অতঃপর_তুমি পর্ব-১৮

0
5240

#অতঃপর_তুমি
#পর্ব-১৮
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি

অনেকক্ষণ পর্যন্ত বাকশূন্য হয়ে,চোখের পলক না ফেলে অভ্র’র সামনে হাতের পাত্রটি বাড়িয়ে রাখায় অভ্র ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকালো।আর তখনই মা এসে পেছন থেকে বলে উঠলো,
‘আরে বাবা তুমি!অরু,অভ্রকে এভাবে বাইরে দাঁড়া করিয়ে রেখেছিস কেনো?’

মায়ের কথায় আমার হুঁশ ফিরলো।মায়ের পেছনে দাঁড়িয়ে নিজেকে তার দৃষ্টি থেকে আড়াল করবার একটা ব্যর্থ চেষ্টা করলাম।অভ্র বলল,
‘আসসালামু আলাইকুম মা।’

মা বলল,’ওয়ালাইকুম আসসালাম বাবা।তুমি ভালো আছো।’
‘জ্বি মা ভালো আছি।আপনি ভালো আছেন?’
‘হ্যাঁ ভালো।তুমি ভেতরে আসো।’

উনি ভেতরে প্রবেশ করলেন।অভ্রকে এভাবে এতো ভোরে আসতে দেখে মা প্রচন্ড অবাক হয়েছেন ঠিকই কিন্তু অভ্র’র এ বাড়িতে আসার খুশিতে মার মুখ থেকে অবাক ভাবটা ছাপিয়ে শুধু খুশিটাই দেখা যাচ্ছে।মা ভেতরে গিয়ে বাবাকে ডেকে নিয়ে আসলেন।পেছন পেছন মামাও চলে আসলো।
সকাল সকাল বাড়িতে একটা হট্টগোল শুরু হয়ে গেলো।সবাই অভ্রকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।বাবা মা অসম্ভব খুশি হয়েছে অভ্রকে পেয়ে।পারলে যেনো মাথায় তুলে রাখে।বাবা তাড়াতাড়ি বাজার করতে বেড়িয়ে পরলেন আর মা রান্নাঘরে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন অভ্র’র জন্য নাস্তা বানাতে।

আমি তখন থেকেই দূরে গুটিশুটি মেরে দাঁড়িয়ে সবার কান্ড দেখে যাচ্ছি।এখান থেকে নড়তে পারছি না শুধু মায়ের জন্য।
এখন পর্যন্ত তার সাথে আমার কোনো কথা হয়নি।শুধু এক দুবার চোখে চোখ পড়ে গেছে।যতবারই পড়েছে আমি দ্রুত দৃষ্টি সরিয়ে ফেলেছি।
অভ্র এখন সোফায় বসে ছোটো মামার সাথে কথা বলছে আর মাঝে মাঝে আড়চোখে আমার দিকে তাকাচ্ছে।ছোটো মামার জন্যই অভ্র এখনো আমার সাথে কোনো কথা বলতে পারছে না।মামা বসে বসে অভ্র’র সামনে বকবক করেই যাচ্ছে।
ছোটো মামা গভীর আগ্রহের সাথে অভ্রকে তার ঢাকা শহরের ভিক্ষুকদের আম গাছের চারা বিলানোর প্লানটা শোনাতে লাগলো।অভ্রকে দেখে মনে হচ্ছে উনিও খুব মনোযোগ দিয়ে মামার কথা শুনছেন।
‘বলো তো অভ্র ব্যাপারটা বেশ জমজমাট হবে না?’

অভ্র বলল,
‘দারুন হবে মামা।এরকম প্রজেক্ট আজ অব্দি কেউ হাতে নেয় নি।আপনার মতো জ্ঞানী লোক দ্বারাই শুধু এই কাজ সম্ভব।’

অভ্র’র দেওয়া পামে মামা ফুলে ফেঁপে একাকার হয়ে যেতে লাগলেন।মনে হচ্ছে এক্ষুণি আকাশে উড়ে গেলো বলেই।অভ্র আবার খুব ভাবনার দৃষ্টিতে বলল,
‘তবে মামা আমার মাথায় আরো একটি ধারণা ঘুরছে।’

মামা প্রচন্ড আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলো,’কি?’

‘দেখুন মামা,আমের পরিবর্তে যদি কাঁঠাল চারা দেওয়া হয় তবে ব্যাপারটা আরো বেশি লাভবান হবে।আমে শুধুমাত্র একটি বিচি থাকে।তার মানে একজন ভিক্ষুক একটি আম খেয়ে শুধু একটিই আম গাছের চারা পাবে।এদিকথেকে একটা কাঁঠালে হিসাব করুন তো কতগুলো বিচি থাকে।একজন ভিক্ষুক একটি কাঁঠাল খেয়ে মোট কতগুলো চারা হাতে পাবে।’

মামা কিছুক্ষণ গভীর মনোযোগের সাথে অভ্র’র কথা শুনে খুশিতে আপ্লুত হয়ে হাতে একটা জোরে বারি দিয়ে বললেন,
‘এক্সিলেন্ট আইডিয়া অভ্র।তোমার মাথায় বুদ্ধি আছে।কি দারুন একটা আইডিয়া দিলে!আমি একটা কাজ করি এক্ষুণি একটা খাতা কলম এনে এই আইডিয়াটা লিখে রাখি।’

মামা উৎফুল্ল হয়ে চলে যেতেই অভ্র বুকে হাত দিয়ে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে একটু মুচকি হাসলেন।মামাকে কি সুন্দর বোকা বানিয়ে মাথায় আরো একটা পাগলামো ঢুকিয়ে দিলেন আমি শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম।
অভ্র উঠে দাঁড়ালো।তার সম্মুখ থেকে সরে আসার জন্য পেছনে ঘুরতেই উনি ডেকে উঠলেন,
‘অরু।’
আমি থমকে গেলাম।উনি বললেন,
‘তোমার ফোন বন্ধ কেনো?আমি কতবার ফোন দিয়েছি।’
‘অন করার প্রয়োজন মনে করিনি তাই করিনি।’
‘তুমি কি এখনও আমার উপর রেগে আছো?’
‘রাগ করার জন্য অধিকার লাগে।আপনার উপর রাগ করার আমি কে?’

‘অরু…..

অভ্র আরো কিছু বলতে চাইছিলো কিন্তু হঠাৎ বাবা বাজার থেকে এসে পড়ায় চুপ হয়ে গেলো।আমিও এই সুযোগে সেখান থেকে সরে আসতে চাইলাম।মা রান্নাঘর থেকে এসে অভ্রকে চা দিয়ে জিজ্ঞাসা করলো,’বাবা এতো সকাল সকাল হঠাৎ তুমি এলে সব ঠিক আছে তো?’
অভ্র বললো,
‘জ্বি মা সব ঠিক আছে।আমি অরুকে নিতে এসেছি।’

উনার কথা শুনে আমি থমকে দাঁড়ালাম।
মা বলল,
‘আর কটা দিন এখানে থাক না।’

‘না মা।এখন আমার সাথে যাক। পরে না হয় আরেক সময় এসে থাকবে।’

মা আর কোনো জোর করলো না।অভ্র আমাকে নিতে এসেছে শুনে বরং মা খুশিই হয়েছেন।মনে যেই খুত খুত টা ছিলো আমাদের মধ্যে ঝামেলা হলো কিনা তা দূর হয়েছে।

রুমে অন্যমনষ্ক হয়ে বসে আছি এমন সময় মা খুন্তি হাতে তড়িঘড়ি করে এসে বলল,
‘কিরে অরু তোর কি কোনো আক্কেল জ্ঞান নেই!জামাই ওখানে একা বসে আছে আর তুই এখানে কি করছিস?আর একটা ভালো জামা পড়তে পারছিস না!কি একটা এক রঙা পুরো সাদা রঙের সেলোয়ার কামিজ পড়ে রয়েছিস।’

‘কেনো মা,এই জামাটায় কি খারাপ?আমাকে দেখতে কি খারাপ লাগছে?’

‘খারাপ লাগবে কেনো?আমার মেয়েটা যা পড়ে তাতেই মানায়।’

রান্নাঘর থেকে প্রেসার কুকারের সিটি বেঁজে উঠায় মা জলদি রান্নাঘরে চলে গেলেন।মা যাওয়ার কিছুক্ষণ পরই অভ্র আমার রুমে আসলো।উনাকে দেখে আমি বিছানা ছেড়ে উল্টো দিকে মুখ করে দাঁড়ালাম।কিচ্ছু বললাম না,একদম চুপ করে রইলাম।উনিও নিশ্চুপ হয়ে আছেন।দুজনের মধ্যে কিছুক্ষণ নিরবতা শেষে অভ্র বলে উঠলো,
‘কিছু বলবে না।’

‘নয়টার আগে আপনাকে অফিস যেতে হয়।তাই নাস্তা করে চলে যাবেন।’

‘তুমি যাবে না?’

তার প্রশ্নের উত্তরে আমি মুখ শক্ত করে চুপ করে রইলাম।অভ্র একটু মুচকি হেঁসে ধীর পায়ে আমার পেছনে এসে দাঁড়ালো।আমার কানের কাছে তার মুখটা বাড়িয়ে মৃদু স্বরে বলল,
‘ম্যাম,কথা রাখতে না পারলে কিন্তু কথা না দেওয়াই ভালো।আপনি কিন্তু বলেছিলেন আমার অনুমতি ছাড়া আপনি কখনো আমাকে ছেড়ে যাবেন না।’

অভ্র’র কথা শুনে আমি ঝট করে উনার দিকে ঘুরে দাঁড়ালাম।উনার মুখে এখনও সেই দুষ্ট হাসি বিরাজমান।আমি আর কোনো কথা না বলে তৎক্ষণাৎ জামা পাল্টে, হ্যান্ড ব্যাগ গুছিয়ে তৈরি হয়ে এসে বললাম,’চলুন।’

অভ্র আমার বিছানায় আয়েশ করে মাথায় হাত দিয়ে আধশোয়া হয়ে বসে বলল,
‘এখনই যাবো নাকি!প্রথমবার শ্বশুরবাড়ি এসেছি একটু পেট ভরে খেয়ে দেয়ে যাবো না।’
উনার মুখের শয়তানি হাসি দেখে রাগে আমার শরীর জ্বলে উঠলো।

অভ্র শেষমেশ খাওয়া দাওয়া করে রিলাক্স করেই গেলেন।গাড়িতে করে যাওয়ার সময় আমি একবারো তার দিকে তাকালাম না।রাগটা আমার এখনো কমে নি।ভার্সিটির রাস্তার কাছাকাছি আসতেই আমি বললাম,
‘গাড়ি থামান।’
‘কেনো?’
‘আমি ক্লাস করবো।’
‘আজ না করলে হয় না?’
‘না হয় না।আজ আমার ইম্পর্টেন্ট ক্লাস আছে।কাল করি নি আজ করতেই হবে।’

অভ্র গাড়ি থামিয়ে বের হলো।আমার দরজা খোলার আগেই এসে নিজে দরজা খুলে দিলো।আমি বের হয়েই জোরে জোরে হেঁটে যাচ্ছিলাম।হঠাৎ পাশ দিয়ে দ্রুত গতিতে একটা বাইক চলে যাওয়ার আগেই অভ্র আমার হাত ধরে টেনে পেছনে নিয়ে আসলো।

‘এভাবে কেউ হাঁটে!আরেকটু হলেই তো বাইকের সাথে লেগে যেতো।’

অভ্র’র কথা শেষ হতেই সেখানে জোবায়ের স্যার এসে পড়লেন।তিনি ভার্সিটির গেট দিয়ে ভেতরেই যাচ্ছিলেন অভ্রকে দেখে আমাদের দিকে আসলেন।স্যার খুশি হয়ে বললেন,
‘অভ্র!’

অভ্র স্যারের দিকে তাকিয়ে হেঁসে বলল,
‘আসসালামু আলাইকুম স্যার।ভালো আছেন?’

স্যার সালামের উত্তর নিয়ে বললেন,’হ্যাঁ,ভালো আছি।কতদিন পর দেখলাম তোমাকে!’

কথাটা বলে এবার স্যার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘তুমি বায়োলজি ডিপার্টমেন্টের রোল নাম্বার থার্টি টু না?’

আমি দ্রুত মাথা ঝাঁকিয়ে বললাম,’জ্বি স্যার।’

জোবায়ের স্যার এবার আমাদের দুজনের ধরে থাকা হাতের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালেন।আমারও হুঁশ হলো কথায় কথায় আমি তো অভ্র’র হাত ছাড়তেই ভুলে গেছি।ঝট করে হাতটা ছাড়িয়ে নিতে চাইলাম।কিন্তু উনি ছাড়লেন না।স্যারের দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘স্যার,আমার স্ত্রী।’

আমি প্রচন্ড চমকে উঠে অভ্র’র মুখের দিকে তাকালাম।

চলবে,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে