অঙ্গীকার (১৪তম পর্ব)

0
1566
অঙ্গীকার (১৪তম পর্ব) লেখা – শারমিন মিশু রাদিয়া ঘুমন্ত বুশরার দিকে তাকিয়ে আছে সেই থেকে। চোখ থেকে অনর্গল পানির ফোয়ারা বইছে। কি মেয়ে কি হয়ে গেলো?? একেবারে রাগ দেখিয়ে নিয়ে আসা?? আমি না হয় বা বুঝে একটু রাগ দেখিয়েছি উনি যা করেছে তাকি ঠিক হলো? মেয়েটা এতো বেশি অসুস্থ হয়ে গেলো আমাদের জানানোর প্রয়োজন ও মনে করেনি।
সালেহা দরজায় দাঁড়িয়ে রাদিয়ার কান্ডকারখানা দেখছে। রাদিয়া একবার বুশরার গালক আদর করছে কখনো বুকের সাথে শক্ত করে চেপে ধরছে। শাফী বোধহয় বাথরুমে বুশরার কাপড় পরিস্কার করছে। রাদিয়া বুশরার সব প্রয়োজনীয় জিনিস আর কাপড় – চোপড় গুছিয়ে নিলো। কোনভাবে মেয়েকে এখানে রাখবেনা ও । আজ এখনি নিয়ে যাবে শাফী বাথরুম থেকে বেরিয়ে রুমের মধ্যে বোরখা পড়া একজন মহিলাকে দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। আমার রুমে মহিলা মানুষ!! তাও আবার বোরখা পরা!! শাফী পিছন থেকে বললো,,, কে আপনি? -শাফীর গলার আওয়াজ পেয়ে রাদিয়া ওখানে দাঁড়িয়ে পড়লো। ঘুরে দাঁড়ানোর সাহস ওর হলোনা। তাড়াতাড়ি মুখের নেকাবটা টেনে দিলো। -কি ব্যাপার কথা বলছেন না কেন?? কে আপনি? আর এখানে কি করছেন? ভিতরে আসলেন কি করে? সালেহা গিয়েছেন রাদিয়ার জন্য নাস্তা রেডি করতে। আফিয়া মারা যাবার পর এই প্রথম মেয়েটা এ বাড়িতে এসেছে। কিন্তু হঠাৎ করে শাফীর জোরে জোরে কথা শুনে উনি কিচেন ছেড়ে একরকম দৌড়ে আসলো। ছেলেকে লক্ষ্য করে বললো,,, কিরে এমন চিৎকার করছিস কেন? -মা উনি কে? অনেকক্ষণ ধরে জিজ্ঞেস করছি কোন কথা বলছে না। -আরে ও রাদিয়া। -কিহ!!! রাদিয়া!!! তো ও কথা বলবেনা? আমি তো ভাবলাম কে না কে। -সালেহাকে দেখে রাদিয়া সামনে ঘুরে ভয়ে ভয়ে সালাম দিলো। আসলে শাফীর সামনে বুশরার সাথে সেদিনের আচরণের জন্য লজ্জায় মাথা উঁচু করে তাকাতে পারছেনা। -শাফী সালামের জবাব দিয়ে এই ভদ্রতা রক্ষার্থে বললো,, কেমন আছো রাদিয়া? আর কখন আসছো? এতক্ষণ কথা বলোনি কেন?? -জী আলহামদুলিল্লাহ। -আচ্ছা বসো বলে শাফী বারান্দার দিকে গেলো। রাদিয়া বুশরাকে কোলে করে ওর কাপড় চোপড়ের ব্যাগটা নিয়ে তাড়াহুড়ো করে রুম থেকে বেরিয়ে আসলো। সালেহাকে ডেকে বললো,, আন্টি আমি বুশরাকে আমার সাথে নিয়ে যাচ্ছি? -নিয়ে যাচ্ছো মানে?? -ও আজ থেকে আমার কাছেই থাকবে। -সালেহা বুঝতে পেরে এ ব্যাপারে আর কোন কথা না বলে বললো,, কিছু মুখে না দিয়ে চলে গেলে কেমন হবে? তুমি বসো ইফতি নাস্তা নিয়ে আসছে। -না আন্টি আমি এখন কিছু খাবোনা। বাহিরে সিএনজি দাঁড় করিয়ে রেখেছি অনেকক্ষণ। -এতক্ষণ সিএনজি দাঁড় করিয়ে রেখেছো কেনো। শাফীকে বললেই ও পৌঁছে দিতো তোমাকে। -লাগবেনা আন্টি। -ইফতি নাস্তা নিয়ে এসে বললো, আপু তা কি করে হয়? এভাবে খালি মুখে চলে যেতে নাই। আর ভাবি থাকলে তো এভাবে না খেয়ে চলে যেতে না। আমিও তো তোমার বোনের মতো। নাকি আমরা পর হয়ে গেছি? -না ভাবি ব্যাপরাট মোটেই ওরকম নেই। আসলে আমার একদম সময় নেই। শাফী বুশরাকে না দেখে রুম থেকে বেরিয়ে আসতে রাদিয়া ব্যাগপত্র গুছিয়ে বুশরাকে নিয়ে যাচ্ছে দেখে কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলো। রাদিয়া বেরিয়ে যেতে গিয়েও আবার ফিরে আসলো। আন্টি আরেকটা কথা!! ইনিয়ে বিনিয়ে কথা বলতে আমার ভালো লাগেনা। বুশরার মায়ের ব্যাপারে আপনারা যা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তা মেনে নিতে আমার কোন আপত্তি নেই। আপনারা সবাই মিলে যা করবেন তাই আমি মেনে নিতে রাজি আছি। আর সবচেয়ে বড় কথা বুশরাকে ছেড়ে একদিন ও কাটানো আমার পক্ষে সম্ভব নয় বলেই দ্রুতগতিতে বেরিয়ে গেলো। শাফী দরজায় দাঁড়িয়া রাদিয়ার এই কথাগুলো শুনে যেনো তাজ্জব বনে গেলো। কি বলে গেলো রাদিয়া এসব?? শাফীর মনে হলো ওর কান ভুল শুনেছে। কথাগুলোর আগামাথা ওর বুঝে আসছেনা। রাদিয়া কেন রাজি হলো?? কেউ কি ওকে জোর করেছে বুশরার মা হতে? সালেহা খুশিতে গদগদ হয়ে পিছন ফিরতেই শাফীকে দেখলো দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। মনে মনে বললো,, যাক আমাকে আর কষ্ট করে কিছুই বলতে হবেনা। যার শুনার সে সব শুনে নিয়েছে ভালোই হয়েছে। এখন পুরো ব্যাপারটা ভালোই ভালোই সেরে গেলে হয়। রাদিয়াকে বুশরাকে কোলে নিয়ে ঘরে ঢুকতে দেখে মুনিরার চোখ বড়বড় হয়ে গেলো। কিরে সকালে কাউকে কিছু না বলে কোথায় বেরিয়ে গেলি? ফোনটা ও নিলিনা। বুশরাকে নিয়ে আসলি কই থেকে? -ওদের বাড়ি গিয়েছি ওকে আনতে। সেখান থেকে নিয়ে এসেছি। -কেন আনলি ওকে? তুই না চাইতি ও ওর বাড়ীতে ফিরে যাক। খালি খালি মায়া বাড়িয়ে কি লাভ? এখন মায়া আসলো কেমনে? -এত কথা বলার মতো ইচ্ছে এখন আমার নেই। মায়া কোন কালেই কম ছিলোনা। শুধু একটা কথা শুনে রাখো,, বুশরাকে ছেড়ে থাকা আমার পক্ষে কোনভাবে সম্ভব নয়। আর তার জন্য যদি নিজের সব ইচ্ছে আর স্বপ্নকে জলাঞ্জলি দিতে হয় তাই দিবো। তোমরা যা চাও তাই হবে। শাফী ভাইয়াকে বিয়ে করলে যদি আমি বুশরার সব দায় দায়িত্ব পাবো তাহলে সেই ব্যবস্থা করো আমার কোন আপত্তি নেই বলে রুমের দিকে গেলো। জাওয়াদ সাহেব আর মুনিরা একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করলো। হঠাৎ করে হলোটা কি? এভাবে রাজি হয়ে গেলো? মুনিরা স্বামির দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলো। -এতো কথা বলার কি দরকার? তোমার মেয়ে রাজি হয়েছে এটাই অনেক। এখন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়ের কাজটা সেরে ফেলতে হবে। রাজি যখন হয়েছে দেরি করে লাভ কি? তুমি বেয়াইনের সাথে কথা বলো। শাফীর কি মতামত তা জেনে যা করার করতে হবে।
শাফী রাদিয়ার কথাগুলো নিয়ে সেই থেকে চিন্তা করছে। মেয়েটা কি বুঝে রাজি হলো?? আমাকে বিয়ে করলে ওর কোনো স্বপ্নই যে পূরণ হবেনা। ওর বয়সের দ্বিগুন বলতে গেলে আমার বয়স। সামান্য আবেগের বশবর্তী হয়ে এরকম কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নেয়ার কোন মানে হয় কি? ও বললে কি হবে? আমি তো কোনদিনও আফিয়ার জায়গায় অন্য কাউকে বসাতে পারবোনা। আফিয়ার সাথে কাটানো সময়গুলো স্মৃতি করে আমি বাকী জীবনটা পার করে দিতে পারবো। কিন্তু রাদিয়া কি পাবে? জীবনের সুন্দর মুহুর্তগুলো ওর এখনো অধরাই রয়ে গেছে। না এটা সম্ভব নয়। এসব চিন্তা করতে করতে শাফী রুমের এ মাথা থেকে ওমাথা পায়চারী করেছে কয়েকবার। ও এখন কঠিন চিন্তায় ডুবে আছে অন্য কোনদিকে ওর খেয়াল নেই সালেহা অনেকক্ষণ ধরে দরজায় দাঁড়িয়ে ছেলের গতিবিধি লক্ষ্য করেছেন। আস্তে করে খাটের একপাশে বসলেন। শাফী মাকে দেখতেই বুকের ভিতরে ধ্বক করে উঠলো। জানে মা এখন কি বলবে। কিন্তু এটা হতে পারেনা। -আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে আছিস কেনো? দেখ তুই তো সব শুনেছিস রাদিয়া ওর মতামত জানিয়ে গেছে অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় তাই তোকে নতুন করে বলার প্রয়োজন মনে করছিনা। ও বাড়ি থেকে তোর শাশুড়িও ফোন দিয়েছে। রাদিয়া নাকি ওদের ও স্পষ্ট ভাষায় ওর মতামত জানিয়ে দিয়েছে। -মা এটা সম্ভব নয়। তোমরা সবাই নিজেদের মতো সিদ্ধান্ত নিলে তো হবেনা। আমার পক্ষে আবার বিয়ে করা সম্ভব নয়। – আমি এখানে তোর মতামত জানার জন্য আসিনি। তোর মতামত নেয়া আমার জন্য জরুরী নয়, যার মতামত সবচেয়ে দরকার ছিলো তা পেয়ে গেছি। তাই তুই বললেও আমি আর শুনছিনা। তোকে শুধু এটুকু জানাতে এসেছি এই সোমবারে আমরা ওই বাড়ী যাচ্ছি। -মা হাতে ধরে একটা মেয়ের জীবন কেন ধ্বংস করছো? -মানে?? -আমি ওকে কখনো মেনে নিতে পারবোনা। পরে রাদিয়া যদি কষ্ট পায় তার জন্য দায়ী তোমরা এটাই মনে রেখো। মুনিরা আর জাওয়াদ সাহেব বিয়ের সব প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। যাই হোক মেয়েটার তো প্রথম বিয়ে। উনি কোন কমতি রাখতে চান না। মেয়েটা যাতে কখনো বলতে না পারে ওর বিয়েতে আমরা কোন অনুষ্ঠান করিনি। ওরা বলেছে সোমবারেই আসবে তাই এতো তোড়জোড়। রাদিয়া কিচেনে এসে বললো,,, মা কথা ছিলো? -কি কথা? -সোমবারে তোমরা কোন অনুষ্ঠান করবে না। কোন মেহমান দাওয়াত করবে না। লোক জাবা জানির কোব দরকার নেই। মানুষ এমনিই জানতে পারবে। খালি খালি টাকা নষ্ট করার কোন মানে হয়না। আর কোনো শপিংও করতে পারবেনা। -কি বলছিস তুই? -যা বলছি ঠিক বলছি। কোন আনুষ্ঠানিকতা নয় একেবারে ঘরোয়াভাবে বিয়েটা হওয়া চাই। শপিং,, ঝাঁকজমক আর কোন আড়ম্বরতা চাইনা আমি বলে চলে গেলো। মুনিরা ভেতর থেকে আসা কষ্টের দীর্ঘশ্বাসটা চেপে গেলেন। কতটা কষ্ট নিয়ে মেয়েটা না জানি বিয়েটা করছে!! আমরা তো ওকে কেউই জোর করিনি। সিদ্ধান্তটা সম্পূর্ণ ওর মতামতের উপর ছেড়ে দিয়েছে। একটা স্বাধীন সাবালিকা মেয়ের উপর মা বাবার জোর করে কোন সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়া মোটেই ঠিক না। আর আফিয়া ও বলে গেছে কেউ যেনো ওর উপর জোর না করে। সেই জন্য উনারা কেউ ওভাবে জোর দিয়ে কিছু বলেনি। কিন্তু ও কি ভেবে রাজি হলো বুঝতে পারছিনা প্রথমে তো কোনভাবেই রাজি হচ্ছিলো না!! যথাসময়ে শাফীদের বাড়ি থেকে সবাই আসলো। কোন আড়ম্বরতা নেই রাদিয়ার কথা অনুযায়ী শুধুমাত্র দুই পরিবারের লোকেরাই উপস্থিত আছে। শাফী আসতে চায়নি অনেক জোর করে ওকে আনা হয়েছে। সকাল থেকে তো দরজাই খুলছিলোনা৷ দরজা আটকে রুমে শুয়ে ছিলো। দরজা খুলে যখন বেরিয়ে আসলো ওকে দেখে সবাই অবাক!! চোখমুখ ফুলে আছে মনে হয় রুমে বসে কেঁদেছে। একটা ফরমাল শার্ট পরে বেরিয়ে বললো,,, চলো। ক্বাফী বললো,, ভাইয়া তুই এভাবে যাবি? -কেন কি সমস্যা কি? -একটা পান্জাবী তো পরবি। যাই হোক না কেন আজ তো তোর বিয়ে!! -দ্বিতীয় বিয়ে এটা কেন বলছিস না? আর ওই বাড়ী আমার জন্য নতুন নয় সবাই চেনাজানা। -তারপরও! -এভাবেই যাবো। সমস্যা হলে যাবোনা। অগত্যা আর কেউ কোন কথা না বাড়িয়ে চলে আসলো। সালেহা নিজে থেকে বিয়ের জন্য যাবতীয় দরকারী কিছু শপিং করেছে। তার ছেলের নয়তো দ্বিতীয় বিয়ে মেয়েটার তো প্রথম।খালি হাতে যাওয়া মোটেই ঠিক হবেনা। ওর ও তো নিজের কোন স্বপ্ন থাকবে যা আজ আমাদের জন্য বিসর্জন দিচ্ছে। তাই ইফতিকে সাথে নিয়ে উনি টুকিটাকু কেনাকাটা করেছেন। কিন্তু রাদিয়াকে কোনভাবেই নতুন কেনা শাড়ীটা পরানো গেলোনা। বোনের গিফট করা শাড়ীটাই ও পরেছে। বড়াপু বলে গেছে,, বিয়ের দিন যাতে রাদিয়া ওর দেয়া শাড়ীটাই পরে। বোনের সব ইচ্ছে পূরণ করেছে এই ইচ্ছাটাই বা কেন অপূর্ণই থাকবে? তাই রাদিয়া ওই শাড়ীটাই পরেছে। এর বাইরে আর কোন সাজগোজ ও করেনি। শাফী মাকে ডেকে বললো,, মা আমি আগে রাদিয়ার সাথে একবার কথা বলতে চায়? -সালেহা বললো,, কথা তো পরেও বলতে পারবি। -শাফী ঈষৎ রাগ দেখিয়ে বললো, মা কথা বলাটা এখন দরকার পরে বলে কি করবো? আগে আমি কথা বলবো পরে বিয়ে হবে। -শাফী জিদ কেন করছিস? -তুমি সোজাভাবে আমার কথাটা শুনলে তো আর আমাকে জোর করতে হয়না। সালেহা গিয়ে মুনিরাকে কথাটা জানালো। পরে শাফীকে রাদিয়ার সাথে কথা বলার অনুমতি দেয়া হয়। শাফী বুশরাকে কোলে করে রাদিয়ার রুমের দিকে আগালো। দরজায় দাঁড়িয়ে নক করতেই ভিতর থেকে অনুমতি পেয়ে শাফী ধীর পায়ে রুমে প্রবেশ করলো…… চলবে………

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে