কলিগস সবাইকেই জানানো হয়ে গেছে যে সে আমাকে বিয়ে করছে।
এনগেজমেন্ট হতে আর ৩দিন বাকি চাচু আমাকে ডেকে বলেন
– মা তোমার শরীর খারাপ? এমন লাগছে কেন আমার মেয়েটাকে? কিছুদিন ধরে?
-না, চাচু।
-চাচু না আমাকে আজকে থেকে বাবা ডাকবে।
এটা শুনে আমি কেদে উঠি।
চাচু আমাকে মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে আসলে?
তখন আমি চাচুকে বলি এই বিয়ে আমি করতে চাইনা।
উনি কিছুক্ষনের জন্য চুপ থাকেন
এরপর আমাকে বলেন
– করতে হবে না তাহলে, তুমি আমার মেয়ে আমার ভাইয়ের শেষ স্মৃতি। তোমার মন যদি সাকিবকে না চায় তাহলে জোর করে বিয়ে দিবো না আমরা।

সেদিন রাতেই চাচা সবাইকে বলে আমার মেয়ে এখম বিয়ে করতে চায় না,, তাই সাকিবের সাথে ওর বিয়ে টা হবেনা। তবে সাকিব বড় হয়ে গেছে ওর জন্য একটা ভালো মেয়ে দেখে আমরা তাড়াতাড়ি বিয়ে করিয়ে দিবো,,প্রথমে চাচি দ্বিধা করলেও পরে সম্মতি দিলো।
আমি খুব খুশি হয়ে গিয়েছিলাম, ভেবেছিলাম সব ঝামেলা শেষ।
বরাবর রাতে আমি কখনো একা ঘুমাতে পারিনা,,ভয় হয় দেখে সবসময় হয় দাদা দাদু নাহয় চাচা চাচির সাথে রাতে ঘুমাতাম। সেদিন দাদুর রাতে খুব জ্বর হয়েছিলো তাই চাচিও রাতে আমাদের বাসায় থেকে গিয়েছিলেন। কিন্তু মাঝ রাতে তার জ্বর এত বেড়ে যায়,, যে চাচি আমাকে বলে তোমার চাচুকে ডেকে নিয়ে আসো।
চাচির কাছ থেকে চাবি নিয়ে,, রাত তখন ২ঃ৪৫ এর মত ছিলো আমি চাচুর বাসায় ঢুকে তার রু রুমেএ…”

কথাটা বলতে রুহি যেন আঁতকে উঠল,, চোখে মুখে, স্পষ্ট ভয়ের ছাপ দেখতে পাচ্ছে ইরাদ।
রুহির হাত কাপছে…
ইরাদ নিজের অজান্তেই ওর হাত আলতোভাবে ধরে বলল
-কি হয়েছে তারপর??
-রুমে গিয়ে দেখি সাকিব চাচুকে বালিশ চাপা দিয়ে বলছে “আমি রুহিকে চাইসি আপনি দিলেন না,, এখন এই দুনিয়ায় আপনার আর দরকার নাই,, আমার চাওয়া পূরণ নাহলে সবার পরিনতি এমন হবে”
চোখেমুখে তার হিংস্রতা প্রকাশ পাচ্ছে। আমার চাচুর হাত পা তখন নিথর হয়ে পরে আছে আলরেডি।
আমি সামনে গিয়ে ওকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেই,, আর চাচুর পালস চেক করে দেখি উনি আর আমাদের মাঝে নেই। তখনই উঠে সাকিবের গালে একটা চড় লাগিয়ে কাদতে কাদতে বলি ” তুমি মানুষ নাকি পশু?? এটা কি করল তুমি?? আমার চাচু…”
“আমি তোকে ভালোবাসি তোর জন্য অমানুষ হইসি”
“আমি সবাইকে এখনি বলে দিবো, তোকে পুলিশে দিবো দ্বারা”

তখন ও সাথে সাথে আমার মুখ চেপে ধরে এরপর আমার মুখ বেধে টেনে হিচড়ে গাড়িতে করে কোথায় যেন নিয়ে যায়।

আমি সেন্সলেস হয়ে পড়ি এরপর যখন হুস ফিরিয়ে তাকিয়ে দেখি একটা রুমে আমি চেয়ারের সাথে বাধা অবস্থায় বন্দী। রুমটা একদম পর্দা দিয়ে বন্ধ,, কেউ নেই আশেপাশে। অনেক চিতকার করেও লাভ হলোনা।
একে তো নিজের চাচাকে হারানোর দুঃখ ২য়ত সেই খারাপ লোকটাকে শাস্তি দিতে না পারার দুঃখ।
অনেকক্ষণ পরে সেই জানোয়ার টা আসলো।
এতক্ষণে আমার শরীরে কোনো শক্তি আর নেই আমি আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছি নিজেকে চেয়ার থেকে মুক্ত করার কিন্তু পারিনি।
সামনে এসে সাকিব আমাকে বলে
“বাসায় মিথ্যা একটা চিঠি দেখিয়েছি আর বলেছি তুই বয়ফ্রেন্ড এর সাথে পালিয়ে গেছিস,, আর এটা পড়ে আব্বু মরে গেসে” সবাই তোকে আর দেখতেও চাচ্ছেনা। দে হেইট ইউ রুহি৷ আর তোর কথা কেউ মানবেনা কারণ আমাকে তুই বিয়ে করতে চাস না এইজন্য বানিয়ে কিছু বলতেই পারিস। এরকম অনেক হিন্ট আমি ২দিনে সবাইকে দিয়ে দিসি। ২দিন তোকে আমি প্যাথেটিন দিয়ে ফেলে রাখসিলাম। নাও মাই ওয়ার্ক ইস ডান। তাই এখন তোর একটাই ওয়ে আছে আমাকে বিয়ে করে চল বাসায় আমি বলবো তোকে বুঝিয়ে নিয়ে আসছি,, তোকে যেন মেনে নেয়।”
ও এটা বলার সাথে সাথে আমি ওর মুখে থুথু দেই এরপর ও আমাকে অনেক অনেক মারে।
এভাবে আরো এক দিন কেটে যায়।
আমি বুঝতে পারি আমার শরীরে আর কোনো শক্তি নেই। পরদিন একই সময় ও আবার আসে,, আজকে ওর চেহারায় হাসি।
রুমে ঢুকে আমাকে বলে,
“তুই এভাবে না হোক অন্যভাবেই নাহয় আমার হবি,, আজকে তোর সাথে বাসর করে ফেলবো তারপর বিয়ে না করে কই যাবি? আর বিয়ে না করলে নাই করলি আমার সমস্যা নাই”
কথাটা শুনে আমার কলিজার পানি শুকিয়ে যায় আর আমার মাথায় বুদ্ধি আসে কিন্তু গলা দিয়ে কথা বলার শক্তি নেই,, আমি ওকে আস্তে আস্তে বলি “দাড়াও আমি তোমাকে বিয়ে করবো”
এটা শুনে ও সাথে সাথে হাটু গেড়ে আমার সামনে এসে বসে
“কি বললে??”
“বিয়ে করবো তোমাকে এভাবে কিছু করোনা প্লিজ”
ওর চোখ চকচক করছে খুশিতে।
“কখন করবি?”
“আমাকে একটু সুস্থ হয়ে দাও তারপর”
ও খুশি হয়ে আমাকে খেতে দিলো,,আমি খেয়ে ওকে হাসি মুখে কিছু ভিটামিন এর নাম দিলাম আমাকে ওগুলো ও এনে দিলো।
আমি একটা জিনিস বুঝতে পেরেছিলাম ওকে আমার টেকনিকালি হ্যান্ডেল করতে হবে। তাই ঠিক মত খেয়ে আমি সুস্থ হই। এরপর ও বলে
চল বিয়ে করি সেদিন প্রথম আমি বেড় হই এতদিন পরে,, আশেপাশের সব অচেনা মানুষ, পরিবেশ।
কিছুক্ষণ পর দেখি কাজি অফিস,,
যখন ঢুকতে যাবো আমরা তখন দেখি রাস্তার পাশে ইট রাখা অনেক গুলো একটা হাতে তুলে সাহস করে নিয়ে সাকিবের মাথায় আঘাত করি।
এরপর ও সাথে সাথে অজ্ঞান হয়ে পরে যায়।
ওর পকেট থেকে হাতিয়ে যা কিছু টাকা পাই তা নিয়ে আমি পালিয়ে যাই।
সব কিছু দেখে আমি অবাক আমাকে শিফট করে রাজশাহী জেলাতে এনে ফেলেছে। সেসময় ঢাকার ট্রেন ছিলো,, আমি উঠে পরি কিছু না বুঝেই। কারণ সাকিব যদি এসে পরে তাহলে আমাকে ও শেষ করে দিবে।
তারপর সেদিন রাতেই ঢাকা আসি আমি। কিন্তু রাস্তায় খারাপ ছেলেরা আমাকে বিরক্ত করছিলো,, আমি এতটা সময় বৃষ্টি তে ভিজার ফলে জ্বর হয়ে যায়। আর তাদের ভয়ে দৌড়াতে থাকি,,তখনই আপনার বাসার দিকে চোখ পরে,, দেখি কোনো দাড়োয়ান ছিলো না। আমি বাচার জন্য ভিতরে ঢুকে পরি,, আর আপনি গেইট খুলতেই কান্না করতে করতে সেন্সলেস হয়ে যাই,, আমার জীবন টায় আমি শুধু হারিয়েই এসেছি সবকিছু তারপরেও মেনে নিয়েছিলাম,, আর যখন সাকিব আসে তখন আর ভালো কিছুই হয়নি আমার সাথে। আমি জানিনা আমার কি হবে এই জীবন এখন অর্থহীন।”

পড়ন্ত বিকেলের সোনালী রোদ জানালা দিয়ে রুহির ওপরে পরছে ও নিচের দিকে তাকিয়ে কথা গুলো বলছিলো,, কতটা অসহায় লাগছে ওকে,,মনের কষ্টে হু হু করে কাদে চলছে ও,,

আর রুহির জীবন বৃত্তান্ত শুনে ইরাদের কলিজায় লাগছে। মেয়েটার চোখের পানি ওর সহ্য হচ্ছেনা।
কেন যেন ইরাদের ওকে অনেক আপন লাগছে,, নিজে থেকেই ইরাদ রুহিকে জড়িয়ে ধরলো
-ভয় পেয়ো না, আমি আছি। আর কেউ কখনো তোমাকে কিচ্ছু করতে পারবে না কোনোদিন।
কান্না করোনা।
রুহি আস্থা পাচ্ছে, পরম আস্থা পাচ্ছে ইরাদের বুকে,,
চোখ বুঝে ও একটা শান্তি পাচ্ছে।
দুই জন আষ্ঠেপৃষ্ঠে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে,, রুহির ইচ্ছে করছে সারাজীবন এই বুকে থেকেই কাটিয়ে দিতে পারবে ও।

(চলবে..)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে