অমানিশায় সেই তুমিই পর্ব-১১+১২

0
10

#অমানিশায়_সেই_তুমিই
#লেখায়_তেজস্মিতা_মর্তুজা

১১.

দুপুর প্রায় দু’টোর কাছাকাছি। ইরাজ গোসল শেষে রুমে এসে আয়নার সম্মুখে দাঁড়াল। গলায় টাওয়াল ঝুলছে, অর্ধভেজা চুল, মুখটা মাত্রাতিরিক্ত ভারী লাগছে দেখতে।
মেঘালয়া সবে তৈরী হয়ে এসে দাঁড়িয়েছে পেছনে। তা দেখে ইরাজ জিজ্ঞেস করল,

‘কোন বাণিজ্যে বের হবি তুই?’

এটা কোন প্রশ্নের ধরন হলো? মেঘালয়া এর চেয়ে বেশি কিছু অবশ্য আশাও করেনা ওই ঘাঁড় ত্যাড়ার কাছে।অসন্তুষ্ট নজরে চেয়ে বলল, ‘আব্বুর কাছে যাব।’

ইরাজ বলল, ‘তো?’

‘আপনি সঙ্গে করে নিয়ে যাবেন। আর এর বিপরীতে কোন উল্টোপাল্টা কথা নয়।’

ইরাজ এ পর্যায়ে কিছু বলল না। মাথায় কয়েকবার টাওয়াল চালিয়ে টাওয়ালটা ছুঁড়ে মারল কোন একদিকে। এমন একটা দৃশ্য দেখে, রাগ উঠল মেঘালয়ার। কিছুক্ষন আগে ইরাজের অবুঝের মতো আচরণে এমনিতেই চটে আছে মেঘালয়া। এখন আবার এমন একটা কাজ। প্রায় চিৎকার করেই বলল,

‘আপনি গণ্ডমূর্খের চেয়েও অতি মূর্খ। টাওয়ালটা কোথায় ফেললেন, আর পড়লই বা কোথায়? সারাদিন রুমে থাকি আমি, রুমটাকে গুছিয়ে রাখি আমি। তা লণ্ডভণ্ড করেন আপনি, রুমের দাবিও করেন আপনি। যুক্তির বড়োই অভাব আপনার কর্মকান্ডে।’

ইরাজ ঘুরে তাকায়। ভাবলেশহীনভাবে আবার সামনের দিকে ফিরে তাকিয়ে নির্লিপ্তভাবে বলল, ‘এক্সাক্টলি। রুমটা তো আমার, অথচ থাকিস তুই। এর ভাড়া তো আর তোর বাপে দেয় না। ভাড়ার বদলে রুমটা গুছিয়ে রাখিস। এ নিয়ে প্যানপ্যান করলে কানটা এক চড়ে গরম করে দেব।’

বলেই বিছানার ওপর থেকে ব্লেজারটা তুলে মেঘালয়ার ওপর ছুড়ে দিয়ে বলল, ‘এটা আয়রন কর।’

মেঘালয়া সেটা হাতে ধরে বলল, ‘পারব না। আমি আপনার বেতনভুক্ত কর্মচারী না। আর আপনার এই মরুভুমি মার্কা বাড়িতে ভাড়া দিয়ে থাকার মতো বোকা আমি নই। আজই যাচ্ছি আমার বাপের বাড়ি।’

শেষের কথাটিতে ইরাজ উপহাস করে হেসে ওঠে। বলল, ‘তা যা। আমার রুম খালি হোক, হাওয়া বাতাস আসুক। তবে এ কদিন যে থেকেছিস বিনা পয়সায়, তার বদলে আমার ব্লেজার আয়রন করে রেখে আস্তে করে চলে যা।’

মেঘালয়া কপাল জড়িয়ে ফেলল। ব্লেজার হাতে নিয়ে ইরাজের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, ‘যাচ্ছেন কোথায়?’

‘জবাবদিহি করতে পারব না।’

‘আমিও।’

ইরাজ ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘আমিও কী?’

‘আয়রন করতে পারব না।’

‘সময় খুব কম। কাজ না হলে তোর ঘটে শনি আছে।’

মেঘালয়া বলে উঠল, ‘ শনি থাক অথবা রবি। আমি যাব আপনার সঙ্গে।’

ইরাজ ঘুরে তাকাল। মেঘালয়াকে দেখল পরখ করে। অতঃপর খানিকটা পেছনে সরে গিয়ে দাঁড়িয়ে দুপাশে দু’হাত ছড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘আমি তোর থেকে যথেষ্ট দূরে। তোকে ধরে রেখেছি বলে তো মনে হয় না।’

মেঘালয়া গম্ভীর স্বরে বলল, ‘আপনি সঙ্গে করে নিয়ে যাবেন। নয়ত কোথাও একা বের হব, যা নয় তা কথা শুনতে হবে। এখন থেকে আপনার সঙ্গে বের হব।’ মেঘালয়ার কথায় চাপা ক্ষোভ ঝরে পড়ে।

ইরাজ তা বুঝেও বুঝল না যেন। উল্টো ওকে খোঁচা দিয়ে বলল, ‘তোর বাপের রাখা রক্ষী আমি তোর?’

মেঘালয়া আওয়াজ সামান্য নিঁচু করে বলল, ‘আপনি কী, তা আপনার নিজের জানা উচিত।’

বলেই ব্লেজারটি নিয়ে আয়রন করতে বসে গেল। ইরাজ বিছানায় বসে রিমোট হাতে তুলে নিয়ে এসির টেমপারেচার কমিয়ে দেয়। চারদিকে গুমোট গরম। পরিবেশ কেমন থেমে আছে। গাছের পাতা ভুলেও নড়ছে না। শান্ত পরিবেশে গরমটা প্রকট লাগছে। ইরাজ অতিষ্ট হয়ে তাড়া দিয়ে বলল,

‘দ্রুত কর, লেইট হচ্ছি আমি।’

মেঘালয়ার কিছুক্ষন ধরেই কিছু বলার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। জিহ্বা দ্বারা ঠোঁট ভিজিয়ে ইরাজকে উদ্দেশ্য করে বলল,

‘আমি বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং করতে চাই।’

ইরাজ উপহাস করে, ‘তোর রেজাল্ট কি আসবে কোন আইডিয়া আছে?’

এ কথা শুনে মেঘালয়া থমকে যায়। নিজেও চিন্তিত হয়ে উঠল। ইন্টারমিডিয়েট লাইফটায় সে আসলেই বড্ড অমনোযোগী ছিল। সর্বক্ষন তাবিরের জ্বালাতনে পড়ালেখার মানসিকতা থেকে বেড়িয়ে এসেছিল। এসব ভাবতে ভাবতেই ততক্ষনে হাত থেমে গেছে ওর। ইরাজ তাকিয়ে দেখল মেঘালয়ার উদাসীন ভাব। ভেতরে কেন জানি জ্বলে উঠল বোধহয়! ক্ষিপ্র গতিতে দ্রুত পায়ে উঠে এসে তড়াক করে ওর হাত থেকে আয়রন কেড়ে নিল। থাপ্পড় মারার ভঙ্গিতে হাত এগিয়ে নিয়ে যায়। মেঘালয়া চমকে উঠে ঘাঁড় কাঁত করল। ইরাজ কিছু একটা বলে বকে উঠল অস্পষ্ট স্বরে। ব্লেজারটা যদিও পুড়ে যায়নি তবে তা ছুঁড়ে মারল মেঝেতে। তা আর গায়ে চড়াল না। ক্ষুব্ধ স্বরে বলল,

‘আমার কোন কিছুতেই তুই মনোযোগ দিতে পারিস না, না? আমি তোর কাছে চিরদিন গুরুত্বহীনই থেকে গেলাম?
বা লে র একটা ছোট্র কাজ দিলাম, তার মধ্যে অন্য ভাবনার সাগরে ডুব দিয়েছিস? ডুবে মরে যাসনি?’

বলেই শার্ট তুলে কাঁধে চড়িয়ে রুম থেকে বের হয়ে যায়। মেঘালয়া কেবল মেঝের দিকে চেয়ে রয় নিরবে। ইরাজ কি বুঝাতে চায়! ইরাজ কি চায়! ইরাজ আচমকা ক্ষেপে ওঠে, কখনও স্বাভাবিক, কখনও দুষ্ট তো কখনও কেমন জটিল হয়ে ওঠে। এতসবের মাঝে মেঘালয়ার নিজেকেই কেমন উন্মাদ উন্মাদ লাগে। ক্ষুধাও লেগেছে এবার। সকাল থেকে কিছুই খাওয়া হয়নি। আর বসে রইল না, রুম থেকে বেড়িয়ে ডাইনিং রুমে এলো। ততক্ষনে ইরাজ আপন মনে খেতে বসেছে। তবে আজ আরআনতারা খানমকে প্রতিদিনের মতো পাশে দাঁড়িয়ে আহ্লাদের সঙ্গে ইরাজকে খাওয়াতে দেখা গেল না। মেঘালয়া এসে দেখল, খাবার সব সাজিয়ে রাখা আছে। সে দীর্ঘশ্বাসটুকু গোপন করে নিরবে খেতে বসল।

গাড়ি চলছে নিজ গতিতে। ইরাজের চেহারা গুরুগম্ভীর। স্থির চোখদুটো সামনের গাড়ির কাঁচ ভেদ করে রাস্তা মেপে গাড়ি চালনায় ব্যস্ত। মেঘালয়া দেখল, ইরাজ ওদের বাড়ির দিকে গাড়ি ঘুরিয়েছে। আর চুপ করে থাকা হলো না। জিজ্ঞেস করল,

‘এদিকে কেন? আব্বু তো এখন অফিসে..

ইরাজের কথায় থেমে গেল, ‘আজ বাড়িতে আছে।’ সংক্ষিপ্ত জবাব। শীতল স্বর। মেঘালয়া একবার তাকাল ইরাজের দিকে। দেখে মনে হচ্ছে যেন এই মুহূর্তের সকল মগ্নতা ড্রাইভিংয়ে। অথচ মেঘালয়ার অন্য কিছু মনে হয়। যেন ইরাজ কোন এক অজানা উদাসীনতায় বুদ হয়ে আছে।

মেঘালয়াদের বাড়ির সম্মুখে এসে গাড়ি থামল। মেঘালয়া নিঃশব্দে নেমে দাঁড়াল। তবে ভেতরে যেতে অগ্রসর হলো না, আর না ইরাজ গাড়ি স্টার্ট করল। সামান্য কিছুসময় দুজনেই নিরবতায় কাটিয়ে, তা ভঙ্গ করতে চায় মেঘালয়া। ঠোঁট দিয়ে অপর ঠোঁট চেপে ধরল। কিছু বলার জন্য হাঁ করেও আবার থেমে যায়। ইরাজ অদ্ভুত আওয়াজে জিজ্ঞেস করে ওঠে,

‘একা ফিরতে পারবি?’

মেঘালয়া পূর্ণদৃষ্টি মেলে তাকাল ইরাজের দিকে। ইরাজও ঠিক ওই মুহুর্তে ওর দিকে তাকাতেই চোখাচোখি হয়ে যায় অপরিকল্পিত ভাবে দুজনের। মেঘালয়া দ্রুত চোখের নজর নত করল। আস্তে ধীরে দু’দিকে ঘাঁড় নাড়ল। ইরাজ আচমকা শান্ত পরিবেশকে অশান্ত করে ধমকে ওঠে,

‘একা বাড়ি ছেড়ে পালাতে পারিস, তবে একা ফিরতে পারিস না। ন্যাকামি!’

মেঘালয়া অতিষ্ঠ ভঙ্গিমায় জিজ্ঞেস করে ওঠে, ‘এ কথা আর কতদিন শোনাবেন?’

দৃঢ় কণ্ঠে জবাব এলো, ‘আজীবন।’

মেঘালয়া সচকিত হয়। খুব জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হলো এ মুহূর্তে, তাহলে কি আজীবন সঙ্গে রাখবেন! অন্তত এ কথা শোনানোর জন্য হলেও!

মুখে বলতে পারল না। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল দুপুরের তেজ্বী সূর্যের তীর্যক তাপময় আলোর নিচে। ঘেমে উঠছে শরীর, তবে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে যেন! ইরাজ আদেশ করল, ‘যা ভেতরে যা।’

বলেই আবার কিছু মনে করার ভঙ্গিতে বলল, ‘আর তোর পাঠ্যবই গুলো সঙ্গে নিবি।’

মেঘালয়ার মস্তিষ্কে কথাটা পৌঁছাতেই একটু চমকাল, সঙ্গে সঙ্গে আবার মনটা খুশিতে নেচে উঠল যেন। দ্রুত চোখ ঘুরিয়ে তাকাল ইরাজের দিকে। সে গাড়ি স্টার্ট করতে ব্যস্ত। মেঘালয়া জিজ্ঞেস করে,

‘কখন আসবেন আপনি?’

ইরাজ সামনের দিকে তাকিয়েই জবাব দিল, ‘এসে কল করব তোর বাপের বাড়ির নাম্বারে।’ বলে আর দাঁড়াল না। মেঘালয়াকে ফেলে, গাড়ি এগিয়ে চলল সামনের দিকে।

_

বিকেলের দিকে প্রকৃতি বেশ অশান্ত হয়ে উঠেছে, চারদিকে বয়ে যাওয়া বাতাস জানান দিচ্ছে ঝড় না হলেও অন্তত বৃষ্টি হবেই। সেই সঙ্গেই আব্বুর সম্মুখে মেঘালয়া চোখ দুটোও যেন শ্রাবনের আকাশে মেঘ ঝরা বাঁধাহীন বৃষ্টির মতো বর্ষনে ভিজে উঠেছে। দুজনের মান-অভিমানের পালা ভেঙে এবার যেন অভিযোগগুলো উঠে এসেছে সম্মুখে। বাবা তো অভিযোগ করতে জানে না সন্তানের সম্মুখে। তাই মেঘালয়ার মুখেই ফুটে উঠল, অনুযোগের সুর,

‘আব্বু! ভুল কি কেবল তোমার মেয়েই করেছে? তোমার মেয়ের আব্বু করেনি?’

পাগলি মেয়ের এমন সরল অভিযোগে বাবার বুকটা ভিজে যায় নিমেষেই। সজল চোখে চেয়ে রইলেন কেবল হেলাল সাহেব মেয়ের ফুলো চোখদুটোর পানে। তার ছোট্র মেঘালয়া আজ শশুরবাড়ি থেকে এসেছে, তাও আবার শশুরবাড়ির নামে নালিশ জানাতে। ভাবতেই বুকে চাপ অনুভূত হলো। তিনি একদম চাননি তার সাজানো পুতুলটিকে নিজের থেকে দূর করতে। তবে পরিস্থিতি তো সায় দিল না সেদিন এ চাওয়াতে। তার বাড়ি জুরে তরতর করে আহ্লাদি পা ফেলে চষে বেড়ানো মেঘালয়া আজ অন্যের বাড়ির বউ!

মেঘালয়া ভেজা স্বরে আবারও বলে উঠল,

‘আব্বু! মামনি কবে যেন মামনি থেকে শাশুরি হয়ে উঠল! আজ আমি তার কাছে, তার বাড়িতে অবস্থানকারী এক অপ্রিয় সত্য। যা সে পারছে না উগরে ফেলে দিতে, গ্রহন করতে তো মোটেই পারছে না। তুমি কি ভুল সিদ্ধান্ত নাও নি– ও বাড়িতে বিয়ে দেওয়ার কথা ভেবে? তুমি মেয়ের সুখের নেশায় মেয়েকে ছোটো করে তোলো নি? যে ভুল আমি আগে তোমার সঙ্গে করেছি, তা তুমি সুধরাতে গিয়ে পুনরায় আমার সঙ্গে করেছ, আব্বু!’

মেয়ের বুকে যে অন্তহীন চাপা আর্তনাদের স্তর জমেছে তা বেশ বুঝলেন হেলাল সাহেব। এ ব্যাপারে তিনি আন্দাজ সেদিনই করেছিলেন, যেদিন আনতারা খানম এখানে এসেছিল এবং তিনি আনতারার চোখে মুখ-চোখে অপ্রসন্নতার ক্ষোভ লক্ষ্য করেছিলেন। আজ সত্যিই তিনি বাকরুদ্ধ। মেয়ের অভিযোগের বিরুদ্ধে, নিজের পক্ষে সাফাই দেওয়ার মতো উপযুক্ত যুক্তি নেই তার কাছে।

_

আকাশ সেই বিকেল থেকে মেঘাচ্ছন্ন। তুলনামূলক তাড়াতাড়িই আজ বেড়িয়ে পড়ল ইরাজ অফিস থেকে। তাছাড়া মেঘালয়াকেও পিক করতে হবে। রাত আটটার বেজে গিয়েছে। ইরাজ রাস্তায় বেরোনোর কিছুক্ষণের মাঝে ঝমঝম করে বৃষ্টি নামল জমিনে। তার মাঝেই গাড়ি চালিয়ে সে মেঘালয়াদের বাড়ির রাস্তার দিকে অগ্রসর হয়। ক্রমেই বৃষ্টির ফোঁটা ভারী হতে লাগল। সাথে বাতাসও প্রবল বেগে বেড়ে গেল যেন! প্রায় এক তাণ্ডবপূর্ন ঝড়ের রূপ নিলো আকাশে ভেসে বেড়ানো মেঘের রাশিগুলো।

এই দুর্যোগের মাঝে গাড়ি চালাতে চালাতে মেঘের এই প্রলঙ্কর রূপের কথা মাথায় আসতেই, মেঘালয়ার মুখটা স্মৃতিতে ভেসে উঠল এক পলকের জন্য। ইরাজ একটু বিভ্রান্ত হয়ে ওঠে যেন! মেঘালয়া তার জীবনে অমাবস্যার রাতে এক খণ্ড মেঘ। তাইতো ইরাজ সর্বদাই মেঘালয়াকে ‘মেঘ’ বলেই সম্বোধন করে; সকলে যেখানে ছোটো করে মেঘালয়া বলে থাকে। বুকের ভেতরে সূক্ষ্ম ছিদ্রক ব্যাথারা নেচে উঠল যেন! মেঘ! এই এমনই তাণ্ডব চালিয়িছে তার জীবনে মেঘালয়া। ইরাজ নামক শান্ত প্রকৃতিকে অশান্ত, অস্থির, বিক্ষিপ্ত করে তুলেছে বারবার। জানায়-অজানায় বারবার আঘাত করেছে!

এসব ভাবতে ভাবতে এসে পৌঁছাল মেঘালয়াদের বাড়ির সম্মুখে। বিদ্যুতহীন অন্ধকারচ্ছন্ন এলাকা। মাঝেমধ্যে মেঘে মেঘে ঘর্ষনে বিদ্যুতের ঝলকানি আকাশকে বিদীর্ণ করে পৃথীবিকে ক্ষণিকের জন্য আলোকিত করে তুলছে। এরই মাঝে একবার চোখ তুলে তাকাল মেঘালয়াদের সাদা বিল্ডিংটির দিকে। তৎক্ষনাৎ চোখ ফিরিয়ে নিলো। বুকের তিরতিরে ব্যথাগুলো সায় দিল না মেঘালয়াকে কল করতে। বাড়ির গেইট ভেতর থেকে আটকানো। এ ঝড়ের মাঝে ডাকলে লাভ হবে না।

গাড়ি ছেড়ে বাইরে বের হয়ে দাঁড়াল ইরাজ। মুহূর্তেই বৃষ্টির ঝাপটা ভিজিয়ে দেয় ইরাজকে। গাড়ি থেকে একটু সরে গিয়ে গাড়ির সম্মুখে গিয়ে ফাঁকা রাস্তার মাঝখানে হাত ছড়িয়ে দাঁড়াল। ওই কালো মেঘের ঘনঘটা থেকে ঝরে পড়া বারিধারা ইরাজের সর্বাঙ্গ ভিজিয়ে, ইরাজকে ছুঁয়ে ধুয়ে গড়িয়ে পড়ে জমিনে। ইরাজ চোখদুটো আবেশে বুজে নিলো। ওর ব্যাথাময় মেঘে বৃষ্টি হয়ে ওর শরীরে ঝরে পড়ে। আশপাশে খেয়াল করে দেখল, মেঘের বর্ষন শুধু ওকেই নয় বরং আশপাশের সকল বস্তুকেও ভিজিয়ে তুলেছে। বিষাদের হাসি ফুটে ওঠে ইরাজের ঠোঁটে। মেঘের বর্ষনে শুধু ইরাজই নয়; আশেপাশের বস্তদ্বয়ও সিক্ত হয়। ইরাজ তো সামান্য; সে তুলনায় ইরাজ ব্যাতিত অন্যকেই বেশি ভেজায় ওই নিষ্ঠুর, নির্বোধ, বোকা মেঘ!

হাঁটু ভেঙে বসে পড়ল রাস্তার ওপর। ভাবল, মেঘের এই বোকামির জন্য হলেও সে আজও মেঘকে কাছে পেয়েও আপন করে নেয়নি। তার মেঘের চেয়েও, বুকে বেড়ে ওঠা যন্ত্রনাগুলোকে সে বরাবরই বেশি প্রাধান্য দিয়ে আসছে!

_

মেঘালয়া সেই সন্ধ্যা থেকে তৈরী হয়ে বসে আছে। এই বুঝি আসবে ইরাজ, একটু দেরী হলে খিটখিটে মেজাজের মানুষটা ক্ষেপে উঠবে নিশ্চয়ই! তাই সে তৈরী হয়ে বসে রইল ক্ষেপা মানুষটির অপেক্ষায়। তারপরই আকাশ বিদীর্ণ করে বৃষ্টি নেমেছে মুষল ধারে। সঙ্গে দমকা বাতাসের ঝাপটাও আছে।

রাত নয়টা বেজে যাওয়ার পরও যখন ইরাজের কোন খোঁজ নেই মেঘালয়ার মনটা অজ্ঞাত কারনেই কেমন চিন্তিত হয়ে উঠল যেন! আব্বুর মোবাইল দিয়ে ইরাজের কন্টাক্ট নম্বরে ট্রাই করল একাধিকবার। তবে ওপাশ থেকে কোন প্রতিক্রিয়া নেই ইরাজের। ক্রমেই চিন্তা বাড়তে থাকে মেঘালয়ার, সঙ্গে রাতও!

চলবে..

#অমানিশায়_সেই_তুমিই
#লেখায়_তেজস্মিতা_মর্তুজা

১২.

অপেক্ষা করতে করতে মেঘালয়ার একসময় অভিমান জাগল। গাল ফুলিয়ে আব্বুর কোলে মাথা রাখে। সেই পুরনো দিনের মতো আজও হেলাল সাহেব মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। এতদিন পর এই আদরমাখা ভালোবাসার স্পর্শে মেঘালয়া সব ভুলে যায়। আজ আর চিন্তা ভাবনার মাঝেও রাত জাগা গেল না। ঘুমিয়ে পড়ল ওভাবেই।

সকাল ন’টার দিকে ঘুম ভাঙল মেঘালয়ার। ঘুম ভেঙে দেখল আব্বু ওকে বিছানায় ঘুমোতে দিয়ে নিজে রকিং চেয়ারে হেলান দিয়ে ঘুমিয়েছে। আজও বেলা হয়ে গেছে ঘুম থেকে জাগ্রত হতে। মেঘালয়ার রাতের ঘটনা মনে পড়ে যায়। আবারও মনটা গুমোট হয়ে উঠল। তবে সিদ্ধান্ত নিলো আবারও একবার কল দেবে। আব্বুর ফোন থেকে ইরাজের কাছে কল করে। প্রথম দুবার বাজল তবে ওপাশ থেকে রিসিভ হলো না। তৃতীয়বার কল যেতেই লাইন কেটে দিল ওপাশ থেকে। মেঘালয়া অবাক হয়। কাল তো শেষবার যখন দেখা হয়েছিল এমন প্রায় ঠিকই ছিল সবটা। ফোনটা হাত থেকে নামিয়ে রেখে এক দীর্ঘশ্বাস টেনে নিল। কিছুক্ষন ওভাবে বসে থেকে ঘুমন্ত আব্বুর মুখের দিকে তাকাল। অজানা এক প্রশান্তিতে বুক ভরে ওঠার সাথে সাথে আবার এক শঙ্কায় ভিতরটা আন্দোলিত হয়ে উঠল। ওই বাড়িতে যাওয়ার ইচ্ছেটুকু কোথাও খুঁজে পেল না। তবে আবার মনে পড়ল, কাল থেকে মেঘালয়ার অভিযোগ গুলো শোনার পর থেকে হেলাল সাহেব মেয়ের সামনে হাসছেন তো ঠিকই, তবে ভেতর ভেতরে তিনি কতটা অস্থির তা মেঘালয়ার দৃষ্টি এড়ায় নি। সে আর চাইল না আব্বুর অস্থিরতা বাড়াতে।

নিজেকে বুঝাল, যে আব্বুকে খুশি করতে সে এই বিষ পান করেছে, সেই আব্বুর খুশির জন্য নাহয় তা হজমও করে ফেলবে! এ মানুষটিকে আর কষ্ট দেবার সাধ্যি নেই মেঘালয়ার। মুখের অভিব্যাক্তি পরিবর্তন করে নিজের স্বভাবসুলভ চঞ্চলতায় ফিরতে সচেষ্ট হলো। সে কাল উত্তেজনায় যা বলেছে, যে ভাবনায় ফেলেছে আব্বুকে তা আজকের হাসিমুখের ঝলকে মিটিয়ে দিয়ে বিদায় নিতে চায়। আবারও তৈরী হয়ে নিলো। আব্বুকে ডাকল। হেলাল সাহেব চোখ মেলে দেখলেন, মেয়ে প্রায় তৈরী। হন্তদন্ত উঠে বসলেন। বললেন,

‘কিরে মা! রাজ এসেছে?’

মেঘালয়া যেন মিথ্যেটা জিহ্বার ডগায় সাজিয়ে রেখেছিল, তা উৎফুল্লতা হিসেবে ফুটিয়ে তুলল আব্বুর সম্মুখে,

‘উহু, তবে কল করেছিল। কাল বৃষ্টির জন্য আটকে গিয়েছিল। সকাল হতেই কল করেছে, সেই কলেই তো আমার ঘুম ভেঙেছে, আব্বু।’

এই সাবলীল মিথ্যাচারের পেছনের বাস্তবতাটুকু গোপন হয়ে গেল বাবার কাছে। হেলাল সাহেব চাইছেন মেয়ে থাক আর কিছু সময় তার কাছে। তবে পরিস্থিতির প্রতিকূলতায় তিনিও হাসিমুখে মেয়েকে বিদায় জানাতে তৎপর। বললেন,

‘যা খেতে বস। আমি হাত-মুখ ধুয়ে আসছি।’

মেঘালয়া চলে যায়। মনটা সামান্য হলেও হালকা লাগল। ওই মা হারা পাগলিটা যে তার বেঁচে থাকার অবলম্বন। ওই পাগলির একটু ভালো থাকা হেলান সাহেবের গোটা ভালো থাকার চাবিকাঠি।

_

আসতে চাইলেও যেন আসা হয় না। আব্বুর থেকে বিদায় নিয়ে আসতে আসতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যার একটু আগে বের হলো মেঘালয়া। হেলাল সাহেবের গাড়িটি কিছুদিন যাবত নষ্ট হয়ে থাকায় তিনি পরিচিত এক গাড়ি রিজার্ভ করে মেঘালয়াকে তুলে দিয়েছেন। গাড়ি এসে নামিয়ে দিল ইমতিয়াজ সাহেবের বাড়ির সামনে। বইয়ে বোঝাই করা প্রকাণ্ড ব্যাগটি নিয়ে মেঘালয়া নেমে দাঁড়াল। এ বাড়ির ভেতরটা তার আতঙ্ক, বাড়ির মানুষগুলো তার আতঙ্ক, তবে তাকে এই সবটা মানিয়ে নিয়ে এ বাড়িতেই বসবাস করতে হবে। আব্বুর খুশির জন্য হলেও তাকে ভালো থাকার চেষ্টা করতে হবে।

বাড়ির ভেতরে এমনিতেও সদস্য সংখ্যা কম। তবে আজ যেন আরও গম্ভীর লাগছে বাড়ির ভেতরটা। আনতারা খানমকে নিচে পেল না মেঘালয়া। ওপরে উঠে গেল। নিজের রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। ঢুকতে একটু ইতস্তত হচ্ছে। হয়ত ইরাজের ওপর জমায়িত ক্ষোভই এর কারন। দরজা চাপিয়ে রাখা আছে। তা ঠেলে ভেতরে ঢূকেই সর্বপ্রথম নজর গেল রুমের কেন্দ্রে বিছানার দিকে। নজর ওদিকেই আটকে যায় মেঘালয়ার।

ইরাজ বেহুশের মতো পড়ে আছে। মাথার শিথানে বসে তার মাথায় জলপট্রি লাগাচ্ছেন আনতারা খানম। তার উপস্থিতি টের পেয়ে একবার তাকালেন ফিরে। মেঘালয়াকে দেখে প্রচণ্ড অনীহার সঙ্গে নজর ঘুরিয়ে নিজের কাজে মনোনিবেশ করলেন আবার। মেঘালয়া অবাক হয়। কি হয়েছে ইরাজের এই এক রাতের মাঝে? সে ব্যাগটা একপাশে রেখে দ্রুত রুমের ভেতরে প্রবেশ করল। খানিক দুরত্ব বজায় রেখে বিছানার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। শক্তপোক্ত ক্ষ্যাপা ইরাজ কেমন মিইয়ে গেছে। ঠোঁটের চামড়া শুকনো খড়খড়ে। তীর্যক চোখদুটো বসে গেছে, শরীরটা বিছানার সাথে মিশে আছে যেন। শরীরে লাল ছোপ ছোপ দাগ। মাথার চুল উশকো-খুশকো। ওভাবেই চোখ দুটো অর্ধবোজা অবস্থায় টান হয়ে শুয়ে আছে ইরাজ।

মেঘালয়া এসেছে, তা কি টের পেয়েছে ইরাজ? পেলেও বা কি? সে তো আর মেঘালয়ার ভুক্তভোগী নয়! এটুকু ভেবে সেখান থেকে সরে আসতে চায় মেঘালয়া। অথচ কিসের টানে যেন আটকে দাঁড়িয়ে রইল। পা উঠল না তার। রুমের নিস্তব্ধতা ভেঙে আনতারা খানম শক্ত স্বরে বললেন,

‘কোথায় নিয়ে গিয়েছিলে রাজ কে? কোথাও বের হতে তোমারও যে কারও প্রয়োজন হয় তা জানা ছিল না। তুমি তো একাই চলে যাও বাড়ি থেকে। তবে এবার আমার ছেলেটাকে নিয়ে গিয়ে বৃষ্টিতে ভেজানোর কি দরকার ছিল?’

এই সকল কটুক্তি! মেঘালয়ার সয়ে যাওয়ার কথা। তবুও চেনা মানুষগুলোর অচেনা রূপে সে আজও নিত্য-নতুন ভাবে কষ্ট পায় এই তিরস্কার গুলোতে। আজও পেল, তবে তা লুকিয়ে গেল। এবং কোন জবাবও দিল না। সে তো কিছুই জানে না এসবের, তা নিয়েও যদি কথা শুনতে হয়, সেখানে বলার থাকে না কিছু।

‘রাজের এলার্জি আছে জানো তুমি?’

আনতারার ধমকে কিঞ্চিত কেঁপে উঠল মেঘালয়া। আনতারা আবারও বলে ওঠেন, ‘বৃষ্টি রাজের সহ্য হয় না জানতে না তুমি? কি করে ভিজল রাতভর বৃষ্টিতে? বায়না ধরেছিলে তুমি নিশ্চয়ই? এবার তবে সেবা করো।’

আরও কিছু বলতে চেয়েও চুপ করে গেলেন যেন! সবটা গিলে ফেলে রুম থেকে বেড়িয়ে যান তিনি। মেঘালয়া যেন কিছু লক্ষ্য করল– আনতারার চোখ চিকচিক করছিল, কণ্ঠস্বর কেঁপে উঠছিল। তবে কি তিনি কাঁদছিলেন!

ইরাজের দিকে তাকিয়ে, ক্ষোভে দুঃখে ইরাজের এই অবস্থার ওপর খুশি হওয়ার কথা থাকলেও মেঘালয়ার তেমন লাগল না। মিশ্র অনুভূতি নিয়ে চেয়ে রইল ইরাজের পাংশুটে চেহারার দিকে। তখনই ইরাজ ঘাঁড় ঘুরিয়ে নিচের দিকে ঝুঁকে পড়ে। মেঘালয়া নিজের অজান্তেই দ্রুত ইরাজকে ধরল। আচমকা ইরাজ গলগল করে বমি করে দেয়। তা মেঘালয়ার শরীরেও লেগেছে। মেঘালয়ার ছিটকে সরে পড়ার কথা, তবে এমন কিছুই করল না সে বরং আরও আঁকড়ে ধরল ইরাজকে। ইরাজ নিভু নিভু চোখে তাকায় মেঘালয়ার পানে। মেঘালয়ার ব্যাথিত কণ্ঠে বলে ওঠে,

‘খুব খারাপ লাগছে আপনার? এভাবে উল্টো হয়ে থাকলে আবারও বমি হতে পারে। আপনি সোজা হয়ে শুয়ে পড়ুন তো। নিন..

অপর হাতে বালিশটা ঠিকঠাক করে ইরাজকে ধরে শুইয়ে দিল। ইরাজ শরীর কেঁপে উঠল আদ্ভুত ভাবে। অস্পষ্ট স্বরে কিছু বলতে চায় ইরাজ। মেঘালয়া ইরাজের হাত চেপে ধরল। মুখটা মুছিয়ে দিল সযত্নে। আচমকা খেয়াল করল ইরাজের হাত বেশ ঠাণ্ডা। সে দ্রুত আশপাশে তাকায়। পাশেই টি-টেবিলের ওপর সরিষার তেলের কৌটা। বুঝল, তার অনুপস্থিতিতেও এমন হয়েছিল, তেল মালিশ করা হয়েছিল। সে খানিকটা তেল হাতে মেখে ইরাজের হাত এবং পায়ে অনবরত নাড়তে থাকল। দ্রুত উঠে গিয়ে আলমারি থেকে পাতলা একটি কম্বল বের করে এনে ইরাজের গায়ে দিল। মেঘালয়ার এই ছুটাছুটি ইরাজ নিমজ্জিত চোখে নিরবে কেবল দেখে যাচ্ছে।

কিছুসময় বাদে মেঘালয়ার মনে পড়ে, ইরাজ বমি করেছে। তাতে নিশ্চয়ই ঔষধও বেরিয়ে গেছে! তবে কি আবার ঔষধ খাইয়ে দেবে! ইরাজের দিকে তাকাল সে। কিছুক্ষন আগে খুব ছটফট করলেও এখন তুলনামূলক শান্ত সে। মেঘালয়া চিন্তিত মুখে বসে রইল পাশেই। আরও খানিকটা সময় পার হলে দেখল, ইরাজ চোখ বুজে ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলছে। মেঘালয়া ধীর কণ্ঠে শুধায়,

‘কেমন লাগছে আপনার? মামনি কে ডাকব?’

ইরাজ চোখ খুলে তাকাল। অর্ধবোজা চোখের দৃষ্টি। আস্তে করে ঘাঁড় নেড়ে না বোঝাল। পাশেই রাখা অনেকগুলো ঔষধ। মেঘালয়া ভাবল, একদিনে এত ঔষধ কোথা থেকে এলো? নাকি এমনটা আগেও হয়েছে ইরাজের? তখনই মনে পড়ল সেদিন বাবাই বলেছিল, ইরাজের এলার্জি আছে। আজ মামনিও তাই বলেছে। তবে তা জেনেশুনে ইরাজ বৃষ্টিতে ভিজল কেন? এলার্জি থাকলে তা থেকে অ্যাজমার সৃষ্টি হয়। আর এ কারনেই বৃষ্টির পানি ইরাজের সহ্য হয়নি, ঠাণ্ডা লেগে গিয়েছে। পুরো শরীর দাগ ত্বকের ওপর। মেঘালয়া শান্ত পরিশ্রান্ত চোখে কেবল অসুস্থ ইরাজের পানে চেয়ে রইল। এই মানুষটি কত তর্জন-গর্জন করে বেড়ায়। আশেপাশে থাকলেই মেঘালয়ার আতঙ্কের শেষ থাকে না। আজ কেমন স্তব্ধ, দুর্বল শরীরে পড়ে রয়েছে!

এক পর্যায়ে ইরাজের শরীর প্রচুর ঘামতে শুরু করে। ইরাজ ছটছট করতে শুরু করল কেমন। ক্ষীণ স্বরে বলল,

‘এসি অন কর, গরম লাগছে।’

মেঘালয়া আপত্তি জানায়, ‘ঘামলে শরীর থেকে জ্বর বেড়িয়ে যাবে। শুয়ে থাকুন এভাবেই।’

প্রত্যুত্তরে ইরাজ নিরব রইল। ঘাঁড় ঘুরিয়ে চারদিকে কিছু খুঁজল। মেঘালয়া বোঝে, ইরাজ কী খুঁজছে। আক্ষেপের স্বরে বলল, ‘সবকিছুতেই জিদ দেখিয়ে জিতে যাওয়া যায় না। এসির ঠাণ্ডা হাওয়ায় অসুখ বাড়লে ভোগান্তিটা কার হবে?’

ইরাজ কিছুক্ষন নিরবে ছাদের দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। নিরবতা ভেঙে গম্ভীর স্বরে বলল,

‘এখানে বসে থাকার প্রয়োজন দেখছি না তোর। উঠে যা।’

মেঘালয়া নিরস মুখে তাকাল ইরাজের দিকে। তার দৃষ্টি উপরের দিকে। আস্তে করে উঠে গিয়ে বেলকনিতে দাঁড়াল। ইরাজ এবার তাকাল সেখানে, যেখানে মেঘালয়া বসেছিল এতক্ষন। বুক ফুলিয়ে শ্বাস নিয়ে, চোখদুটো বুজে নিল। মুখে মলিনতার ছাপ স্পষ্ট।

রাত প্রায় আটটা। মেঘালয়া সোফার ওপরে বসে অগোছালো কাপড় ভাজ করতে বসেছে। মাঝেমধ্যে আড়চোখে খেয়াল করছে অসুস্থ জেদি মানুষটিকে। ইরাজ ক্ষীণ আওয়াজে ডেকে ওঠে, ‘মেঘ!’

তৎক্ষনাৎ মেঘালয়া তাকাল সেদিকে। চোখের ইশারায় জানাল, ‘কী?’

উঠে গিয়ে কাছে দাঁড়াল। ইরাজের অভিব্যাক্তি শান্ত, ‘দুটো ডিম সিদ্ধ করে নিয়ে আয়। পারিস তো?’

মেঘালয়া কপাল কুঁচকে তাকাল। এটা কে পারে না? সবসময় খুঁত ধরার ছুতো না খুঁজলে হয় না? মুখে কিছু বলল না তবুও, কেবল মৃদূ মাথা ঝাঁকাল।

রান্নাঘরে যাওয়ার পথে ড্রইং রুমের সোফাতে আনতারা খানমের সঙ্গে দেখা হলো। মেঘালয়া মাথাটা ঝুঁকিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে যায়। আনতারাকে দেখতে বড়োই বিষন্ন আর অস্থির লাগছে। মেঘালয়াকে রান্নাঘরে ঢুকতে দেখে কলিজার ভিতরে পুড়ে উঠল যেন! ইরাজের ভয়ানক এলার্জি আছে বৃষ্টির পানিতে। আগে কিছুসময় এমনও হয়েছে, ইরাজ এলার্জিজনিত ঠাণ্ডায় শ্বাস আটকে পড়ে থেকেছে। গ্যাস দেওয়ার মাধ্যমে শ্বাসকষ্ট রোধ করা হয়েছে। এবার ঠাণ্ডার সঙ্গে ব্লাড প্রেসার লো। এমন হলে আনতারা খানম ছেলেকে সিদ্ধ ডিম, গরম দুধসহ আমিষ জাতীয় খাবার বানিয়ে বাচ্ছা ছেলের মতো পেছনে ঘুরে ঘুরে খাওয়াতেন। ইরাজ বরাবরই দুধ খেতে চায়না। এত বড়ো হওয়ার পরেও দুধ নিয়ে ইরাজের পেছনে দৌড়েছেন তিনি।

সেসব ভেবে, চোখ ভিজে উঠল যেন! মেঘালয়া যাওয়ার পানে চেয়ে রইলেন। ছেলে কি সত্যিই পর হয়ে গেল! আজ মায়ের প্রয়োজনীয়তা কি তবে ফুরিয়েছে? দেখাশুনা করার নতুন কেউ এসেছে তার পুত্ররত্নের জীবনে!

চলবে..

[রিচেইক করিনি। ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন❤️]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে