মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া পর্ব-৩৮+৩৯

0
651

#copywritealert❌🚫
#মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া
#লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৩৮
ইন্ডিয়া থেকে ফেরার পর সপ্তাহ খানেকের মতো পেরিয়ে গেছে। মীরা ও শেহজাদ দুজনেরই ইউনিভার্সিটি খুলে দিয়েছে। দুজনে আবার আগের মতো কাজে ব্যস্ত। বিগত মাসগুলোর রুটিন অনুসারে শেহজাদ মীরাকে ভার্সিটিতে পৌঁছে দেয় তারপর নিয়েও আসে। কয়েকদিন পর শেহজাদের জন্মদিন। মীরা কিছু গিফট কিনবে। অনেক ভেবে ভেবে ডিসাইড করলো কী কিনবে। অনলাইনে অর্ডার করবে একবার ভেবেও নিজেই একটা ক্লাস রিসিডিউল করে শপিংমলে চলে গেলো। স্বচক্ষে দেখে কেনার মধ্যে একটা প্রশান্তি তো কাজ করে। শপিংমলে এসে প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিটের মতো সময় ব্যয় করে অতঃপর সে একটা সুট পছন্দ করতে পেরেছে! নিজের এই সময়জ্ঞান নিয়ে হেলাফেলার বিষয়টা বুঝে নিজে নিজেই বলে,

“উনি আসলে চুপ করে থেকে শুধু এক্সপ্রেশণ দিতেন। কতো রকমের এক্সপ্রেশন! চোখ ছোটো ছোটো করা, ভ্রু কুঁচকে থাকা, বারবার হাতঘড়ি দেখা, পায়ে জোড়ে শব্দ করা, এদিক-ওদিক হাঁটা! কেন যে বুঝে না? মেয়েদের শপিং করতে একটু তো সময় লাগেই। আমরা কাপড়ে সুতা পর্যন্ত চেক করি!”

মীরার বিড়বিড় করার মধ্যে এক মহিলা সেলসওমেন এসে জিজ্ঞাসা করেন,
“এনিথিং রং, ম্যাম?”

মীরা থেমে যায়। জোরপূর্বক হেসে হাতের সুটটা এগিয়ে দিয়ে বলে,
“এটাকে কাউন্টারে জমা করুন।”

সেলসওমেনটি মিষ্টি হেসে সম্মতি দিয়ে সুটটি নিয়ে কাউন্টারে চলে যায়। এরপর বিল পে করে মীরাও সেখান থেকে বেরিয়ে আসে। তারপর আরও আধ ঘণ্টার মতো সময় ব্যয় করে ফ্রিশার জন্য একটা টপস কিনে শপিংমল থেকে বেরিয়ে আসে। উবার ড্রাইভারকে কল করলে ড্রাইভার তাকে কিছুটা সামনে যেতে বলে। বাধ্য হয়ে মীরা তাই করতে সামনে এগুচ্ছে। তখনি হঠাৎ অপ্রত্যাশিত ভাবে একটা গাড়ি তীব্র গতিতে রং সাইড থেকে এসে মীরাকে ধাক্কা দিবে দিবে তৎক্ষণাৎ এক বৃদ্ধ রিকশাচালক মীরাকে টান দিয়ে সাইডে নিয়ে আসে। আচমকা ঘটনায় মীরা হতবাক! কী থেকে কী হচ্ছিলো সব তার বুঝার বাহিরে। আশেপাশের লোকজনও জড়ো হয়ে গেছে। কয়েকজন লোক গাড়ির পেছনে ছুটতে ছুটতে ধরতে না পেরে ফের ফিরে এসেছে। রিকশাচালক লোকটা জিজ্ঞাসা করেন,

“মা, আপনে ঠিক আছেন?”

মীরা মাথা নাড়ায়। রিকশাচালক ফের বলে,
“ওই গাড়িয়ালার মনে হয় মাথায় সমস্যা। নাইলে এই পাশ দিয়া কেন আইবো? ম*দ-গা*ঞ্জা খা*ইয়ানি গাড়ি চালায় আল্লাহ মালুম।”

জড়ো হওয়া লোকজনও অনেকে অনেক কথা বলছে। মীরা কিছুক্ষণ সময় নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে রিকশাচালকটাকে বলল,
“চাচা, আমার সাথে একটু ওই সামনের গাড়িটা পর্যন্ত আসবেন? আপনার রিকশাও সাথে করে আনেন।”

রিকশাচালক তাই করলো। সামনে গিয়ে মীরা উবার ড্রাইভারকে না করে তার প্রাপ্য ভাড়াটা মিটিয়ে বিদায় করে দিয়ে রিকশাতে চেপে বসে। এখন আর সে ভার্সিটিতে যাবে না। একেবারে বাড়িতে ফিরবে। বাড়ির সামনে এসে নেমে রিকশাচালককে এক হাজার টাকার নোট দেয়। রিকশাচালক অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলে মীরা মুচকি হেসে বলে,
“আপনি এমনিতে নিতেন না। তাই আপনার রিকশায় করে আসলাম। আপনি আমার প্রাণ বাঁচিয়েছেন। এর কাছে সামান্য টাকা কিছুই না।”

“কিন্তু মা, আমার ভাড়া তো এতো হয় নাই। ১৫০-২০০ টাকার বেশি তো ভাড়া হইতো না। আপনে আমারে হাজার টাকা দিয়েন না।”

“চাচা, প্লিজ। এটা নিতে মানা করবেন না। আমি খুশি হয়ে দিচ্ছি।”

“কিন্তু মা, এতো টাকা!”

“এটা কিছুই না। আপনি প্লিজ রাখেন। আজকে বাড়িতে ভালো কিছু নিয়ে যাবেন। আমি নিজেও বাজার করে দিতে পারতাম। কিন্তু আমার একটু তাড়া ছিল ফেরার জন্য। আরেকটু লেট হলে সিগন্যালে পড়লে অনেক দেরি হয়ে যেত।”

রিকশাচালকটির চোখ ভিজে ওঠলো। তিনি গলায় ঝুলানো গামছা দিয়ে চোখ মুছে নিয়ে বললেন,
“আল্লাহ আপনের ভালো করুক, মা। অনেক ভালো থাকেন। দীর্ঘায়ু হোক আপনের।”

এই বলে মীরার মাথায় হাত বুলিয়ে রিকশাচালকটি চলে যান। মীরা হেসে বাড়ির ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে মোবাইলের স্ক্রিণে সময় দেখলো পাঁচটা বাজে। শেহজাদ এখন ভার্সিটি থেকে বোরোবো। সে দ্রুত শেহজাদকে টেক্সট করে জানিয়ে দিল যে সে চলে এসেছে। তবে আজকের ঘটনাটা শেহজাদকে সে জানাতে চায় না। কারণ শেহজাদ অনেক রাগ করবে। ব*কাব*কিও করবে। যতোই হোক, শেহজাদের রাগকে সে ভয় পায়!

এদিকে নিজেদের আস্তানায় গাড়ি পার্ক করে লোকটি গাড়িতে দুই-তিনটে লা*থি মে*রে আস্তানা প্রবেশ করে। চেয়ার টেনে বসে। টেবিলের বিপরীত পাশে বসা একজন তার মুখের অবস্থা দেখে বুঝতে পারলো এবারও অসফল হয়ে ফিরে এসেছে। বিপরীত পাশে বসা মানুষটি জিজ্ঞাসা করলো,

“এবারও কিছু করতে পারোনি?”

এবার যেন লোকটির রাগ বর্ষে ওঠলো। টেবিলে সজো*ড়ে আ*ঘা*ত করে বলল,
“এবারও পারলাম না, মামা! এবারও ব্যার্থ হলাম। তিন তিন বার বেঁচে গেছে। আজকে তো সাথে ওই শেহজাদও ছিল না।”

টেবিলের বিপরীতে বসা মানুষটি হাসলেন। ফের বললেন,
“ভাগ্য ওই মেয়ের সাথে আছে বুঝলে। আরও কতোবার এটেম্প্টে সফল হও দেখো!”

“মামা, তুমি এসব বলছো? তুমি? তুমি অন্তত এসব বলো না। আমি ওই মীরাকে সুখে থাকতে দিব না। কিছুতেই না।”

কথাগুলো বলে রাগে ফুঁসছে লোকটি। লোকটির মামা এবার উঠে এসে লোকটিক কাঁধে হাত রেখে বললেন,
“শান্ত হও, রাদিব! এসব করতে সময় দিতে হয়। তুমি খুব অল্প সময়ে পরপর তিন বার অ্যা*টা*ক করে বসেছ। এখন ওদের সন্দেহ হলে ওরা আরও সতর্ক হয়ে যাবে।”

“কিন্তু মামা, আমি ওই মীরার এই সুখ সহ্য করতে পারছি না। কতোকিছু করলাম। বর্ণকে উসকেও ওর বিয়েটা আটকাতে পারলাম না। আমার জীবন নষ্ট করে নিজে সুখে থাকবে? তা আমি হতে দিব না।”

“শান্ত হও, রাদিব। কিছুদিন কোনো অ্যা*কশন নিও না। ওরা সব স্বাভাবিক ভাবতে শুরু করলে আবার করা যাবে।”

কথাটা বলে রাদিবের মামা সেখান থেকে চলেই যাচ্ছিলেন, তখন রাদিব তাকে ডাক দিয়ে বলে,
“তোমার উচিত এবার বাড়ি ফেরা। ১২ বছর হলো দেশ ছেড়েছ। এবার যখন দেশে ফিরেছো তখন বাড়ি চলো।”

লোকটি শক্ত কণ্ঠে বলল,
“তুমি খুব ভালো করেই জানো, আমি এখানে ফিরেছি শুধুমাত্র তোমার কথায়। নয়তো ফিরতাম না। তাছাড়া তোমার মা আমাকে ঘৃণা করে। নিজের কাজে ফোকাস করো। কাজ শেষ হলে আমি আবার ফিরে যাব।”

এই বলে লোকটি সেখান থেকে চলে গেলো। রাদিবও এরপর চলে যায়।

________

দুইদিন পেরিয়ে গেছে। আগামীকাল শেহজাদের জন্মদিন। মীরা কিছু প্ল্যানিং করছে। আজকে একটা এক্সট্রা ক্লাস করিয়ে আগামীকালকের একটা ক্লাস কমিয়ে রাখবে তারপর জলদি বাড়ি চলে আসবে। ফ্রিশার পাশে বসে বসে মীরা এসব ভাবছিল। তখন ফ্রিশা বলে ওঠে,

“হোয়াট আর ইউ থিংকিং, ফেইরিমাম্মাম?”

মীরা ভাবনার সুতো ছিঁড়ে ফ্রিশার দিকে চেয়ে মিষ্টি হেসে বলে,
“কাল তোমার বাবার বার্থডে তো। কী করা যায় ভাবছি।”

ফ্রিশা ভীষণ এক্সসাইটেড হয়ে গেল। সে জিজ্ঞাসা করে,
“কী করবে?”

“উম ভাবছি।”

“চলো বাবার জন্য সারপ্রাইজ প্ল্যান করি।”

“কী করবে?”

“তুমি গান গাইবে। আমি ডান্স করবো।”

মীরা অবাক হয়ে বলে,
“রিয়েলি? তুমি একদিনে নাচ কীভাবে শিখবে? আমিও নাচ পারি না।”

“উফ ফেইরিমাম্মাম! ইউটিউব আছে না? আমি দেখে দেখে শিখব। কাল সারাদিনে শিখে ফেলব।”

মীরা বলে,
“কিন্তু বাচ্চা, আমাকে তো ভার্সিটিতে যেতে হবে।”

“ওকে। নো প্রবলেম। আমি দাদুমনির সাথে শিখে ফেলব। বাবা একদম সারপ্রাইজড হয়ে যাবে। ইয়ে!”

ফ্রিশা খুশিতে হাতে তালি দিচ্ছে। তখন শেহজাদ দরজার কাছে এসে বুকে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে শুধায়,
“কী প্ল্যান করছো মা-মেয়েতে?”

মীরা ও ফ্রিশা দুজনে একে-অপরের দিকে চাওয়া-চাওয়ি করে ভ্রু কুঁচকে একসাথে সন্দেহের সুরে প্রশ্ন ছুড়ে,
“আমাদের কথা শুনছিলেন?”
“আমাদের কথা শুনছিলে?”

শেহজাদ মাথা নুইয়ে হেসে জবাবে বলে,
“না। জাস্ট কিছু একটা শিখে ফেলবে এটুকু শুনেছি। কী শিখবে তা শুনিনি।”

ফ্রিশা খুশি হয়ে উঠে গিয়ে তার বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
“তোমার সারপ্রাইজ, বাবা। টুমোরো দেখবে।”

শেহজাদ হাঁটু গেড়ে বসে মেয়েকে আগলে নিয়ে বলে,
“ওকে। এখন ঘুমিয়ে পড়ো তো। ইটস লেট, বেবি।”

ফ্রিশা তার বাবার গালে চু*মু এঁকে বই-খাতা গুছিয়ে রেখে শুয়ে পড়ে। এরপর মীরা ও শেহজাদ কিছুক্ষণ ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলে ঘুমিয়েও পড়ে।

চলবে ইনশাআল্লাহ,

#copywritealert❌🚫
#মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া
#লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৩৯
আজ সকালে মীরার ক্লাস না থাকলেও বিকেলের একটা ক্লাস স্টুডেন্টদের সাথে কথা বলে ক্লাসটা সকালে নিয়ে এসেছিল। যাতে করে জলদি ফিরতে পারে। অবশেষে ঘড়ির কাঁটা তিনটার ঘরে ছুঁই ছুঁই। মীরা ভার্সিটি থেকে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা করেছে।

এদিকে শেহজাদ নিজের অফিস রুমে বসে চিন্তায় মগ্ন। আজ ব্রেকের সময় সে একটু বেরিয়েছিল। তখন হঠাৎ একজনকে দেখে পুরোনো কিছু তিক্ত অতীত মনের কোণে উঁকি দেয়! এতো বছর পুরোনো স্মৃতি সব মনে পড়ে যায়। অতঃপর সে গাড়ি থেকে নেমে আশেপাশে লোকটাকে খুঁজেছিল। কিন্তু পায়নি। তারপর হতাশ হয়ে আবার ভার্সিটিতে ফিরে আসে। সেই থেকে বিষয়টা কোনোভাবেই তার মস্তিষ্ক থেকে বেরোচ্ছে না। দীর্ঘ ভারী নিঃশ্বাস ছেড়ে আজকের দিনের শেষ ক্লাসের জন্য তৈরি হয়ে নিলো।

_______

বাড়ি ফিরে মীরা তড়িঘড়ি করে সব রান্না করছে। সার্ভেন্টরা আগে থেকে অনেকটাই গুছিয়ে রেখেছিল বলে এখন রান্না করে শান্তি পাচ্ছে। ফ্রিশা একটা শাড়ি হাতে রান্নাঘরে এসে বলল,
“ফেইরিমাম্মাম,”

মীরা রান্নার দিকে মনোযোগ দিয়েই প্রত্যুত্তর করে। ফ্রিশা এরপর বলে,
“আমি রেড শাড়ি পড়ব?”

“পড়ো।”

“তাহলে পড়িয়ে দাও।”

মীরা এবার ফ্রিশার দিকে নজর ফেরালো। ফ্রিশার হাসিমাখা উৎসাহী চেহারা দেখে মীরাও মৃদু হাসে। তারপর আদুরে স্বরে বলে,
“উম, তুমি যদি এখন শাড়ি পরে বসে থাকো তাহলে তুমি টায়ার্ড হয়ে যাবে। সোয়েটিং হবে। যখন বাবাকে সারপ্রাইজ দিবে, তার আগে চট করে পড়িয়ে দিব। ওকে?”

” ওকে। ”

“তাহলে এখন যাও, প্র্যাকটিস করো।”

ফ্রিশা মীরার হাত ধরে হালকা নিচু হতে ইশারা করে। মীরা কৌতুহলের বশে নিচু হলে ফ্রিশা ও-কে চট করে একটা চু*মু দিয়ে ছুটে পালায়। ফ্রিশার এই আদুরে কাণ্ডে মীরা হেসে ফেলে। সেখানে উপস্থিত সার্ভেন্ট দুজনও হাসে। একজন বলে,
“ছোটোম্যাডাম, আপনারে আর ফ্রিশামনিরে দেইখা মনেই হয় না যে আপনে তার সৎ মা! আইজকাল এতো আদর তো আপন মাও করে না।”

মীরা কয়েক সেকেন্ড নিরব থেকে আবার রান্নায় চামচ নাড়তে নাড়তে মুচকি হেসে বলে,
“জরুরী না যে মা হতে হলে জন্ম দিতে হবে। তাছাড়া ফ্রিশাকে ভালো না বেসে থাকা যায় নাকি? তোমরা ওইদিকটা গুছিয়ে ফেলো তো। আর প্লেট-বাটিগুলো নামিয়ে ক্লিন করে ফেলো।”

সার্ভেন্টরাও বুঝলো যে মীরা এই বিষয়ে কথা বাড়াতে ইচ্ছুক না। ওরা জলদি করে সেখান থেকে কাজে লেগে পড়ে। সার্ভেন্টরা রান্নাঘর ছাড়তেই মীরা হাতের কাজ থামিয়ে চোখ বন্ধ করে ঘন নিঃশ্বাস ছেড়ে নিজে নিজেই বলে,
“মাকে তো কেউ কখোনো এসব বলেনি। আজকাল জামানাই এমন যে ভালো ব্যবহার করলেও সন্দেহ হয়!”

আফসোস করে নিজেই হাসে। অতঃপর দ্রুত কাজ শেষ করতে থাকে।

______

সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে শেহজাদ সবার আগে তার ফুফিজানের রুমে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দেয়। মিসেস শাহিদা হঠাৎ করে শেহজাদকে নিজের রুমে বিনা নক করে ঢুকতে দেখে কিছুটা অবাক হন। তিনি বিছানায় বসে তসবিহ পড়ছিলেন। অতঃপর ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করেন,

“কী হয়েছে, শেহজাদ? হঠাৎ আমার রুমে আসলে?”

শেহজাদ চেয়ার টেনে মিসেস শাহিদার কাছে বসে। কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে বসে থাকে। মিসেস শাহিদা উদগ্রীব হয়ে নিজের ভাতিজাকে দেখছেন। কয়েক মুহূর্তের পর শেহজাদ চেয়ার ছেড়ে ফ্লোরে বসে নিজের ফুফির কোলে মাথা রাখে। এতে যেন মিসেস শাহিদা ভীষণ অবাক হয়ে যান। হঠাৎ কী এমন হলো যে শেহজাদ এতোটা ভেঙে পড়েছে? ভেঙে না পড়লে তো শেহজাদ এমনটা করে না। শেষবার ফিওনার মৃ*ত্যুর সময় তার কোলে মাথা রেখেছিল। মিসেস শাহিদা উৎকণ্ঠা নিয়ে প্রশ্ন করেন,

“কী হয়েছে, বাবা? তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?”

শেহজাদ চোখ বন্ধ করে জবাবে বলে,
“আজকে ওই লোকটাকে দেখেছি, ফুফিজান।”

“কোন লোকটা?”

“যার জন্য আমার আপু সু*ই*সা*ই*ড করেছিল!”

মিসেস শাহিদা কয়েক সেকেন্ডের জন্য যেন প্রত্যুত্তর করতে ভুলে গেছেন। কিছু সময় পরে তিনি ফের শুধালেন,
“মুরাদ?”

“হ্যাঁ ফুফি। ওই জা*হিল মুরাদ!”

শেহজাদের কণ্ঠে তীব্র রাগের বহিঃপ্রকাশ। মিসেস শাহিদা তড়িঘড়ি করে আবার প্রশ্ন করেন,
“কোথায় দেখলে? এতো বছর পর? এতো বছর পর আবার কেন ফিরে এসেছে?”

“জানিনা আমি। আমি তাকে দেখে গাড়ি থেকে নামতে নামতেই সে হারিয়ে গেছে। আবাে কেন ফিরে এসেছে আমি জানিনা। কিন্তু এবার ও-কে পেলে আমি ছাড়ব না! আমার ফ্যামিলির দিকে চো*খ তু*লেও তাকাবে তো আমি ওর লা*-শ ফেলে দিব।”

মিসেস শাহিদা ঘাবড়ে গেলেন। তার ভাতিজার রাগ যে খুব খারাপ! নিজের বোনের ঝু*ল*ন্ত লা*-শ সামনে দেখে অতো বছর আগে সত্যি সত্যিই তো মুরাদকে নিজ হাতে খু*-ন করতে গিয়েছিল পর্যন্ত! মিসেস শাহিদা তড়িঘড়ি করে বলেন,
“শোন, বাবা। এসব কিছু করিস না। আগে থেকে পু*লি*শে বলে রাখ। কিন্তু মা*থা গরম করে কিছু করিস না।”

“ফুফিজান, ওই লোকটা….”

“চুপ! চুপ! যা হয়ে গেছে গেছে। তুমি তো সানিয়াকে ফিরিয়ে আনতে পারবে না। এখন তোমাকে যারা আছে তাদের কথা ভাবতে হবে। শান্ত হও। স্বাভাবিক থাকো। এখন নিজের রুমে গিয়ে ফ্রেশ হও। বাড়ির আর কেউ যেন বুঝতে না পারে। যাও।”

শেহজাদ অনিচ্ছাসত্ত্বে মেনে নিলো। তারপর নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালো। শেহজাদ চলে যেতেই মিসেস শাহিদা নিজের আলমারির গোপন ড্রয়ার খুলে একটা ডায়েরি বের করলো। এটা শেহজাদের দুই বছরের বড়ো বোন সানিয়ার ব্যাক্তিগত ডায়েরি। সানিয়া ছোটো থেকেই তার ফুফির পা*গ*ল ছিল। সবকিছু শেয়ার করতো কিন্তু বড়ো হতে হতে সন্তান যেমন নিজের প্রাইভেসি বুঝতে শুরু করে তারপর কথা শেয়ার করা বন্ধ করে দেয়, তেমনি সানিয়াও। ইউনিভার্সিটিতে উঠে প্রেমে পড়ে এক ইয়াং ল্যাব ডেমোনিস্ট্রট মুরাদ আহমেদের। ওদের প্রেম অনেক গভীর হয়ে গিয়েছিল। সানিয়া অনেক দুর্বল মনের একটা মেয়ে ছিল। কিন্তু মুরাদ ছিল চতুর। সে সানিয়ার সাথে সম্পর্কে গিয়েছিল সানিয়ার প্রোপার্টি ও সৌন্দর্যের মোহে পড়ে। সানিয়া যেদিন জানতে পারে সে বিয়ের আগেই কনসিভ করে ফেলেছে! সেদিন সে মুরাদকে বিষয়টা জানালে মুরাদ তাকে আশ্বাস দেয় বিয়ে করার। দুই পরিবারের মধ্যে কথা-বার্তার মাধ্যমে বিয়েও ঠিক হয়। সানিয়ার পরিবার প্রথমে রাজি হচ্ছিলো না কারণ মুরাদদের সাথে তাদের মিলে না। কিন্তু সানিয়ার জেদে অবশেষে রাজি হয়েই গিয়েছিল। সানিয়া খুব খুশি ছিল কিন্তু মুরাদের মনে যে অন্য পরিকল্পনা তা সানিয়া ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি। মুরাদ আগে থেকেই বিবাহিত ছিল! এই সত্যটা জানতে পারে সানিয়ার ফুফা মানে ড: আকবর রেহমান। তিনি গায়ে হলুদের দিনই সত্যটা জানতে পেরে বিয়ে ভেঙে দেন। কিন্তু সানিয়া এটা মেনে নিতে পারেনি। সে তো কাউকে এখনও জানায়নি যে সে দুই মাসের অন্তঃসত্ত্বা! সে কোনোভাবেই কারও কথা বিশ্বাস করতে পারছিল না। ভালোবাসায় এতোটাই অ*ন্ধ হয়ে গিয়েছিল যে চোখের সামনে মুরাদ ও মুরাদের স্ত্রীর ছবি দেখেও তার বিশ্বাস হচ্ছিল না। তার মনে হচ্ছিল, সবাই ইচ্ছে করে তাদের বিয়েটা ভাঙতে চাইছে। সানিয়া নিজের বিশ্বাসে অটল থেকে নিজেকে রুমবন্ধি করে কাঁদতে কাঁদতে মুরাদকে বহুবার কল করেছিল। অনেকক্ষণ পর মুরাদ কল রিসিভ করেও। তারপর নিজ মুখেই সব সত্য স্বিকার করে নিয়েছিল। মুরাদ নিজের মোহ ও লালসার কথা জানালে সানিয়া সেটা সহ্য করতে পারে না। তখন সে আ*ত্মহ*ন*নের পথ বেছে নিয়েছিল। তার আগে সানিয়া প্রতিদিনকার রুটিনের মতো নিজের ডায়েরিতে লিখে যায় ও সেই সাথে বাড়ির সবার জন্য একটা চিঠিও রেখে যায়। সানিয়ার মৃত্যুর পর অনেক জলঘোলা হয় এই নিয়ে। এলাকাবাসীর কাছে সানিয়ার প্রেগন্যান্সির ব্যাপারটা আড়াল থাকতে পু*লি*শকেও অনুরোধ করা হয়েছিল। শেহজাদ এখনও জানে না যে তার বোন প্রেগন্যান্ট ছিল। ওই সময়ে শেহজাদের অবস্থাও খারাপ হয়ে গিয়েছিল। মানসিক ভাবে প্রায় বিপর্যস্ত হয়ে যাচ্ছিলো। তাই শেহজাদের বাবা-মা শেহজাদকে নিয়ে দেশ ছাড়েন। আমেরিকাতে শেহজাদের ট্রিটমেন্ট ও স্টাডি একসাথে চলতে থাকে।

ডায়েরিতে হাত বুলিয়ে পুরোনো স্মৃতি রোমন্থন করে দীর্ঘ বেদনাময় নিঃশ্বাস ছাড়েন মিসেস শাহিদা। আবারও অতীতের কালো ছায়া কেন ফিরে এসেছে? শেহজাদ তো প্রিয়জনদের হারাতে হারাতে ক্লান্ত। আবার কেন?

_______

রাত নয়টার দিকে মীরা সবকিছু সাজিয়ে জোড় করে শেহজাদকে ড্রয়িংরুমে নিয়ে আসে। শেহজাদ আসতে চাচ্ছিলো না। তার মাথা ধরেছে খুব। কিন্তু ফ্রিশার এক্সাইটমেন্টের কথা বলে মীরা শেহজাদকে আনতে পেরেছে। ফ্রিশা ও মীরা মিলে একত্রে নাচ ও গান করলো। মীরা গান গেয়েছে আর ফ্রিশা নাচ করেছে। শেহজাদ শুধু জোরপূর্বক মুখে হাসি ফুটিয়ে রেখেছে পুরোটা সময়। এতে তার একটুও মন লাগছে না। মিসেস শাহিদা এটা লক্ষ্য করে মীরাকে ডেকে বলেন,

“মীরা, আমার মনে হয় শেহজাদের শরীরটা একটু খারাপ। তুমি ও-কে খাবার দাও। ও একটু রেস্ট করুক।”

মীরা এবার ভালো করে শেহজাদের দিকে লক্ষ করলো। এখানে আনার সময়ই বলেছিল শরীর ভালো লাগছে না। মীরা তাই আর দেরি না করে সবাইকে খাবার বেড়ে দেয়। শেহজাদ অল্প খেয়ে সবার আগে উঠে যায়। মীরা সেদিকে উদাস হয়ে চেয়ে আছে। অন্তত একটু কমপ্লিমেন্ট সে আশা করেছিল। মিসেস শাহিদা নরম সুরে বললেন,

“শরীর খারাব তো। তুমি এটা নিয়ে কষ্ট পেয়ো না। তুমিও তো ক্লান্ত। খাওয়া শেষ করে তুমিও রুমে চলে যাও। রেস্ট করো। এগুলো সার্ভেন্টরা গুছিয়ে নেবে। আজকে ফ্রিশাকে আমি ঘুম পাড়িয়ে দিব।”

ফ্রিশা তার দাদুমনির কথা শুনে খুশি হয়ে বলে,
“ইয়ে” দাদুমনি, তুমিও আজ আমার সাথে ঘুমাবে। হ্যাঁ?”

“আচ্ছা, বাচ্চা। জলদি খাবারটা ফিনিশ করো তো।”

ফ্রিশা কথা শোনে। মীরা খাওয়া শেষ করে ফ্রিশাকে গুড নাইট উইশ করে রুমে চলে যায়। গিয়ে দেখে শেহজাদ ঘুমিয়ে গেছে। টেবিলে স্লি*পিংপি*লের স্ট্রিপ থেকে একটা ঔষুধ নেই। তার মানে ঔষুধ খেয়ে ঘুমিয়েছে। মীরাও কী করবে! সেও মন খারাপ করে পাশে শুয়ে পড়ে।

চলবে ইনশাআল্লাহ,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে