অতঃপর সন্ধি পর্ব-১৭+১৮

0
1839

#অতঃপর_সন্ধি (১৭)
রূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম)

আঙুলের ফাঁকে কলম গুঁজে সেই কলম কে নাচাচ্ছে পুষ্পিতা। পুরো মনোযোগ তার বইয়ে। ফাইনাল ইয়ার পড়াশোনার চাপটাও বেশি। দৈবাৎ মায়ানের স্মৃতি মস্তিষ্কে বিচরণ করতেই কলম রেখে দিলো বইয়ের উপর। অনুভূতি যেন ডানা মেলে ঝাপটানো শুরু করলো মনের আনাচে-কানাচে। চেয়ারে গা এলিয়ে চোখ বুঁজে রইলো। সমস্ত কায়া যেন পুষ্পিতার অসাড় হয়ে এলো। নড়ার বিন্দুমাত্র শক্তি পেলো না। একটু একটু করে মিলিয়ে যাওয়া ক্ষ’তটা পুনরায় মাথা চারা দিয়ে উঠছে। অদৃশ্য র’ক্ত’ক্ষ’র’ণ হচ্ছে সেই ক্ষ’ত হতে। ঘায়ের গভীরতা খুব বেশি। বুকের ভেতর জ্বলছে। পুষ্পিতা কি ভেবে বালিশের তলা থেকে মোবাইল বের করলো। মায়ানের রেস্ট্রিকটেড করে রাখা আইডিতে গেলো। হয়তো বা স্যরি লেখা থাকবে সেই আশায়। তবে যা দেখলো তাতে যেন ক্ষরিত র’ক্তের মাত্রা বাড়লো ক্রমান্বয়ে। ঝাপসা হয়ে এলো তার চোখ। নিমিষ ফেলতেই গাল স্পর্শ করলো নেত্রজল। চোখের ভুল ভেবে পুনরায় পড়লো মায়ানের প্রেরিত বার্তা।

‘বান্ধবীকে দিয়ে কল করিয়েছেন আপনার হয়ে ওকালতি করতে? এই আপনার আত্মসম্মান? ছেলের কি অভাব পড়েছে যে আপনার আমাকেই লাগবে? নাকি ভবিষ্যত সুখের আশায় আমায় ছাড়তে চাইছেন না?’

নিচে লেখা, দিস পার্সোন ইজ নট এভেইলেভল।

চোখ জোড়া মুদে আসছে পুষ্পিতার। যতটুকু অনুভূতি অবশিষ্ট ছিলো আজ সেটাও বিলীন হয়ে গেলো। আর বাকিটুকু শুধু ঘৃণা।

_______________________

ক্লাস রুমে সবার সাথে গানের সুর মিলিয়েছে জারিন।

‘বন্ধুরা এলোমেলো
মুঠো ভোরে নিয়ে এলো
আনকোরা সূর্যের লাল
কলেজের ঘাসে ঘাসে
হুল্লোড় ক্যাম্পাসে
একমুঠো ছুটির সকাল।’

হনহনিয়ে পুষ্পিতা এসে জারিনের সামনে দাঁড়াল।পুষ্পিতার চোখ দিয়ে যেন অগ্নি ঝরছে। জারিন হাসিমুখে ভ্রু উঁচিয়ে ইশারায় জিজ্ঞেস করল, ‘কী?’

পুষ্পিতা ক্লাসের কাউকে পরোয়া না করে কষিয়ে চড় বসিয়ে দিলো জারিনের গালে। আকস্মিক, অতর্কিত অভিক্রমণে জারিন আহাম্মক হয়ে গেলো। হাসিখুশি, আনন্দঘন পরিবেশ মুহুর্তেই থমথমে হয়ে গেলো। সবার মুখের খুশির ঝলক সরে গিয়ে আঁধার নিমজ্জিত হয়ে গেলো এক লহমায়। উপস্থিত সকলের চোখেমুখে প্রশ্নের ছড়াছড়ি। গালে হাত রেখে পুষ্পিতার দিকে নিমেষহীন চোখে তাকিয়ে আছে জারিন।

‘নিজেকে খুব চালাক মনে করিস তুই?’ কান্নামাখা স্বরে বলল পুষ্পিতা। জারিন তখনো নির্বোধ, বেকুবের মতো পুষ্পিতার দিকে চেয়ে রইলো। ফুস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো পুষ্পিতা। পুষ্পিতা চোখ মুছে জারিনের হাতটা শক্ত করে ধরলো। টানতে টানতে নিয়ে গেলো বাইরে। বাইরে গিয়ে পুষ্পিতা জারিনের হাত ছেড়ে দিলো।

‘আমার পিছু পিছু আসবি। তোর সাথে আমার বোঝাপড়া বাকি।’

জারিনও বাধ্য মেয়ের মতো পুষ্পিতার পিছু পিছু যেতে শুরু করলো। পুষ্পিতার এমন অদ্ভুত আচরণ কিছুই তার বোধগম্য হচ্ছে না।

ডিপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়ের পিছন দিকটায় এসে থামল পুষ্পিতা। তার পিছনে জারিনও এসে দাঁড়াল।

‘তুই মায়ানের সাথে কেন কথা বলেছিস?’ বলে জারিনের চোখের দিকে তাকাল পুষ্পিতা। মাথা নুইয়ে ফেলে জারিন। পুষ্পিতা পুনরায় ব্যগ্র, কাতর স্বরে বলল,

‘আমার জন্য কেন অপমানিত হতে গেলি? তুই আমার বান্ধবী কম বোন বেশি। আর কোথাকার কে তোকে আমার জন্য কথা শুনিয়ে দিলো।’ কন্ঠনালী অসহায়ত্বের ছাপ পুষ্পিতার।

জারিন পুষ্পিতার গালে হাত রাখে আলতো করে। বিষন্ন মুখে মৃদুস্বরে বলল,

‘বান্ধবী কম বোন বেশি। সেজন্য বোনের কষ্টটা আর সহ্য করতে পারছিলাম না। তোর প্রাণহীন, নির্জীব চোখ, মলিন মুখ আমার কাছে বি’ষে’র মতো ছিলো। তাই,,,,

‘তাই? তাই কি করলি? গলা ধরে এলো পুষ্পিতার। বিলম্ব না করে জারিনকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো।
চক্ষে পানি টইটম্বুর। দু’পাপড়ির আলিঙ্গনে গাল স্পর্শ করবে সেই পানি।

‘যেন তোদের দূরত্ব মিটে।’

‘যে মানুষটা নিজে আমার থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলছে সে আর কখনো আমার কাছে আসবে না। আমাদের সন্ধির বিচ্ছেদ হয়ে গিয়েছে। সে মানুষটা আমার না।’

আচমকা করতালির শব্দে জারিনকে ছেড়ে দিলো পুষ্পিতা। সামনে তানজিফ।

‘মেয়েরা আসলেই অদ্ভুত। একজন তোকে পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে আছে সেদিকে তোর খেয়াল নেই।আর যে তোকে চাইছে না বার বার তার কাছেই ছুটে যাচ্ছিস। আসলে কি বলতো আমার ভাগ্যটাই খারাপ। শত চেষ্টা করেও আমার আবেগ অনুভূতি তোকে বুঝাতে পারছি না।’ বিবর্ণমুখ তানজিফের। আরো দু’পা এগিয়ে এলো সে।

‘আমার অনুভূতির গভীরতা কখনো মাপার চেষ্টা করেছিস পুষ্পিতা?’

মাথা নুইয়ে ফেলে পুষ্পিতা। নিস্তেজ হাসলো তানজিফ। চোখেমুখে হতাশার ছাপ।

‘কখনো যদি মাপার চেষ্টা করতি হয়তো তলিয়ে যেতি। তুই নিজেও জানিস আমি তানজিফ তোকে কতটা ভালোবাসি। তুই বুঝেও না বুঝার ভান করিস। এইচএসসি দেওয়ার পর বাবা চেয়েছিল আমি যেন বাহির থেকে পড়াশোনা কমপ্লিট করি। আমি শুধু তোর কাছাকাছি থাকার দেশে রয়ে গেলাম। সাবজেক্ট আমার জন্য পড়তে কষ্টকর হয়ে পড়বে জেনেও আমি পড়ছি।তুই আমার র’ক্তে মিশে গিয়েছিস।’

নিজের মনের জমানো কথাগুলো বলে চলে যাওয়ার জন্য অগ্রসর হলো তানজিফ। সামনের দিকে পা দিয়েও দিলো না। পিছন ফিরে বেদনার্ত কন্ঠে বলল,

‘আমার অনুভূতি আমি তোর হাতে তুলে দিলাম। আজকের পর আমি আর তোকে ভালোবাসি বলবো না। অপেক্ষায় থাকবো তোর মুখে শুনার জন্য।’

_____________________

হাসপাতালের করিডোরে বসে অনবরত কেঁদে চলেছে পুষ্পিতা। আশহাব শেখ এক্সিডেন্ট করে হাসপাতালে ভর্তি। অবস্থা আশংকাজনক। অপারেশন থিয়েটারে আছেন। ওটির বাইরে দাঁড়িয়ে চিন্তিত মুখে দাঁতে নখ কাটছে তানজিফ। গায়ের শার্ট তার র’ক্তে মাখামাখি।

তখন তানজিফ চলে আশার পর পুষ্পিতার মোবাইলে আননোন নম্বর হতে কল আসে একটা। জারিনকে কিছু না বলে হন্তদন্ত হয়ে ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে আসে। আধঘন্টা বাদে স্পটে পৌঁছে আশহাব শেখের র’ক্তা’ক্ত দেহ দেখে দু-চোখে আঁধার দেখে পুষ্পিতা। কি করবে না করবে ভেবেই যেন গগনবিদারী চিৎকার করে উঠলো। দিক বেদিক না ভেবেই তানজিফকে কল করে।

জারিনের কাঁধে মাথা রেখে অশ্রু বিসর্জন দিয়েই যাচ্ছে পুষ্পিতা। থামার নাম নেই। সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য জারিন এটা ওটা বলে যাচ্ছে। বাবার রক্তাক্ত মুখের সামনে কন্যার কোনো কথা কি বুঝ মানে। উপায়ন্তর না পেয়ে তানজিফ পুষ্পিতা সামনে এসে দাঁড়াল। পুষ্পিতা তানজিফের হাতটা খপ করে ধরে সেখানেই কপাল ঠেকাল। জারিন চোখের ইশারায় তানজিফকে বলল পুষ্পিতাকে একটু সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য। অন্যহাতে পুষ্পিতার মাথায় হাত রাখে তানজিফ। আলতো করে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে কোমল,নরম গলায় বুঝাল,

‘মা আন্টিকে নিয়ে আসছে হাসপাতাল। তোকে এই রূপে দেখলে আন্টিকে সামলানো দায় হয়ে যাবে। নিজেকে একটু শক্ত কর। আমাদের থেকেও আন্টির পাশে তোর দাঁড়ানোটা বেশি জরুরি। ফারদিনকেও সামলাতে হবে।’

মাথা তুলে পুষ্পিতা। উড়না দিয়ে চোখ মুছে নিলো ভালো করে।

‘আমি আর কাঁদবো না।’ বলেই নিরব হয়ে গেলো। বাদে বাদে হেঁচকি দিচ্ছে। তানজিফের চোখের দিকে তাকিয়ে আবারও কেঁদে দিলো। তানজিফ সযত্নে পুষ্পিতার চোখের পানি মুছে দিলো।

‘কাঁদে না। আঙ্কেল একদম সুস্থ হয়ে যাবে।’

তানজিফ মুখের কথা শেষ করতে পারলো না, এর আগেই হাসপাতাল কাঁপিয়ে চিৎকার করে তানজিফের পায়ের কাছে এসে লুটিয়ে পড়লো আফসানা হক। তানজিফ তড়িঘড়ি করে উনাকে ধরলেন।

‘পুষ্পিরে তোর বাবার কিছু হলে আমি বাঁচবো না।’

তানজিফ উনাকে বসালো। আপাতত সান্ত্বনা দেওয়া ছাড়া আর কিছু করার নেই।

______________________

অন্ধকারে নিমজ্জিত ধরনী। আশহাব শেখ কে আইসিউতে শিফট করা হয়েছে। রাত পেরোলেই কেবিনে দেওয়া হবে।

পুষ্পিতা জারিনের কাঁধে হাত রাখতেই কেঁপে উঠল সে।

‘বাবার বিপদ তো কেটে গিয়েছে। বাসায় চলে যা। আবার কাল সকালে আসিস। নয়তো অসুস্থ হয়ে যাবি।’

‘তুই অসুস্থ হবি না?’

‘জানি না। তবে জানি আমার তোদের মতো বন্ধু আছে। যারা বিপদে সবার আগে ঝাপিয়ে পড়ে।’

‘আল্লাহ না করুক আমার ক্ষেত্রে এমন হলে তুইও আমার মতো করতি।’

‘হাসপাতালে এতোজন হয়তো এলাউ করবে না। বাসায় যা শাওয়ার নে। হালকা লাগবে।’

আফসানা হকের সামনে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসল পুষ্পিতা। আফসানা হক মেয়েকে চোখের সামনে দেখে আবারও কান্নার জন্য উদ্যত হতেই পুষ্পিতা উনার গালে হাত রাখে।

‘কাঁদে না মা। বাবা আবারও সুস্থ হয়ে যাবে। তুমি আন্টির সাথে ফারদিনকে নিয়ে বাসায় চলে যাও। আমি আছি এখানে।’

আফসানা হক বাচ্চাদের মতো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বললেন,

‘আমি তোর বাবাকে রেখে আমি কোথাও যাবো না।’

‘বাবাও অসুস্থ আবার তুমিও যদি অসুস্থ হও আমরা দুই ভাইবোন কোথায় যাবো মা? ভোর হলে আবার এসো।’

‘আন্টি পুষ্পিতা ঠিক বলেছে। আপনি মায়ের সাথে চলে যান।’

পুষ্পিতা উঠে দাঁড়াতেই ওড়নায় টান পড়ে তার। ফারদিন বোনের দিকে তাকিয়ে রইলো। ফোলা ফোলা চোখমুখ তার।

‘আমি আম্মুর সাথে যাবো না। আমি তোমার সাথে আব্বুর কাছে থাকবো।’

____________________

অনেক কিছু বদলে গিয়েছে। সেদিনের পর হতে গত হয়েছে সাড়ে সাতটি মাস। পুষ্পিতার গ্রাজুয়েশন শেষ। মাস্টার্সে ভর্তি হবে ক’দিন বাদে। এক্সিডেন্টের পর থেকে খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটেন আশহাব শেখ।

ডিনার টেবিলে বসে আছে সবাই। পুষ্পিতা একটু পরে পরে আশহাব শেখের কপালে কাঁটা দাগটার দিকে তাকাচ্ছে আর তপ্ত শ্বাস ফেলছে। ভাত খেতে ইচ্ছে করছে না তার।

এক লোকমা ভাত মুখে দিয়ে আফসানা হক। উৎফুল্ল গলায় বলল,

‘আজ দুপুরে মায়ান জাপান থেকে কল করেছিল। আমাদের সবার খবরাখবর নিলো। ফারদিনের পড়াশোনা ব্যপারে জিজ্ঞেস করলো।’

মায়ানের নাম শুনে চোখেমুখে কাঠিন্য দেখা দিলো পুষ্পিতার।মুহুর্তেই মাথায় র’ক্ত চেপে গেলো।

‘আসলেই ছেলেটা খুব ভালো। ব্যবহারও অমায়িক। কত ভালো ফিউচার। এমন একটা ছেলের হাতে পুষ্পিতাকে তুলে দিতে পারলে নিশ্চিন্তে মরতে পারতাম। আমার মেয়েটাকে নিয়ে বড্ড চিন্তা হয়।’

ব্যস পুষ্পিতা নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণ করে রাখতে পারলো। আশহাব শেখের কথায় তেতে উঠলো।

‘ফিউচার ভালো হলেই তোমার মেয়ে সুখী হবে? তুমি জানো? একটা বেকার দেশে পড়াশোনা করেছে এমন ছেলে তোমার মেয়েকে সুখী করতে পারবে না? ফিউচার ভালো না দেখো কে তোমার মেয়েকে চায়। আর কে তাকে সুখী করতে পারবে।’

‘পুষ্পিতা বাবার সাথে কেউ এভাবে কথা বলে? এই শিক্ষা আমি দিয়েছি?’

‘তোমরা কেন একজন সফল ছেলেকেই খুঁজো? যে ছেলেটা বেকার সেই ছেলের কথা কেন ভাবতে পারো না? বরং একটা বেকার ছেলের পাশে থেকে একটা মেয়ে যখন তার ক্যারিয়ার গুছিয়ে দিবে তখন মেয়েটার মর্ম বুঝে।’

‘যখন মা হবে তখন বুঝবে কেন করে এমন। প্রত্যেক বাবা মা তার সন্তানকে সুখী দেখতে চায়।’

___________________

রুমে এসে তানজিফের নম্বরে ফোন লাগালো। রাগে গা রিঁ রিঁ করছে তার। ফোন রিসিভ হতেই তানজিফ কে কিছু বলতে না দিয়ে কর্কশ গলায় বলল,

‘তুই আমার উত্তরের আশায় ছিলি না? আমি তোকে সাতদিন সময় দিলাম। এই সাতদিনের মধ্যে তুই পরিবার নিয়ে আমার বাসায় বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসবি। সাতদিনের এক সেকেন্ড পরে এলেও তুই আমাকে আর পাবি না। আমার তোর পাশে থেকে তোর সফল ক্যারিয়ারের সঙ্গী হতে চাই। প্রমাণ করতে চাই সব মেয়ে ব্রাইট ফিউচার দেখলে জোর করে থাকে না। একটা বেকার ছেলের হাতও মেয়েরা ধরে।’

#চলবে

#অতঃপর_সন্ধি (১৮)
রূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম)

চোখের পলকে সাতটা দিন চলে গেলো। তানজিফ না বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছে আর না কিছু বলেছে। উপায়ন্তর না পেয়ে পুষ্পিতা নিজেই আবারও তানজিফকে কল করলো। রিং হচ্ছে কিন্তু রিসিভ হচ্ছে না। একে একে তিনবার কল করার পরও কোনো রেসপন্স না পেয়ে এবার মনে মনে পণ করলো পুষ্পিতা। এটাই লাস্ট কল। এইবার কল রিসিভ না হলে আর কখনো তানজিফের সাথে কথা বলবে না সে। তানজিফের নম্বরটা পুনরায় ডায়াল করে মোবাইল কানে ঠেকালো। প্রথমবার রিং হতেই তানজিফ রিসিভ করলো। ওপাশ থেকে কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে পুষ্পিতা ঠেঁটা গলায় বলল,

‘তোর সময় কিন্তু আজ রাত দশটা অবদি। এরপর যদি,,,,,,

‘জানি, এরপর তোকে আর পাবো না। বার বার এককথা বলে খোঁচা দেওয়ার দরকার নেই। আমার মনে আছে।’

বলে ঠাস করে কল কে’টে দিল। পুষ্পিতা যেন বোকা বনে গেলো তানজিফের এমন কর্কশ গলা শুনে।

__________________

আশহাব শেখ খুড়িয়ে খুড়িয়ে সোফায় এসে বসলেন। পুষ্পিতা রসুন থেঁতু করে গরম করা সরষে তেলের বাটি টা নিয়ে আশহাব শেখের সামনে দাঁড়াল । তিনি আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন পায়ের কোন জায়গাটায় ব্যথা করছে। তারপর মেঝেতেই বসে পড়ল পুষ্পিতা। আঙুলের ডগায় একটু একটু তেলে নিয়ে সেই স্থানে পরম মমতায় তেল মালিশ করতে থাকে। কিঞ্চিৎ আরাম আর একটু স্বস্তিবোধ হতেই চোখ বুঁজে রইলেন আশহাব শেখ।

পুষ্পিতা নতজানু হয়ে মালিশ করছে আপনমনে।

‘আজকাল আমার সাথে ঠিক করে কথা বলিস না কেন মা? আমার দিকে তাকাসও না। বাবার উপর কি রেগে আছিস?’

মাথা উঁচিয়ে আশহাব শেখের মুখপানে নেত্রপাত করল পুষ্পিতা। ভেজা আঁখি পল্লব। লালাভ চক্ষু জোড়ায় পানি টলমল করছে। মেয়ের মুখের দিকে নিমেষহীন তাকিয়ে রইলেন আশহাব শেখ। উত্তরের আশায়।

‘তোমার কপালের কাটা দাগ, ডান পাশের গালের ক্ষ’তের চিহ্ন আর পা দেখলে আমার খুব কষ্ট হয় বাবা। আমার বাবা তো এমন ছিলো না। আমার বাবার মুখে তো কোনো কাটাছেঁড়ার দাগ ছিলো না। আমার বাবা তো ছিলো একদম সুস্থ।’

মেয়ের উৎকন্ঠা আর ব্যগ্রতা দেখে বিস্তর হাসলেন আশহাব শেখ। শুনেছিলেন মেয়ে বড় হলে নাকি মায়ের রূপ নেয়। আজ তার প্রমাণ চোখের সামনে।

‘নিশ্চয়ই তোর বাবা হাসপাতালে বদলাবদলি হয়ে গিয়েছে। দাঁড়া আজই ওই হাসপাতালের বিরুদ্ধে মা’ম’লা করবো। এতো বড় চক্রান্ত মেনে নেওয়া যায় না।’

আশহাব শেখের কথায় অশ্রুসিক্ত লোচনে ফিক করে হেসে দিলো পুষ্পিতা।

দূর থেকে বাবা মেয়ের কথা শুনে নিঃশব্দে অশ্রুপাত করছেন আফসানা হক। কলিংবেলের শব্দে নিজেকে সামলে নিলেন তিনি। চোখের পানি মুছে অগ্রসর হলেন সদর দরজার দিকে।

দরজা খুলে চমকে উঠেন তিনি। এই সন্ধ্যায় পুরো পরিবার নিয়ে হাজির সুমনা এহমাদ। আফসানা হকের কপালে চিন্তার বলিরেখা ভাসমান।

‘এই সন্ধ্যায় তোরা?’

‘কেন? এই সন্ধ্যায় না বলে এসেছি বলে বাসায় ঢুকতে দিবি না?’

তাজওয়ার নওশাদের থমথমে মুখ দেখে আর কথা বাড়ালেন না আফসানা হক।

‘আরে নওশাদ ভাই যে?’ আশহাব শেখ উঠতে চাইলেন। কিন্তু পায়ের জন্য দাঁড়াতে পারলেন না।

__________________

ট্রে তে সাজানো চায়ের কাপে থাকা চা ঠান্ডা হয়েছে অনেক্ক্ষণ। থমথমে মুখে আশহাব শেখের মুখোমুখি বসে আছে তাজওয়ার নওশাদ। উনার পাশে সুমনা এহমাদ। এককোনায় মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে তানজিফ। তাজওয়ার নওশাদ আমতাআমতা করছে কিছু বলতে গিয়েও পারছে না।

পুষ্পিতা সোফার এককোণে দাঁড়িয়ে আছে। আর একটু পর পর তানজিফের বিধ্বস্ত চেহারার দিকে দৃষ্টিপাত করছে।

আশহাব শেখ তাদের মতিগতি কিছুই বুঝতে পারছেন না।

‘চা যে ঠান্ডা হয়ে গেলো?’

আশহাব শেখের কথায় যেন একটু বল পেলেন তাজওয়ার নওশাদ। জিহবা দিয়ে ঠোঁট জোড়া ভিজিয়ে নিলেন। চোখ জোড়া বন্ধ করে বলল,

‘আপনার মেয়েটাকে আমায় দিবেন?’

ঘটনা বুঝতে পেরে ড্রয়িংরুম থেকে নিঃশব্দে প্রস্থান করে পুষ্পিতা।

আকস্মিক প্রস্তাবে আশহাব শেখ থতমত খেয়ে গেলেন। প্রস্তাব বুঝেও যেন বুঝলেন না তিনি।

‘বুঝলাম না কি বললেন আপনি?’

‘আপনার মেয়েটাকে আমি আমার ছেলের বউ হিসেবে চাইছি। দিবেন?’

_______________

সাতদিন আগে!

সাতসকালে পেপার পড়ছেন তাজওয়ার নওশাদ। দেশের অবস্থা তেমন একটা ভালো না।

তানজিফ উনার পায়ের কাছে এসে বসলো। গায়ে সেন্ডো গেঞ্জি আর থ্রি কোয়াটার প্যান্ট। এলোমেলো চুল আর ঘুম জড়ানো চোখ। দেখেই বুঝা যাচ্ছে ঘুমের রেশ এখনো কাটিনি।

এতো সকালে ছেলেকে জাগতে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠেন তিনি।

তানজিফ ঢুলতে ঢুলতে ঘুমো ঘুমো গলায় বলল,

‘আমি বিয়ে করবো।’

স্তম্ভিত, হতবাক তাজওয়ার নওশাদ। হাত থেকে পেপার পড়ে গেলো উনার। ছেলের এমন আজগুবি কথা হজম হচ্ছে না উনার।

‘বাবা? তোমার ঘুম এখনো কাটে নাই। যাও আর একটু ঘুমিয়ে এসো। ঘুমের ঘুরে কি বলতে কি বলে ফেলছো নিজেও জানো না।’

‘আমি বিয়ে করবো আব্বু।’

মেঝে থেকে পেপার খানা তুললেন তাজওয়ার নওশাদ। ছেলের দিকে বিরক্তিকর চাহনি নিক্ষেপ করে স্থান ত্যাগ করলেন তিনি।

________________

সারাদিনে তাজওয়ার নওশাদের সাথে দেখা হয়নি তানজিফের। অনেকবার কলও করেছে। কিন্তু তিনি কল কেটে দিয়েছেন। সারাদিন অস্বস্তিতে কেটেছে তার। চিন্তায় গলা দিয়ে খাবারও নামেনি।

রাতে যখন তাজওয়ার নওশাদ বাড়ি ফিরে তানজিফ অপেক্ষায় থাকে আবারও বিয়ের কথাটা বলার জন্য। অতঃপর খাবার টেবিলে সেই সুযোগটা আসে। পুনরায় বিয়ের কথা বলতে আঁতকে ওঠেন সুমনা এহমাদ। ত্রাসিত,ভয়চকিত মুখে কিছু উচ্চারণ করার আগেই তাজওয়ার নওশাদ থমথমে, গম্ভীর কণ্ঠে বলেন,

‘বিয়ে করলে খাওয়াবি কি? তোর ইনকাম সোর্স কি?’

তানজিফ নতজানু হয়ে বলল,

‘আমাদের বাসায় কি একজন বাড়তি খাওয়ার মতো রান্না করা হয় না? নাকি একজন খেলে সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাবে?’

লোকমা মুখে দিতে গিয়েও দিলেন না তিনি। ছেলের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকালেন।

‘একজনকে খাওয়ানোর সামর্থ্য আমার আছে। কিন্তু কোনো বাবা কি চাইবে কোনো বেকার ছেলের তার মেয়ে বিয়ে দিতে? সব বাবা মাই একজন প্রতিষ্ঠিত ছেলে খুঁজে।’

‘আমি কি কখনো ইনকাম করবো না?’

‘ছেলে হয়ে জন্ম নিয়েছিস ইনকাম অবশ্যই করবি।’

‘তাহলে?’

‘তাহলে কিছু না। মাস্টার্স কমপ্লিট কর।হয় চাকরি করবি না হয় আমার ব্যবসা সামলাবি। তখন বিয়ের কথা ভাবা যাবে।’

থমথমে মুখে টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় তানজিফ। সুমনা এহমাদ ছেলেকে টেনে, জোর করে বসানোর চেষ্টা করলেন। তানজিফ মায়ের হাত ছাড়িয়ে ভারী গলায় বলল,

‘বাবা মায়ের একটাই দোষ ছেলে মেয়ে যখন বিয়ে করতে চায় তখন চাকরি বাকরির অজুহাতে নিষেধ করে। এরপর ছেলের পিছু পিছু ঘুরে বিয়া করানোর জন্য। আমি আমার মনোবাসনা কেবল ব্যক্ত করেছি তোমার নিকট। বাকিটা তোমার ইচ্ছে। জীবনের এতোবড় সিদ্ধান্তে তোমার মতের বিরুদ্ধে কিছুই করবো না আমি। তবে এতটুকু বলতে পারি, ছয়দিনের মধ্যে যদি বিয়ে সংক্রান্ত কিছু না আগায় আর কখনো আমাকে বিয়ের কথা বলো না।’

করুণ, বিষাদভারাতুর চক্ষে মায়ের পানে চাহনি নিক্ষেপ করল,

‘মনেপ্রাণে যাকে চাই তাকে পাওয়ার একটা সুযোগ আমি পেয়েছি। তাকেই যদি বিয়ে করতে না পারি পরবর্তীতে অন্যকারো সাথে ঘর বাঁধার কোনো ইচ্ছে নেই আমার। হয় আমার তাকে চাই নয়তো কাউকে নয়।’

_____________________

সাতদিনের মধ্যে চারদিন চলে গেলো। তাজওয়ার নওশাদের মতের কোনো পরিবর্তন নেই। নিজের সিদ্ধান্তে অনড় তিনি।

সকালে নাস্তার টেবিলে তানজিফকে না দেখে সুমনা এহমাদ ধীরপায়ে তানজিফের রুমের দিকে এগিয়ে গেলেন। তানজিফ মেঝেতে বসে আছে খাটে পিঠ ঠেকিয়ে। চক্ষু জোড়া বন্ধ তার।

সুমনা এহমাদ তানজিফের কাঁধে হাত রাখতেই কেঁপে উঠল তার শরীর। চক্ষু মেলে সুমনা এহমাদকে দেখে ফিচেল হাসলো। তপ্ত শ্বাস ফেলেন সুমনা এহমাদ।

‘নাস্তা করবি চল। তিতির আর তোর বাবা অপেক্ষা করছে।’

‘খাবো না আম্মু। তোমরা খেয়ে নাও।’

‘সামান্য বিষয় নিয়ে রাগ করে না বাপ।’

‘তোমাদের কাছে সামান্য ব্যপার হলেও আমার কাছে না। আমার বুকে যে ঝড়ের তান্ডব চলছে। কেউ টের পাচ্ছে না। তবে তিনদিন পরে আমাকে আর কখনো তোমরা বিয়ের জন্য জোর করতে পারবে না। আমার অনুরোধ রইলো।’

‘মেয়েটার কি বিয়ে ঠিক হয়েছে?’

বিষাদভরা চোখে সুমনা এহমাদের পানে চাইলো তানজিফ।

‘মেয়েটা পুষ্পিতা মা।’

_____________________

সাতদিনের শেষদিন আজ। গত তিনদিন মুখে কিছু তুলেনি তানজিফ। সুমনা এহমাদ ছেলের মুখের দিকে তাকাতে পারছেন না। তিনি পড়েছেন গেঁড়াকলে। ভরদুপুরে তিনি জরুরি তলব করলেন তাজওয়ার নওশাদকে। বিপদ ভেবে অফিসের জরুরি কাজ ফেলে বাসায় ছুটে এসেছেন তাজওয়ার নওশাদ

ব্যতিব্যস্ত হয়ে বাসায় প্রবেশ করতে সুমনা এহমাদ এর প্রশ্নের তোপে পড়েন তিনি।

‘আমায় যখন বিয়ে করেছিলে তখন কি করতে তুমি তাজওয়ার?’

বহু বছর পরে স্ত্রীর মুখে নাম শুনে আঁতকে ওঠেন তাজওয়ার নওশাদ। তানজিফ জন্ম নেওয়ার পর সুমনা এহমাদ কখনো স্বামীর নাম ধরে ডাকেননি। তাজওয়ার নওশাদ স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে রইলেন অপলক।

‘কি করতে তুমি? আজকের মতো তোমার অবস্থান ছিলো?’

‘আজ হঠাৎ এসব কথা বলছো কেন?’

‘ভালো করেই বুঝতে পারছো কেন বলছি।’

‘তোমরা যেমন ভাবছো বিষয়টা এতো সোজা না। একে ছেলেটার পড়াশোনা শেষ হয়নি।না ছোটোখাটো কোনো কাজ করে। কে মেয়ে বিয়ে দিতে চাইবে বলো? তুমি বিয়ে দিবে তিতিরকে এমন একটা ছেলে সাথে?’

‘মেয়েটা পুষ্পিতা।’

স্তম্ভিত তাজওয়ার নওশাদ। হতভম্ব হয়ে গেলেন তিনি মুহুর্তেই। উষ্ম শ্বাস ফেলেন।

‘তাহলে তো হলেই। তোমার ছেলে আগে কিছু একটা করুক। তারপর আমি যাবো আশহাব ভাইয়ের কাছে উনার মেয়ের হাত চাইতে।’

‘তোমার কি মনে হয় তারা ততদিন মেয়ে রেখে দিবে?’

‘আমি কোন মুখে যাবো?’

‘যে মুখে আমার হাত চাইতে গিয়েছিলে সেই মুখে।’

________________

থমথমে, বিরস মুখ আশহাব শেখের। বড্ড দ্বিধায় পড়ে গেলেন। সহসা এতোবড় সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না। চিন্তানিমগ্ন, উদ্বিগ্ন হয়ে মেঝের দিকে চেয়ে রইলেন নিমেষহীন।

‘আফসানা আর আমার এমন একটা সুপ্ত মনোবাসনা ছিলো আরো আগে থেকেই। আপনাদের দুজনের কাছে বলার সাহস হয়নি। আমার ছেলেটা আপনার মেয়েকে চেয়েছে ফিরিয়ে দিবেন না দুলাভাই।’

সুমনা এহমাদের কথায় মনে মনে একটু সাহস পেলেন আফসানা হক।

‘তোমার এক্সিডেন্ট হওয়ার পরে ছেলেটা কেমন ছোটাছুটি করেছে তা একটু হলেও দেখেছো। সেই দিক গুলো বিবেচনা সিদ্ধান্ত নিও। আর কিছু বলবো না।’

স্ত্রীর দিকে তাকালেন আশহাব শেখ। দৈবাৎ পুষ্পিতার সেদিনের বলা কথাগুলো মস্তিষ্কে কড়া নাড়ল। চোখ বুঁজে সমীকরণ মিলাতে লাগলেন। আকস্মিক জহুরির চোখে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল তানজিফকে। আশহাব শেখের এমন চাহনি দেখে কিছুটা ভরকে গেল সে।

‘তোমাদের দু’জনের মাঝে কি কোনো প্রেমের সম্পর্ক আছে তানজিফ?’

চকিত হয় তানজিফ। নতজানু হয়ে জবাব দিল,

‘না। পুষ্পিতা বরাবরই আমার প্রস্তাব প্রত্যাখান করেছে।’

‘কেন? অন্য কোথাও সম্পর্ক ছিলো?’

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে