প্রাণ বসন্ত পর্ব-১২+১৩

0
6

#প্রাণ_বসন্ত
#পর্ব১২
#রাউফুন

তাওহীদা এখন মাদ্রাসার পড়াশোনায় ব্যস্ত। রুশদার সঙ্গে তার বন্ধুত্ব আরও গভীর হচ্ছে। ক্লাসে বসে দু’জন গল্প করছিলো। রুশদা তাওহীদা বিবাহিত সে শুনে বিশ্বাস করতে পারছিলো না। বিস্ময় নিয়ে বলে,
“তাওহীদা, তোমার মধ্যে একটা অদ্ভুত শান্তি আছে। তুমি এত স্থিরভাবে কীভাবে সব সামলাও? মানে সংসার, স্বামী, তারপর পড়াশোনা। আমি হলে জীবনেও পারতাম না।”
তাওহীদা হাসি দিয়ে বলে,
“আল্লাহর প্রতি ভরসা রেখেই চলি। তিনিই আমাকে শক্তি দেন। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা নারীদের মাঝে আলাদা ধৈর্য্য শক্তি এবং মনোবল দিয়ে তৈরি করেছেন। ইসলামে নারীদের সম্মান সবচেয়ে বেশি। নারীদের যেমন ধৈর্য্য শক্তি আর সহ্য করার ক্ষমতা আল্লাহ দিয়েছেন তেমন ধৈর্য্য বা সহ্যশক্তি কোনো পুরুষ মানুষকে দেননি৷ নারীরা চাইলেই সব দিক থেকেই পারদর্শী উঠতে পারে। তুমিও পারবে!”

“আমি আসলেই পারবো না তোমার মতো।”

ক্লাসে বসে দুজনে গল্প করছিলো। একজন শিক্ষিকা এলেন এমন সময় ক্লাসে। তিনি ক্লাস শুরু করলে আর কোন কথা হলো না রুশদার সঙ্গে। ক্লাসের প্রায় সবার সঙ্গেই তাওহীদার ভালো বন্ধুত্ব হয়েছে। যেহেতু এটা গার্লস মাদ্রাসা তাই ছেলেদের নিয়ে ইন সিকিউরিটির কোনো চান্স নেই।তবে পুরুষ শুধু শিক্ষক রয়েছে।

মাদ্রাসা থেকে যাওয়ার পথে তাওহীদা ব্যাগে একটি চিঠি পেলো, আশ্চর্য এটা কিভাবে এলো তার ব্যাগে? যখন সে টিফিন টাইমে বাইরে এসেছিল তখন কেউ রেখে আসেনি তো? সে কাগজের ভাজ খুলে পড়লো। চিঠিটি খুবই সংক্ষিপ্ত:
“আমি সব সময় আপনার পাশে আছি। আমাকে চিনতে পারলেন না? অথচ আমি আপনাকে প্রথম দেখাতেই চিনেছি।”

তাওহীদা ভয়ে কেঁপে ওঠে। তার মনে হয়, হয়তো তাকে আবারও কেউ নজরে রেখেছে। এই মাদ্রাসার কেউ? কে হতে পারে? এই ব্যাপারে ও রুশদাকে কিছু জানালো না। সে ভয়ে তটস্থ হয়ে বাসায় এলো। আশে পাশে বার বার ঘুরে ফিরে দেখতে দেখতে বাড়ি এলো সে। রোজকার মতোই আজও ঝামেলা হলো। সে জানে তাকে এসব সহ্য করতে হবে তাই নিজেকে প্রস্তুতই রাখে সে। কানের মধ্যে তুলো গুঁজে চুপ করে থাকে। বুদ্ধি টা তার না, আহসানের। হঠাৎই আহসান তার কাছে এসে কানে তুলো গুঁজে দিয়ে বলে, “তোমাকে কেউ কিছু বললে কানে এগুলো দিয়ে রেখো৷ হাহা, সবাই শুধু বলবে তুমি শুনবে না।”

কাজটি করে সে হাত তালি দিতে দিতে বাচ্চাদের মতো হাসছিলো। তাওহীদা কতক্ষণ বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো। আহসান হুটহাট এমন সব কর্মকাণ্ড করে যে তার মনে সন্দেহ ঢুকে যায়। পরক্ষণেই ভাবে হইতো মানুষ টা আস্তে আস্তে সুস্থ হচ্ছে। তাই তার দিকে একটু খেয়াল রাখতে শুরু করেছে।

রাতের খাবার তৈরি করছিলো তাওহীদা। এমন সময় সালমা তার হাতে একটা কাগজ নিয়ে এলো।

“তা মাদ্রাসার নাম করে কি এসবই করিস তুই? এসব কি তোর ব্যাগে?”

বড়ো জা সালমা কথা শুনে তাওহীদার হাতের কাজ থেমে গেলো। সালমা হাঁক ছেড়ে সবাইকে ডাকলো। সালমা ছাদের নাম করে তবে তার রুমে গিয়ে ব্যাগ সার্চ করছিলো? কিন্তু হঠাৎ কেন এমন কাজ করলো? সালমা মূলত তাওহীদার বই খাতা ছিড়তে গেছিলো। ছিড়েও এসেছে। আসার সময় ব্যাগে দেখে এউ চিঠি টা। বই ছেড়ার আগে পাগল আহসানকে বাথরুমে আঁটকে রেখেছিলো।

রওশন আরা সহ রিমি আর পারভীনও বাইরে এলো। পুরুষ তিনজন ব্যবসার কাজে ব্যস্ত। পারভীন বললো, “ঘুমাচ্ছিলাম, এমন সময় তোমার ডাক। কি হয়েছে ভাবি?”

“এই যে আমাদের স্বতী সাবিত্রী মেয়ের ব্যাগে তার প্রেমিকের দেওয়া চিঠি। আমার কথা বিশ্বাস না হলে একবার নিজেরাই দেখো। শুনেছি, কিছু মেয়ে পর্দার আড়ালেও কেমন যেন সব কিছু করে ফেলে। আহসান তো পাগল, সে তো কিছু বলবেও না। তাই ভাবে, সব চলবে!”

পারভীনও কটাক্ষ-বানে বিদ্ধ করলো তাওহীদাকে।,
“তোর মতো বউ এনে এই বাড়ির মান-ইজ্জত চলে যাবে দেখছি। শাশুড়ির কথাও শুনিস না, জেদ করে পড়তে যাস আবার বড় গিন্নি হওয়ার শখ করিস!”

রওশন আরা বিক্ষিপ্ত হয়ে তাওহীদার গালে থাপড় বসিয়ে দিলেন। টাল সামলাতে না পেরে তাওহীদা নিচে পড়ে গেলো। রিমি ছুটে এলো তাকে ধরতে। টনটন করে উঠলো তাওহীদার গাল। এমনিতেই পোড়া ক্ষ’ত রয়েছে, তারপর আবার নতুন আগ’ঘা’ত। তাওহীদার মনে হলো ওর গাল ছিড়েখুঁড়ে কেউ খুব’লে নিচ্ছে।

“তোর এতো তবে এই অধঃপতন পড়াশোনার নামে? নতুন নাগর জুটিয়েছিস, তাই না? পাগল স্বামী রেখে আরেক জনের সঙ্গে লটরপটর করিস!”

তাওহীদা অবাক হয়ে শোনে। বড় জা, মেজো জা, আর শাশুড়ীর একে একে তার চরিত্র নিয়ে কথা বলতে শুরু করে। তাদের কথা যেন আগুনে ঘি ঢালে। রওশন আরা আবার আঘাত করতে নিলে রিমি নিজের মাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো।

“খবরদার কেউ ভাবির নামে এমন মিথ্যা, নেক্কারজনক অপবাদ দেবে না৷ ঐ চিঠি টাই এমন কোনো কথা লেখা নেই যাতে প্রমাণ হয় ভাবি তার সঙ্গে পরকীয়ায় জড়িত অথবা কোনো জানা শোনা আছে, বরং বোঝা যাচ্ছে ভাবি তাকে চেনেইনি৷”

“এক কানা আরেক কানার সই। নিজেও তো এমন দুশ্চরিত্রা মেয়ে, আবার আরেকজন দুশ্চরিত্রা মেয়ের হয়ে সাফাই গাইছে।”

তাওহীদা এবার আর নিজেকে থামাতে পারলো না। এক ঝটকায় উঠে দাঁড়ালো। তার চোখে আগুন জ্বলে উঠলো। বললো, “আমার চরিত্র নিয়ে কথা বলার আগে নিজের চরিত্র ঠিক করুন ভাবি। আপনিও জানেন আপনি নিজে কি, কারোর কোনো পাপ নিয়ে খোটা দেওয়ার মতো মন মানসিকতা আমার নেই। যদি কারোর পাপ গোপন করা হয় তবে তাকে সৃষ্টি কর্তা উত্তম প্রতিদান দেন৷ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন: “যে ব্যক্তি কোনো মুসলমানের দোষ-ত্রুটি গোপন করবে, আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন তার দোষ-ত্রুটি গোপন করবেন।”
আমি এই বাড়িতে সবার সব কাজ করি। তবু আপনাদের কথা থামে না। আজ যদি আমার স্বামী সুস্থ হতো, তাহলে কেউ এভাবে কথা বলতো না। আমি আমার চরিত্র নিয়ে একটা কথাও বললে মেনে নেব না।”

তাওহীদার প্রতিবাদে পুরো বাড়ি চুপ হয়ে গেলো। প্রথমবারের মতো তাওহীদা তার জায়গা থেকে কথা বললো। তার এই দৃঢ়তায় কেউ কিছু বলার সাহস পেলো না। সালমাও কেমন যেনো ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেলো। এবারে সবার নজর সালমার উপর। তাওহীদা আরও বললো,

“কারোর সম্পর্কে সঠিক ভাবে না জেনে তার চরিত্র নিয়ে কথা বলবেন না৷ যদি বলতেই হয় তবে চার জন সাক্ষী আনুন, আপনার কথার যথাক্রমে প্রমাণ দিন
সুরা নূরে, বলা হয়েছে,
“আর যারা সৎ নারীদের ওপর অপবাদ আরোপ করে, কিন্তু চারজন সাক্ষী উপস্থিত করতে পারে না, তাদেরকে আশি দফা বেত্রাঘাত কর এবং কখনোই তাদের সাক্ষ্য গ্রহণ করো না। তারাই হলো পাপী।”
অনুরূপ অন্য একটি হাদিসে নবী (সা.) বলেছেন:
“যে ব্যক্তি তার মুসলিম ভাইয়ের কোনো গোপন ত্রুটি নিয়ে মিথ্যা বলে বা অভিযোগ করে, আল্লাহ তাকে জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করবেন।”

কাউকে চরিত্রহীনতা বা অপবাদ দেওয়া ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। যদি কেউ এই ধরনের অভিযোগ করে, তবে তাকে চারজন সাক্ষী উপস্থিত করতে হবে, যারা সেই ঘটনাটি প্রত্যক্ষ করেছে। যদি সাক্ষ্য দিতে ব্যর্থ হয়, তাহলে অভিযোগকারীকে “কাজফ” (মিথ্যা অপবাদ) শাস্তি দেওয়া হবে, যা অত্যন্ত গুণাহের কাজ।

আর রইলো চিঠির কথা, আমি নিজেও জানি না কে এই কাগজ আমার ব্যাগে রেখেছে৷ চিঠিতেও কিন্তু এটা প্রমাণ হয় না আমাকে সেই ব্যাক্তি প্রেম পত্র দিয়েছে অথবা সেই ব্যাক্তি টি কোনো পুরুষই, সে তো মহিলাও হতে পারে!”

তাওহীদার চোখ থেকে অনবরত পানি পড়ছে। সে ধপ করে সোফায় বসে পড়লো৷ সবাই যার যার রুমে চলে গেলো। রিমি তাকে সামলে বলে, “ভাবি একদিন সবার বিচার করবেন আল্লাহ! শুধু তুমি নিজেকে শক্ত করো। সব সময় এতো নরম গলায় কথা বললে হবে না। মনে রেখো, নরম মানুষের ভাত নে। জোর যার মূলুক তার।”

তাওহীদা উঠে রান্না ঘরে চলে গেলো। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলো যেনো সবার হেদায়েত দান করেন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা। কিচেনের জানালা দিয়ে বাইরে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো। কে ওই আগুন্তুক? যে তাকে দেখতে পায় সব সময়? কে তাকে এতো ভালো ভাবে চেনে? ভালো ভাবে না চিনলে অবশ্যই শুধু মাত্র চোখ দেখে চেনা সম্ভব নয়? কে সে? তাওহীদার মাথা ছিড়ে যাচ্ছে যেনো এসব ভাবতে ভাবতে। তাওহীদা জানে, এই বাড়িতে তার জায়গা কোথাও নেই। সবাই কেবল তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহারই করে। কিন্তু সে মনে মনে ঠিক করে নেয়, এখন থেকে আর সে এসব সহ্য করবে না, কিছুতেই না। একদিন সে সবাইকে বুঝিয়ে দেবে, তার চরিত্র নিয়ে কটু কথা বলা সহজ, কিন্তু সেই চরিত্রের পবিত্রতা কেউ নষ্ট করতে পারবে না।

রুমে গিয়ে তাওহীদা নিজের ব্যাগ আর বইয়ের করুণ পরিনতি দেখে হতভম্ব হয়ে গেলো। এদিকে বাথরুম থেকে দরজা ধাক্কানোর শব্দ পেলো। জলদি গিয়ে বাথরুমের দরজা খুলে দেখলো আহসান হাঁপাচ্ছে। তাওহীদা আহসানের এমন অবস্থা দেখে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো। আহসানের সারা মুখ লাল হয়ে আছে রীতিমতো। মানুষ টা এতক্ষণ তবে এই বাথরুমে আঁটকা পড়েছিলো?

#চলবে.

রেফারেন্স১:— (সহীহ মুসলিম, হাদিস: ২৫৯০)
রেফারেন্স:২(কুরআন: সুরা নূর, আয়াত ৪)
রেফারেন্স:৩(সহীহ মুসলিম)

#প্রাণ_বসন্ত
#পর্ব১৩
#রাউফুন

বাড়িতে মফিজ উদ্দিন তাওহীদার পড়াশোনার জন্য নতুন করে বই কিনে আনেন। সালমার উপর ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন তিনি তাওহীদার বই ছিঁড়ে ফেলার ঘটনায়। মফিজ উদ্দিন এই বিষয়ে খুব রাগান্বিত হন এবং সবার সামনে ঘোষণা দেন,
“আজ থেকে কেউ যদি তাওহীদার পড়াশোনায় বাঁধা দেয়, তাকে এই বাড়ি থেকে বের করে দেব। এতোদিন অনেক কিছু চোখের সামনে দেখেও চুপচাপ দেখেছি, কারণ আমি ঝামেলা চাইনি। কিন্তু এরপর তাওহীদার অধিকার বা ওর চলার পথে কেউ বাধা হলে তাকে আমার সঙ্গে আগে মোকাবিলা করতে হবে। ওর বিষয়ে কেউ কোনো হস্তক্ষেপ করলে আমি তাকে দেখে নেবো। মনে রেখো এই সাম্রাজ্যের অধিকারী এখনো আমি মফিজ উদ্দিন।”

সবাই থমথমে পরিবেশ দেখে সটকে পড়ে। তাওহীদা চুপচাপ নিজের বই নিয়ে উপরে চলে যায়। সকালটা অন্য দিনের মতোই শুরু হয়। তাওহীদা মাদ্রাসায় যেতে প্রস্তুত হয়। তবে আজ তার মনে অজানা এক উদ্বেগ কাজ করছে। আগন্তুকের সেই চিঠি তার মনের ভেতরে শিকড় গেড়ে বসেছে। রুশদার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর কিছুটা স্বস্তি পেলেও, প্রতিটি মুহূর্তে যেন তার মনে হয়, কেউ তাকে দূর থেকে লক্ষ্য করছে।

মাদ্রাসায় ঢোকার পরেই সে দেখে, একটি ছায়ামূর্তি গেটের কাছেই দাঁড়িয়ে আছে, তাকে দেখামাত্রই সেই আগুন্তক সরে যায়। তাওহীদা বুঝতে পারে এটা হইতো সেই আগন্তুক! তাওহীদা মাথা নিচু করে দ্রুত ক্লাসে ঢুকে পড়ে। এভাবে কি আদোও কোনো সুস্থ মানুষ ছায়ার মতো তাকে অনুসরণ করতে পারে? যখন যেখানে সে যাচ্ছে সেখানেই কেন আগুন্তককে দেখতে পাচ্ছে সে? কি চায় সেই আগুন্তক তার থেকে? আহঃ তাওহীদার মাথা ছিড়ে যাওয়ার উপক্রম হচ্ছে। যদি তার কোনো ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে তাকে অনুসরণ করে লোকটা? পরক্ষণেই সাহস জোগায় সে,মনে মনে আওড়ায়,

“আমি কেন ভয় পাবো? আল্লাহ আমার সঙ্গে আছেন। আল্লাহ ব্যতীত কাউকে ভয় পাবো না আমি।”

রুশদা তাওহীদার পাশে বসে। তাওহীদা বুঝতে পারলো না। রুশদা তাকে ধাক্কা দিয়ে বলে, “কি হইছে তোমার? কি ভাবো?”
“হাহ্‌?”
“কিছু নিয়ে চিন্তিত তুমি?”
“না,তেমন কিছু না। তুমি কখন এলে?”
“যখন তুমি কোনো ভাবনায় নিমজ্জিত ছিলে তখনি!”

তাওহীদা চুপ করে ভাবতে লাগলো। এতো অল্প পরিচয়ে কি সব কথা বলা যায়? তখনই টিচার প্রবেশ করলো শ্রেণী কক্ষে। সবাই সমস্বরে সালাম দিলো হুজুরকে।যেহেতু এটা নূরানি মাদ্রাসা সব হুজুর আর হুজুরানী রয়েছেন শিক্ষক -শিক্ষিকা হিসেবে। দুই বান্ধবী একসঙ্গে পড়াশোনা করছে। হঠাৎ রুশদা বলে,
“তাওহীদা, তুমি কি কোনো বিষয়ে অনেক বেশিইই চিন্তায় আছো? আমি লক্ষ্য করছি, তুমি খুবই অস্বস্তি বোধ করছো, পড়ায় মন দিতে পারছো না।”

তাওহীদা একটু দ্বিধা করে রুশদাকে সবকিছু খুলে বলে। চিঠি থেকে শুরু করে আগন্তুকের তাকে প্রতিটি মূহুর্তে অনুসরণ করা, সব কথা জানায়।

রুশদা কিছুক্ষণ ভেবে বলে,
“তুমি কি পুলিশে জানাবে? সত্যিই তো যদি কোনো ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে নিয়ে তোমায় ফলো করে তবে তো এটা খুব ভয়ের ব্যাপার। তোমাকে সাবধানে থাকতে হবে। পুলিশ স্টেশনে যাবে?”
“না,” তাওহীদা জবাব দেয়।
শান্ত স্বরে বলে, “আমি আগে বুঝতে চাই, সে আসলে কে এবং তার উদ্দেশ্য কী।”
রুশদা তার সিদ্ধান্তে সম্মতি জানায়।

ছুটির ঘণ্টা পড়ার পর, তাওহীদা স্কুলের ব্যাগ খুলে আরেকটি চিঠি দেখতে পায়। এবার চিঠিটি আরও অদ্ভুত:
“তোমার ভীত মুখ দেখতে পেলাম। ভয় পেও না। অবশ্য আমি বিশ্বাস করি তুমি অনেক বুদ্ধিমতী এবং সাহসী। আমি তোমাতে মুগ্ধ। আচ্ছা, তুমি কি জানো? তোমার চারপাশে অনেক শত্রু? সাবধান থেকো। হুহ?”

তাওহীদার গা শিউরে ওঠে। কে তার শত্রু হতে পারে? সালমা আর পারভীন? নাকি আরও বেশি ভয়ংকর কেউ? লোকটা তার ব্যাগে চিঠি রাখে কখন? সে কেন দেখতে পায় না? আশ্চর্য, ব্যাগ টিফিন টাইম ক্লাসে রাখা হয়। তখনই কেবল চিঠি রাখা যেতে পারে। কিন্তু সে তো আজ কোনো ভাবেই ব্যাগ হাত ছাড়া করেনি, তবে কখন রাখলো চিঠি? তাওহীদার মস্তিষ্কে এই প্রশ্নটা ঘুরপাক খেতে লাগলো৷ রুশদাও চিন্তা করতে লাগলো তাওহীদার মতোই।

“লোকটা কি জীন ভূত নাকি? কখন রাখলো চিঠি? আর তোমার শত্রু কে হতে পারে?”
“আমি জানি না।”
“আন্দাজ নেই একটুও?”
“উঁহু!”

রুশদার বাবা আসার পর সে চলে গেলো। তাওহীদা একায় বাড়ি ফিরলো। ফ্রেশ হয়ে রাতের রান্না সেরে রুমে গিয়ে আবার ফ্রেশ হয়ে বই নিয়ে বসলো। আহসান এসে তার কাছে ঘুরঘুর করতে লাগলো৷ তাওহীদা লক্ষ্য করলো আহসানের ছটফট করা চেহেরা।

“কি হয়েছে তোমার?”
“খিদে, খিদে! খাইনি! আমাকে খেতে দেয়নি ওরা।”

তাওহীদা দাঁত দিয়ে জিব কামড়ে ধরলো। মাদ্রাসা, রান্না বান্না, বাড়ির সমস্ত কাজ করতে গিয়ে তাওহীদা কেমন যেনো আহসানের যত্ন নিতেই ভুল গেছে। বড্ড মন খারাপ হলো তার। সে কিভাবে অসুস্থ স্বামীর সেবা করতে ভুলে গেলো? অসুস্থ মানুষ টা কিছু বলতে পারে না বলে এই অবহেলা? ইশ কিভাবে পারলো সে? অপরাধ বোধে ভেতরটা দগদগে ক্ষতর সৃষ্টি করলো যেনো। সে বই বন্ধ করে বললো,“একটু বসো হ্যাঁ? আমি এই যাবো আর আসবো।”

আহসান বাধ্য ছেলের মতো মাথা নাড়লো। তাওহীদা দ্রুত পায়ে রুম ত্যাগ করলো। প্লেটে খাবার নিয়ে আসার সময় শাশুড়ীর মুখোমুখি হলো সে। সে বিনয়ী কন্ঠে বললো, “কিছু বলবেন মা?”

“কি আর বলবো? আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি। তুমি কিছু মনে করো না। সেদিন তোমার মুখে চা ছুড়েছিলাম।আমাকে পারলে ক্ষমা করিও। এই বুড়ো মায়ের উপর রাগ, -ক্ষোভ রেখো না। আমি তোমার বড়ো, বড়ো হয়ে ক্ষমা চাইছি।”

“মা, মা, দয়া করে এভাবে ক্ষমা চাইবেন না। আমি কখনোই আপনার উপর রেগে থাকতে পারি না। মায়েরা সন্তানদের শাসন করবে ভুল হলে এটাই তো নীতির মধ্যে পড়ে। আপনি আমার মায়ের মতো, শাসন করবেন এটাই স্বাভাবিক। আমি সবকিছু মাথা নেবো। শাসন করা আপনার অধিকার।”
“তোমার মতো এমন ভালো মেয়েকে কিনা আমি কাচ ভেবে পায়ে মারাতাম? এমন হিরের টুকরা মেয়ে তুমি। আমার আসলেই মতিভ্রম হয়েছিলো। আমি আমার ভুল বুঝতে পেরে অনুতাপে দগ্ধ হচ্ছি মা। তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও।”

তাওহহীদার দুই চোখ ভরে উঠল। এই প্রথম বোধহয় তার শাশুড়ী নামক মানুষটা তার সঙ্গে এতো মিষ্টি স্বরে কথা বলছে। তাওহীদার হৃদয়ে বেশ প্রভাব পড়লো। সে খাবারের প্লেট রেখে রওশন আরার হাত ধরে বললো, “মা আপনি যে আপনার ভুল বুঝতে পেরেছেন এটাই অনেক। আপনি আমার হলেন আরেকটা মা, তাই আমি ভুলে গেছি সবকিছু।”

তাওহীদা কান্নায় ঠিক ভাবে কথা বলতে পারছিলো না। রওশন আরা মাথায় হাত রাখলো তাওহীদার।
“যাও আহসানের জন্য খাবার নিয়ে যাচ্ছিলে তো? যাও। আমি ওকে খাওয়াতে গেছিলাম, কিন্তু ছেলেটা আমাকে কেন যেনো ভয় পায়। আর শোনো, আজ তুমি আমার সঙ্গে বসে খাবে। যদি না খাও আমি মনে করবো, তুমি এখনো মনে আমার জন্য দুঃখ পুষছো।”
“আচ্ছা আমি আপনার সঙ্গেই খাবো। আর আমি আহসানকেও বলে দেবো, এবার থেকে আপনাকে আর ভয় পাবে না মা।”

রওশন আরা হাসলেন। তাওহীদা খাবার নিয়ে রুমে গেলো। আহসান টেবিলের কাছে বসে কি যেনো করছিলো। কাগজ হাতে কি যেনো করছে। তাওহীদা অংকন টা দেখলো। কি অদ্ভুত ছবিটা। কি সব এঁকেছে। একটা মেয়েলী ছবি, যেনো মাটি খুড়ছে, অন্য পাশে একটা ছায়া যেনো সে পাহারা দিচ্ছে। খুব ভালো করে দেখলে বোঝা যাচ্ছে যেনো কেউ কিছু মাটিতে পুঁতে রাখছে। কোনো পুটুলী। এই অদ্ভুত ছবির মানে কি? হঠাৎই এমন ছবি কেন আঁকলো আহসান?

“আহসান, এই ছবিটি কেন আঁকলে হঠাৎ? ”

“আজ কি হয়েছে জানো বউ? ঐ ডাইনিটা এলো একবার, কি যেনো করছিলো। আমার ঘরেও এলো। কি করলো কে জানে। ঐ তো ছাদ থেকে দেখেছি ডাইনিকে।”

তাওহীদা আশ্চর্যান্বিত হয়ে আহসানের মুখপানে তাকিয়ে রইলো৷ কোনো ভাবেই ভ্রম থেকে তো একটা অসুস্থ মানুষ এসব কথা বলার কথা না। তবে কি বোঝাতে চাইছে আহসান? এখানে আসার পর তো অসুস্থ আহসানকে কখনো মিথ্যা বলতে দেখেনি৷ আর এমনি এমন সন্দেহ জনক একটা ছবিই বা কেন আঁকতে যাবে? তাওহীদা সকল ভাবনা বাদ দিয়ে বললো,“আচ্ছা, এখন খাবে এসো৷ তোমার তো খিদে পেয়েছে বললে!”

“ডাইনি এসেছিলো যে। ওকে মারবে না তুমি?”
“এই ডাইনি কাকে বলছো?”
“ঐ বুড়িটাকে!”
“আহসান, আর এভাবে বলবে না। উনি তোমার মা হয়। উনাকে কেন ভয় পাও? শোনো, মায়েরা কখনোই খারাপ হতেই পারে না৷ আজ আমাকে কতো স্নেহ করলো জানো? আজ অব্দি এমন ভাবে কখনোই কথা বলেন নি তিঁনি। আমি তো সব সময় এমনটাই চাইতাম। একটা সুখী পরিবার।”

অনেক দিন পর তাওহীদা হাসলো। আহসান তার হাসির দিকে তাকিয়ে হাত তালি দিয়ে বললো,“বউ হেসেছে, বউ হেসেছে৷ সুন্দর, সুন্দর!”

তাওহীদা আবারও মিষ্টি করে হাসলো। রাতের খাবার খেতে সে নিচে নামলো। কথা মতো আজ সে রওশন আরার সঙ্গে খাবে। আজ ডাইনিং টেবিলে যেনো একটা সুখ সুখ বিরাজমান। এমন একটা সুখী পরিবারের স্বপ্নই তো তাওহীদা এতো দিন দেখে এসেছে। রিমিকেও হাসিখুশি দেখাচ্ছে, এমন কি এই প্রথম সালমা আর পারভীন খাবার টেবিলে একটিও কটূ কথা বলেনি৷ তাওহীদার সুখে কেমন কান্না পাচ্ছে। তবে মফিজ উদ্দিন যেনো এই নিঃশব্দটা মানতে পারছেন না। তাওহীদার খুশি খুশি মুখ দেখে প্রবল সন্দেহ হওয়া সত্ত্বেও চুপচাপ খেয়ে উঠে গেলেন। একে একে সবাই খেয়ে যে যার রুমে চলে গেলো। তাওহীদা খুশি মনে সবকিছু গুছিয়ে রাখছিলো। রওশন আরা তখন রান্না ঘরে এসে বললেন,

“তাওহীদা, মা আমাকে এক গ্লাস দুধ দাও তো!”
“আপনি তো দুধ খান না মা।”
“আহা দাও ই না।”
তাওহীদা গ্লাসে দুধ দিলো। রওশন আরা গ্লাস হাতে নিয়ে তাওহীদার মুখের কাছে ধরলো। নরম গলায় বললেন,“এখন তোমার দুধ খাওয়া প্রয়োজন। কতো চাপ মাথায়। পড়াশোনা করছো, দুধ না খেলে হবে? নাও হা করো দেখি। এখন থেকে রোজ এক গ্লাস করে দুধ খাবে!”

তাওহীদা মানা করতে গিয়েও কেন যেনো করতে পারলো না৷ এতোদিন পর অবহেলিত তাওহীদা অল্প স্নেহে গলে গেলো। এই ভালোবাসা টা সে সাদরে গ্রহণ করতে চাইলো। রওশন আরা নিজ হাতে তাকে এক গ্লাস দুধ পুরো টা খাইয়ে দিলেন৷ তাওহীদা হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো শাশুড়ী স্নেহ পেয়ে। খাওয়া শেষে আদর আঁচলে মুখ মুছে দিলো রওশন আরা দুধটা খাওয়ার পাঁচ মিনিট এর মধ্যে তাওহীদা জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়লো। রওশন আরা খিটখিট করে হাসলেন৷ আহা শখ করে স্নেহ পেতে এসে কি হালটাই না হলো। রওশন আরা অজ্ঞানরত তাওহীদাকে সেভাবেই রেখে নিজের রুমে গিয়ে দরজা আঁটকে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়লেন৷ আহ শান্তি!

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে