ব্রহ্মকমল পর্ব-০৪ এবং শেষ পর্ব (১)

0
5

#ব্রহ্মকমল
শেষ পর্ব (১)
___________________

দাদির কথামতো জীবন-মরণ সমস্যায় তখনও পড়িনি আমরা কেউ, তবু হাতে গুঁজে দেয়া চিরকুটের কথা মনে রয়ে গেল দিব্যি। সারাদিন পড়াশুনো, কাজ সামলেও চিরকুটের ঠিকানা আর ঐ ঠিকানার মানুষকে একটাবার দেখার, জানার আগ্রহ দিনকে দিন বাড়তে লাগল আমার।
প্রায়ই মনে হতো ক্লাস শেষে বেরিয়ে গাড়িতে চেপে ফট করে যদি ঠিকানাটায় গিয়ে উপস্থিত হই, কাকে দেখতে পাব সেখানে? কোন অপ্রত্যাশিত মানুষ অপেক্ষা করে আছে আমার জন্য? সেকি ছেলে নাকি মেয়ে!
আমি তাকে চিনি?
ছোট্ট একখানি এবড়োখেবড়ো কাগজ নিয়ে হাজার প্রশ্নের বেলাভূমি। বয়ে যেতে যেতেই শেষ মুহুর্তে রাশ টেনে সামলাতাম নিজেকে। যদিও সে-বছরই মানুষটার মতো সব প্রশ্নের উত্তরও আমার জন্য অপেক্ষা করছিল অধীর আগ্রহে; আমিই টের পাইনি।

প্রতিবছর স্প্রিং, ফল আর উইন্টারে যারা ভর্তি হয় অ্যালবার্টাতে, তাঁদের জন্য বাংলাদেশ স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের তরফ থেকে ফ্রেশার’স রিসেপশনের আয়োজন করা হয়। গোটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাকি বাংলাদেশি স্টুডেন্টদের সাথে যেন নতুনরা মিলেমিশে যেতে পারে, এবং সবার একটা পরিচিতি পর্ব সারা হয়, সে উদ্দেশ্যেই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা। এবং এই নবীন বরণের এত চমৎকার চমৎকার নামকরণ তাঁরা করে থাকেন! নিজেকে স্পেশাল না ভেবে যাবে কোথায় ব্যাচগুলো।

এডমান্টনে শিফট করার আগে অনলাইনে ঘাটাঘাটির সময় কিছুটা ধারণা নিয়ে এসেছিলাম আমি। বলার অপেক্ষা রাখে না, আর্টিকেল পড়ে আর জমকালো ছবিটবি দেখে প্রোগ্রামটা নিয়ে যথেষ্ট আগ্রহও ছিল আমার। এতকাল খোলসের ভেতরে থেকে জীবন কাকে বলে সেটা তো জানতে পারিনি ঠিক করে। তাই গতিপথ পাল্টাতেই মনে হলো নিজেকেও পাল্টে ফেলা যাক সব উৎসব আনন্দে মেলে গিয়ে।
“অতীত মুছে ফেলার শ্রেষ্ঠ উপায় হলো জায়গা পরিবর্তন”
শরৎচন্দ্রের বিখ্যাত কথাটাকে বহুদিন আগে মনেপ্রাণে মেনে নিলেও নিজের আচরণে টের পেলাম সেবার থেকেই অল্প অল্প করে।

মোটামুটি স্টুডেন্টরা ভর্তি হয়ে যাওয়া অবধি আমার আগ্রহ তুঙ্গে উঠে রইল। কি পরে যাব রিসিপশানে, কেমন মেকআপ নেব, সবার সাথে কীভাবে পরিচিত হব; জল্পনা কল্পনা করেই কাটতে লাগল। তবে প্ল্যান যতটা আমি করলাম, তারচাইতে বেশি করল অংক। ওতো সুযোগ পেলে আমাকে বা ওর কোনো বন্ধুবান্ধবকে বগলদাবা করে রোজ একবার চক্কর কাটতে লাগল শহরের নানাকোণের নামকরা শপিংমলগুলোতে। দিব্যি টের পেলাম নিজে যতটা না তৈরি হবে, তারচে বেশি আমাকে রেডি করানোর জন্য পাগলপারা হয়েছে ছেলেটা।
ভীষণ অবাক হলেও চট করে প্রকাশ করা হলো না। আমি তো লোভী। লোভী এতটুকু কেয়ারের, স্নেহের। এক ভাইয়ের মধ্যে বাবা-মাসহ ফেলে আসা সব চেনা মানুষগুলোর ছাপ দেখতে চাইছিলাম। তাই তো খানিক লজ্জা পেলেও মুখ ফুটে বললাম না ওর বাচ্চামো অস্থিরতায় কি অবারিত খুশির ঝর্ণাধারা বইতে শুরু করেছে আমার ভেতরে। সেই ছোট্টবেলায় বাবার আঙুল ধরে গুটিগুটি পায়ে হেঁটে বেড়িয়ে পৃথিবীর সব বিস্ময় জানতে যেমন আনন্দ লাগত অনেকটা তেমনই।

আমার মতো চিরকাল নিজের ভেতর গুটিয়ে থাকা বোকা একটা মেয়ের জন্য কেউ নিঃস্বার্থ এতটা করতে পারে, নিজের ছোটভাইকে না দেখলে আসলে জানতে পারতাম না।
মাঝেমধ্যে খুব করে একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খেত মাথায়; বুঝতে পারতাম না, গড়পড়তা বাঙালি পরিবারে জন্মে, বাবার মতো ওরম একটা মানুষের সন্তান হয়ে ছেলেটা এত ভয়াবহ ব্যক্তিত্বের হলো কীভাবে! ভালোবাসা কিংবা স্নেহের বিশেষ বহিঃপ্রকাশ তো কখনো আমরা দেখিনি সেভাবে। তবে কি ফুপুর বাড়িতে কাউকে দেখে.. নাহ্ তা কি করে হয়! ফুপা নিজেও বাড়িতে থাকেন না। ওনাদের বাড়িতে নেই কোনো ছেলে মানুষ কিংবা কেউ। তাহলে অংক’র এই পরিবর্তন হলো কার হাত ধরে?
তখন কি আর জানতাম ব্যক্তিত্ব সবসময় রক্ত থেকে আসে না, অনেক সময় আসে আনএক্সপেক্টেড কিছু মানুষের থেকে। যেমন অংকের ছিল একজন আইডল। যাকে মনেপ্রাণে অনুসরণ করে গড়ে উঠছিল সে এমন পারফেক্টভাবে।
অবশ্য গড়ে উঠছিল বলার চাইতে বলা ভাল গড়েপিঠে নিচ্ছিল মানুষটাই অংককে সুদূর এই ক্যানাডায় বসে, শুধু আমার খেয়াল রাখবার জন্যে, আমারই অজান্তে।
যখন প্রথম জেনেছিলাম তাকে, শুনেছিলাম আমার প্রতি তার এতবছরের অবসেশানগুলো, গোপন যত্নগুলোর সম্পর্কে; তখন বিশ্বাস হচ্ছিল না, অবাক হয়ে শুধু ভাবছিলাম,
দু-হাত ভরা ভালোবাসা তবে কি একেই বলে? সৃষ্টিকর্তা আদৌ আমার জন্য এতবড় উপহার সাজিয়ে রেখেছিলেন পৃথিবীর একপ্রান্তে। সত্যিই?

ভালোবাসা, জটিল শব্দ। কখনো এর অর্থ বের করতে পারিনি আমি। তবে শিখেছি, দু’জন মানুষ হাতে ধরে শিখিয়েছে আমায়, ভালোবাসা মানে যত্ন, অপর মানুষটার ভালো থাকার সমস্ত দায়িত্ব স্বেচ্ছায় কাঁধে তুলে নেয়া;কাছে থেকে হোক কিংবা দূরে..
মানুষদুটোর একজন তো নিঃসন্দেহে অংক। আর অন্যজন?
এবার বলব তাকে নিয়ে। যে কিনা আমার জীবনের চূড়ান্ত সারপ্রাইজের অন্যতম অংশ। নতুন শুরুর দোরগোড়ায় যাকে খুঁজে পেলাম ভিনদেশে সম্পূর্ণ নতুনভাবে। নামে আরসালান ইউসুফ হলেও যার প্রিয় পরিচয় সবসময় ইপশার স্বামীরূপে।

অদ্ভুত তাই না? পারিবারিক কিছু নোংরামির সাক্ষী হয়ে যে মেয়েটার সম্পর্কের ওপর থেকে একসময় বিশ্বাস উঠে গিয়েছিল, তার জীবনেও ভালোবাসার একটা বিশাল জায়গা তৈরি হয়ে গেল সময়ের স্রোতে; সৃষ্টিকর্তা ভীষণ যত্নে গড়ে দিলেন তার খুশির জন্য সাতসমুদ্দুর তেরো নদী সেচে মুক্ত এনে দেয়ার মতো একজন সুপুরুষকে। ভালোবাসা শব্দের অর্থ না বুঝেও যার নামে আমার হৃদয় কলরব করে উঠতে লাগল “ভালোবাসি, ভালোবাসি” সুরে সারাবেলা।

লুকব না৷ ঘোরতর বিয়ে বিরোধী থেকে, স্বামীর প্রেমে হাবুডুবু খাওয়া মেয়েতে কনভার্ট হওয়া কিন্তু সহজ ছিল না দ্বিধান্বিতা ইপশার জন্য। ভাগ্যিস আরসালানের এত ধৈর্য ছিল। তাই তো পাথরে ফুল ফোটাতে পেরেছিল সে দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর।

____….________….__

আরসালানকে কিন্তু প্রথম দেখলাম আমাদের ফ্রেশারস রিসিপশনে; সিনিয়র হিসেবে। নাহ্ হঠাৎ দেখা নয়, বরং ওখানে উপস্থিত সবাই ঘটা করেই আমায় হোস্ট আরসালান ইউসুফের সাথে এমনভাবে পরিচয় করিয়ে দিল! যেন গোটা পৃথিবী এতদিন থমকে ছিল শুধু এই মুহুর্তটার অপেক্ষায়। বিশাল ধৈর্য নিয়ে প্রহর গুনছিল, কবে ইপশা মুখোমুখি হবে তার হবু বরের সাথে, আর কবে বহুদিনের লুকনো কিছু সত্যের ওপর থেকে পর্দা উঠে যাবে এক ঝটকায়।

আমি ততদিনে বিস্মিত হতে হতে ক্লান্ত। তবু সেদিন সন্ধ্যের পার্টিতে অংকর এনে দেয়া অফহোয়াইট শাড়িতে নিজেকে তৈরি করে যখন হলে পা রাখলাম, তখন আমায় দেখেই সিনিয়ররা সবাই এমনভাবে আনন্দে হল্লা করে উঠল! একমুহূর্তের জন্য চমকে উঠে দরজায়ই দাঁড়িয়ে পড়তে বাধ্য হলাম আমি।
তাঁদের হল্লার তেঁজ এত তীব্র ছিল! একরাশ দ্বিধা আর বিব্রতভাব নিয়ে একবার পার্টিতে উপস্থিত বাকিদের দিকে, আরেকবার নিজের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম,
একলা একলা মাতব্বরি করে তৈরি হতে গিয়ে কোনো ভুল করে ফেললাম নাকি? সামহাউ ড্রেসাপে কিংবা পথভুল করে ভুল জায়গায় এসে পড়লাম! কিন্তু ভ্যানিউ তো এটাই লেখা ছিল কার্ডে। ইশশ! অংকটা যে কোথায় গেল। ডানপিটে ছেলে কার পাল্লায় পড়েছে আজকাল কে জানে! নির্ঘাত ওর বয়েসী মেয়েগুলো মাথা ঘুরিয়ে দেবার জন্য ফিটফাট হতে সময় নিচ্ছে এভাবে। বয়সের দোষ কাকে বলে!

দাঁতে ঠোঁট কামড়ে বিব্রতভাবেই দাঁড়িয়ে থাকব নাকি ভেতরে যাব কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিলাম না আমি। লজ্জায় এমন দশা যে পরিচিত মুখগুলোও আর পরিচিত লাগছিল না ঐ মুহুর্তে।
ওরা হয়তোবা বুঝতে পেরেছিল আমার অবস্থা। গোলযোগের ভেতর একটা আপু অবশেষে সেভিওর হয়ে বন্ধুদের ধমকে টমকে সামলিয়ে সহাস্যে এগিয়ে এসে কাঁধ জড়িয়ে ধরে আমায় স্থির করল। থুতনিতে হাত বুলিয়ে গালে আলতো চুমু খেয়ে বলল,
— কি মিষ্টি লাগছে তোকে! একদম ঐ নামটার মতই ম্যাসম্যারাইজিং। “বহ্মকমল”
আরসালানের ব্রহ্মকমল।

এতক্ষণের অদ্ভুত মুহুর্ত কেটে সুপরিচিত স্বর শুনে স্থিত হতে হতেও মনি আপুর অস্ফুটে বলা শেষ কথাটা মাথায় আবারও একটা জট পাকিয়ে দিল। বিভ্রান্তের মত তাঁর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম,
— কি বললে?
— নাহ্ কিছু নয়। বললাম, তোকে তো দুর্দান্ত লাগছে। আজকের শোজ স্টপার তুই-ই হয়ে গেলি পিচ্চি।

দ্রুত কথা কাটিয়ে বেশ জোর দিয়ে বলে আমায় আবারও জড়িয়ে ধরল আপু। আমিও পাল্লা দিয়ে লাজুক হেসে মুখ লুকালাম ওর জড়িয়ে ধরার বাহানায়৷ কিন্তু মনের কোণে কাঁটার মত বিঁধে রইল “ব্রহ্মকমল” শব্দটা। বারবার মনে হতে লাগল শব্দটা আমি আগেও কোথাও শুনেছি। অথবা পড়েছি হয়তো। কোথায় পড়েছি? কোথায় পড়েছি? কোনো বইতে কি! চেষ্টা করেও ঐ মুহুর্তে মনে করতে পারলাম না। তবে বুঝলাম, কোনো কারণে সে প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলল হুট করে।
আচ্ছা, পুরো কথাটায় শুধু বহ্মকমল তো সে বলেনি। কারোর একটা বহ্মকমল বলেছিল। সে কে?
প্রশ্নের উত্তর তৎক্ষণাৎ পাওয়া হলো না। মনি আপুর হাত ধরে গুটিগুটি পায়ে ভেতরে যেতে যেতেও বিষয়টা আমায় ভাবাতে লাগল। ঘুরেফিরে দু-চোখ অংককেই খুঁজছিল বারবার। আমার মুশকিল আসান, ছোট্ট ভাইটা। ও থাকলে নিশ্চয়ই চট করে একটা সমাধান করে দিত এই প্রশ্নজ্বালার। কেন যে ও না থাকা অবস্থাতেই আমার সাথে এতকিছু হয় কে জানে!
_______________

সচরাচর রিসেপশানগুলো যেভাবে হয়, নাচ-গানে আর হৈ-হুল্লোড়, আনন্দে। আমাদের ওয়েলকাম সেরেমানিও সেভাবেই হলো। তবে গোটা অনুষ্ঠানে বাঙালিয়ানার ছোঁয়া লেগে রইল বিশেষভাবে। ড্রেসাপ, ডেকোরেশন থেকে শুরু করে খাওয়াদাওয়া; সবকিছুতেই দেশীয় সংস্কৃতি এমনভাবে মিশে রইল! মনে হলো অচেনা ভীড়ে অচীনপুরে এই একখণ্ড স্বদেশ।

সিনিয়ররা আবার অধিকাংশই ম্যারেড। গল্পে গল্পে উঠে এলো সব্বার পড়াশোনার চাপে চিঁড়েচ্যাপটা সংসারের গল্প। আমি একদমই ওসব গল্পের সাথে কানেক্টেড হতে পারছিলাম না;তবু হা করে মুগ্ধ হয়ে শুনতে ভালো লাগছিল।
হ্যাঁ, নিজে বিশ্বাস করতে পারতাম না আর সম্পর্কে, তাইবলে কি লোকের সুখী হবার গল্পেও খুশি হব না! বরং একেকজনের সাকসেসফুল লাভস্টোরির গল্প শুনে এত অদ্ভুত ভালো লাগায় মন ভরে উঠছিল! ভাবছিলাম আমার বাবা-মায়ের বিষাক্ত সম্পর্কের মতন পৃথিবীর ঐ একাংশ নোংরামিটুকু বাদ দিলে বাকি সব বোধহয় এমনই স্বচ্ছ, এমনই নির্মল।

গল্পে অবশ্য শুধু সিনিয়রদের কথাই উঠে এলো না। উঠে এলো আমার সমবয়সী, এমনকি জুনিয়র ব্যাচমেটদের কথাও। তাঁদের মধ্যেও কেউ পার্টনারসমেত ড্রিম লাইফের আশায় পাড়ি জমিয়েছে, কেউবা লং ডিস্টেন্সের যন্ত্রণা মাত্র পেতে শুরু করেছে; মান অভিমান, ভালোবাসা.. কত কত এক্সপিরিয়েন্স!
বাহারি গল্পে এমনভাবে বুঁদ হয়ে যাচ্ছিলাম একটু একটু করে, ভাবিনি তখন, এত মানুষের এত এত গল্পের ভীড়ে মাইক ঘুরে হুট করে আমার হাতেও চলে আসবে একবার।
এর দায় অবশ্য গোটাটাই মনি আপুর। কোত্থেকে এক জুনিয়র মেয়ের ইমোশনাল এক লং ডিস্টেন্সের গল্প শেষে হুট করে মাইক কেড়ে নিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে সে সারির মাঝামাঝি এসে আমার হাত ধরে টেনে তুলল ভীষণ অপ্রত্যাশিতভাবে। তারপর অনেক এক্সাইটেড হয়ে রীতিমতো অ্যানাউন্স করার মতো করে বলল,
— অনেক হয়েছে পৃথিবীর নানাপ্রান্তের মিলেমিশে থাকা ইমোশনের মিষ্টি মিষ্টি গল্প শোনা। এবারে আমি স্পেশাল রিকোয়েস্ট করে আমার পার্সোনাল ফেভরেট পুতুলের থেকে ওর লাইফের সবচাইতে হ্যাপেনিং গল্পটা শুনতে চাই, যে গল্পের অপেক্ষায় দেশ-বিদেশ মিলে দীর্ঘ সাড়ে ছয় বছর কাটিয়ে দিয়েছি ভীষণ ভীষণ অস্থিরতায়। যদিও সে বড্ড চুপচাপ আর অনেকটা লাজুক। কতটা রেখে কতটা বলবে জানা নেই। তবু আজ এই বড় আপুর রিকোয়েস্ট তাকে রাখতেই হবে। ঝুলিভরা স্পেশাল গল্পটা শোনাতেই হবে। এ্যাই ইপশু শোনাবি তো?

ঐযে বলেছিলাম বিস্ময় শেষেও, বিস্ময়ের ভাগ কিছুটা বাকি ছিল। সেদিনে হুট করে মনি আপুর গ্র্যান্ড অ্যানাউন্সমেন্টে কিন্তু তার ষোলোকলা পূর্ণ হলো।
বলা বাহুল্য আমি তাঁর কথার আগাগোড়া কিছুই বুঝলাম না। উল্টো বজ্রাহতের মতো চোখ গোলগোল করে মাইক হাতে এমনভাবে তাকিয়ে রইলাম! আমার দৃষ্টিও সে অবাক হওয়া প্রকাশ করতে পারছিল না আর।
মুখ ফুটে কি বলব! কিইবা বলা যেতে পারে তা ভাবতেও যথেষ্ট বেগ পেতে হচ্ছিল আমায়। তবু অস্ফুটে আপুকে ডাকতে চাইলে, চোখের ইশারায় মেকি রাগ করে সে মাইক দেখিয়ে বলল,
— শুরু কর।

কি শুরু করব? এই প্রশ্নই তো করতে যাচ্ছিলাম আমি। কোন সাড়ে ছয় বছরের গল্প! কি গল্পই বা শুনতে চাইছে সে। আমার জীবনে স্যাড গল্প আছে জানতাম৷ স্পেশাল গল্পের খোঁজ আছে তা তো জানতাম না। সে আবার কোন ইপশার হ্যাপেনিং গল্প জানতে চাইছে। যার কানাকড়ি আমি ইপশা জানি না। অদ্ভুত!

#ব্রহ্মকমল
শেষ পর্ব-২
____________

গোটা হলের অগণিত চোখ নিশানার মতো আমার দিকে তাক করা বুঝতে পেরে নার্ভাসনেস বাড়ছিল তরতর করে। টের পাচ্ছিলাম জীবনে প্রথম যত্ন নিয়ে করা মেকআপ ঘামের সাথে ছেড়ে যাওয়ার দশা হচ্ছে দ্রুত। তবু মনি আপুর এক্সপেকটেশন মাঠে মারা যেতে দেখাও সম্ভব হচ্ছিল না আমার পক্ষে। আফটার অল এখানে আসার পর সেই তো হাতে ধরে গাইড করে আমাদের অ্যাডজাস্টমেন্টে হেল্প করল। মিনিমাম কৃতজ্ঞতাবোধ থেকেও তার মান রাখা আমার দায়িত্ব।
এদিকে ভেতরে বলার মতো একটা শব্দের খোঁজও জানা নেই; মাথা ব্ল্যাংক।
কি করতাম! কোমল মনের মিষ্টি যন্ত্রণা। কাউকে না বলার দুঃসাহস নেই। অগত্যা…

বহু কষ্টে নিজেকে সামলে নিতে নিতে ঐ নার্ভাসনেসে ঠোঁট আলগা করে বানিয়ে কিছু একটা বলতে চাইলাম যদিও, শেষ মুহুর্তে বলার প্রয়োজন পড়ল না;তার আগেই আলাদীনের প্রদীপ থেকে বেরুনো জিনির মতো কেউ এসে মাইক নিয়ে বাঁচিয়ে দিলো আমায় চরম দুর্বিপাক থেকে। ঘুরে তাকানোর সময় পেলাম না। শুধু টের পেলাম আঙুলের ডগায় একটা অপরিচিত আঙুলের অল্প স্পর্শ আর কানে উষ্ণ শ্বাস ছেড়ে ফিসফিসিয়ে বলা দুটো শব্দ,
— স্যরি সুইটডল।

যদিও পরমুহুর্তে তা চাপা পড়ে গেল হলভর্তি ছেলেমেয়েদের সমস্বরের হল্লায়; রিঅ্যাকশন দেবার সুযোগও হলো না বিপরীতে। বরং কণ্ঠের মালিক দূরে সরার সাথেসাথে টের পেলাম অন্য আরেকটা হাত কাঁধে উঠে এসেছে ভরসা যোগানোর বাহানায়। এবার আর চমকাতে হলো না। এ স্পর্শ যে আমার খুব আপন। হাতের মালিকও চেনা। আমার ভাই অংক।
অংককে পাশে পেয়েছি বুঝতে পেরে দুশ্চিন্তার মুহুর্তটায় কিছুটা স্বস্তি ফিরে এলো। ওদিকে আমাকে ধাতস্থ হতে দিয়ে খানিক বাদে হল্লা এড়িয়ে গলা খাঁদে নামিয়ে কানের কাছে মুখ এনে অংক বলল,
— জানি আপু, খুব অবাক হবি তুই এরপর। কিন্তু ট্রাস্ট মি যা শুনবি এখন, এটা তোর লাইফের সবচাইতে বেস্টেস্ট একটা ঘটনা৷ জাস্ট লাইক এ্য সারপ্রাইজ গিফট। গড নিজহাতে র‍্যাপিং পেপারে মুড়ে যে গিফটটা পাঠিয়েছেন তোর ঝুলিতে৷ আর আমাকে চ্যুজ করেছেন তোদের ডাকপিয়ন। যে ডাকপিয়ন বোকাসোকা, ভীষণ ইমোশনাল আপুটাকে হাজারবার লুকনো গিফট খুলে দেখানোর জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকত এতদিন। উফফ! আনবিলিভাবল ম্যান। কীভাবে যে সামলাতাম নিজেকে।

শেষ বাক্যটা বলতে গিয়ে খানিক হাসল ও। ওর সেই হাসিটা টের পেয়েই আমি সুবোধের মতো ঘুরে তাকালাম। দেখলাম সত্যিই। আনন্দ আর অন্যরকম আবেগ মিশ্রিত এক অনুভূতি চোখে ফুটিয়ে আমার দিকেই তাকিয়ে আছে অংক। ওর সেই আবেগতাড়িত চোখজুড়ে মিশে আছে এত স্নেহ! এত খুশির ঝলক। যেন বহুদিনের কাঙ্ক্ষিত কিছু হাতে পেয়েছে, এমন মনে হলো।
অংকও বুঝতে পারল ওর খুশির পরিমাপটা আমি ধরতে পেরেছি। চোখের হাসি দ্রুত ঠোঁটে ছড়িয়ে পড়ল। এরপর অপেক্ষার সময়টুকুকে সরিয়ে দিতে বিশেষ দেরি ও করল না। আমার আকাশকুসুম ভাবনার লাইনকে মাঝপথে থামিয়ে ভ্রু উঁচিয়ে আঙুলে ইশারা করে মৃদু হেসে বলল,
— ওদিকে তাকা। ওই হ্যান্ডসাম মানুষটাকে দেখছিস, তোর দিকে কি মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে? উনিই তোর গিফট। আরসালান ইউসুফ।

পরিচয়ের আগেই মানুষটার নাম শোনা সেই প্রথম।
_______________

ছোটভাইকে পাশে রেখে যদিও একটা ছেলের দিকে তাকাতে আমার ভীষণ কুণ্ঠাবোধ হচ্ছিল, তবু বাঁধনহীন আগ্রহ আর অংকর জোরাজোরিতে লজ্জা টিকতে পারল না। অজ্ঞাতের ভীড় ঠেলে বেরিয়ে নিজের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অজানা সত্যিকে জানার আশায় উদগ্রীব হয়ে মুখ ফেরালাম আমি। দেখতে পেলাম, আমার থেকে স্বল্প দূরত্বে এমারেল্ড কালারের ব্লেজারে ভীষণ হ্যান্ডসাম ড্যাশিং একটা ছেলে মাইক হাতে বিশাল হাসি ঝুলিয়ে আমার দিকেই তাকিয়ে আছে অপলক, অংকের কথামতো।
বুঝতে অসুবিধে হলো না, এতক্ষণ আমাকে ঘিরে তৈরি হওয়া সমস্ত প্রশ্নের উত্তর জলজ্যান্তরূপে ঐযে দাঁড়িয়ে আছে স্বল্প দূরত্বে।

অস্বীকার করব না৷ কিছুটা সময় একমনে সৌম্যদর্শন মুখটার দিকে তাকিয়ে থাকতে গিয়ে মুহূর্তের জন্য মুগ্ধতার ঢেউ দোল দিয়ে গেল আমাকে। অস্ফুটে আওড়ালাম,
— জলজ্যান্ত মানুষ?
জবাবে জোরে জোরে মাথা দুলিয়ে অংক বলল,
— হুম। জলজ্যান্ত মানুষই৷
— কিন্তু আমি তো এ ব্যাপারে…

কথা শেষ করার প্রয়োজন পড়ল না৷ বিস্ময় আর অসামঞ্জস্যতার হাত থেকে বেরিয়ে ধাতস্থ হতে হতে কানে ভেসে এলো ওই জলজ্যান্ত মানুষেরই গাঢ় স্বরে বলা কিছু কথা,
— ভেরি স্যরি তোমাদের আশার ওপর বাকেটভরা পানি ঢেলে দেয়ায়। কিন্তু রাইটার যে স্টোরি টেলিংয়ের ভার এখনো আমার কাঁধেই ফেলে রেখেছেন; তাই মনিসহ এই হলভর্তি সব মানুষের প্রশ্নের উত্তর দেয়ার জন্য আমিই দাঁড়িয়ে পড়লাম একা থেকে। কি, স্টোরিটেলার হিসেবে আমাকে চলবে তো?
— একদম না। আমি মোটেই তোর কাছে গল্প শুনব না না না। তুই একদম গল্প জমাতে পারিস না। আমি শুনলে শুধু পুতুলের কাছেই শুনব।

জিদ্দি মেয়ের মতো বায়না ধরল মনি আপু। জবাবে হাসির আকার আরও বিশাল করে আরসালান অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
— জিজ্ঞেস করে দেখ তোর পুতুলকে, এসবের এক অংশও সে জানে কিনা! পাগল। মুখ দেখে বুঝতে পারছিস না?

এবারে যেন বিস্মিত হয়ে তাকাল আমার দিকে মনি আপু। মুখে কিছু বলল না, কিন্তু ওর চোখ দেখে বুঝলাম জানতে চাইছে,
— ইপশা, সত্যিই তুই কিচ্ছু জানিস না?

ভ্রু কোঁচকানো তার সেই অবিশ্বাস্য দৃষ্টি দেখে এত অসহায় লাগল আমার! থাকতে না পেরে করুণ চোখে মুখ ফিরিয়ে তাকালাম অংকর দিকে। অংকর অবশ্য হেলদোল নেই। তাকালে, ফিরতি ইশারায় আশ্বস্ত করে আরসালানের দিকে ফিরল ও।
আমারও করার কিছু ছিল না। নিজের জীবন নিয়ে অজানা এত থ্রিল, এত সাসপেন্স ক্রিয়েট হয়ে গেল কম সময়ে! বাকি মানুষগুলোর মতো মাইক ধরে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার দিকে তীর্থের কাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম নিজের জীবনেরই অজানা গল্প জানতে।
আরসালান কিন্তু ততক্ষণে অসংখ্যবার ফিরে ফিরে তাকিয়েছে আমার দিকে। অবিশ্বাস্য লাগলেও মনে হচ্ছিল ইপশার চোখের তৃষ্ণা তার চোখকেও ছুঁয়ে ফেলেছে কোনোভাবে। অথবা বহুকাল ধরে এভাবেই সে অপেক্ষা করছিল চমৎকার সন্ধ্যেটার। কে জানে!

মনি আপু অন্যরকম একটা মেয়ে। ভীষণ ভীষণ ছেলেমানুষ। দিব্যি বুঝতে পারছিলাম জেদ আর অবিশ্বাসের ট্যানট্রাম আরও কিছুটা চালাবে বলে প্রস্তুত হচ্ছে সে। বডি ল্যাঙ্গুয়েজেই বোঝা যাচ্ছিল। এদিকে অজানাকে জানার আগ্রহ এত প্রবলভাবে পেয়ে বসেছিল! ভীষণভাবে চাইছিলাম এবারে অন্তত কোনো ট্যানট্রাম সে না করুক। তার জিদে ফুলস্টপ লেগে যাক এক্ষুনি। নিশ্চিত আমি একাই শুধু ভাবছিলাম এমনটা, কারণ উপস্থিত সকলের মধ্যে বিস্ময়ের দৃষ্টি ছাড়া অন্যকিছুর উপস্থিতি তো ছিলই না।
রইল বাকি আরসালান? সে তো আমাকে দেখেই কূল পাচ্ছে না, বান্ধবীর দশা বুঝবে কীভাবে!

ইশশ, সেদিন কি পাগলামোটাই না করেছিল মানুষটা। মোটেই বুঝতে পারছিল না, তার অমন অস্থির দৃষ্টি কি বিপাকেই না ফেলে দিচ্ছিল আমাকে একটু একটু করে। আরে বাবা, জীবনে প্রথম অপ্রত্যাশিত একটা পরিবেশে অন্যরকম পরিচয়ে একজন মানুষকে নিজের জন্য আবিষ্কার করা। আবিষ্কারের মূলটা না জেনেই, স্বল্প দূরত্বে থেকে তার বহু পুরনো আবেগের তাড়না অনুভব করা; এযে কত অদ্ভুত আর লজ্জার ঘটনা, তা কি বলে দিতে হয়? নিজের জীবনে না দেখলে তো আমিও বিশ্বাস করতাম না। করতে পারতমই না। অথচ সে… আনবিলিভেবল!
সে যাকগে, আমি তো বরাবরই মুখচোরা। লজ্জাবতী গাছের মতই বিনা কারণে নুয়ে পড়ি। সেখানে এতবড় অস্বাভাবিক কান্ডে আমার দশা স্বাভাবিক। তেমনই স্বাভাবিক তার এসব না জানা। কখনো আদৌ দেখেছে আমাকে সামনে থেকে? হাহ।

কিন্তু আমি যে ভেবেছিলাম মনি আপুর বডি ল্যাঙ্গুয়েজ একলা থেকে আমি খেয়াল করেছি, অন্যকেউ নয়। তা খানিক পর ভুল প্রমাণিত হলো। স্টেজ থেকে কেউ একজন ছোট্ট করে ধমক দিয়ে বলল,
— আহ মনি, আরসালান হয়েছে তো। কথা থেকে কথা বাড়ে। তোরা আবার কথাকে পেঁচাচ্ছিস পাগলের দল। বুঝতে পারছিস না, হলভর্তি মানুষগুলো কি ভয়াবহ দশায় ফেঁসে গেছে। যাকে বলে হিট অব দ্য মোমেন্টে সবাই আটকে গেছে। এই সময়ে এসে সত্যি না বলে ট্যানট্রাম করে কেন আমাদের বিপি বাড়াচ্ছিস ভাই!

বিস্মিত চোখ গুলোর সম্বিত ফিরল ওই ভাইয়ের কথায়। তক্ষুনি সমস্বরে মৌঁমাছির ঝাঁকের মতো সবাই ঘিরে ধরল আরসালানকে, তার সাসপেন্স থ্রিলার স্টোরিবুকের ওপর থেকে পর্দা ওঠাতে।
আরসালানের বোধহয় আবদারটা ভারী পছন্দসই লাগল। আমার দিকে তার স্থির চোখজোড়া হেসে উঠল চঞ্চল ঢেউয়ের মতো। পরক্ষণে মৃদু হেসে ছোট্ট শ্বাস ফেলে সে বলতে শুরু করল তার বহু আকাঙ্ক্ষিত গল্পকে, যা গল্প হলেও আসলে সত্যি;ইপশা জানত না।

— শুরুতেই ভেরি স্যরি অডিয়েন্স, ইপশা আর আমার অজানা অচেনা গল্পকে বলতে গেলে কিন্তু আমাদের ব্যাকগ্রাউন্ডটা একটু টেনে বলতে হবে। তোমরা আবার বোরিং ফীল করবে না তো?
— একদম নাহ। বলুন আপনি।
সমস্বরে সবাই দ্বিতীয় দফা চিল্লিয়ে উঠল। জবাবে মাথা নাড়ল আরসালান।
— বেশ। শুরু থেকেই শুরু করছি তবে। হুমহ। ইপশা আসলে আমার কাজিন। আওয়ার ফাদার্স আর আইডেন্টিক্যাল টুইনস। বাট, ফর সাম রিজনস শী ডাজন্ট নো আবাউট দিস রিলেশন।

বলার ফাঁকে আঁড় চোখে আরেকবার চাইল সে আমার দিকে। নতুন সম্পর্কের খোঁজ পেয়ে আমি যে বিস্মিত হয়েছি তা বলা বাহুল্য। সেও বুঝতে পারল ষোলোআনা। মাইকে তার শ্বাস পড়ার শব্দ হলো। মনে হলো কঠিন একটা কথা চেপে গেল এর মাধ্যমে। নিশ্চিত হওয়ার জন্য অংকর দিকে তাকাতে হলো না৷ তার আগেই ও কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে রাখল,
— লোকের সামনে সব সত্যি তো বলা যায় না। তাই বেচারাকে কিছু রেখে কিছু বলতে হচ্ছে।

আমি মাথা নাড়লাম। ওদিকে আরসালান আবারও বলতে শুরু করেছে,
— বাবার প্ল্যান ছিল অ্যালবার্টাতেই রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট হিসেবে জয়েন করবে, অফারও পেয়েছিল সে। কিন্তু মমের পোস্টিং! ওহ বলা হয়নি, আমার মম ডিফেন্সে ছিল। ড্রিম জব, ছেড়ে আসা পসিবল ছিল না।
অন্যদিকে মম, বাবার ড্রিম উমেন। স্বাভাবিক ভাবেই তাই…

কথা শেষ হওয়ার আগেই হলরুমে কলরব উঠল “ওহহোওও”।
বাবা মায়ের হ্যাপিলি এভার আফটারের গল্প! বিষয়টা কত গৌরব, কত আনন্দের; স্পষ্ট ফুটে উঠল আরসালানের চোখেমুখে। মাইক হাত মাথা নামিয়ে আলতো করে হাসল সে। আমার এত মায়া হলো! ইশশ, কি লাকি ছেলেটা। সবাই যদি ওনার বাবা-মায়ের মতো হত.. সামনা সামনি দুটো পরিবারের ভিন্ন চিত্র দেখে মনের অজান্তে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।

— নিজের সব কাজবাজ ফেলে আমার বউপাগলা বাবা কিছু না ভেবে কিন্তু উঠে গিয়েছিল বস্টনে, মমের ফ্ল্যাটে। মম যদিও তাঁকে অনেক পুশ করেছিল ফিরে এসে ক্যারিয়ারে সিরিয়াস হওয়ার জন্য। বাট বাবা চেয়েও তা কন্টিনিউ করতে পারেনি। আই মাস্ট সে, হি ওয়াজ ম্যাডলি ইন লাভ উইথ মাম। বাবা নাকি বলত, একই ছাদের নীচে থাকলে সারাদিনে একনজর তো কাছে থেকে তাকে দেখা যাচ্ছে, তার উপস্থিতি অনুভব করে প্রাণ জুড়নো যাচ্ছে। দূরে থাকলে শুধু কণ্ঠ শুনে কীভাবে কাটিয়ে দিত! হাহ্ ইনসেইন ম্যান হি ওয়াজ।

দ্বিতীয় দফা হাসির ফাঁকে একবার আমার দিকে নজর বোলাতে ভুলল না আরসালান। যেন বোঝালো, চোখ মেলে একবার দেখতো ইপশা, বাবার মতই প্রেমে ইনসেইন কি লাগে আমাকে?

প্রশ্নটা কল্পনা করে আমার ভারী লজ্জা লাগল। হাতড়ে অংকর ব্লেজারের হাতা খামচে ধরে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলাম আমি। পাশ থেকে মনি আপু বোধহয় তাকে টোকা দিয়ে বলল,
— ওহহ তাহলে আপনার সামনাসামনি না দেখে, না চিনে এক নারীর প্রেমে আশিক দিওয়ানা হয়ে ওঠা ডিএনএগত! হুমম?

আরসালান দুষ্টুমির ছলে ভ্রু নাচালো একবার। পরক্ষণে পাশ কাটিয়ে বলল,
— মমের থেকে আলাদা না হলেও বাবাকে একটা সার্ভিস কিংবা আউট ইনকামে তো ঢুকতে হতো! সেই সূত্রে হুট করে কোনোপ্রকার আইডিয়া না থাকা সত্বেও বাবা একটা ক্যাফে খুলে বসল আমাদের পুরনো বাড়ির কাছেই। অ্যাজ আই সেইড, হিজ লাক ওয়াজ ফ্যান্টাবিউলাস ফ্রম দ্য বিগিনিং। তাই খুব সহজে স্যাচুরেটেড মার্কেটেও স্টার্টআপটা দাঁড়িয়ে গেল। ডিউরিং দ্যাট পিরিয়ড আমার বেড়ে ওঠা। তখনও কিন্তু আমি জানতাম না, আমার শেকড় এখানে নয়। আই ওয়াজ মেন্ট টু বি বর্ন অ্যান্ড গ্রু আপ ইন বাংলাদেশ৷
— তাহলে পুতুলের খোঁজ পেলি কোথা থেকে তুই?
— হুমম! ইন্টারেস্টিং কোয়শ্চন।

একটু থেমে মাইক হাতে হেঁটে হেঁটে কিছুটা এগিয়ে এলো আরসালান৷ মৃদু হাসি ফুটিয়ে বলল,
— পুতুলের খোঁজ পেলাম বাবার ওয়ালেট থেকে। ওর প্রথম জন্মদিনের ভারী মিষ্টি একটা ছবি যত্ন করে বাবা নিজের ওয়ালেটে রেখে দিয়েছিলেন ফ্যামিলি ফটোর সাথে।

হাতের ইশারা করতেই সামনের স্ক্রিনে একদিকে ফ্যামিলি ফটোটা আর তার পাশে আমার ১ বছর বয়সী ছবি ভেসে উঠল। ছবিতে বিছানার ওপর হালকা হলুদ ফ্রক পরা আমি চামচ মুখে নিয়ে বিস্মিত গোল গোল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি কারুর দিকে;নিশ্চয়ই সেটা ক্যামেরা!

— ওহ সুইটহার্ট!

ছবি দেখে আবেগে আপ্লুত মনি আপু চিৎকার দিয়ে ফ্লাইং কিস ছুঁড়ে দিল দূর থেকে। আরসালান তা দেখে চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে স্টেজের একদিকে বসল। নস্টালজিক স্বরে এরপর বলল,
— আমার সেবার ভীষণ জ্বর। একশো তিন অথবা চার। ছোট্ট ছেলে জ্বরের ঘোরে পাগলের মতো মমকে পাশে চাইছি। বাট দ্যাট টাইম মম ওয়াজ আউট অব টাউন। ডিউটি পারপাসে। তখন তো ফোনের এভাইলেবলিটি কম। ওদিকে ওয়েদারও এত খারাপ যে তাকে ল্যান্ডলাইনেও রিচ করা যাচ্ছিল না। শেষে উপায় না পেয়ে আমার মাইন্ড ডাইভার্ট করতে বাবা ওয়ালেট থেকে ইপশার ছবিটা বের করে আমার সামনে রাখে। বলে, “এই যে ছবির জ্যান্ত পুতুলটাকে দেখছ? তোমার মম তো আসলে এই পুতুলটাকে আনতে গেছে শহরের বাইরে। এত জ্বর গায়ে, কীভাবে খেলবে পুতুল নিয়ে এলে? তারচেয়ে ওষুধ খেয়েছ, এখনের মতো ঘুমো। ঝড়বৃষ্টি থেমে গেলে সক্কালবেলা দেখবে মমও এসছে, পুতুলও এসছে। ওকে?”

আমার বাবা খুব এলোমেলো মানুষ বুঝলে৷ মম ছাড়া সে খুব অগোছালো কাজকারবার করে ফেলে সবসময়। এই যে অদ্ভুত সময়ে ইপশার সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেয়া তার! এটাও কিন্তু অগোছালো কাজের মধ্যেই একটা।
— পাগল এটাকে বলে ডেস্টিনি। অগোছালো কাজ না।

পিঠে চাপড় মেরে তার কোনো এক বন্ধু পাশে বসতে বসতে বলল। শ্রাগ করল আরসালান।

— মেইবি। বাট আনওয়ান্টেড ঐ মোমেন্টটায় ইপশা আমার মাথার ভেতরে ঢুকে গিয়েছিল শক্তপোক্তভাবে। আমি জানতাম না ও কে, কোথা থেকে ওকে নিয়ে আসা হবে। কিন্তু মনে একটা আশার জন্ম হয়েছিল সত্যিই বোধহয় সকালবেলা মমের কোলে ছবির পুতুলকে দেখতে পারব আমি। জ্বর সেরে গেলেই পারব। আনফরচুনেটলি যদিও পারিনি। কিন্তু আমার জ্বর সেরে গিয়েছিল রাতারাতি।
— ইপশার জাদু!
সমস্বরে পুনরায় কলরব করে উঠল সবাই। আমার মনে হলো তক্ষুনি মাটি ফাঁক হোক আর আমি ঢুকে যাই। কিসব বলছে লোকটা। ইশশ! আমাকে জড়িয়ে এতসব সত্যিই হয়েছে? চোখ বুঁজে লজ্জাটাকে সামলে নিলাম। ওদিকে নস্টালজিক আরসালানের কথা চলছে,

— কাইন্ড অফ। বাট সকালবেলা ইপশাকে না দেখতে পেয়ে আমার কিন্তু আবারও জ্বর এসেছিল। সে জ্বর ছেড়েছে অনেক ঝামেলার পর। যে বাবা প্রথম ইপশার জেদ মাথায় তুলে দিয়েছিল, সামলাতে না পেরে তাকেই শেষে খেটেখুটে টেলিগ্রাম করে দেশ থেকে ইপশার ছোটবেলাকার ভিডিও সিডি আনাতে হয় শুধু আমার জ্বর সারাতেই।
— তারপর? প্রেমের শুরু?
— প্রেম নয় অবসেশান।

তীব্র অধিকারবোধ কণ্ঠে ফুটিয়ে অদ্ভুত গভীর স্বরে কথাটা বলে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে অনেকক্ষণ বাদে তাকাল আরসালান আমার দিকে। আমি যদিও তার দৃষ্টির ভাষা বুঝতে পারলাম না। কিন্তু অংক পাশে থেকে থাম্বস আপ দেখালো এক্সাইটেড হয়ে।

— এরপর বলতে গেলে আমার গোটা বেড়ে ওঠার সঙ্গী হয়ে যায় ইপশা একটু একটু করে। আর ওকে সঙ্গী বানাতে হেল্প করে বাবা, দাদু অ্যান্ড চাচু;ইপশার বাবা। যেমন, টেকনোলজির আগে ওর ভিডিও ক্লিপস, ওর ফটোগ্র্যাফস এসব টেলিগ্রাম করত ওরা দেশ থেকে। জানাত আমাকে ইপশার বেড়ে ওঠার হিসেব। অ্যান্ড টেকনোলজির ডেভলপমেন্টের পরে রোজকার আপডেট পাঠানো জিনি হয়ে যায় দ্যাট হ্যান্ডসাম বয় আউট দ্যার। অংক। ইপশার ছোটভাই।

আরসালান পয়েন্ট করে দেখাতেই অংক সবাইকে হাত নেড়ে হ্যালো বলল। একজন জানতে চাইল,
— অংক তোকে চিনল কীভাবে?
— ইপশা বাদে সবাই চিনত তো আমাকে ওদের ফ্যামিলির। প্রথম পরিচয় বাবার ছেলে হিসেবে, আর দ্বিতীয়টা ওর উডবি।
ফান ফ্যাক্ট ইজ, আর্লি এইটিনেই কিন্তু আমি থাকতে না পেরে নিজেই নিজের বিয়ের প্রস্তাব রাখি ফ্যামিলির সামনে। আই হ্যাভ বিন স্ট্রেইটফরওয়ার্ড সিন্স চাইল্ডহুড। সার্টেইন টাইমের পর বুঝতে বাকি ছিল না আই ক্যান্ট লিভ উইদআউট দ্যাট গার্ল। এত দূরত্বের বাহানা, এত অপেক্ষা আমার পক্ষে টলারেট করা সম্ভব ছিল না।
— আরসালান ইউসুফ তো তার বাবারই ছেলে। কাজে কর্মে চিন্তায় বাবার ছাপ থাকবে স্বাভাবিক!

মনি আপু মৃদু ধাক্কা দিল ওকে। আরসালান মাথা নেড়ে হ্যাঁ বোঝালো সহাস্যে। পাগলাটে প্রেমিকের মতো নাছোড় স্বরে বলল,
— ওকে পার্মানেন্টলি নিজের কাছে নিয়ে আসাটা আমার জন্য ভীষণ ইম্পর্ট্যান্ট হয়ে দাঁড়িয়েছিল। দো সেটা পারিনি সে-সময়। চাচি রাজি হয়নি বিয়েতে। অ্যান্ড তার রাজি না হওয়া কিন্তু আজ পর্যন্ত চলমান। অ্যাপ্রোচ করার সময়টাতে আমাদের বাগদান হয়নি শুধু ওই একজন মানুষ চায়নি বলেই।

— তোদের কি বিয়ের কথাবার্তা এগিয়েছিল।

আরসালানের বন্ধুরা জানতে চাইল।

— হ্যাঁ। আমাদের দু পরিবারের সাথে, ইপশার মমের সাইডের সাথেও কথা হয়। তাঁরা সবাই রাজি ছিলেন আমাদের বিয়েতে, ইভেন আমার ভীনদেশী মমও। শুধু রাজি ছিল না চাচি। শী হ্যাড হার রিজন। কিন্তু চাচিকে রাজি করাতে গিয়েই আমি প্রথমবারের মতো দেশে, আমার পৈতৃক বাড়িতে পা রাখি। অংকর সাথে দেখাটাও হয় তখন।

— ভাইয়া এর পরেরটুকু আমি বলি?

হঠাৎ হাত তুলে আবদারের সুরে বলে ওঠে অংক। আরসালান একটু থেমে সহাস্যে তাকায় ওর দিকে। কেন যে মেনে যায় সাথেসাথে! উঠে দাঁড়িয়ে প্রশ্রয়ের ভঙ্গিমায় মাথা নাড়ে। অংক আমার হাত ধরে তৎক্ষনাৎ ছুটে যায় স্টেজের কাছটায় চঞ্চল ঘুড়ির মতো। লাজলজ্জা যেন আমারও উড়ে যায় স্বল্প ঐ মুহুর্তটুকুর জন্য। একরুম ভর্তি অচেনা মানুষকে মুছে ফেলে আমি টের পাই, এইমুহুর্তে অন্য সবাইকে আড়াল করে এই একটা মানুষ আমার দৃষ্টিজুড়ে মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে নাকি সৃষ্টিকর্তার তরফ থেকে ঠিক করে দেয়া ইপশার জীবনের মুখ্য চরিত্র। এই মুলুকে ছিল তবে তার বাস! ভাগ্যের সুতো একই সুঁচে গেঁথে যার সাথে আমায় মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিল এই প্রথম, এত অদ্ভুতভাবে।

★ এটা অনেক বড় একটা পর্ব ছিল। জানি না কেন একসাথে পোস্ট করতে গিয়ে ফেইলড দেখাচ্ছিল। পরে তাই কেটে হাফ করে পোস্ট করলাম। আরেকটা স্কেজউল করে দিয়েছি। কাল রাতে পোস্ট হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।

লেখা: সিনিন তাসনিম সারা’র গল্পসমূহ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে