অতঃপর_তুমি পর্ব-১৬

0
5164

#অতঃপর_তুমি
#পর্ব-১৬
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি

২০.
‘অরু,আমি তোমাকে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট দিয়েছি।একসেপ্ট করো।’

‘তুমি আমার ফেসবুক আইডি পেলে কিভাবে?’

‘শাওনের কাছে কোনো কিছুই অসাধ্য নয়।’

আমি কপাল ভাঁজ করে কোকাকোলার বোতলে থাকা সিপ এ চুমুক দিলাম।নির্ঘাত শাওন আমার কোনো বান্ধবীকে পাম দিয়ে আমার আইডি আদায় করে নিয়েছে।

‘কি হলো অরু,একসেপ্ট করছো না কেনো?’

‘শাওন,আমার ফোনে না আসলে কেনো এমবি নেই।নেট অন করবো কিভাবে?’

‘আরে এই ব্যাপার।তোমার ফোন নাম্বার বলো তো আমি তোমাকে ইন্টারনেট প্যাক কিনে দিচ্ছি।’

আমি মনে মনে বললাম,’বাহ!এক ঢিলে দুই পাখি মারা।আইডির সাথে সাথে আবার ফোন নাম্বারটাও পেতে চাইছে।

‘কি হলো অরু?বলো না।’

‘আমার ক্লাস শুরু হয়ে যাচ্ছে।শাওন তোমার সাথে পরে কথা বলছি ঠিক আছে।’

‘ক্লাস শুরু কি বলো?আজকে তো আর তোমার কোনো ক্লাসই নেই!অরু…অরু’

আমি শাওনের কথা আর কানে নিলাম না।দ্রুত ব্যাগ কাঁধে নিয়ে ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে এলাম।
শাওনের বিরক্তি করার সীমা দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে।আমার খুবই বিরক্ত লাগে।এর থেকে পিছু ছাড়ানোর কোনো উপায় খুঁজতে হবে।আচ্ছা!আমি কি বলে দিবো আমি বিবাহিত।বিবাহিত শুনলে নিশ্চয়ই আর আমার পিছনে পড়ে থাকবে না।এই ভালো!

শাওনকে বলবো বলেই পিছনে ঘুরতেই দেখলাম শাওন আমার পিছনে এসে অলরেডি দাঁড়িয়েও পড়েছে।

‘উফ অরু!কখন থেকে ডাকছি জানো?আজকে তুমি ফ্রি থাকলে চলো না কোথাও ঘুরে আসি।বড্ড বোরিং লাগছে।’

‘শাওন শোনো,তোমাকে একটা কথা আমার বলা হয়নি।এখন বলতে চাই।’

শাওন উৎফুল্ল হয়ে বলল,’অরু এক মিনিট,প্লিজ এক মিনিট দাও।আমি যাবো আর আসবো।’

শাওন আমার হাতে ও’র হাতের একটা বই ধরিয়ে দিয়ে হুট করে সেখান থেকে চলে গেলো।অরু,অরু করে আমার মাথাটাই ধরিয়ে দিয়েছে।আমি একটু বিরক্তিকর নিঃশ্বাস ছেড়ে হাতের ঘড়িটার দিকে তাকাতেই পিছন থেকে একটি চিরচেনা মিষ্টি স্বর ডেকে উঠলো,’অরু।’

আমি চমকে উঠে পেছনে ঘুরলাম।অভ্র একটি চকলেট কালারের শার্ট গায়ে দাঁড়িয়ে আছে।শার্টের হাতা কনুই পর্যন্ত ভাঁজ করে রাখা।ফর্সা হাতে ফুটে আছে কালো ব্রান্ডেড ঘড়িটি।হাত দুটো সাদা জিন্স প্যান্টের পকেটে ঢুকানো।পায়ে বাদামি রঙের জুতো।গলার কাছটায় একটা অ্যাশ রঙের টাই একটু ঢিলে করে রাখা।আর মুখে সেই মন মুগ্ধ করা মিষ্টি হাসি।তাকে দেখেই মুহুর্তের মধ্যে সব বিরক্তগুলো কোথাও যেনো উধাও হয়ে গেলো।নিজের অজান্তেই ঠোঁটের কোনায় হাসি ফুটে উঠলো।উনি কাছে এসে তার হাত বাড়িয়ে বললেন,
‘অরু,এটা কি?’

আমি তার হাতের দিকে দৃষ্টি নিয়ে দেখলাম,
তার হাতে একটা ইয়া বড় ট্যাবলেট।কিছুদিন আগে গ্যাস্টিকের ব্যাথার জন্য ডাক্তার আমাকে খেতে দিয়েছিলো।এই নিয়ে অভ্র কম হৈচৈ করেনি।প্রথমেই সব দোষ আমার ফুচকার উপর লাগিয়ে দিলো।তারপর ঘোষণা দিলো আজ থেকে আমার ফুচকা খাওয়া বন্ধ।আমি চরম বিরোধিতা করে তার এই ঘোষণা বাতিল করালাম।তারপরও উনি আমার উপর শকুনের মতো দৃষ্টি দিয়ে রাখলেন।কারণ ঔষধটা আমি নিয়মিত খাচ্ছি না।সুযোগ পেলেই ফাঁকি দেই।কি করবো এতো বড় ট্যাবলেট আমার গলা দিয়েই নামে না।মুখ পুরো তেতো হয়ে যায়।অভ্র আবারো হাতটা ঝাঁকিয়ে বলল,
‘কি হলো বলো এটা কি?’

‘ঔষধ।’

‘সেটা আমিও জানি ঔষধ।এখন বলো এই ঔষধটা আমার কাছে এলো কি করে?’

আমি একটা ঢোক গিলে আমতা আমতা করতে লাগলাম।সকালে ঔষধটা আমার হাতে দেওয়ার পর তিনি সামনে থেকে সরে যাওয়ায় আমি জানালা দিয়ে ঢিল দিয়ে নিচে ফেলে দিয়েছিলাম।তিনি কোনোভাবে সেটা পেয়ে বসলেন না তো!যদি পেয়ে থাকেন তবে অরু,আজকে তুই শেষ!নিজেকে শেষ রক্ষা করার জন্য বললাম,
‘আপনি প্যাকেট থেকে ছিঁড়ে নিয়ে এসেছেন।’

‘আমি প্যাকেট থেকে ছিঁড়ে নিয়ে এসেছি নাকি তুমি জানালা দিয়ে ঢিল মেরে আমার গাড়িতে ফেলেছো?এসব কি অরু!তুমি কিন্তু এতোটাও ছোটো না।বোঝো না ঔষধ খাওয়াটা জরুরি।’

‘আজকে তো একদমই ব্যাথা নেই।বুকে ব্যাথা করেছিলো সেই পরশু দিন রাতে।এখনও এই ঔষধ খাওয়ার কোনো মানে আছে!’

‘আছে।ডাক্তার যখন বলেছে তখন খেতে হবে।আজই লাস্ট।এরপর যদি আর ওষুধ নিয়ে এমন করেছো তাহলে একদম মার খাবা।’

আমি মুখ ফুলিয়ে বললাম,
‘আপনি কি আমাকে এই ওষুধ দেখাতেই এসেছেন?’

অভ্র শার্টের হাতায় মুখ মুছে বলল,
‘হ্যাঁ।’
আমি চোখ বড় বড় করে অবাক হয়ে বললাম,
‘আপনি সত্যিই এই ওষুধ দেখাতে সেই অফিস থেকে চলে এসেছেন।’

‘হ্যাঁ বাবা!হ্যাঁ,তুমি যদি স্বাস্থ্য নিয়ে এভাবে অনিয়ম করো তবে তো আমাকে এভাবে আসতেই হবে।’

আমি মনে মনে মৃদু হাসলাম।উনি আমার এতোটা খেয়াল রাখেন কেনো?তার বিরক্ত হওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেঁসে বললাম,

‘সবদিকেরই যেমন একটি ভালো দিক থাকে তেমনই আমার ওষুধ না খাওয়ারও একটি ভালো দিক হয়ে গেলো।আপনি এখানে চলে এসেছেন, ভালো হয়েছে।আমার না খুব আইসক্রিম খেতে ইচ্ছে করছে।চলুন না আইসক্রিম খেয়ে আসি।’

উনি পুনরায় ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকালেন।

আমার পেছনে শাওন এসে বলল,
‘অরু বলো।’
ইতিমধ্যে ওয়াশরুমে গিয়ে শাওন ফ্রেশ হয়ে,চুলে জেল মাখিয়ে গায়ে এক গাঁদা পারফিউম লাগিয়ে এসেছে।ভুলক্রমে ও এটা ভাবেনি তো আমি ওঁকে প্রপোজ করতে যাচ্ছি!
আর সেই সৌজন্যেই শাওন এভাবে ফিট হয়ে এসেছে যাতে সঙ্গে সঙ্গে সেলফি তুলে ফেসবুকে আপলোড করে রিলেশন স্ট্যাটাস লিখতে পারে

শাওনের কথার কোনো উত্তর না দিয়ে আমি ও’র হাতে বইটা দিয়ে দিলাম
শাওন হঠাৎ সামনে তাকিয়ে বলে উঠলো,
‘আরে অভ্র ভাইয়া!আসসালামু আলাইকুম।

শাওনের কথায় আমি চমকে গেলাম।
শাওন অভ্রকে কি করে চিনে?আমাকে চরম চমকে দিয়ে অভ্রও বলে উঠলো,
‘ওয়া আলাইকুম আসসালাম।ভালো আছো শাওন?’

‘জ্বি ভাইয়া আমি ভালো আছি।আপনি কেমন আছেন?

‘এই তো ভালো।মাহবুবের কি খবর?

‘ভাইয়া তো এখন দুবাই আছে।’

‘ও হ্যাঁ।শুনেছিলাম।মাহবুবের নতুন নাম্বারটা দিয়ো তো।অনেকদিন কথা হয় না।’

তাদের দুজনের কথায় যা বুঝতে পারলাম শাওনের বড় ভাই অভ্র’র বন্ধু।সেই সূত্রেই শাওন অভ্রকে চিনে।অভ্র হঠাৎ শাওনকে জিজ্ঞাসা করলো,
‘তোমরা দুজন কি ক্লাসমেট?’

শাওন বলল,
‘জ্বি ভাইয়া।অরুর সাথে আমার একটা ক্লাস সেম।কিন্তু তবুও অরুর সাথে আমার খুব ভালো সম্পর্ক।’

শাওনকে থামাতে আমি অভ্রকে জিজ্ঞাসা করলাম,
‘আপনি বাসায় কখন আসবেন?’

অভ্র কিছু বলার আগেই শাওন চমকে উঠে অভ্রকে জিজ্ঞাসা করলো,
‘ভাইয়া আপনি কি অরুকে চিনেন?’

শাওনের প্রশ্নের উত্তর আমি দেওয়ার জন্য মুখ খুলতেই অভ্র একটু শুকনো মুখে কিছুক্ষণ আমতা আমতা করে বলল,
‘হ্যাঁ…আমার পরিচিত।’

তার কথা শুনে আমি প্রচন্ড পরিমাণে অবাক হলাম।কিছুক্ষণ থ মেরে শুধু তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম।তারপর শক্ত মুখে বললাম,
‘না,উনাকে আমি চিনি না।একদম চিনি না।’

কাঁধে ঝুলানো হ্যান্ডব্যাগের ফিতা শক্ত করে খামছে ধরে দ্রুত গতিতে সেখান থেকে রাস্তার দিকে চলে আসলাম।অভ্রও আমার পিছু পিছু নাম ধরে ডাকতে ডাকতে ছুটে এলো।শাওন প্রচন্ড অবাক হয়ে আমাদের দুজনের দিকে তাকিয়ে রইলো।

অভ্র বারবার আমার নাম ধরে ডেকে হাত ধরে থামাতে চাইলো কিন্তু আমি তার হাত ছিটকে সরিয়ে দিয়ে আবার খুব জোরে জোরে হাঁটা শুরু করলাম।নিজেকে আজ খুব তুচ্ছ আর মূল্যহীন মনে হচ্ছে।এই নিয়ে দ্বিতীয় বার তিনি এই কাজটা করলেন।অভ্র আমার হাত শক্ত করে ধরে তার দিকে ঘুরিয়ে বললেন,
‘অরু,তুমি এমন করছো কেনো?’
‘আমি কেনো কেমন করছি তা নিয়ে আপনাকে মাথা ঘামাতে হবে না।আপনি আমার হাত ছাড়ুন।কেউ যদি আবার এভাবে দেখে ফেলে মনে করে বসে আমি আপনার কিছু হই!তখন তো সাংঘাতিক ব্যাপার হয়ে যাবে।’

‘অরু,ব্যাপারটা এমন নয়।’

‘তাহলে ব্যাপারটা কেমন অভ্র?আপনি আমাকে বোঝান।সবার সামনে আমাকে স্ত্রী বলে পরিচয় দিতে আপনার বাঁধে।আমার সামনেই কি সুন্দর তা প্রত্যাখান করে দেন।কখনো পরিচিত আবার কখনো কেউ না।আমার কি কোনো অস্তিত্ব নেই?নাকি আমি এতটাই ফালতু?’

অরু,এভাবে বলছো কেনো?আমি শাওনকে এই কথাটা এ কারণে বললাম কারণ শাওনকে দেখে বুঝতে পেরেছিলাম শাওন তোমাকে পছন্দ করে।আমার মনে হয়েছিলো তোমাদের দুজনের মধ্যে হয়তো ধীরে ধীরে ভালো সম্পর্ক তৈরী হচ্ছে।আমি আরো কয়েকবার তোমাদের দুজনকে একসাথে দেখেছিলাম।তাই আমি ভাবলাম হয়তো আমাদের দুজনের সম্পর্কের কথা শুনে শাওন ভুল বুঝতে পারে।তোমাদের মধ্যে যদি ঝামেলা হয়।’

‘এই সুযোগে আপনার মাথায় যে অরু নামের ঝামেলাটা আছে সেটা নামিয়ে ফেলতে পারবেন।’

‘অরু,এভাবে বলছো কেনো?তুমি আমার জন্য কোনো ঝামেলা নও।ঝামেলা তো আমি তোমার জীবনে সৃষ্টি করেছি।অনেক।আমি ভাবলাম যদি শাওনকে পেয়ে তুমি ভালো থাকো তাই….

‘আপনার মনে হলো আর আপনি ভেবে নিলেন।তাই তো!
আচ্ছা!একটা কথা বলুন তো আমার জীবন নিয়ে কিছু করার আমার কেনো কোনো অধিকার নেই?যার যা ইচ্ছা হয় সে সেটা চালিয়ে নেয়।আপুকে শাস্তি দেওয়ার জন্য আপনি আমাকে বিয়ে করতে চাইলেন করে নিলেন,আমার বাবা তার মান সম্মান বাঁচানোর জন্য আমাকে বিয়ে দিয়ে দিলেন,আপনার বাবা তার ছেলের জীবন গোছানোর জন্য আমাকে বাড়িতে নিয়ে এলেন তারপর আপনার মনে হলো আপনি অন্যায় করেছেন তাই প্রায়শ্চিত্তের জন্য আমার দায়িত্ব নিয়ে নিলেন আর এখন আবার আপনার মনে হলো শাওনের সাথে আমি ভালো থাকবো তাই….।

একটাবারও কেউ আমাকে জিজ্ঞাসা করলো না যে ‘অরু তুমি কি চাও?’যার যা মনে হলো আমার উপর চালাতে লাগলো।আমার নিজেকে কি মনে হয় জানেন?একটা তুচ্ছ রাস্তার মেয়ের মতো।যার কোনো মূল্যই নেই।শাওনকে দেখে আপনি কেনো ভেবে নিলেন আমি ও’র সাথে ভালো থাকবো?কেনো ভেবে নিলেন আমার ও’র সাথে ভালো সম্পর্ক হচ্ছে?
আমাকে কেনো জিজ্ঞাসা করলেন না আমি শাওনকে কেমন চোখে দেখি?শাওনকে আমার বিরক্ত লাগে বুঝেছেন?বিরক্ত।শাওন আমাকে ভালোবাসে না বিরক্ত করে।আপনার কাছে একটা রিকোয়েস্ট আপনি যদি আমাকে নিয়ে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েন তবে প্লিজ আমাকে বলে দিবেন।আপনাকে ভাবতে হবে না সমাজে আমি কিভাবে থাকবো না থকাবো।এতোটাও দূর্বল আমি নই যে নিজের দায়িত্ব নিজে নিতে পারবো না।আপনি এখন এখান থেকে যান’

অভ্র পুরো নিশ্চুপ হয়ে আহত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।কিছু মুহুর্ত নিরবতা শেষে অভ্র বলল,
‘অরু,চলো বাড়ি যাই।’

আমি চেঁচিয়ে বললাম,
‘আপনি প্লিজ এখান থেকে যান।আমাকে একটু একা থাকতে দিন।’

উনি শুকনো মুখে সেখান থেকে চলে গেলেন।তার যাওয়ার পথ থেকে দৃষ্টি সরাতেই আমি মুখে দু হাত দিয়ে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললাম।

চলবে,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে