অতঃপর_তুমি পর্ব-২৪

0
4820

#অতঃপর_তুমি
#পর্ব-২৪
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি

২৫.
দরজা খুলে আমাকে দেখেই চম্পা একটা জোরে কান ফাটানো চিৎকার দিয়ে উঠলো।অভ্র চম্পাকে একটা ধমক দিলো।কিন্তু আজ চম্পার ধমকে কোনো ভ্রুক্ষেপ হলো বলে মনে হলো না।সে সেভাবেই দ্বিতীয় বার চিৎকার করে বলে উঠলো,
‘ও খালাম্মা!দেইখা যান আফামনির কি হইয়া গেছে।’

চম্পার উপর আমি কিঞ্চিত বিরক্ত বোধ করলাম।ও এখানে মাকে ডাকছে কেনো?অভ্র আমাকে কোলে করে দাঁড়িয়ে আছে,এই অবস্থায় শ্বাশুড়ির সামনে থাকাটা যথেষ্ঠ লজ্জাজনক।চম্পার চিৎকারের জোরে মা হন্তদন্ত হয়ে রুম থেকে বের হয়ে আসলেন।পেছন পেছন বাবাও চলে আসলেন।তারা আমাকে হাতে পায়ে ব্যান্ডেজ অবস্থায় দেখেই অস্থির হয়ে পড়লেন।
‘কি হয়েছে?’,’কিভাবে হয়েছে?’ প্রশ্ন করে করে অভ্রকে অতিষ্ট করে তুললেন।অভ্র আমাকে প্রথমে রুমে নিয়ে গিয়ে বিছানায় আধশোয়া করে রেখে তারপর সবার প্রশ্নের উত্তর দিলেন।বাবা আর মা দুজনেই খুব চিন্তায় পড়ে গেলো।আমি হাসিমুখে বললাম,
‘বাবা,এতো চিন্তা করবেন না।ডাক্তার বলেছে হাতে অতো বড় সমস্যা হয়নি।কিছুদিন পরই ঠিক হয়ে যাবে।’

কিছুক্ষণ পর বাবা মা চলে গেলে অভ্র দরজা লাগিয়ে আমার কাছে এসে বললেন,
‘অতো বড় সমস্যা না তাই না!হাত ভেঙে বসে আছো আর বলছো কোনো বড় সমস্যা না।ছোটো সমস্যা না বড় সমস্যা তা আমি বুঝবো তুমি এখন একদম রেস্টে থাকবে।আর এই চঞ্চলতাটা একটু কমাতে হবে।তোমার হাত পা দুইজায়গাতেই চোট লেগেছে অরু।’

উনি আমাকে বাচ্চাদের মতো করে বোঝাতে লাগলেন।আর আমিও বাচ্চাদের মতো মুখ করে তার নির্দেশনা শুনতে লাগলাম।উনাকে দেখতে খুবই ক্লান্ত লাগছে।এসি থাকা সত্ত্বেও কিভাবে ঘামছেন,বোঝাই যাচ্ছে প্রচুর ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন।আমার একবার মনে হলো তার মাথায় হাত দিয়ে তার এলোমেলো চুলগুলো ঠিক করে দেই।সব বলা শেষ হলে উনি হাত দিয়ে কপালের ঘাম মুছে বললেন,
‘বুঝেছো অরু।’

আমি বললাম,
‘অনেক বুঝেছি।এবার আপনি এসব ছেড়ে আমার পাশে একটু বসুন তো।’
অভ্র আমার পাশে বসে পড়লো।উনার শুকনো মুখটা দেখেই আমার খুব মায়া লাগলো।উনি আমার এতো খেয়াল রাখেন কিভাবে!মনে মনে বললাম,
‘অভ্র আপনি এতো ভালো কেনো?’
আমার চোখে পানি চলে আসলো।অভ্র বললো,
‘অরু,তোমার কিছু লাগবে?’
আমি মাথা ঝাঁকিয়ে হ্যাঁ বললাম।উনি বললেন,
‘একি!তোমার চোখে পানি কেনো?খুব বেশি ব্যাথা করছে?’
আমি মাথা ঝাঁকিয়ে না বললাম।আর বললাম,
‘একটা জিনিস লাগবে।’
উনি উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন,
‘কি?বলো।’
‘আমার সামনে যে আছে তার মুখে হাসি লাগবে।’
উনি মৃদু হেঁসে উঠলেন।আমার মাথায় আস্তে করে একটা বাড়ি দিয়ে বললেন,
‘পাগলী,হাত পা ভেঙে বসে থেকেও মাথা থেকে দুষ্টুমি যায় না।’

আমিও আহ্লাদি চোখে তাকিয়ে মুখ চেঁপে হাসলাম।অভ্র বললেন,’তোমার প্রেসক্রিপশনটা যেনো কোথায় রাখলাম!’
আমি অস্ফুট স্বরে বলতে লাগলাম,
‘আচ্ছা!আমি যদি আজ মারা যেতাম তাহলে আপনি কি করতেন?’

উনি প্রেসক্রিপশন খোঁজায় ব্যস্ত থাকায় আমার কথা শুনতে পেলেন না।আমিও আরেকবার জোরে কথাটি আর বললাম না।কেনো যেনো আমি মরে যেতে পারতাম এই মুহুর্তে এই মানুষটির সামনে থাকতে পারতাম না এই কথাটি আমার আর ভাবতে ইচ্ছে করছে না।আমার শুধু এই মুহুর্তে অভ্র’র দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে।শুধুই অভ্র’র দিকে।

২৬.
ওয়াশরুমের সামনে এসে অভ্র আমাকে কোল থেকে নামিয়ে দিলেন।আমি খোঁড়াতে খোঁড়াতে ভেতরে চলে গেলাম।উনি বাইরে দাঁড়িয়ে রইলেন।পা টেনে টেনে হাঁটতে আসলেই কষ্ট হচ্ছে।পায়ের ব্যাথায় আমি একটু উহ! করে উঠলাম।অভ্র বাইরে থেকে বললেন,
‘অরু,তুমি কি ঠিক আছো।’
আমি ভেতর থেকে বললাম,
‘হ্যাঁ।’
কিছুক্ষণ থেমে উনি বললেন,
‘অরু,তোমার সমস্যা হলে…আমি কি ভেতরে আসবো?’
আমি দ্রুত বলে উঠলাম,’না!’
অভ্র আর কিছু বললো না।কিছুক্ষণ পর আমি বের হলে আমাকে হাত ধরে আবার বিছানায় বসিয়ে দিলো।একটি পানির গ্লাস আর সাথে একগাদা ঔষধ নিয়ে এসে আমার সামনে বাড়িয়ে দিলো।আমি ঔষধ দেখে করুণ মুখে তার দিকে তাকালাম।ঔষধ খেতে খেতে আমি আসলেই ক্লান্ত।

‘এমন চেহারা বানিয়ে লাভ নেই অরু।একদিনও সম্পূর্ণ না যেতেই ঔষধ খেয়ে ক্লান্ত হলে তো চলবে না।’

‘আমি সত্যিই এতো বড় ঔষধ খেতে পারবো না।দুপুরে যেগুলো খেয়েছিলাম তবুও তা একটু ছোটো ছোটো ছিল।আর এখন দেখুন এই ঔষধগুলো কি বড় বড়।আমার গলায় আটকে যায়।সত্যি খুব খারাপ লাগে।’

আমার কথায় অভ্র একটা কাজ করলো।বড় বড় ঔষধগুলোকে ছোটো ছোটো কয়েক টুকরোয় ভেঙে দিলো।একটা ঔষধকেই চার ভাগ করলো।আমি একটা একটা করে ঔষধগুলো খেতে লাগলাম।এতে আমার বেশ সুবিধা হলো।আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম অভ্র’র এই কাজে।ঔষধ নিয়ে আজীবন সবাই শুধু আমাকে ধমকে ধামকে খাওয়ার জন্য জোর করে গেছে কিন্তু কেউ তো আজ অব্দি এভাবে আমার সমস্যা বুঝে কষ্ট করে ঔষধ ভেঙে ভেঙে খাওয়ায় নি!

আমার এই অসুস্থতার সময় জুড়ে উনি যে আমার ঠিক কতোটা যত্ন নিচ্ছেন তা আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না।আমাকে খাইয়ে দেওয়া,চুল বেঁধে দেওয়া,হাত ধরে ধরে হাঁটতে সাহায্য করা,অনেকক্ষণ সময় ধরে ধৈর্য্য নিয়ে প্রতিবেলায় ঔষধ ভেঙে দেওয়া,আমার খেয়াল রাখা সব….সব উনি একা হাতে করেন।অন্য কাউকে হাত লাগাতে দেন না।আমার থেকে একচুলও নড়েন না।অফিস বাদ দিয়ে সারাদিন আমার পাশে পাশে থাকেন।এমনকি এখন উনি আমার সাথে একই বিছানায় ঘুমান।যাতে ঘুমের মধ্যেও কাছে থেকে আমার খেয়াল রাখতে পারেন।আমার কিছু চাইতে যেন অসুবিধা না হয়।
স্ত্রীর অসুস্থতায় স্বামীর যত্ন নেওয়ার একটি আদর্শ নিদর্শন হচ্ছে অভ্র।একটা মেয়ের এতোটা যত্ন নিতে কোনো ছেলেকে আমি এখনও পর্যন্ত দেখিনি।মাঝে মাঝে তার যত্ন নেওয়া দেখে আমি থমকে যাই।একটা ছেলে দায়িত্বশীলতার জন্য যদি এতো কিছু করতে পারেন তবে সে কাউকে ভালোবাসলে ঠিক কি করবেন?
মাঝে মাঝে একটু লোভে পড়ে যাই আবার নিজেকে সংযত করে ফেলি।ইরা আপু হয়েছিলো সেই ভাগ্যবতী মেয়ে।কিন্তু আপু সেই ভাগ্য ধরে রাখতে পারেন নি।

গোসল সেরে বের হতেই দরজার সামনে প্রতিদিনের মতো অভ্রকে পেলাম।উনি হাত ধরে আমাকে বিছানায় বসিয়ে আমার হাত থেকে টাওয়েল নিয়ে আমার মাথা মুছতে লাগলেন।ভেজা এলোমেলো চুলের ফাঁকে ফাঁকে আমি তাকে দেখতে লাগলাম।তাকে দেখে মনে হচ্ছে তার সামনে এখন একটি বাচ্চা বসে আছে।দুষ্টু বাচ্চা।যাকে শাসন করে একটু পরপর দমিয়ে রাখতে হয়।
গোসলের পর আমি যতটুকু মাথা মুছে রাখি তাতে নাকি হয় না।চুল থেকে যে টপটপ করে পানি পড়ে তাতেই নাকি ঠান্ডা লেগে যাবে।মাঝে মাঝে উনি যে আমাকে এমন বাচ্চাদের মতো ট্রিট করে এতে আমার ভালোই লাগে,কেমন যেন প্রিন্সেস প্রিন্সেস ফিল হয়।আবার মাঝে মাঝে আমার কথার গুরুত্ব না দিলে রাগ লাগে আমি কি এতোটাও পিচ্চি নাকি!

আমি বিছানায় বালিশের সাথে ঠেস দিয়ে আয়েশ করে আধশোয়া হয়ে বসলাম।অভ্র আমার সামনে একটি থালায় করে আপেল নিয়ে ছুড়ি দিয়ে কাটতে বসে গেলো।আমি একটু না অনেকটুকু বিরক্তবোধ করলাম।জানি বলে কোনো লাভ নেই তাই কিছু বললাম না।এই কয়দিনে ফলমূল খেতে খেতে আমি অতিষ্ট।আমি এখন অনেকটাই ঠিক হয়েছি।আস্তে আস্তে নিজে হাঁটতে পারি।হাতও মোটামুটি নাড়াতে পারি তবুও অভ্র এসব অখাদ্য থেকে মুক্তি দিচ্ছে না।
আমি একবার তার হাতের দিকে আরেকবার তার মুখের দিকে তাকালাম।অভ্র একটি অ্যাশ কালারের টি শার্ট পড়ে গভীর মনোযোগ দিয়ে ফল কাটছে।তার মনোযোগ ভাঙতে আমি বললাম,
‘এই যে মশাই!আমি কিন্তু অর্ধেক আপেল খাবো।’
‘অর্ধেক খাবে না পুরোটা খাবে তা এই মশাই বুঝবে।’
আমি তার দিকে সরু চোখে তাকালাম।

‘চম্পাকে বলবেন নিচের বসার ঘরটা ভালো মতো ঝেড়ে মুছে সাজিয়ে রাখতে।’

‘হঠাৎ বসার ঘর নিয়ে পড়লে কেনো?আমাদের বসার ঘরতো সবসময় সাজানোই থাকে।’

‘উঁহু!আরো গোছগাছ রাখতে হবে।নিউজ রিপোর্টাররা আসবে,সুন্দর দেখাতে হবে না!’

উনি ভ্রু কুঁচকে বললেন,
‘নিউজ রিপোর্টাররা আসবে মানে?’

‘হুম,আসবেই তো।কয়দিন পরই নিউজ রিপোর্টাররা এ বাড়িতে এসে হট নিউজ বানিয়ে নেবে না যে অভ্র নামের একজন ভদ্রলোক কিভাবে তার স্ত্রীকে ফল খাইয়ে খাইয়ে ফলের বস্তা বানিয়ে ফেলেছে।’

আমার কথায় অভ্র আরো কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ জোরে জোরে হাসতে লাগলেন।

‘অরু,সিরিয়াসলি!তুমি এতো মজার মজার কথা বলো কি করে?এমন অবস্থার মধ্যেও কেউ এভাবে কথা বলতে পারে!’

আমি মুগ্ধ চোখে তার হাসি দেখতে লাগলাম।অট্টহাসি থেমে গেলেও ঠোঁটের কোণায় এখনো সেই হাসির ছটাক লেগে আছে।ভাবাবেগ প্রকাশে এখনো চোখগুলো চিকচিক করছে।সেই মনোমুগ্ধকর রূপ নিয়ে তিনি আবারো আপেলগুলোকে পিছ পিছ করতে লেগে গেলেন।

‘আপনাকে কি কেউ কখনো বলেছে আপনি ‘অতিরিক্ত’ শব্দটার চাইতেও একটু বেশি সুন্দর।’

আমার কথায় তিনি লাজুক ভঙ্গিতে মুচকি হেঁসে উঠলেন।আমি ভ্রু কুঁচকে গম্ভীর হওয়ার ভাণ ধরে বললাম,
‘এভাবে হাসবেন না।নয়তো একদিন দেখবেন মেয়েদের হার্ট এট্যাক হওয়ার অপরাধে আপনাকে পুলিশ ধরে জেলে ঢুকিয়ে দেবে।’

উনি আমার নাক ধরে মৃদু টেনে বললেন,
‘তুমি যে খুব দুষ্ট এটা কি তুমি জানো?’

আমি গভীর ভাবনায় পড়ে যাওয়ার ভঙ্গি করে পরক্ষনেই খিলখিল করে হেঁসে উঠলাম।উনিও হাসতে লাগলেন।আমি হাসি থামাতে থামাতে বললাম,
‘একটা কথা বলবো,আমি কিন্তু মোটেও এমন না।এতো বেশি কথা আমি এর আগে কারো সাথে কখনো বলেছি কিনা সন্দেহ।কিন্তু আপনি সামনে থাকলেই আমি শুধু বেশি বেশি কথা বলে ফেলি।আপনার সাথেই আমার শুধু দুষ্টুমি করতে ইচ্ছে হয়।’

‘এই গোলাম আপনার সব দুষ্টুমিই গ্রহণ করতে প্রস্তুত রাজকুমারী।’

অভ্র’র কথায় এবার আমি প্রচন্ড খিলখিল করে হেঁসে উঠলাম।একদম চোখে পানি এসে পড়ার মতো হাসি।আর এবার আমি না অভ্র আমার দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো।

চলবে,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে