অঙ্গারের নেশা পর্ব-১+২

0
150

“অঙ্গারের নেশা”
” নাঈমা হোসেন রোদসী ”
-সূচনা পর্ব

ভয়ে কাঁপতে থাকা প্রানেশা পাত্রের দিকে তাকিয়ে লজ্জা ভুলে হা করে তাকিয়ে থাকলো৷ সকাল থেকে তার মায়ের বকাবকির কারণে পাত্রপক্ষের সামনে বসেছিলো সে। নার্ভাসনেসের জন্য নিচের দিকে তাকিয়ে পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে ফ্লোরে ঘষছিলো৷ পাত্রের দিকে ভূলেও তাকায়নি৷ হঠাৎ নাম জিজ্ঞেস করায় প্রানেশার মনে হলো অতি পরিচিত কেউ। মুখের দিকে তাকাতেই, মুখ আপনা আপনি হা হয়ে গেলো৷
এটাতো তারই বয়ফ্রেন্ড রেয়ান!

পাঁচ বছরের সম্পর্ক প্রানেশার রেয়ানের সঙ্গে, রেয়ানের প্রপোজের থেকে প্রেমের শুরু। এখন প্রানেশা প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে রেয়ানকে৷ কয়েক দিন আগেও প্রানেশা যখন রেয়ানকে বিয়ের জন্য বললো, রেয়ান বলেছিলো ‘ কয়েক দিন যাক, তারপর বিয়ের ব্যাপারে ভাববো’ অথচ পরিবার নিয়ে বিয়ের কথা বলতে এলো! প্রানেশা অবাক হলেও ভিষণ খুশি হলো৷ ইশ,ভালোবাসার মানুষটার সঙ্গে সারাজীবন কাটানোর মতো সুসংবাদ আর কী হতে পারে!

প্রানেশা ঠিক করলো, রেয়ানকে এবার ধরবে। পেয়েছেটা কী! সকাল থেকে ফোনের পর ফোন দিয়েছে সে একবারও রিসিভ করেনি। কিছুক্ষণ পর,রেয়ানের বাবা নিজেই বললো দুজনকে একটু আলাদা করে কথা বলতে। প্রানেশা সুযোগ পেয়ে হাতছাড়া করলোনা, রাজি হলো। প্রানেশা রেয়ানকে নিজের রুমে নিয়ে গেলো। যেহেতু, প্রানেশা আগে থেকেই রেয়ানকে চেনে তাই লজ্জা না পেয়ে রুমের সিটকানি লাগিয়ে দিলো। রেয়ান পাশেই ঠান্ডা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। প্রানেশা কয়েক কদম এগিয়ে খপ করে রেয়ানের কলার টেনে রাগী মুখে তাকালো৷

-‘সমস্যা কী? ফোন ধরনি কেনো? জানো আমি কত ভয় পেয়েছিলাম৷ তোমার জায়গায় অন্য কেউ হলে কী হতো?জবাব দাও রেয়ান তেহজিব ‘

রেয়ান কোনো উত্তর দিলো না। ব্যায়ামপুষ্ট লম্বা দেহের উপর আক্রমণাত্মক দৃষ্টি দিয়ে তাকানো প্রানেশাকে হালকা হাতে ছাড়িয়ে নিলো। আয়েশি ভঙ্গিতে পাশের সোফায় বসে এসির রিমোট দিয়ে পাওয়ার বাড়িয়ে দিলো৷ পায়ের উপর পা তুলে হাত ঘড়ির টাইমটা দেখে নিলো৷ প্রানেশা অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছে। রেয়ান এমন কেনো ব্যবহার করছে, সে বুঝতে পারছেনা। হঠাৎ করে প্রানেশার মনে হলো, রেয়ানকে আজ
মাত্রাতিরিক্ত সুন্দর লাগছে৷ সাধারণত রেয়ান সুন্দর, পাঁচ ফুট দশের লম্বা দেহের ফর্সা ত্বকের অধিকারী। কিন্তু, এখন সামান্য কিছু পার্থক্য লাগছে। যেমন,বেশী ফর্সা দেখাচ্ছে, চুলগুলো একটু বড়, দেহটাও যেন আরও বেশি আকর্ষনীয় দেখাচ্ছে। এমন সৌন্দর্য বৃদ্ধি হওয়ার কারণ বুঝতে পারলো না৷ বেশির ভাগ সময় রেয়ান তার রাগ ভাঙায়। যখনই প্রানেশা রাগে তখন রেয়ান কান ধরে, আদুরে কথা বলে। কিন্তু এখন এমন করছে কেনো?

রেয়ান প্রানেশার হাত হেঁচকা টান দিয়ে কোলে উঠিয়ে নিলো৷ প্রানেশা হকচকিয়ে তাকিয়ে আছে৷ তাকে আরও বিভ্রান্ত করতে রেয়ান প্রানেশার ঘাড়ে ঠোঁট ছোঁয়াল। প্রানেশা থরথরিয়ে কাঁপা শুরু করলো। তিন বছরে প্রানেশা কখনোই রেয়ানকে এত কাছে আসতে দেয়নি। আজকে রেয়ানের ছোঁয়াও বোধ হয় বদলে গেছে। আগে হাত ধরলেও তেমন কোনো অনুভূতি হতো না, অথচ কেমন অস্থিরতায় ভেসে যাচ্ছে সে। এত প্রখর ছোঁয়ায় চুপসে গেলো প্রানেশা। রেয়ান কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো –

‘এত রাগ ভালো না প্রাণ। শরীরের ক্ষতি হয়। ‘

‘ প্রাণ? কখনো তো এই নামে ডাকোনি। তাহলে আজ কেনো?’

রেয়ান অধর ছড়িয়ে হাসলো। প্রানেশার চুলগুলো পিছনে সরিয়ে হিম শীতল কণ্ঠে বললো –

‘ আগে তো শুধু প্রেমিকা ছিলে, কয়েক দিন পর বউ হয়ে যাবে। বউ তো নেশার জিনিস প্রাণ,তাই এখন থেকে তোমার এই নামই বরাদ্দ হবে ‘

প্রানেশা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। রেয়ান তার ছোয়াঁয় তাকে আবার ডোবালো। প্রানেশা কাঁপতে থাকা গলায় বললো –

‘আজ কী আমায় মেরে দেয়ার মনোভাব স্থির করলে?’

রেয়ান হাসলো। দূরে সরে এসে প্রানেশার গলায় দুই আঙুল আলতো ছুঁয়ে বললো ধীর গতিতে বললো –

‘ এমন হাজারওবার মরতে তৈরি হও প্রাণ ‘

প্রানেশা কথাটাকে স্বাভাবিক ভাবেই নিলো৷ দুইজন বের হয়ে সম্মতি দিতেই বিয়ের কথা আগালো৷ ধুমধামে রেয়ান প্রানেশার বিয়ের আয়োজন শুরু হলো।

নিজের রুমে বসে প্রানেশা বধূ বেশে চুপটি করে বসে আছে৷ কিছুক্ষণ পরই বর আসবে। রেয়ান আর কিছুক্ষণ পরই তার নামে লেখা হয়ে যাবে৷ কী মনে করে প্রানেশা মোবাইল হাতে নিলো৷ মনে মনে ভাবলো একবার কল করে দেখা যাক রেয়ান কোথায়! কল দিতেই তিন বারের সময় রিসিভ হলো। সাথে সাথেই রেয়ান অতি আদুরে কন্ঠে বললো –

‘সরি জান এই দশদিন কল করতে পারিনি। বাবা আমাকে আর্জেন্ট কিছু কাজে সিঙ্গাপুর পাঠিয়েছিলো। এত ঝামেলা যে তোমায় কল করার সময় পাইনি। ‘

প্রানেশা থম মেরে বসে পড়লো। বুকের ভিতরটা হঠাৎ অস্থিরতায় ভরে উঠছে। ভাঙা কন্ঠে বললো –

‘মানে! আজ তোমার আর আমার বিয়ে। কয়েকদিন আগেও তো তুমি বললে আমায় লাল বেনারসিতে দেখতে চাও’

রেয়ান বিরক্তি ভঙ্গিতে অবাক হয়ে বললো-

‘এসব কী উল্টো পাল্টা বলছো প্রানেশা? দশ দিন আগেই আমি সিঙ্গাপুর চলে এসেছি, বিয়ে কীভাবে করবো?’

চলবে…..

অঙ্গারের নেশা
নাঈমা হোসেন রোদসী
পর্ব-২

প্রানেশা ধপ করে নিচে বসে পড়লো৷ কী করে সম্ভব এটা? যদি রেয়ান সিঙ্গাপুরেই থাকে তাহলে দুইদিন আগেও এসে ওকে জড়িয়ে ধরলো সে কে? প্রশ্নে মাথা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। নাহ,আর চুপ করে থাকা যাবে না। নাহলে ভালোবাসা চিরকালের জন্য হারিয়ে ফেলবে প্রানেশা। দ্রুত উঠে দাড়িয়ে কপালের উপর জমা ঘাম মুছলো সে৷ দরজা খুলতে হাত বাড়াতেই, কেউ একজন দরজা টান দিয়ে খুলে ফেললো৷ হকচকিয়ে সামনে তাকালো প্রানেশা, রেয়ান দাঁড়িয়ে আছে। প্রানেশা মনে মনে ভাবলো ‘নাহ, এ রেয়ান হতে পারে না। ‘ রেয়ান অদ্ভুত ভঙ্গিতে মুচকি হেসে দাঁড়িয়ে আছে। প্রানেশা ভেতরে ভেতরে ভয়ে কাঁপছে। সাহস করে চিৎকার করে বললো-
‘কে আপনি? আপনি আমার রেয়ান হতে পারেন না ‘

রেয়ানের মাঝে কোনো আলাদা প্রতিক্রিয়া দেখা গেলো না। সে যেনো আগে থেকেই এই ব্যাপারে অবগত। চুপ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে প্রানেশার কোমর ধরে টেনে নিলো৷ প্রানেশা এত শক্তির সাথে না পেরে হাঁপিয়ে উঠলো৷ ব্যাক্তিটি প্রানেশার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো –
‘বলেছিনা প্রাণ? এত রাগ দেখাবে না। আর আমার সাথে তো নয়ই। এখনো চেনোনি আমায়। ‘

কিছুটা থেমে অস্বাভাবিক ভাবে ঘাড় বাকিয়ে বললো-
‘শোনো প্রাণ, আমাকে রাগিও না। এর ফল ভালো হবে না। শুনেছিলাম তোমার বাবার হার্টের অসুখ আছে। এর আগেও দুইবার এট্যাক হয়েছে। একমাত্র মেয়ের বিয়ের আসরে বিয়ে ভাঙলে নিশ্চয়ই সহ্য করতে পারবে না? এবার কিন্তু এট্যাক হলে মারা যাওয়ার সম্ভবনা ১০০ পার্সেন্ট’

প্রানেশা ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। এ কেমন পরীক্ষায় পরলো সে? ঠিকই, এবার যদি বিয়ের আসরে বিয়ে ভাঙে তাহলে আর সে সহ্য করতে পারবে না। কিন্তু বিয়ে করলে, রেয়ান কী করে সহ্য করবে! তার প্রথম ভালোবাসা রেয়ান। তাকে ভূলে এই বহুরূপীর সঙ্গে কী করে সংসার করবে ভেবে পাগল লাগছে নিজেকে প্রানেশার। জোর করে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে জোরে বলে উঠলো –
‘কখনোই না। আপনাকে বিয়ে করবো না আমি। আমার ভালোবাসা রেয়ান। ‘

ব্যাক্তিটি ভীষণ রেগে গেলো। নিজের গায়ের সব শক্তি লাগিয়ে প্রানেশার গলা চেপে ধরলো । ফুঁসতে ফুঁসতে বললো-
‘খবরদার, তোমার মুখে অন্য কারো নাম আমি সহ্য করবো না প্রাণ। তোমার চোখে মুখে, অন্তরে, তোমার দেহের সর্বাঙ্গে শুধু এই আমার বিচরণ চলবে। তুমি আমার প্রাণ, যে আমার প্রাণকে আমার কাছে থেকে ছিনিয়ে নিতে চাইবে তাকে কেটে টুকরো করতে আমি দুবার ভাববো না।’

প্রানেশা বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে । কেমন হিংস্র পশুর মতোন ব্যবহার। এই মানুষটাকে বিয়ে করলে বাঁচার সম্ভবনা আছে কী? মনে সংশয় জাগে প্রানেশার। চোখের পানি পড়তে পড়তে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে৷ ব্যাক্তিটি লম্বা শ্বাস ফেলে প্রানেশাকে ছেড়ে দিলো। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো-
‘বিয়ে ভাঙার কোনো চেষ্টা করবে না প্রাণ। চুপচাপ নিজে যাবে কবুল বলবে। যদি কোনো গন্ডগোল করার চেষ্টা করো তো তোমার রেয়ানকে সিঙ্গাপুরের মাটিতেই পুতেঁ রাখবো’
প্রানেশা শব্দ করা ভুলে গেছে। সে বুঝে গেছে সামনে দাঁড়ানো ব্যাক্তিটি সামান্য কেউ নয়। কতটা শক্তিশালী হলে, ফোনে রেয়ানের সাথে কথা বলে যে সত্যিটা প্রানেশা জেনে গেছে তা নিমিষেই ধরে ফেললো। অর্থ ও শক্তি দুটোই প্রচুর পরিমাণে আছে এর। কোনোভাবেই এখন পালানো সম্ভব না। প্রানেশাকে চুপ থাকতে দেখে লোকটি ঠোঁট এলিয়ে হাসলো । সে বুঝে গেছে প্রানেশা আর পালানোর চেষ্টা করবেনা। প্রানেশার কাছে দুই পা এগিয়ে গেলো সে। হাত দিয়ে গাল মুছে দিয়ে মাথার ঘোমটা টেনে আরেকটু বাড়িয়ে দিলো। মুখ বাড়িয়ে প্রানেশার চোখের পাতায় চুমু খেয়ে সরে গেলো। ধীর পায়ে গম্ভীর ভঙ্গিতে দরজা খুলে বেরিয়ে গেলো। প্রানেশা চুপ করে চেয়ারে পুতুলের ন্যয় শক্ত হয়ে বসে থাকলো৷ ব্যাক্তিটির সত্যিটা জানতে হলেও বিয়ে করতে হবে। মনে মনে স্থির করে এখন পালানোর পথ না পেলেও বিয়ের পর তো পাবে। এক না একদিন তো রহস্য বের করবেই সেদিনই এই হিংস্র বহুরূপীকে ডিভোর্স দেবে। এতে যা হওয়ার হোক৷ কিছুক্ষণ পরই কাজিনরা এসে তাকে নিচে নিয়ে গেলো৷ পুতুলের মতোই কবুল বলে বিয়ে সম্পন্ন করলো৷
বিদায়ের সময়ও প্রানেশা কাঁদলো না। অনুভূতিহীন ভাবে বসে থাকলো৷ গাড়ি দিয়ে যাওয়ার সময় মাথা এলিয়ে বসে নিজের ভাগ্যের উপর তাচ্ছিল্য হাসলো।
মনের তীব্র হাহাকার যেনো বেড়েই যাচ্ছে। কী হবে আগামীর ভবিষ্যৎ! রেয়ানকে সে কী জবাব দেবে? আর এই বহুরূপীকেই বা কী করে স্বামীর স্হান দেবে সে!
শ্বশুর বাড়ির সামনে গেট খুলতেই প্রানেশা বাহিরে বের হলো৷ বাড়ি দেখে অবাক না হয়ে পারলো না। কালো রঙের এমন বিশাল বাড়ি প্রথম বার দেখলো সে৷ প্রানেশার বাবারও যথেষ্ট টাকা পয়সা আছে৷ বাড়িও যথেষ্ট সুন্দর। কিন্তু এতবড় নয়, কালো রঙ দিয়ে এমন কেন করলে বাড়িটাকে প্রানেশা বুঝে উঠতে পারলো না। লম্বা শ্বাস ছেড়ে সবার সাথে ভেতরে প্রবেশ করলো।

রাহাত তেহজিব নিজের রুমে বসে চিন্তায় পায়চারি করছেন৷ মিসেস অদিতি তেহজিব ভেতরে প্রবেশ করে বললেন-‘কী হয়েছে?আপনি এভাবে পায়চারি করছেন কেনো?’

তিনি চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন-
‘তুমি বুঝতে পারছো না? কেনো আমি এত চিন্তা করছি! এমন করে মেয়েটাকে ধোঁয়াশায় রাখা উচিত হচ্ছে? ‘

মিসেস অদিতি ভাবলেশহীন ভাবে ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়ালেন৷ তিনি ভীষণ ক্লান্ত। ছেলের বিয়েতে খাটুনি কম হয়নি৷ এখন লম্বা একটা ঘুমের প্রয়োজন তার। হাতের চুড়ি গুলো খুলতে খুলতে হাই তুলে বললেন-
‘এত চিন্তা করো না। যা হয়েছে ভালোই হয়েছে। মেয়েটার জীবন নষ্ট হয়ে যেতো’

মিস্টার রাহাত অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন –
‘আর এখন? মেয়েটার জীবন এখন নষ্ট হয়নি? তোমার বড় ছেলে কেমন মানুষ তুমি জানো না! মেয়েটাকে বাঁচতে দেবে! ‘

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে