অঙ্গীকার (৮ম পর্ব)

0
1692
অঙ্গীকার (৮ম পর্ব) লেখা- শারমিন মিশু রাত বারটা বাজে। বাইরে মুষলধারায় বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টি হচ্ছে আল্লাহর দেয়া রহমত। শাফী ড্রয়িংরুমে বসে আছে তখনি ভেতর ঘরে বাচ্ছার কান্নার আওয়াজ পাওয়া গেলো। শাফী সাথে সাথে আলহামদুলিল্লাহ বলে উঠলো। বেশ কিছুক্ষণ পর সালেহা এক ফুটফুটে বাচ্ছা এনে শাফীর কোলে দিয়ে বললো,,, শাফী,,, এই নে দেখ তোর মেয়ে হয়েছে। দেখেছিস কি সোভাগ্য আমাদের!! আমার নাতনি জন্মের সাথে সাথে রহমতের বৃষ্টি নিয়ে এসেছে। -শাফীর ভিতরে অদ্ভুত এক অনুভূতি ছুঁয়ে গেলো। শাফী কাঁপা কাঁপা হাত বাড়িয়ে সেই ছোট্ট বাচ্ছাটাকে কোলে নিয়ে বললো,,, আলহামদুলিল্লাহ!!! আল্লাহ আমাকে একটা জান্নাতের অধিকারী বানিয়ে দিলো। ওর হাত কাঁপছিলো অনেক বেশি। বাচ্ছাটা এতোটা ছোট যে মনে হচ্ছে হাতের ফাঁক দিয়ে পড়ে যাবে। আর শাফী কখনো এতো ছোট বাচ্ছা কোলে নেয়নি। মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,,, মা তুমি কোলে নাও আমার ভয় লাগছে যদি পড়ে যায়। ছেলের কথা সালেহা হেসে হাত বাড়িয়ে বাচ্ছাটাকে কোলে নিলো। পরক্ষনেই শাফী মুখ তুলে বললো,,, মা আফিয়া?? ও ঠিক আছে তো? -সালেহা একটুখানি হেসে বললো,,, হ্যা বাবা বউমা আল্লাহর রহমতে সুস্থ আছে। শাফী প্রশান্তির নিঃশ্বাস ফেলে আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করলো। আল্লাহ তার ডাক শুনেছে। তার স্ত্রী আর বাচ্ছা দুজনেই সুস্থ আছে। সালেহা বলে উঠলেন,,,নে এবার মেয়ের দু কানে আযান আর ইকামতের বাক্য গুলো শুনিয়ে দে। তুই অনেক ভাগ্যবান বাবা হয়ে তুই আল্লাহর পবিত্র বানীগুলো তোর মেয়ের কানে প্রথম শুনাতে পারার সৌভাগ্য অর্জন করবি। সালেহা বাচ্ছাটাকে বিছানায় শুইয়ে দিলো। শাফী অযু করে এসে মেয়ের ডান কানে আযান আর বাম কানে ইকামতের বাক্য গুলো সুস্পষ্ট উচ্চারণে শুনিয়ে দিলো। তারপর সালেহা আবার বাচ্ছাটাকে নিয়ে ভেতর রুমে চলে গেলো।
রাতে সব মহিলারা ওই রুমে ছিল বিধায় শাফী আফিয়ার সাথে দেখা করতে পারেনি। ও গেস্টরুমেই শুয়ে ছিলো। কিন্তু মনটা ভীষণ ছটপট করছিলো নিজের মানসপ্রিয়ার মুখটা একবার দেখার জন্য। এদিকে প্রথম বাবা হওয়ার আনন্দে ওর ভিতর বাইরে জোরেশোরে উৎসব চলছে। এ যে এক অদ্ভুত অনুভূতি। সারারাত ওর নির্ঘুম কেটেছে। ফজরের নামাজ পড়ে একটু শুয়েছিলো চোখটা মনে হয় একটু খানি লেগে এসেছিলো। মায়ের কথা শুনে চোখ থেকে ঘুম ছুটে গেলো। সালেহা ছেলের মাথার পাশে বসে বললো,,, ঘুমিয়েছিস ? -না মা । কিছু বলবে??? -না তেমন কিছুনা। বলছিলাম বউমার সাথে গিয়ে দেখা করে আয়। এখন ওখানে কেউ নেই। শাফী মায়ের কথায় কিছুক্ষন বসে ছিলো। মা বেরিয়ে যেতেই ধীর পায়ে ও ঘরের দিকে এগুলো। আফিয়া অন্যদিকে ফিরে শুয়ে আছে। বোধহয় ঘুমাচ্ছে। শাফী আস্তে করে মেয়ের পাশে গিয়ে বসলো। বাচ্ছাটা জেগে আছে। ছোট ছোট হাত পা গুলো নাড়াচ্ছে। শাফী কখনো হাত দিয়ে ওর মুখ ছুঁয়ে দিচ্ছে কখনো ছোট ছোট হাত পা গুলো নিয়ে নাড়াছাড়া করছে। কিছুক্ষণ পর বাচ্ছাটা কেঁদে উঠলো। আফিয়া ওপাশ থেকে এপাশে ফিরলো। ফিরতেই শাফীর দিকে চোখ পড়ে লজ্জাবনত হয়ে নিচের দিকে তাকিয়েই সালাম দিলো। শাফী সালামের জবাব দিয়ে নিজেও সালাম দিলো। তারপর বললো কেমন আছো? -আফিয়া নিচের দিকে তাকিয়ে বললো,,, আলহামদুলিল্লাহ,,,, আলা কুল্লি হাল!!! আপনি কখন এলেন? -সেতো অনেকক্ষণ। -আমাকে ডাকেন নি যে? -ভাবলাম ঘুমিয়ে আছো তাই। ওভাবপ নিচের দিকে তাকিয়ে আছো কেন? -আমার না আপনার দিকে তাকাতে লজ্জা লাগছে -শাফী শব্দ করে হেসে দিলো। এতো লজ্জা কেন গো? -জানিনা!! -শাফী আস্তে করে উঠে গিয়ে আফিয়ার পাশে বসে ওর কপালে ঠৌঁট ছুঁইয়ে দিলো। আফিয়া ও সাথে সাথে শাফীর গালে ঠৌঁট ছোয়ালো। শাফী আফিয়ার হাত ধরে নিচের দিকে তাকিয়ে চোখের পানি ছেড়ে দিলো। এতক্ষণ অনেক কষ্টে কান্না চেপে রেখেছে আর পারেনি আটকাতে। – শাফীকে হঠাৎ এভাবে কাঁদতে দেখে আফিয়া অবাক হয়ে গেলো। ও নিজের দুহাত দিয়ে শাফীর হাত আরো শক্ত করে ধরলো। আরে আপনি কাঁদছেন কেন? আমি ঠিক আছিতো দেখেন। – -শাফীকে চুপ থাকতে দেখে আফিয়া বললো,,, দেখেন আপনার কান্না দেখে আমার কিন্তু কান্না আসছে। প্লিজ…. -শাফী কান্না জড়িত কন্ঠে বললো,,, তুমি জানোনা কাল রাত আমার কিভাবে কেটেছে। তোমার কষ্টের সেই মুহুর্তগুলো আমার ভেতর বাহির ভেঙে চুরমার করে দিচ্ছিলো। কি যে ভয় হচ্ছিলো! আল্লাহর কাছে বারবার করে বলেছি তোমার যেন কিছু না হয়। আমার কাছ থেকে তোমাকে যেন কেড়ে না নেয়। -আল্লাহ আপনার কথা শুনেছে। দেখেন আমি সুস্থ আছি। এবার চোখ মুছেন তো। পুরুষ মানুষ কান্না করলে একদম ভালো দেখায় না। কেমন যেন ন্যাকা ন্যাকা লাগে। পুরুষ মানুষকে হতে হয় শক্ত মনের। -শাফী হাতের পিঠ দিয়ে চোখ মুছে বললো,,,, এতো জ্ঞান দিওনা। -আমি মোটেও জ্ঞান দিচ্ছিনা। -শাফী চোখ মুছে মুচকি হেসে বললো,,, হুম। -চোখ এতো লাল কেনো?? সারারাত ঘুমান নি বুঝি? -তোমাকে ছাড়া আমার ঘুম আসেনা তা তুমি জানো না? -হুম জানিতো। আপনি বড্ড পাগল!! -হুম আর তুমি আমার পাগলী! রাদিয়া রুমে ঢুকতে যাচ্ছিলো শাফীর গলা পেয়ে ওখানে দাঁড়িয়ে পড়লো। ওর একদম মনে ছিলনা শাফী এখানে। মুনিরা ওকে দিয়ে আফিয়ার জন্য সুজি রান্না করে পাঠিয়েছিলো তাই দিতে এসেছিলো। শাফী রাদিয়ার উপস্থিতি টের পেয়ে সরে বসলো। রাদিয়া দরজায় দাঁড়িয়ে বললো,,, আপু আমার ভিতরে আসা লাগবে। মা তোমার খাবার পাঠিয়েছে। একথা শুনে শাফী বারান্দার দিকে চলে গেলো। রাদিয়া রুমে ঢুকে সুজির বাটিটা টেবিলে রেখে বাবুটাকে কোলে নিয়ে আদর করলো। তারপর আফিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,,, আপু আমি ওকে নিয়ে যায়? আবার দিয়ে যাবো। -আফিয়া মুচকি হেসে বললো,,হুম নিয়ে যা। তোর আজ ভার্সিটি নাই? -আজ যাবোনা। -কেন? -বাড়ীতে নতুন অতিথি আসার আনন্দে এ বলে রাদিয়া বেরিয়ে গেলো। রাদিয়া চলে যেতেই শাফী ভিতরে আসলো। টেবিলের উপর থেকে খাবারের বাটিটা নিয়ে আফিয়ার পাশে রাখলো। তারপর ওকে ধরে শোয়া থেকে উঠিয়ে পিছনে বালিশ দিয়ে খাটের সাথে হেলান দিয়ে বসালো। তারপর এক চামুচ সুজি আফিয়ার মুখের দিকে বাড়িয়ে ধরলো। আফিয়া বললো,,, কি করছেন আমি নিজে খেতে পারবো। -সেটা তো আমি ও জানি। -তাহলে দেন। -কেন আমার হাতে খেতে কি প্রবলেম? -কি বলছেন আপনার হাতে খেতে পারাটা তো আমার সৌভাগ্য। -তাহলে কথা না বলে চুপচাপ খেয়ে নাও। আফিয়ার খাওয়া শেষ হতে মুনিরা এসে বাচ্ছাটাকে ওর কোলে দিয়ে গেলো। আফিয়া শাফীর দিকে তাকিয়ে বললো,,, কোলে নিবেন? -না আমার ভয় লাগে। -কেনো? -যদি হাত ফসকে পড়ে যায় তো!! -আরে পড়বে না আমি আছি তো। শাফী বিছানায় পা তুলে বসে আফিয়ার কোল থেকে আস্তে করে তুলে বাচ্ছাটাকে নিজের কোলে নিলো। আফিয়া বললো,,, কার মতো হয়েছে বলেন তো? -মনে হচ্ছে মায়ের চেহারা পেয়েছে। তারপর ও বলা যায়না এ সময় চেহারা একবার একরকম হয়। -হুম। কিছুক্ষণ চুপ থেকে আফিয়া বললো,,, আপনি খুশি তো!! -আফিয়া এটা একটা কথা বললে? তুমি জানোনা আমি কতটা খুশি হয়েছি। আজ তুমি আমাকে পৃথিবীতে সব থেকে বড় সৌভাগ্য এনে দিয়েছো। আল্লাহ আমাকে একটা জান্নাতের মালিক বানিয়ে দিয়েছে। এর থেকে বড় খুশি কি আর কিছু হতে পারে? -বাব্বাহ!!! এমনভাবে বলছেন যেন আমি কেউ না৷ মেয়েকে পেয়ে কি আমাকে পর করে দিলেন নাকি? -হিংসা হচ্ছে?? আফিয়াকে চুপ থাকতে দেখে শাফী আবারো বললো,,, যার মাধ্যমে এতবড় সৌভাগ্যের অধিকারী আমি হলাম তাকে কি করে ভুলে যায়। কারো ভালোবাসা কেউ ভাগ করতে পারেনা। যার যার ভালোবাসা তার জন্য তা উপরওয়ালাই ভাগ করে দিয়েছেন। -হুম জানি তো এমনি একটু দুষ্টমি করলাম। সালেহা ভিতরে এসে বললো,,, শাফী তোর বাবা আর ক্বাফী এসেছে। শাফী মেয়েকে মায়ের কোলে দিয়ে বেরিয়ে গেলো। সাতদিনের দিন বেশ বড় করে মেয়ের আকীকা সম্পূর্ণ করলো শাফী। ইসলামে আকীকা করা সুন্নাত। আকীকা দিয়ে মেয়ের নাম রাখলো আনজুমান বুশরা। নামটা রাদিয়া ঠিক করেছে। আর সবার পছন্দ হওয়াতে এটাই রেখেই দিলো। ছোট্ট বুশরা আস্তে আস্তে বড় হতে লাগলো। ওর এক মাসের সময় আফিয়া শশুড়বাড়ি ফিরে গেলো। শাফীও আস্তে আস্তে ওর ব্যবসাটা শুরু করলো। আগে নামাজের পর শাফী একটু ঘুমাতো। এখন বুশরার জন্য পারেনা। বুশরা প্রতিদিন ফজরের আগে উঠে যায় আর তারপর কাউকে ঘুমাতে দিবেনা। মেয়েটা হয়েছে ভারী দুষ্টু শুইয়ে রাখলেই কাঁদবে যখনি কোলে নিয়ে হাটাহাটি করবে ও খিলখিল করে হেসে উঠবে। যতক্ষণ না ওকে কোলে নিয়ে বাহিরে যাবে ততক্ষণ চিৎকার দিয়ে কাঁদতেই থাকবে। অগত্যা শাফী ওকে নিয়ে বাহিরে হাটাহাটি করে আর আফিয়া এদিকে নাস্তা বানানোর কাজটা সম্পন্ন করে নেয়। এভাবে ওদের প্রতিদিনের রুটিন চলে। বাবা চলে গেলে বুশরার দিন কাটে মা,, দাদা-দাদুর সাথে সময় কাটিয়ে। ক্বাফীর বিয়ের তোড়জোড় চলছে। আগামী শুক্রবারে আকদ করা হবে। তার পরের মাসে বিয়ে। এ নিয়ে বাড়ীতে বেশ উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করছে। আফিয়া কিচেনে রান্না করছে তখনি কলিংবেল বেজে উঠলো। শাফী বাসায় ছিলো। আফিয়া ডেকে বললো,,, শুনছেন দরজাটা খুলে দেখুন কে আসছে…..
চলবে………

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে