প্রাণ বসন্ত পর্ব-১৯

0
6

#প্রাণ_বসন্ত
#পর্ব১৯
#রাউফুন

আগুন্তক কে জানার জন্য তাওহীদার ভেতর থেকে ছটফটানি বাড়ছে। জিজ্ঞাস্য ও কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তাওহীদা আহসানের পানে। আহসান লম্বা একটা শ্বাস ফেলে বললো, “তিনি আমার বাবা, স্বয়ং মফিজ উদ্দিন। মায়ের কালো জাদু আর বশিকরণ বিদ্যার কারণে তিনি সরাসরি তোমাকে সাহায্য করতে পারতেন না। তাই বাইরে থেকে আগুন্তক সেজে তোমাকে সাবধান করতেন।”

তাওহীদা বিস্মিত হয়ে বললো,” আমি যেদিন বাজারে গেছিলাম তবে সেদিন তিঁনি কে ছিলেন?”

আহসান ফোস করে শ্বাস ফেলে বলল,“ তুমি বাইরে গেলে আমি নিজেও শঙ্কায় থাকতাম৷ তাই তুমি বাইরে গেলেই আমি আর বাবা কেউ না কেউ তোমাকে ছায়ার মতো ফলো করতাম। যেদিন বাজার থেকে আসার সময় তোমাকে বাজে লোকেরা পথ রোধ করে দাঁড়িয়েছিলো সেদিন আমিই ছিলাম। আমি ক্যারাটের পাশাপাশি মার্শাল আর্টও শিখেছি। তাই ওদের কাবু করা আমার জন্য কোনো ব্যাপার ছিলো না৷”

“আলহামদুলিল্লাহ্‌। আল্লাহ সুবহানাহু তাআ’লা আমাকে সত্যের পথ দেখিয়েছেন। এদিকে আগুন্তক কে জানার জন্য আমি কতটা চিন্তিত আর তৎপর থাকতাম। তুমি এমন কেন আহসান? আমি তবে এতোদিন সুস্থ মানুষের সেবা করে এসেছি?”

আহসান ঠোঁট এলিয়ে হেসে ফেললো। বললো,
“স্বামী সেবাই তো করেছেন ম্যাডাম!”

“তুমি জানো, আমি কতটা ভয় পেয়েছিলাম সেদিন বাজার করে আনার সময়?”

“জানি, যখন ঘরে আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁপে কেঁপে উঠছিলে আর কাঁদছিলে তখনই বুঝেছিলাম! তাছাড়া একটা জিনিস আমি খুব বুঝেছিলাম, আমার বউ কতটা সৎ আমার প্রতি, কতটা গায়রত সম্পন্ন!”

“কিভাবে বুঝেছিলেন মশাই?”

“সেদিন আমি তোমাকে বাঁচালাম, হাত বাড়িয়ে দিলাম ধরে উঠানোর জন্য তুমি কিনা দূর্বল শরীরকে টেনে উঠিয়ে সোজা দৌঁটে চলে এলে। বুঝেছিলাম ভয় পেয়েছিলে কিন্তু যে তোমাকে বাঁচালো তাকেও?”

“আমি আর ঐ বিভৎস দিন মনে করতে চাই না!”

তারপর আহসান তাওহীদার সঙ্গে পরপর ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলোকে মনে করালো। কিভাবে তাকে বশে রাখার চেষ্টা করছিলো তার মা রওশন আরা। সম্পত্তির লোভে মানুষ এতোটা বধির হয়ে যেতে পারে তা যেনো রওশন আরাকে না দেখলে বোঝা যেতো না। আহসান ক্ষণে ক্ষণে মায়ের এমন নিম্ন মানের কর্মকাণ্ডের কথা ভেবে ভয়ে নিমজ্জিত হয়ে রয়। আল্লাহর কাছে সব সময় দোয়া করে সে যেনো তার মা আল্লাহর পথে ফিরে আসে। এমন গাফেল না থাকে।

সালমা আর পারভীন তাওহীদাকে সকালে জীবিত অবস্থায় রান্না করতে দেখে যেনো ওদের পিলে চমকে উঠলো। এই মেয়েটা এখনো বেঁচে আছে?, নাকি তাদের মতিভ্রম হয়েছে? সবকিছুই কি হ্যালোসিনেশন হচ্ছে? তাওহীদা সালমাদের দেখতে পেয়ে মুচকি হেসে বললো,“ভাবি আপনারা আজ এতো সকালে? যাক ভালো করেছেন। সকাল সকাল উঠে নামাজ পড়বেন, একটু হাঁটাহাঁটি করবেন দেখবেন ভালো লাগছে। শরীর খারাপ ঝম্পট দিয়ে পালাবে!”

“তু-তুমি বেঁচে…!”

পারভীন সালমার মুখ চেপে ধরলো। আতংক যেনো ওদের সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে পড়েছে। জলদি শাশুড়ীকে খবরটা দিতে হবে। তাওহীদার মুখে তখনও মুচকি হাসি। কিঞ্চিৎ ভ্রুকুটি করে বললো,“কি হলো পারভীন ভাবি? বড়ো ভাবিকে কথা সম্পুর্ন করতে দিন। ওভাবে মুখ চেপে ধরলো দম বন্ধ হবে তো!”

“না না কিছু বলবে না ভাবি। আমরা তো এমনিই চা খেতে এলাম।”

“ঠিক আছে এই নাও চা নিয়ে যাও।”

পারভীন আর সালমা দুজন দুজনের দিকে ভীত চোখে তাকিয়ে আমতাআমতা করে চা নিলো। ওঁদের হাত কাঁপছে। তাওহীদা আঁচ করতে পেরে বললো,“তোমরা কাঁপছো কেন?”

“কই না তো!” দুজনেই সমস্বরে বললো।

এরপর সালমা নিজেকে সামলে বললো,“আসলে, শীত বেড়েছে তো তাই কাঁপছি।”

“ঠিক আছে তুমি রান্না করো, আমরা যাই!”

তাওহীদার আচরণ আজ কেমন অদ্ভুত। ওর নরম চাহনীতেও সালমা আর পারভীন ভেজা বেড়ালের মতো চুপসে গেছে। দ্রুত গিয়ে শাশুড়ীকে ডাকতে লাগলো। মফিজ উদ্দিন গভীর রাতে এসেছেন৷ ফজরের নামাজ শেষ করে এসে আবার শুয়েছেন তিঁনি। এখন দরজায় ঠকঠক আওয়াজে বড্ড বিরক্তি বোধ করছেন। খানিক বিরক্তি গলায় বললেন“রওশন আরা, ওঠো, দেখো কে ডাকছে!”

“আমি পারবো না। ঘুমাতে দাও। বহুদিন এমন শান্তিতে ঘুমাইনি!”

পরক্ষণেই লাফিয়ে উঠলেন তিঁনি। মনে পড়লো গতকাল রাতের কর্মকাণ্ডের কথা। তাওহীদার লাশ তো তিঁনি সরাননি৷ আশ্চর্য এতো কড়া ঘুমের কারণে আজ আবার বিপদে না পড়তে হয়। নিজের উপর এবং নিজের ঘুমের উপর বেজায় বিরক্ত হলেন রওশন আরা।

মফিজ উদ্দিন রওশন আরার ওমন লাফিয়ে উঠা দেখে খানিকটা বিরক্ত চোখে তাকিয়ে আবার চোখ বন্ধ করলেন৷ ক্লান্তিতে শরীর টা যেনো অসাড় হয়ে আসছে তার। রওশন আরা উঠে দরজা খুলেই দেখলেন সালমা আর পারভীন দাঁড়িয়ে আছে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে। রওশন আরার ঘুম ছুটে গেছে ততক্ষণে। বললেন,“চলো ছাদে চলো, এখনো তোমার শ্বশুর উঠেনি৷ বাকি কাজ শেষ করি গিয়ে!”
সালমা ভয়ে ভয়েই চায়ে চুমুক দিয়ে বললো,“কোন কাজ মা?”
“স্মৃতি ভ্রষ্ট হইছে মাথামোটা মেয়ে?, তাওহীদার বডি সরাতে হবে চলো! বড্ড দেরি হলো। রাতেই কাজটা করা উচিত ছিলো।”

“জীবিত মানুষের বডি কিভাবে সরাবেন মা?” পারভীন বললো।

রওশন আরা যেনো অসুস্থ হয়ে পড়লেন। আলতো স্বরে বললেন,“জীবিত মানে? কি সব বলো? সকাল সকাল গাজা খেয়েছো?”

“মা, মেয়েরা কি গাজা খায়?”

“তাহলে এসব কথা বলো কিভাবে? গতকাল রাতে আমরা তিনজন ওকে শেষ করেছি। আমি আসার সময় পানির মোটর ছেড়ে এসেছি। ও জীবিত মানে? হেয়ালি করো? আমার সঙ্গে মশকারার ফল জানো?”

“ওতো কথা জানি না মা। আপনি স্বচক্ষে দেখে নিন। রান্না ঘর থেকে টুংটাং আওয়াজ আসছে শুনছেন?”

রওশন আরা দৌঁড়ে গেলেন। ভারী শরীর এটুকুতেই যেনো হাঁপিয়ে উঠলেন৷ দেখলেন তাওহীদা কড়াইতে কিছু একটা রান্না করছে। একদম সুস্থ স্বাভাবিক। তাওহীদা ঘুরে তাকালো৷ শাশুড়ীকে দেখে খুব স্বাভাবিক ভাবে একটা হাসি দিলো। বলল,“মা আপনাকে চা দেবো?”

রওশন আরা যেনো চমকে উঠলেন৷ একটা ভ্রম বা চোখে ভুল দেখেছে এমন মনে হচ্ছে। কিভাবে সম্ভব এটা? কে বাঁচালো মেয়েটাকে? আহসান? নাকি মফিজ উদ্দিন? কে? রওশন আরার নানান প্রশ্নে মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগলো। তাঁর বশীকরণ ব্যর্থ হলে যে তার বশীকরণের প্রভাব নিজের উপরেই পড়বে। নিজের বড়সড় ক্ষতি হবে। এতোদিন তাঁর বশীকরণ ব্যর্থ হয়নি, পরপর দুবার ব্যর্থ হওয়ার ফল তিনি জানেন। তার ব্যর্থতার ফলপ্রসূতিতে কতটা ভয়াবহ পরিণতি হবে ভাবতেই রওশন আরার আত্মা শুকিয়ে গেলো। তাওহীদা চায়ের কাপে সন্তর্পণে চা ঢেলে রওশন আরার সামনে ধরলো। হঠাৎই সারা শরীর কাঁপতে লাগলো রওশন আরার। কাঁপতে কাঁপতে গড়িয়ে পড়লেন মাটিতে। বুকে হাত চেপে ধরে তাওহীদার দিকে তাকিয়ে রইলো। তাওহীদা অনুভূতিশূন্য চোখে তাকিয়ে থেকে চায়ের কাপ হাতে দাঁড়িয়ে রইলো। যেনো সে পাথর হয়ে গেছে। যেনো তার কান ও অন্তর বধির হয়ে গেছে। তার মধ্যে কোনো ভাবান্তর নেই এতো বড়ো একটা ঘটনায়। অথচ আগের বার যখন রওশন আরা এভাবে অসুস্থ হয়ে যায় তখন কেবল সেই সেবা করেছিলো, সে-ই সবার চাইতে বেশি চিন্তিত ছিলো।

সালমা আর পারভীন ছুটে এলো শাশুড়ীকে পড়তে দেখেই। চিৎকার চেঁচামেচিতে বাড়ির প্রত্যেকের ঘুম ছুটে গেলো৷ সানোয়ার, আর আনোয়ার দুজন বেরিয়ে এলো। দুজনের পড়নেই ট্রাওজার আর টি-শার্ট। মফিজ উদ্দিন লুঙ্গি পড়া অবস্থায় ছুটে এলেন। সবাই ধরাধরি করে রওশন আরাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলো। তাওহীদা সম্পুর্ন সময় ছিলো নির্বিকার। যেনো কিছুই ঘটেনি৷ সবাই চলে গেলে সে গিয়ে নিজের মতো রান্না করতে লাগলো। সবাই হাসপাতালে গেলেও সে আর আহসান বাড়িতেই রইলো।

বিকেলে ভয়ে কুন্ঠিত হয়ে সালমা আর পারভীন ছুটে এলো তাওহীদার কাছে। তাওহীদা আহসানের সঙ্গে বসে গল্প করছিলো। হঠাৎই ওদের দুজনকে দেখে তাওহীদা বলল,“তোমরা এভাবে? ছুটছিলে কেন?”

“শাশুড়ী মায়ের পুরো শরীর প্যারালাইজড হয়ে গেছে। আমরাও তো নিকৃষ্ট পরিকল্পনার সঙ্গে তাল মিলিয়ে ছিলাম। তুমি নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে কেঁদেছো, আল্লাহ তাই তোমার চোখের পানি সহ্য না করতে পেরে গজব দিয়েছেন। আমরা ওরকম পরিনতির স্বীকার হতে চাই না তাওহীদা। আমাদের ক্ষমা করো বোন। আমরা অনেক ভূল করেছি!”

তাওহীদা বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। বললো,“তোমরা কি করেছো?”

“তোমার সঙ্গে প্রতি মূহুর্তে অন্যায় করেছি। আমাদের ক্ষমা করো। আমরা আমাদের কৃত কর্মের জন্য লজ্জিত, অনুতপ্ত। আমাদের ক্ষমা করো তাওহীদা।”

আহসান ঠোঁটে বিদ্রুপের হাদি টেনে বললো,“আমার বউকে জীবিত অবস্থায় ট্যাংকের মধ্যে ফেলে দিতে তোমাদের হাত কাঁপে নি? কিভাবে পারলে? তখন কলিজা কাঁপে নি?”

পারভীন আর সালমা একে অপরের দিকে চাওয়াচাওয়ি করলো। ওরা যেনো আকাশ থেকে পড়লো। এক সঙ্গে বললো,“তুমি সুস্থ আহসান?”

“অনেক আগে থেকেই!”

ওরা দুজনেই এসে আহসানের পায়ের কাছে পড়লো। ওর পা চেপে ধরে বললো,“ভাই, তাওহীদাকে বললো, আমাদের ক্ষমা করতে। ও যদি আমাদের ক্ষমা না করে তবে যে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লাও আমাদের ক্ষমা করবেন না। আমরা সত্যিই আমাদের ভুল বুঝতে পেরেছি। অনুতাপে দগ্ধ হচ্ছি!”

“আমার পা ধরে তো লাভ নেই। যার সঙ্গে অন্যায় করেছো তার কাছে ক্ষমা চাও!”

ওরা তাওহীদার পা চেপে ধরলো। তাওহীদা পিছিয়ে গেলো।।বললো, “আমি কখনোই তোমাদের প্রতি রাগ বা ক্ষোভ পুষে রাখিনি। যাও ক্ষমা করে দিলাম।”

এরপর আহসানের দিকে তাকিয়ে বললো,“আমাকে হসপিটালে নিয়ে চলো আহসান! আমিও যদি আমার মনে রাগ -বিরাগ পুষে রাখি, হিংসাত্মক মনোভাব পোষণ করি তবে ওদের আর আমার মধ্যে পার্থক্য কি রইলো?
আমি সংযমী, আমি কোমলতার এক প্রতিচ্ছবি।
“আমি উদার, আমি আশ্রয়ের ছায়া।
আমি সাহসী, আমি সংকল্পের প্রতীক।
আমি ধৈর্যশীল, আমি সহনশীলতার অবয়ব।
আমি মায়াবী, আমি ভালোবাসার অমিয় সুর।
আমি দৃঢ়, আমি বিশ্বাসের ভিত্তি।
আমি বিনয়ী, আমি নম্রতার আলোকস্তম্ভ।
আমি নির্ভীক, আমি সত্যের পথপ্রদর্শক।
আমি আশাবাদী, আমি স্বপ্নের দিশারী।
আমি রহস্যময়, আমি অন্তরের গভীর স্রোত।
আমি সহমর্মী, আমি মানবতার ভাষা।
আমি প্রখর, আমি বুদ্ধির শাণিত ফলক।
আমি জাগ্রত, আমি আত্মার আলোকধারা।
আমি আমি—একটি জীবনের প্রতিচ্ছবি।”

আমাকে কঠোরতা মানায় না, আমি যেনো কোনো পরিস্থিতিতেই মানুষের জুলুমের কারণ না হয়। সৃষ্টি কর্তা যেনো আমাকে কখনোই গাফেল দের অন্তর্ভুক্ত না করেন।”

তাওহীদা জানে, আল্লাহ তার পাশে আছেন, এবং সে সত্যের পথে থেকেই তার জীবনকে পরিচালিত করবে। আহসান তাওহীদাকে নিয়ে চললো হসপিটালের উদ্দ্যেশ্যে। সে তার অর্ধাঙ্গিনীকে যতো দেখছে ততোই মুগ্ধ হচ্ছে। এই মেয়েটা এতো ভালো কেন?

সালমা আর পারভীন দুজনেই আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাইলো। তারা অত্যন্ত অনুশোচনায় ভুগছে। তারা একত্রে আল্লাহর পথে চলার জন্য দৃঢ় সংকল্প করলো।
তাওহীদা আর আহসান বুঝতে পারল, তাদের সামনে আরও বড় চ্যালেঞ্জ আসছে। কিন্তু আল্লাহর ওপর ভরসা রেখে তারা এগিয়ে চলল।

“অন্যায় যতই শক্তিশালী হোক, সত্যের আলো একদিন তাকে নিভিয়ে দেয়। আর পাপের পরিণতি ভয়ংকর, সত্য কখনো পরাজিত হয় না।”

#চলবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে