নিষিদ্ধ প্রেম পর্ব-০৬

0
1957

#নিষিদ্ধ প্রেম
#জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা
|৬|
~
ছিমছাম ভাবে হলুদের অনুষ্ঠানটা হয়ে গেল। দুইবাড়িতেই আহামরি কোনো আয়োজন নেই। বিয়েটা পারিবারিক ভাবেই হচ্ছে বিধায় বাইরের তেমন কাউকে আপাতত জানানো হয়নি। উদ্দেশ্য পরে বড়ো করে অনুষ্ঠান করা হবে। এখন কেবল আকদ করা হবে আরকি।
.
হলুদের শাড়িটা এখনও রাইমার গায়ে জড়ানো। গালে, গলায় এক গাদা হলুদ লেগে আছে তার। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে কোমর পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে। শুষ্ক ঠোঁট জোড়া কাঁপছে খানিক। চোখ থেকে তার অনর্গল পানি পড়ে যাচ্ছে। কষ্ট হচ্ছে যে খুব। এইভাবে এসব কিছু তারও মানতে কষ্ট হচ্ছে। কোনোভাবেই ভুলে থাকতে পারছে না। মা বাবার হাসি মুখটার দিকে তাকালে যেন আরো কষ্ট হয় তার। বুকটা কেঁপে উঠে যখন মনে পড়ে এই হাসিটা আর বেশি দিন থাকবে না।
রাইমা অনেকক্ষণ কাঁদে। দরজা আটকে নিশ্চুপে কেঁদে কেটে ভাসিয়ে দেয়। এবার তার মাথা ব্যথা করছে। আর পারছে না। চোখ মুখ ভয়ানক ফুলে গেছে। নিজেকে আয়নায় দেখে ঘাবড়ে যায় সে। মা দেখলে নির্ঘাত বুঝে যাবে সে যে কেঁদেছে। তখন মাও কান্না জুড়ে দিবে। রাইমা তাই তাড়াহুড়ো করে ওয়াশরুম থেকে গোসল সেরে বের হলো। ভালোভাবে চোখ মুখ মুছে মুখে অনেকটা পাউডার মাখলো যেন লাল লাল ভাবটা অতটাও বোঝা না যায়। চোখগুলো ভালোমতো বুঝে নিল। কিন্তু তাও মায়ের চোখ ফাঁকি দেয়া আর কি এত সহজ? রাইমা জোরে জোরে নিশ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করলো। মুখে মিথ্যে মিথ্যে একটা হাসির রেখা ফুটাল। তারপর দরজা খুলে বাইরে বের হলো সে। বাড়িতে অনেক বেশি মেহমান না এলেও মা আর বাবার বাড়ির মামা চাচারা এসেছে। আর তাদের সাথে এসেছে তাদের বিচ্ছুর দলগুলো। পুরো বাড়ি ঝমঝম করছে যেন তাদের কোলাহলে। সবার কত ব্যস্ততা। মা, চাচিরা রান্নাঘরে ব্যস্ত। মামিরা সব নানান রকম পিঠা বানাচ্ছে। বাবা কাকারা বসেছে জটিল সব হিসাব নিকাশে। পিচ্চিগুলো ছুটাছুটি করছে পুরো বাড়ি জুড়ে। রাইমার প্রিয় কিছু কাজিনও আছে। যারা এই মুহুর্তে মেহেদি পড়ায় ব্যস্ত। রাইমাকেও বলেছিল মেহেদি পরতে তবে সে তখন বারণ করে দিয়েছিল, বলেছিল পরে পরবে। সবার মধ্যে কত কত উত্তেজনা। অথচ তার মনে কোন অনুভূতি নেই। যেন আত্মাহীন এক জ্যান্ত শরীর কেবল চারদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। রাইমার খুব কষ্ট হচ্ছে এই মানুষগুলোকে দেখে, তাদের এত আগ্রহকে দেখে। মনে হচ্ছে ইশ, যদি আর পাঁচটা মেয়ের মত সেও তার বিয়েটাকে এনজয় করতে পারতো!
.
.
বাইরে মাগরিবের আযান হচ্ছে। দিনের আলো কেটে গিয়ে রাতের আধার তার জায়গা দখল করে নিচ্ছে। আর এই রাত পেরুলেই অরিকের বিয়ে। অরিকের বাড়িতেও কোনো আয়োজনের কমতি নেই। লিমা সোবহান সৌখিন মানুষ। অনুষ্ঠানটা ছোট খাটো পরিসরের মধ্যে হলেও তিনি কোনো জিনিসের কমতি রাখেননি। কিছুক্ষণ আগেই মেয়ের বাড়িতে এক গাদা ঢালা পাঠিয়েছেন। এখন আবার নিরাকে বসিয়ে দিয়েছেন অরিকের হাতে মেহেদি দিয়ে দেওয়ার জন্য। এই নিয়ে অরিক মারাত্মক কান্ড ঘটিয়ে ফেলেছে। সে কোনোমতেই মেহেদি দিবে না অন্যদিকে তার মা তাকে দেওয়াবেই। একটু হলেও মেহেদি তার হাতে ছোঁয়াতেই হবে। মেহেদি ছাড়া হলুদ সম্পন্ন হয় না, এটাই উনার দাবি। তাই হাজার ঝড় তুফান করেও অরিক বাঁচতে পারল না, শেষ পর্যন্ত তাকে তার মা’র কাছে হার মানতেই হলো।

নিরাকে কড়া গলায় সে বলে দিল কেবল একটুখানি মেহেদি দিতে, যদি বেশি হয়েছে তবে এই মেহেদি নাকি তার গালে মাখাবে সে। নিরাকে হুমকি ধুমকি দিয়ে সে চোয়াল শক্ত করে অন্যদিকে মুখ করে বসে রইল। বেশি সময় রাখল না দশ মিনিট পরই নিরা বললো,

‘ভাইয়া শেষ।’

অরিক ঘুরে তাকাতে তাকাতেই নিরা মেহেদি নিয়ে সেখান থেকে কেটে পড়ল। অরিক তার বাম হাতটার দিকে মনোযোগ দিয়ে তাকাল। হাতের তালুতে ‘রাইমা’ নামটা দেখতেই যেন তার গায়ে আগুন জ্বলে উঠল। চিৎকার দিয়ে উঠল সে,

‘নিরার বাচ্চা, তোকে খালি পায় আমি। ফাজিল হয়েছিস তাই না? থাপড়িয়ে সোজা বানাবো। অসভ্য মেয়ে!’

রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে অরিক গিয়ে তার হাত ধুঁয়ে ফেলল। সাবান দিয়ে ঘষে ঘষে সেই নামটা উঠাতে চাইল। তাও পুরোপুরি উঠল না। হাতটা মুখের সামনে ধরে সে রাগি গলায় বললো,

‘উফফ, এই নামটাও দেখছি তার মালিকের মতো, আমার হাতে আঠার মতো লেগে গিয়েছে। শালা, কপালটাই খারাপ। হাজারটা ধ/র্ষ/ণ করেও যেখানে এই দেশে মানুষের কোন শা/স্তিই হচ্ছে না সেখানে একটা ধ/র্ষ/ণ করেই আমার রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। শা*লি একটা জিনিস আছে। একেবারে যেন দাবানল!’

কথাগুলো বলে বিরক্ত ভরা নিশ্বাস ফেলে সে নিজের রুমে চলে গেল। তারপর বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিরবকে কল লাগাল। নিরব কল রিসিভ করতেই সে বললো,

‘কালকে কখন আসবি?’

নিরব মৃদু সুরে বলে,

‘সরি রে দোস্ত, কাল আসতে পারবো না।’

অরিকের রাগ হলেও সে কিছু বললো না। তপ্ত কন্ঠে বললো,

‘ঠিক আছে, রাখছি।’

কল কেটে দিল সে। আকাশের দিকে তাকিয়ে আনমনে বললো,

‘বিপদের সময় বন্ধুরাও স্বার্থপর হয়ে যায়।’
.
.
রাত অনেক গভীর হলো। চারদিকের হৈ চৈ নিভে গিয়ে এখন একদম নিস্তব্ধ। সারাদিনের ব্যস্ততা শেষে সবাই এখন তলিয়ে গেছে গভীর ঘুমে। ঘুম নেই কেবল দুই জোড়া চোখে। রাইমার ক্লান্ত চোখের দৃষ্টি তার দক্ষিণের জানলার পর্দাগুলোর দিকে। মুক্ত স্বাধীন স্নিগ্ধ বাতাসে কি সুন্দর উড়ছে তারা। ইশ, সেও যদি তাদের মতো মুক্ত হতে পারতো! যদি পারতো এই অভিশাপের জীবন থেকে নিজেকে মুক্তি দিতে!

অন্যদিকে বারান্দার কোণে দাঁড়িয়ে আরেক জোড়া চোখ আকাশ দেখতে ব্যস্ত। আগে কখনো সে এভাবে আকাশ দেখেনি। তবে আজ কেন? আজকের দিনটা কি অন্য দিনের চেয়ে একটু ভিন্ন? হয়তো তাই! কাল তো আবার তার বিয়ে, জানে হবে না। তাও আপাত দৃষ্টিতে তো বলা যায়, কাল তার বিয়ে। তারও একটা বউ হবে। ‘বউ’ এই শব্দটা মাথায় আসতেই তার রাইমার কথা মনে পড়ে গেল। রাইমার শুকনো মুখটা ভেসে উঠল তার চোখের সামনে। হঠাৎ করেই কেন যেন তার মনে হলো, মেয়েটার সাথে সে খুব বেশি অন্যায় করে ফেলেছে। আজ যদি এমনটা না হতো। এটা যদি একটা স্বাভাবিক বিয়ে হতো, তবে সে হাসি মুখে রাইমাকে মেনে নিত। মেয়েটা মায়াবী। বড়ো বড়ো চোখগুলোতে অসম্ভব মায়া আছে তার। কিন্তু এখন সেই মায়ার বদলে এই চোখ জোড়াতে দেখা যায় কেবল আক্রোশ। যেন উপছে পড়া আগুনের লাভা। কি ভয়ংকর সেই চাহনি! চোখ বুজে জোরে নিশ্বাস নেই অরিক। না দুর্বল হলে চলবে না। তাহলে ঐ মেয়ে তাকে আরো পেয়ে বসবে। সে তার সিদ্ধান্তে অটল। আগে থেকেই সব প্ল্যানিং করা, এবার শুধু কালকের দিনের অপেক্ষা।

________________________________________

বর যাত্রী কনের বাড়িতে পা রাখতেই শোনা গেল এক মারাত্মক ঘটনা। কনেকে নাকি পাওয়া যাচ্ছে না। মিনিটে সে খবর ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। বরের আর বরণ হলো না। অরিকের বাড়ির লোকজনও যেন আকাশ থেকে পড়ল। রাইমার বাবা দুশ্চিন্তা আর ভয়ে একেবারে ভেঙে পড়লেন। রাইমার চাচা মামারা কোনোরকমে মেহমানদের ভেতরে আনলেন। বাড়ির মধ্যে হৈ চৈ পড়ে গেছে। ভেতরের রুম থেকে রাইমার মায়ের কান্নার শব্দ শোনা যাচ্ছে। এদিকে বর পক্ষের মানুষজন সব হতভম্ব হয়ে বসে আছে। যেন এখনও তারা কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। তবে এই সব কিছুর মাঝেও যে খুব নিশ্চিন্ত সে হলো অরিক। তার মধ্যে কোনো ভাবান্তর নেই। যেন সে এই মুহূর্তটার জন্যই আগে থেকে অপেক্ষা করছিল।
.
.
চলবে..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে