অদৃশ্য বাসর পর্ব ২

0
4196

অদৃশ্য বাসর পর্ব ২

: বুবু দেখো আমাদের লজিং মাস্টার , হুজুর , হি হি । শায়লা বলে।
: “হ হুজুর । টুপি দাড়ি ওয়ালা। কেবল জুব্বা জামা নাই। তুমি দেখো জানালার ফাঁক দিয়ে। “শাকিল বলতে থাকে।
“মাওলানা সাহেব । “ হি হি হি।

শায়লা, সায়মাকে তাদের নতুন লজিং মাস্টারের কথা বলছিলো। তাদের বাবা সদর বেপারী অত্র অঞ্চলের প্রভাবশালী লোক।মাঠ জুড়ে বিস্তর ধানী জমি ,গঞ্জে আরৎ আর মাছ ভর্তি ফিসারি, সম্পদের কোনো অভাব নাই। কিছু দিন হলো বাড়ির পাশে নিজ জমিতে মসজিদ মাদ্রাসা করেছেন। ভবিষ্যতের ব্যয় নির্বাহের জন্য মাসজিদ মাদ্রাসার নামে অনেক জমিও ওয়াক্ফ করে দিয়েছেন।

মসজিদ ওয়ালা বাড়ি হওয়ার কারণে এই বাড়ির নিয়ম কানুন অন্যান্য বাড়ি থেকে আলাদা। মেয়েদের কঠিন পর্দা-পুশিদা মেনে চলতে হয়। বাড়িতে দুটি আঙ্গিনা। ভিতর বাড়ির আঙ্গিনাকে বলে উঠান, সুপ্রশস্ত , চার পাশে গড়ে তুলা টিনের চৌচালা ঘর। বাহির বাড়ির আঙ্গিনাকে বলে বাইর বাড়ি। মূল ঘর থেকে পূর্বদিকে অনেক খানি খালি ভিটার পর গোয়াল ঘর । পাশেই বছরের কামলাদের থাকার ঘর । আর লজিং মাস্টার বা অতিথিদের জন্য চৌচালা ঘর বানানো হয়েছে বাইর বাড়ির উত্তর পাশে। বেপারী সাহেব সবসময় লজিং মাস্টার রাখেন বাচ্চাদেরকে নিবিড় ভাবে পড়া লেখা ও আদব কায়দা শিক্ষা দেয়ার জন্য। বাচ্চারা সকালে মক্তবে কুরআন আর দ্বীনিয়্যাত পড়ার পর স্কুলে যায়। এরপর লজিং মাস্টারের তত্বাবধানে বিকাল বেলা খেলা ধুলা করে আর সন্ধার পর বৈঠক খানায় পড়তে বসে। পড়া লেখা চলে রাত নয়টা দশটা পর্যন্ত।

নতুন লজিং মাস্টারের নাম নাসির উদ্দীন। বাড়ি ফুলপুর উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম হাতিবান্ধায়। দরিদ্র গৃহস্থের এক মাত্র পুত্র। পড়া লেখায় বেশ ভালো। গত বছর ফুলপুর ডিগ্রি কলেজ থেকে পরীক্ষা দিয়ে এইচ এস সিতে ভালো রেজাল্ট করে আনন্দ মোহন কলেজে ইংরেজীতে অনার্সে ভর্তি হয়েছে।দরিদ্র গৃহস্থ বাবার মেসে রেখে পড়ানোর ব্যয় ভার বহন করা সম্ভব নয় কারণে নাসিরের মেসে উঠার পরিবর্তে সদর বেপারী সাহেবের বাড়িতে লজিংয়ে আসতে হয়েছে।

সদর বেপারীর দুই মেয়ে এক ছেলে। বড় মেয়ে সায়মা, আগের সংসারের। পরের সংসারে শায়লা মেঝো আর সবার ছোট শাকিল।

সায়মা যেহেতু ক্লাস টেনে পড়ে যথেষ্ট বড় হয়ে গেছে তাই তাকে পর্দা করতে হচ্ছে । ফলে সে আর লজিং মাষ্টারের কাছে পড়তে আসে না। সায়মা প্রাইভেট পড়ে স্কুলের ম্যাডামের কাছে । লজিং মাস্টারের কাছে পড়ে শায়লা আর শাকিল।

শায়লা আর শাকিলের কাছে মাষ্টার মানুষ হুজুরের মত দাড়ি ওয়ালা হওয়াতে বিষ্ময়রে শেষ নেই । এজন্য প্রথম দেখাতেই দৌড়ে গিয়ে সায়মার কাছে বিষ্ময় প্রকাশ করছে। আর তিন ভাই বোন মিলে হাসাহাসি করছে।

সায়মা অত্যন্ত বুদ্ধিমতি মেয়ে। এই বাড়ির সব কিছু তার ইশারায় হয়ে থাকে। কদিন যেতে না যেতেই নাসির এই বিষয়টি পরিষ্কার ভাবে বুঝতে পেরেছে। শায়লা শাকিল যে সায়মার কথা ছাড়া কিছুই করে না সেটা টের পেয়েছিলো প্রথম দিনই। বাচ্চাদের জন্য নাসির বিস্কুট আর চকলেট এনেছিলো । শায়লার হাতে বিস্কুট দিতে গেলে সে নিচ্ছিলো না। বলছিলো বিস্কুট নিলে বুবু বকবে। তারা দুই ভাই বোন বুবু ছাড়া কিছ্ছু বুঝে না।

সদর বেপারী সায়মাকে সবার চেয়ে বেশি আদর করেন। মা মরা মেয়ে। সায়মার প্রসবের সময় শাহানার প্রচন্ড খিচুনী হয়েছিলো। তিনদিন একটানা খিচুনীর পর শাহানা মারা গিয়েছিল সদর বেপারীর কোলে মাথা রেখে। এরপর দীর্ঘ দিন বেপারীর কেটেছে সায়মাকে নিয়ে। মায়ের মত যত্ন আত্তি দিয়ে শিশু সায়মাকে লালনো পালন করে ভেবেছিলো জীবনে আর কোনো দিন বিয়ে করবে না।মাতৃহীনা দুঃখিনী মেয়েটিকে নিয়েই বাকি জীবন এভাবেই পার করে দিবে। কিন্তু দুনিয়ার নির্মম কঠিন নিয়মের কাছে শেষ পর্যন্ত সদর বেপারীকে হার মানতে হলো। শাহানা মারা যাওয়ার নয় বছরের মাথায় তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করতে বাধ্য হলেন ।

বুদ্ধি আর আন্তরিকতার গুনেই সায়মা এই বাড়ির রানী। যেদিন সায়মা বাড়িতে থাকে না সেদিন নাসির বুঝতে পারে সায়মা কতটুকু যত্নশীলা। সেদিন খুবই নিম্ন মানের তরকারী দিয়ে বৈঠক খানায় খাবার আসে। লজিং বাড়ি থেকে তিন বেলা সাদা মাটা খাবার আসাই নিয়ম। কিন্তু সায়মা সেই সাধারণ খাবারকেই একটু যত্ন করে অসাধারণ রূপে পরিবেশন করে। তেমন কিছু না থাকলে আলু, পুদিনা বা কালিজিরা ভর্তা করে পদ বৃদ্ধি করে।

বেপারী সাহেবের বাড়ি নানা রকম ফলফলাদি গাছে সবুজাভ। সারাবছর মৌসুমী ফল লেগেই থাকে। সায়মা সেগুলো যত্ন করে নাসিরের জন্য বৈঠক খানায় পাঠায়। অল্প খাওয়া ফলও থাকে। হয়ত কোনো একটি আম বরই বা জামে সায়মা একটু কামড় দিয়ে বুঝেছে যে ফলটি সুস্বাদু তখন সেটি না খেয়ে নাসিরের জন্য পাঠিয়ে দেয়।

নাসির কখনও সায়মাকে দেখেনি। সায়মা থাকে পর্দার আড়ালে। তারপরও নাসির সায়মাকে উপলব্ধি করতে পারে। জোরে জানালা আটকানো ,পর্দা টেনে দেয়া, দরজায় অহেতুক শব্দ করা বা জোরে দৌড়ে যাওয়ার পদধ্বনী সায়মার চঞ্চল উপস্থিতি নাসিরের হৃদয়ে নাড়া দেয়ে। নাসির সব বুঝেও না বুঝার ভান করে থাকে। কারণ বেপারী সাহেব বড় লোক। নাসির দরিদ্র কৃষকের সন্তান। তাছাড়া ছাত্রাবস্থায় মেয়েদের প্রতি দুর্বলতা হৃদয়ে স্থান দিতে নেই। মেয়ে লোক মায়াবী, কুহকিনী। মেয়ে মানুষের নেশা সর্বনাশী। সম্ভাবনাময় জীবনের সব রস কষ খেয়ে তুষ করে দেয়।

প্রথম প্রথম সায়মার কাছে নাসিরকে ভালো লাগতো না। জোয়ান একটি ছেলে বয়স্ক মুরুব্বী মানুষের মত মুখে এক জঙ্গল দাড়ি নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু সময় যাওয়ার সাথে সাথে লোকটার প্রতি এক প্রকারের মায়া অনুভব করতে থাকে। যে বয়সে ছেলেরা পড়া লেখার ফাঁকে দোকান পাটে বন্ধু বান্ধবদেরকে নিয়ে আড্ডায় মেতে থাকে সেই বয়সে নাসির তার রুটিনেই থাকে সীমাবদ্ধ। কলেজ ,পড়া ,মসজিদে নামাজ কালাম আর শায়লা শাকিলকে পড়ানো এর বাইরে সে বের হয় না। আশপাশের লোকজনও নাসিরের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। সব মিলিয়ে সায়মার কাছে দিনকে দিন ভালো লাগা গভীর হতে থাকে।

সদর বেপারী সাহেবও নাসিরের প্রতি মুগ্ধ। এই যুগে এমন ভালো ছেলেই হয় না। তিনি মনে মনে ভাবেন সায়মার সাথে নাসিরের সম্বন্ধ হলে মানাতো বেশ। চরিত্রবান ছেলে পাওয়াই তো কঠিন। কিন্তু নাসির যে দরিদ্র ঘরের সন্তান । সামাজিক অবস্থানও বেপারী সাহেবের সাথে সামঞ্জস্য পূর্ণ হয়না। তাছাড়া নাসির ছাত্র মানুষ। চাকরি বাকরি পেয়ে প্রতিষ্টিত হওয়া সুদূর পরাহত।

নাসির, বেপারী বাড়ি থেকে চলে গেছে চার বছর আগে। এই সময়ের মাঝে সায়মার বিয়ের জন্য অনেক বড় বড় ঘর থেকে একাধিক প্রস্তাব এসেছে। বেপারী সাহেব সায়মার কান পর্যন্ত কথা তুলেছেন। সায়মার মতামত জানতে চেয়েছেন। সায়মা কিছু বলে না। কেবল কান্না করে। প্রচুর কান্না। বেপারী বুঝতে পারেন নাসিরের প্রতি সায়মার টান। মা মরা মেয়ের জন্য বেপারী সব কিছু করতে রাজি। তিনি নতুন করে নাসিরের খুঁজ খবর নিতে থাকেন।

নাসির মাস্টার্স শেষ করার পর বুঝতে পারে চাকরির জগত কতটা নির্মম। টাকা আর চাচা মামা না থাকলে কেবল যোগ্যতা দিয়ে যে চাকরির রাজ্য জয় করা যায় না তা সে হারে হারে টের পায়। বেকার জীবনে সায়মাকে খুব মনে পড়ে। একটি চাকরির ব্যবস্থা হলেই বেপারী সাহেবের কাছে প্রস্তাব পাঠানোর স্বপ্ন দেখে সে। যদিও নাকি সায়মার সাথে তার এপর্যন্ত কোনো সাক্ষাত বা কথা বার্তা হয়নি। সায়মা কি আসলেও তাকে ভালোবাসে ? নাকি নাসিরই কেবল নিজের মনে তার প্রতি ভালোবাসা লালন করে যাচ্ছে ? বেপারী বাড়িতে লজিং থাকার সময় কেবল একদিনই নাসির তার টেবিলের উপর একটি চিরকুট পেয়েছিলো। তাতে লেখা ছিলো” পৃ্থিবী সুন্দর, পৃথিবীর মানুষ গুলো আরও সুন্দর। “
চিরকুটের নিচে লেখা ছিলো “ অসুন্দর সায়মা। যাকে কেউ পছন্দ করে না”

পরের ইতিহাস খুবই সংক্ষিপ্ত। বেপারী সাহেব আট লক্ষ টাকা ডোনেশনের ব্যবস্থা করে স্থানীয় চান্দুপুর কলেজে নাসিরের চাকরির ব্যবস্থা করেন।এমপিও ভূক্ত কলেজে ইংরেজীর প্রভাষক। এর মাস খানেক বাদেই নাসিরের সাথে সায়মার বিয়ের আকদ সম্পন্ন হয়। নাসিরের বাবা মা সায়মার রূপে মুগ্ধ। এই তল্লাটে এমন রূপবতি মেয়ে আর একটিও নাই। নাসির সায়মাকে প্রথম দেখে আংটি পড়ানোর সময়। মাথা ঘুরে যাওয়া টাইপ সুন্দরী মেয়ে। এ যেনো সাক্ষাত উপর ওয়ালার পক্ষ থেকে নাসিরের জন্য বিশেষ উপহার।

আকদ সম্পন্ন হওয়ার এক সপ্তাহ পর বিয়ের তারিখ ধার্য্য হয়। এই কদিন নাসিরের যেনো কাটেই না। সুযোগ পেলেই সায়মার সাথে কথা বলতে চেয়েছে। সায়মা বড় লাজুক। মোবাইল রিসিভ করে চুপ থাকে। নাসির সায়মাকে বলে তুমি মায়াবিনী। মায়ার জালে সেই যে আমাকে বন্দি করলে আমি আর জাল ভেদ করে বের হতে পারলাম না। এপর্যন্ত দয়াময়ের কাছে আমার সকল পূন্যের বিনিময়ে কেবল তোমাকেই চেয়েছি। তুমি আজ থেকে সায়মা নও । তুমি আমার মায়াবিনী। তোমাকে মায়াবিনী বলেই ডাকবো।

সায়মার বিয়েতে বেপারী সাহেব বিশাল আয়োজন করেন। একহাজার লোকের মেজবানী। জামাইয়ের জন্য দামি মটর বাইক। আর সায়মাকে মুড়িয়ে ছিলেন সোনার নানা পদের অলঙ্কারে। অবশ্য এই সব অলঙ্কার সায়মার মা শাহানাকে বিয়ে করার সময় বেপারী সাহেবের বাবা উপহার হিসাবে দিয়েছিলেন। শাহানা ইন্তিকাল করার পর এই গুলো তিনি যত্ন করে রেখে দিয়েছিলেন সায়মার জীবনের বিশেষ এই দিনটির জন্য।

মানুষ ভাবে এক রকম আর কপালে লেখা থাকে ভিন্ন রকম। বিধাতা মহা প্রজ্ঞাময়। তার কৌশল জানা কারও পক্ষেই সম্ভব না। তবে তিনি সবার জন্য যা করেন তা মঙ্গলের জন্যই করে থাকেন। সায়মার যেদিন বাসর হবে সেদিন সন্ধায় নাসির নতুন মটর সাইকেল নিয়ে শহরে গিয়ে ছিলো সায়মার জন্য বাসর রাতের বিশেষ উপহার খরিদ করতে। সেই যাত্রাই ছিলো নাসিরের শেষ যাত্রা। সুস্থ দেহে সে আর সায়মার কাছে ফিরে আসেনি। ট্রাকের সাথে মটর সাইকেল এক্সিডেন্ট করে সে স্পটেই নিহত হয়।

সায়মাকে লাশ দেখানো হয়নি। সংবাদ পাওয়ার পর সায়মা স্বাভাবিক ছিলো না। সে বার বার অজ্ঞান হচ্ছিলো।

আজ প্রায় এক বছর হতে চললো। সায়মা ভয়াবহ রকমের মানসিক বিকারগ্রস্ত। ডাক্তারের চিকিৎসায় কখনও কিছুটা নিয়ন্ত্রণ আসে কখনও নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। সমস্যা একটাই। ঘুমের চেষ্টা করলেই সায়মার সামনে রক্ত মাখা পাগড়ী পড়ে নাসির হাজির হয়। আর তখনই সায়মা চিৎকার দিয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে।

আবু জিয়াদ

সমাপ্ত

নোট : দুই পর্বে সমাপ্ত খুবই সাদামাটা গল্প। এরকম আবেগ পূর্ণ ঘটনার উপর ভিত্তি করে আবহমান কাল থেকে গড়ে উঠেছে অসংখ্য গল্প উপন্যাস ও ছায়াছবি। উপরে বর্ণিত গল্পটি বলেছেন আমার অপরিচিত একজন পাঠিকা। তার জীবনে এরকম একটি ঘটনা ঘটে । ফলে কিছুদিন পরপর তার মাথায় তীব্র ব্যথা-যন্ত্রণা দেখা দেয়। তখন তাকে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিতে হয়।

হতাশার বিষয় হলো গল্পটি আমার মত একজন অদক্ষ লেখকের হাতে অস্তিত্বে এসেছে। অথচ তাকে বারবার অনুরোধ করেছিলাম তিনি যেনো নাম করা কোনো দক্ষ শক্তিমান লেখককে গল্পটি লেখার জন্য অনুরোধ করেন।তাহলে হয়ত সাধারণ না থেকে গল্পটি অসাধারণ হয়ে পাঠকের মনে দাগ কাটতে সক্ষম হতো।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে