অতঃপর_তুমি পর্ব-২০

0
5169

#অতঃপর_তুমি
#পর্ব-২০
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি

২২.
আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নেমেছে।রাতের নিস্তব্ধতা ছেদ করে কানে আসা বারিধারার ঝমঝম শব্দ মনের কোনো গোপন কুঠুরিতে যেনো অজানা সুর ছড়িয়ে দিচ্ছে।আমি বারান্দায় চলে এলাম।রাস্তায় জ্বলতে থাকা সোডিয়ামের আবছা আলো ঝরতে থাকা বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটাকে স্পষ্ট করে ফুটিয়ে তুলছে।বৃষ্টির পানি ছুঁতে হাত বাড়িয়ে দিলাম।মুহুর্তেই ঠান্ডা পানিতে হাত ভর্তি হয়ে বাইরে উপচে আমার সিলভার রঙের চুরিগুলো ভিজিয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগলো।বৃষ্টির মাঝে মাঝে শীতল হাওয়া বইছে।আর সাথে আকাশ কাঁপিয়ে তোলা কঠিন বজ্রপাতের শব্দ তো আছেই।

আমি হাত নামিয়ে পেছনে তাকালাম।অভ্র তুতুলকে বাথরুম থেকে বের করে নিয়ে এসে বিছানায় বসিয়ে দিলো।
তুতুল আজ ভীষণ জেদ চেপে বসেছে।আজকে তাকে মামা মামীর সাথে ঘুমানো চাই মানে চাই।আরিশা আপু আর দুলাভাই অনেক জোড়াজুড়ি করে,লোভ দেখিয়েও তুতুলের এই আব্দার ফেরাতে পারে নি।শেষমেশ ক্লান্ত হয়ে আমাদের কাছে ঘুমাতে দিতে বাধ্য হলেন।আমিও বলে দিলাম,আমার কাছে ঘুমাতে দিতে।আপা আর দুলাভাই আজই এসেছিলেন আর তুতুল এমন একটা জেদ শুরু করে দিলো।
তুতুলের পরনে একটা লাল গেঞ্জি আর নেভি ব্লু কালারের থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট।ঘুমানোর আগে পূর্ব প্রস্তুতি স্বরূপ মামার সাথে বাথরুমে গিয়ে কাজ সেরে এসে সে এখন গম্ভীর ভঙ্গিতে বসে মামার কথা শুনছে।তুতুলের গালগুলো এমনিতেই খুব সুন্দর ভরাট।আর যখন গম্ভীর হয় তখন ফর্সা গাল গুলো দেখতে বেশ লাগে।মনে হয় ইচ্ছে মতো ফোলা গাল গুলো টিপে দেই।
আমি কাছে গিয়ে শুনতে পেলাম উনি বলছেন,
‘তুতুল সোনা,তুমি এখানে অরুর সাথে ঘুমিয়ে পড়ো ঠিকাছে।রাত অনেক হয়েছে মামানিকে জ্বালাবে না।একদম দুষ্টমি করবে না।মনে থাকবে?’

তুতুল তার মিষ্টি স্বরে বলল,’আমি মামানির সাথে ঘুমাবো আর তুমি কোথায় ঘুমাবে মামা?’

তুতুলের প্রশ্নে অভ্র একটু ফিচকে হাসি দিয়ে বলল,
‘আমি এই সোফায় ঘুমাবো।বিছানাটা একটু ছোটো তো।তুমি আর অরু এখানে আরাম করে ঘুমাবে।’

‘এই বিছানা তো অনেক বড় মামা।মা বাবাও তো একসাথে ঘুমায় আমাকে নিয়ে এমনই এর সমান একটি বিছানায়।’

উনি একটু ঢোক গিলে ফ্যাকাসে হাসি দিয়ে বললেন,’থাক,আজকে তোমরা এখানে আরামে ঘুমাও আমি সোফায় ঘুমাবো।’

‘না।তুমি আমার আর মামানির সাথে এখানেই ঘুমাবে।’

অভ্র চোখ বড় বড় করে তুতুলের সামনে মুখ ফসকে বলে ফেললো,
‘অসম্ভব!’

একই অবস্থা আমারও।তুতুলের কথায় বেশ হকচকিয়ে গেছি।এই ছেলে বলে কি!
উনি আর আমি এক বিছানায় কি করে!ভাবতেই তো কেমন যেনো লাগছে।

তুতুল হাত ঝাঁকিয়ে জেদের ভঙ্গিতে বলল,
‘না তোমাকে এখানেই ঘুমাতে হবে।আমি তোমাদের দুজনের মাঝখানে ঘুমাবো।’

অভ্র বলল,’তুতুল সোনা,গুড বয়।জেদ করে না।তুমি মামানির সাথে এখানে চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়ো।তোমাকে আমি সকালে এত্তগুলা চকলেট দেবো।’

আমিও তাল মিলিয়ে বললাম,
‘হ্যাঁ বাবা।আমার সাথে এখন ঘুমাও।আমি তোমাকে অনেক সুন্দর সুন্দর গল্প শোনাবো।’

তুতুল এবার হাত পা ছুঁড়ে জেদ করে কান্না কান্না ভঙ্গিতে বলল,
‘অসম্ভব।আমি কিনারে শোবো না।আকাশ কেমন গুড়ুম গুড়ুম করছে।যদি ভেঙে পড়ে যায়।তখন?আমি তোমাদের মাঝখানে শোবো।শোবোই।’

তুতুল জোরে জোরে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো।আমি আর অভ্র দুজনেই নানা প্রয়াশে ও’র চিৎকার থামাতে লাগলাম।শেষমেশ বাধ্য হয়ে অভ্র বিছানায় একসাথে ঘুমাতে রাজী হয়ে গেলো।কারণ তুতুল যেভাবে চেচাঁমেচি শুরু করেছে তাতে দুলাভাই আর আরিশা আপু এই ছুটে এলো বলেই।তাছাড়াও তুতুল যদি একবার এই কথা বাইরে পাচার করে যে আমি আর অভ্র আলাদা ঘুমাই তখন সবার কাছে ব্যাপারটা কেমন হবে!

বিছানার ডান দিকে আমি তুতুলকে নিয়ে শুয়ে পড়লাম।অভ্র বেশ ইতস্তত করে বাম দিকে শুয়ে পড়লো।তুতুলের খুশি আর দেখে কে।মামা মামী দুজনকে দু’পাশে পেয়েছে এই খুশিতে সে হাত তালি দিতে লাগলো।বাইরে তুমুল ধারায় ঝড়তে থাকা বৃষ্টির ঝমঝম শব্দের সাথে সেই হাত তালির শব্দ শুনতে বেশ মিষ্টি লাগলো।

সকালের নরম আলো চোখে লাগতেই ঘুম ভেঙে গেলো।ঘুমে আচ্ছন্ন চোখ খোলার আগেই হাতে একটা উষ্ণ স্পর্শ অনুভব করলাম।চোখ মৃদু খুলতেই দেখলাম তুতুলের গায়ে রাখা আমার একটি হাতের উপর অভ্র ঘুমের ঘোরে তার হাত রেখেছে।আর আমিও ঐ হাতের একটি আঙুলকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে রেখেছি।উনার আর আমার দুজনের ঘুমই একসাথে ভেঙেছে।দুজনেই একসাথে হকচকিয়ে গিয়ে একজন আরেকজনের দিকে তাকালাম।এরপর দ্রুত গতিতে দুজনে হাত সরিয়ে নিলাম।দুজনেই বেশ লজ্জা পেয়ে গেলাম।আর এদিকে যার জন্য এই কান্ড টা ঘটলো সে নিষ্পাপ ভঙ্গিতে মাঝখানে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে।

২৩.
তুতুলরা চলে গেছে দু’দিন হলো।আজ দুপুরে আমাদের তুতুলদের বাসায় নিমন্ত্রণ।দুলাভাই আর আরিশা আপু অনেক করে বলে গেছেন অভ্রকে।আজ যদি আমাকে না নিয়ে যায় তাহলে দুলাভাইয়ের হাত থেকে অভ্র’র আর নিস্তার নেই।সে সাহস না করে তাই অভ্র অবশেষে সময় বের করে আমাকে নিয়ে যাচ্ছে।মা আর বাবা সকালেই চলে গেছেন অভ্র’র বড় মামার বাড়িতে।অভ্র’র বড় মামা ওমরাহ হজ্জ্ব করতে যাচ্ছেন।যাওয়ার আগে বাবা আর মা দেখা করতে গেছেন।

অভ্র তৈরি হয়ে নিচে হল রুমে বসে আছে আমার তৈরি হওয়ার অপেক্ষায়।কিন্তু আমি তৈরি হতে গিয়ে বেশ বিপত্তি বাঁধিয়ে ফেললাম।কিছুতেই আর তৈরি হতে পারছি না।অভ্র’র মা সকালে যাওয়ার আগে আমাকে একটা লাল রঙের শাড়ি দিয়ে গেছেন ও বাড়িতে পড়ে যাওয়ার জন্য।এবং খুব করে বলে গেছেন এই শাড়িটাই যেনো পড়ে যাই।হয়তো মা ভুলে গিয়েছিলেন আমি শাড়ি পড়তে পারি না।আর আমিও মা এতো করে এভাবে বলছে বিধায় আর কিছু বললাম না।ভেবেছিলাম একবার পড়ানো দেখেছি এখন নিজে নিজে পড়তে পারবো।কিন্তু এখন দেখছি কিছুতেই পারছি না।
নতুন শাড়ি,এখনো ভাঁজ ভাঙা হয়নি।তাই পড়তে আরো কসরত করতে হচ্ছে।কুচি টা তো ঠিক রাখতেই পারছি না।এদিকে ও বাড়ি যেতেও অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে।
কিছুক্ষণ পর অভ্র বিরক্ত মুখে এসে আমার পেছন থেকে জিজ্ঞাসা করলো,
‘তোমার হয়েছে?খুব দেরি হয়ে যাচ্ছে তো অরু।’

আমি শাড়ির অগোছালো কুঁচিগুলো দুই হাত মুঠ করে তার দিকে ঘুরে তাকালাম।পুরো শাড়িটা কোনোমতে শরীরে পেঁচিয়ে আছে।আঁচলের দিকটাও ফুলে পাহাড়ের মতো হয়ে আছে।আর আমি কাঁদো কাঁদো ভঙ্গিতে শাড়ি সামলাবার ব্যর্থ চেষ্টা করে অভ্র’র দিকে তাকিয়ে রইলাম।অভ্র আমার আপাদমস্তক একবার দেখে ক্লান্ত মুখে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
‘এতক্ষণে এই অবস্থা!’
‘আমি শাড়ি পরতে পারি না তো।’
‘খুব দেরি হয়ে যাচ্ছে অরু।একটা কাজ করো শাড়ি খুলে অন্য কিছু পড়ে নাও।’
‘না আর একটু দাঁড়ান।আমি শাড়ি পড়েই যাবো।’
‘পড়তে যখন পারছো না তখন এতো কষ্ট করে কি দরকার?’
‘না।আমি পড়বো।মা এতো করে বলেছে!আমি মাকে কষ্ট দিতে চাই না।’
‘তোমাকে দেখে তো মনে হচ্ছে না এই শাড়ি তুমি সারাদিনে পড়তে পারবে।কাউকে পড়িয়ে দিতে বলো।’
‘কাকে বলবো?বাসায় তো কেউ নেই।’
‘ও..।চম্পাকে বলো।’
‘চম্পা গ্রাম্য ভাবে পড়াতে পারে।এছাড়া আর কুঁচি দিয়ে পড়াতে পারে না।’

অভ্র আরো একবার বিরক্ত হয়ে হাতের রোলাক্স ঘড়িটির দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে আমার সামনে এসে আমার হাত থেকে শাড়ির কুঁচি গুলো নিয়ে ঠিক করতে লাগলো।আমি একটু অবাক হলাম।এখন উনি কি আমাকে শাড়ি পড়িয়ে দিবেন।অবশ্য আরিশা আপুর থেকে শুনেছিলাম অভ্র শাড়ি পড়াতে পারে।শাড়ির আঁচল টাচল সব ঠিক করে দিয়ে অভ্র আমার সামনে হাঁটু গেড়ে বসলো।
শাড়ির কুচির উপরিভাগ আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে খুব যত্ন করে নিচ দিয়ে কুঁচি গুলো ভাঁজ করতে লাগলো।কুঁচি গুলো ধরে রেখে আমি উনার দিকে তাকিয়ে রইলাম।অভ্র আজ একটা হালকা সবুজ রঙের শার্ট পড়েছে।শার্টের হাতাগুলো গুটিয়ে কুনুই পর্যন্ত ভাঁজ করে রেখেছেন।কালো প্যান্টের নিচে সাদা কেডস জুতো গুলো ফুটে উঠেছে।চুলগুলো খুব সুন্দর পরিপাটি করে রেখেছেন।গায়ের থেকে একটা মিষ্টি সুগন্ধি পারফিউমের ঘ্রাণ নাকে আসছে।সব মিলিয়ে উনাকে আজ দারুণ লাগছে।

অভ্র’র এতো যত্ন করে ভাঁজ করে দেওয়া কুঁচি গুলো আমি কোমড়ে গুজতে গিয়ে আরো একবার বিপত্তি বাঁধিয়ে ফেললাম।কুঁচি গুলো কোমড়ে গুজতে গিয়ে সব হাত ফসকে পড়ে গিয়ে পুনরায় এলোমেলো হয়ে পড়েছে।থুতনির কাছে দু হাত মুষ্ঠি করে নিয়ে আমি মুখে একটা নির্দোষ ভাব নিয়ে অভ্র’র দিকে তাকালাম।
চোখ বন্ধ করে একটি ক্লান্তিকর নিঃশ্বাস ছেড়ে কুঞ্চিত ভ্রু যুগল আরো একটু কুঞ্চিত করে অভ্র দ্রুতগতিতে আমার শাড়ির কুচি পুনরায় ঠিক করতে লাগলো।কুঁচি গুলো আগের মতো ঠিক হয়ে গেলে এবার আর আমার হাতে না দিয়ে তাড়াহুড়োয় উনি বেখেয়ালি ভাবে নিজেই আমার কোমড়ে গুঁজে ফেললেন।
অভ্র’র হাতের শীতল স্পর্শ আমার পেটে লাগতেই সর্বাঙ্গ আমার যেনো কেঁপে উঠলো।
পুরো স্থীর হয়ে গিয়ে একহাতে শক্ত করে শাড়ি খামছে ধরলাম।তাড়াহুড়োয় বেখেয়ালি ভাবে কাজটি করে ফেলে উনিও প্রচন্ড চমকে উঠেছেন।লজ্জায় মুখটা লাল হয়ে আছে।আমরা দুজনেই বেশ অপ্রতিভ হয়ে উঠলাম।কোনো কথা ছাড়াই কিছুক্ষণ সেখানে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম।

চলবে,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে