#জীবন_পেন্ডুলাম
#পর্ব_৩৪
তাজরীন ফাতিহা
রাহমিদের স্বভাব হলো কেউ তাকে পাত্তা না দিলে সেও তাকে পাত্তা দেয় না। ইগনোর করে। ইফরার সাথে রাহমিদের সম্পর্কটা অনেকটা সাপে নেউলে টাইপ। ইফরা মুখ গম্ভীর করে তাদের কিছু বললে রাহমিদ ফোঁস করে ওঠে। যদিও ইফরা তাদের সাথে উচ্চস্বরে কখনো কথা বলে না তবুও মুখ গম্ভীর করে কথা বললেই রাহমিদ মনে করে ইফরা বিরক্ত হচ্ছে তাদের উপর। তখনই বাঝে বিপত্তি। রাহমিদকে কিছু বলতে নিলে রাহমিদ ছেড়ে দেয়না। রুদ চুপ থাকলেও সে প্রতিউত্তর করে।
আজকের বিকেলটা অনেকটা গুমোট। ইফরা রুদকে গম্ভীর স্বরে কি যেন একটা বলেছে অমনি রাহমিদ প্রতিউত্তর করেছে। তার মতে, যে তাদেরকে দেখতে পারেনা সেও তাকে দেখতে পারে না। রুদ বহুবার ছোট ভাইকে থামাতে চাচ্ছে কিন্তু রাহমিদ থামতে নারাজ। এক চুল ছাড়ও দেয়া হবে না। রুদ আবারও থামাতে এলে রাহমিদ ঝটকা মেরে সরিয়ে বললো,
“বেশি সাধু সাজতে গেলে এরকম করেই সারাজীবন মানুষের কথা শুনতে হবে। মুখ বুঝে খালি শুনে গেলেই হয় না আপুনি। মাঝে মধ্যে প্রতিউত্তরও করতে হয়। সে প্রত্যেকটা কথা এমন ভাবে বলে যেন সে প্রিসেন্স ডায়না আর আমরা হলাম কোনো এক ক্ষেতের পঁচা মুলা। মুখটাকে এমন বানিয়ে রাখে যেন পেঁচা উনি। মনে হয় পেঁচার কষা হয়েছে তাই মুখটাকে এমন করে রেখেছে।”
রুদের এ পর্যায়ে হাসি পেলো। তবে ভাবির সামনে হাসলো না। ইফরা চোখ মুখ কঠিন করে তাকিয়ে আছে। তাকে পেঁচা বললো। সে মুখ পেঁচার মতো করে রাখে। ইফরা এবার বললো,
“এই কি বললে? কার সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় জানো না? কথাবার্তার কোনো আদব লেহাজ নেই। দুই দিনের পুঁচকি যা ইচ্ছে তাই বলে যাচ্ছো। কথার লাগাম টানো।”
“আপনি টানুন। আসছে আদব লেহাজের গোডাউন। আপনার জ্ঞান আপনার মাথার ভিতর ঢুকিয়ে রাখুন। পুঁচকি কাকে বলছেন? আমি যথেষ্ট বড়। অন্তত আপনার ত্যাছড়া কথার প্রতিউত্তর করার মতো বড় নিশ্চয়ই হয়েছি।”
কথাটুকু বলে রাহমিদ প্রস্থান করলো। এর থেকে বেশি বাড়াবাড়ি করা যাবে না। শত হলেও উনি ভাইয়ুর বউ। যা বলেছে এটাই বেশি হয়ে গেছে। ভাইয়ু জানলে কষ্ট পাবে। কারণ তার আদর্শে প্রশ্ন উঠবে। অবশ্য ভাবির একটা গুণ তার খুবই পছন্দনীয়। তাদের মাঝে শত রেষারেষি হলেও ভাইয়ুকে কখনোই বলে না। তাদের অবর্তমানে ভাইয়ুর কান ভাঙায় না, কথা লাগায় না। ঝগড়া তার সাথে হলে তার সাথেই গম্ভীর স্বরে ঝগড়া করে ঝগড়ার পরিসমাপ্তি ঘটায়। এইতো একটু পরই তাদেরকে নাস্তা খেতে ডাকবে গম্ভীর স্বরে।
_______
আজকের সন্ধ্যার নাস্তার মেন্যু হলো, ঝাল ঝাল চানাচুর মুড়ি মাখা আর লাল চা। বাসায় আজকে দুধ নেই নাহলে দুধ চা-ই বানানো হতো। রায়হান বাসায় চলে এসেছে মাগরিব পড়ে। এখন পাটিতে বসে আছে তিনজন। রায়হান, রাহমিদ আর রুদ। মুড়িতে মরিচের পরিমাণ দেখেই রাহমিদ আর রুদ বুঝলো ভাবির রাগ এখনো কমেনি। রায়হান হাত গুটিয়ে বসে আছে। ইফরা আসার অপেক্ষা করছে। কিন্তু ইফরার দেখা নেই। মুড়ি মাখা দিয়ে চলে গেছে। রায়হান বললো,
“রুদ, রাহমিদ পড়াশোনার কি খবর?”
“আলহামদুলিল্লাহ ভাইয়ু।”
দুইজন একসাথে বলে উঠলো।
“আলহামদুলিল্লাহ হলেই ভালো। যাক আজকে বাসার পরিবেশ এমন নিস্তেজ কেন? কোনো কিছু হয়েছে?”
রুদ এবং রাহমিদ এদিক ওদিক তাকালো। কিছু বললো না। এর মধ্যেই ইফরা মুখ গম্ভীর করে এসে বসলো। রায়হান বললো,
“আপনার মন মেজাজ কি কোনো কারণে খারাপ?”
ইফরা রোবটের মতো উত্তর দিলো,
“না।”
রায়হান বললো,
“চলুন খাওয়া শুরু করা যাক।”
এরপর সবাই মিলে খাওয়া শুরু করলো। রাহমিদ মরিচ বেছে বেছে মুড়ি খাচ্ছে। এতেই ভীষণ ঝাল লেগে গেলো তার। সে ছোট দেখে ঝাল খেতে পারেনা তেমন। রায়হান ভাইকে পানি খাওয়ালো। তারপর চা খেতে বললো। রাহমিদ খেলো। একটু ঝাল কমেছে। ইফরা চোখ ছোট করে তার দিকে তাকিয়ে আছে যেন বলতে চাচ্ছে, “কি কেমন দিলাম?” রাহমিদও ত্যাছড়া চোখে তাকিয়ে বুঝিয়ে দিলো পরের চাল আমার। সকলের অগোচরে দুইজনের চক্ষু যুদ্ধ হয় গেলো কেউ তা টেরও পেলো না। আজকের “নাস্তা সন্ধ্যাটা” তেমন জমলো না।
_____
—-
আজকের আবহাওয়া যেহেতু ঠান্ডা ঠান্ডা সেহেতু ইফরা ভেবেছিল আজকে খিচুড়ি রাঁধবে। কিন্তু আজকে মন মেজাজ ভালো না থাকায় রাঁধতে ইচ্ছে করছে না। রায়হান কোচিং সেন্টারে চলে গেছে। ঘরে রাহমিদ আর রুদ আছে।
আজকে দুই জনের একজনও স্কুলে যায়নি। বৃষ্টি পড়েছে দেখে নানা অজুহাত দেখিয়ে বাসায় থেকে গেছে। ইফরা বাইরে তাকিয়ে আছে। অনেক কিছু ভেবে চলছে সে। আসলেই কি সে একজন টক্সিক মানুষ? তাকে কেউই পছন্দ করেনা। সেই ছোট্টবেলা থেকে এখন পর্যন্ত সবাই অবহেলার চোখে, দোষীর চোখে দেখে চলছে। আসলে সে মানুষটাই বোধহয় খারাপ। কারো সাথে কথা বলতে পারেনা, আগ বাড়িয়ে মিশতে পারে না, কথার কোনো সৌন্দর্য নেই। এতো এতো ত্রুটিপূর্ণ একজন মানুষ সে। কারো চোখেই আজ পর্যন্ত ভালো হতে পারে নি।
কত চেষ্টা করে একটু স্বাভাবিকভাবে ননদের সাথে কথা বলতে। কিন্তু সেই গম্ভীর, রোবটিক ভাব এসেই যায় তার। কি করবে বুঝতে পারছে না সে। রায়হান মানুষটা যথেষ্ট ভালো একজন মানুষ। তার খ্যাটখ্যাটে কথার বিপরীতে কখনোই উচ্চবাচ্য করেনি। সে কথা শোনালে সুন্দর করে বুঝিয়ে দিয়েছে তবুও ঝগড়া করেনি। এই মানুষটার সাথে সে কিভাবে ঝগড়া করবে?
কালকে রাতে ভীষণ মাথা ব্যথা উঠেছিল। সারারাত মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছে। মাথা টিপে দিয়েছে। কিছু খেতে ইচ্ছে করছে কিনা জিজ্ঞাসা করেছিল। সে বলেছে একটু টক জাতীয় কিছু খেলে ভালো লাগতো। মানুষটা কোথা থেকে যেন লেবু কেটে মরিচ, লবণ দিয়ে মাখিয়ে এনেছে।
লেবু একটা ছিল বোধহয় নাকি কিনে এনেছে সে সঠিক জানে না। তবে দরজার আওয়াজ পেয়েছে। হয়তবা বাইরে গিয়েছিল। রাত বেশি হয়নি অবশ্য তখন। বসে বসে যখন সে লেবু খাচ্ছিলো তখন মাথায় তেল দিয়ে চুল আঁচড়িয়ে দিয়েছে। এতে নাকি মাথা ব্যথা কমে যাবে। এই প্রথম মানুষটা তাকে খুব যত্নের সাথে ছুঁয়েছে। ভীষণ ভালো লাগছিল তার। বাবা, মা অন্তত ভালো একজন মানুষের কাছে তাকে দিয়েছে এতে সে চিরকাল কৃতজ্ঞ থাকবে তাদের কাছে।
তার বিয়ের বয়স পাঁচ মাস। এই পাঁচ মাসে মানুষটার সাথে যথেষ্ট দুরত্ব রেখে চলেছে সে। প্রথম প্রথম রান্নাঘরে ঢুকতও না সে। একদিন এতো ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরেছিল তার এতো খারাপ লাগলো সেদিন। ঘামে ভেজা শরীর নিয়ে গোসল করেই রান্না ঘরে ঢুকে রান্না করতে দেখে সেই প্রথম তার উপলব্ধি হলো এই মানুষটার কাজে একটু সাহায্য করতে হবে। রান্না শেষে ভাই, বোনকে খাইয়ে দিতেও যে মানুষটা ক্লান্তিবোধ করে না ওই মানুষটার সাথে এতোটা পাষাণ ব্যবহার করতে তার বিবেকে বাধা দিয়েছিল প্রচণ্ড।
তারপর আর কি। সেদিনের পর থেকে রান্নাটা সেই করে। সাথে রুদ সাহায্য করতে থাকতো। তবে রুদকে সাথে থাকতে নিষেধ করেছে সে। রান্নাবান্নায় তার পাশে কেউ থাকলে রান্নাটা ঠিক করে করতে পারেনা। তাই এখন একাই রান্নাটা করে। রুদের ডাকে ভাবনা থেকে বেরিয়ে এলো ইফরা।
“ভাবি আসবো?”
“আসো জিনাত।”
“আপনার মন কি বেশি খারাপ? ভাইয়ু ভাত খেয়ে আপনাকে ওষুধ খেতে বলেছিল মাথা ব্যথার।”
“না মন খারাপ না। তুমি যাও। রান্নার বেলা গড়ালো বলে। শরীরটা কেমন করছিল দেখে এখনো রান্না করতে যায়নি। তুমি কিছু বলতে এসেছিলে কি?”
“আমি আপনাকে হেল্প করি একটু। রান্না নাহয় আপনিই করবেন আমি পিঁয়াজ, রসুন কুচি করে দিবো।”
“ভালো কথা মনে করেছো আজকে রসুনের ভর্তা করবো। তোমরা রসুন খাও?”
“খাই তবে রসুনের ভর্তা আমরা কেউ কখনো খাইনি। আপনি বানাতে চাইলে বানাতে পারেন ভাবি। আপনি বানাবেন আমি পাশে দাঁড়িয়ে দেখে শিখবো।”
“আচ্ছা। পাশে থেকো।”
ইফরার শরীরটা আজকে খারাপ দেখে রুদকে সাথে থাকতে সায় জানালো।
_____
ছোটবেলা থেকেই ইফরা মা, বাবার আদর স্নেহ থেকে বঞ্চিত হওয়ায় দাদি তাকে আদর ভালবাসা দিতো। রান্না করলে আদরের নাতনিকে সাথে নিয়েই রান্না করতো। ছোট্ট ইফরা দাদির পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রান্না দেখতে দেখতে রান্নাটা ভালোভাবেই আয়ত্ত করে ফেলেছিল। প্রায় সব রান্নাই সে মোটামুটি ভালোই পারে। রান্না শিখে ভালোই হয়েছে এখন কাজে লাগছে তার।
আজকে রান্না করেছে গরম গরম খিচুড়ি। সাথে মুরগি ভুনা, ডিম ভাজি আর রসুনের ভর্তা। রাহমিদের খিচুড়ি অনেক পছন্দের। ভাবির সাথে তার ঝগড়া হলেও খাবারের সময় রাহমিদ রাগ করে থাকতে পারেনা। এই যেমন এখন গরম গরম ধোঁয়া ওঠা খিচুড়ির দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে তাকিয়ে কখন এটা পেটে চালান করবে তাই ভাবছে।
ইফরা যোহরের নামাজ পড়ে খিমার পড়েই ওদেরকে খাবার বেড়ে দিতে চলে আসলো। রায়হান বাসায় আসে এই সময়টায়। এসে খেয়েদেয়ে আবার চলে যায় কোচিংয়ে। আজকে ফিরতে কিছুটা দেরি হলো তার। এসেই খিচুড়ি আর মুরগির ঘ্রাণে পেট মোচড় দিয়ে উঠলো। বহু বছর আগে এরকম ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরার পর পাশের ঘরে রান্না করা খিচুড়ি, গোশতের ঘ্রাণে পেট মোচড় দিয়ে উঠেছিল তার। সেই দৃশ্য স্মৃতির পাতায় উঁকি দিয়ে উঠলো।
রায়হান হাত, মুখ ধুয়ে এসে খেতে বসলো। ইফরা সবার প্লেটে খিচুড়ি, গোশত, ডিম ভাজি আর রসুনের ভর্তা দিলো। সাথে নিজেও নিলো। রাহমিদ খাবার পেয়েই বিসমিল্লাহ বলে খাওয়া শুরু করেছে। তার আয়েশ করে খাওয়া দেখেই বুঝা যাচ্ছে খুব তৃপ্তি পাচ্ছে সে। বাকিরাও তৃপ্তি করে খেতে লাগলো। রুদ তো বলেই বসলো,
“দারুন হয়েছে রসুনের ভর্তাটা। খিচুড়ির সাথে মজাই লাগছে। ভাইয়ু এই ভর্তা আগে খাওয়াও নি কেন?”
রায়হান খেতে খেতে জবাব দিলো,
“আমি পারতাম নাকি? আমিও এই প্রথম খেলাম। মজা লাগছে।”
একমাত্র রাহমিদ কোনো কথা না বলে খাচ্ছে। শত হলেও ভাবির সাথে তার রেষারেষির সম্পর্ক। এখানে প্রশংসা করা তার ধাঁচে নেই। তবে মুখে তৃপ্তি ফুটিয়ে খেয়ে চলছে সে।
ইফরার ওদেরকে এভাবে তৃপ্তি করে খেতে দেখে ভীষণ ভালো লাগছে। রায়হান খেতে খেতে হঠাৎ মনে পড়ার ভঙ্গিতে বললো,
“আপনার না মাথা ব্যথা? এতো রান্না করতে গেলেন কেন এই অবস্থায়?”
“এখন আলহামদুলিল্লাহ ঠিক আছি। মাথা ব্যথা নেই।”
মানুষটার এতটুকু যত্ন তার ভীষণ প্রিয়। শত ব্যস্ততার মাঝেও ভাই, বোন, বউ করো চিন্তা তার মাথা থেকে যায়না। “বউ” কথাটা ভেবেই ইফরা একটু লজ্জা পেলো। একদিন রায়হানকে বলেছিল,
“আমাকে বউয়ের মতো দেখবেন না আর কোনো যত্নও করবেন না। এসব আমার বিরক্ত লাগে। রায়হান ফট করে বলেছিল,
“বউয়ের মতো না দেখলে কিসের মতো দেখবো? আপনাকে দেনমোহর দিয়ে কবুল পড়ে বিয়ে করেছি কি বউয়ের মতো না দেখে বোনের মতো দেখার জন্য? কি রকম কথা বলছেন?
ইফরা সেদিন তব্ধা খেয়ে গিয়েছিল। রায়হানকে সহজ সরল ভেবেছিল সেদিন তার ধারনা ভেঙে যায়। কিভাবে তার মুখের উপর বউয়ের ভাষণ দিয়ে গেলো। লজ্জায় ইফরার মুখ নিচু হয়ে গিয়েছিল। তবে তার স্বভাবের সাথে লজ্জা যায়না দেখে চেহারায় ফুটিয়ে তুলেনি যে সে ভীষণ লজ্জা পাচ্ছে। খাবার খেতে খেতে পুরোনো কথা মনে পড়ায় ইফরার হঠাৎই বিব্রত লাগলো।
চলবে…
#জীবন_পেন্ডুলাম
#পর্ব_৩৫
তাজরীন ফাতিহা
আজ সকাল থেকে রাহমিদের শরীরটা কেমন যেন খারাপ লাগছে। শীত শীত অনুভূত হচ্ছে। আজকে স্কুলে যেতে পারেনি। রুদ বহুবার ডেকেছে “যাবে না” বলে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়েছে। রুদ আর ঘাটায় নি। ওর স্কুলের সময় চলে যায় দেখে তাড়াহুড়া করে বেরিয়ে গেছে রায়হানের সাথে। রায়হান রাহমিদের কথা জিজ্ঞাসা করলে রুদ বলেছে “ও স্কুলে যাবে না।”
রায়হান চিন্তিত হয়েছিল কথাটায়। পরক্ষণে রুদের স্কুলের আর তার কোচিংয়ের দেরি হয়ে যাচ্ছে দেখে বেরিয়ে পড়েছে দুইজন।
বাসায় এখন ইফরা আর রাহমিদ। ইফরা রাহমিদের সাথে প্রয়োজন ছাড়া তেমন কথা বলে না। বলেই না একেবারে। শুধু ঝগড়া টা হয় দুইজনের ফাটাফাটি ভাবে। সে রাহমিদ বাসায় থাকলে পুরো শরীর ঢেকে রাখে। শুধু মুখমন্ডল খোলা রাখে। কারণ রাহমিদ শত হলেও তার দেবর। আর দেবর মৃত্যু সমতুল্য। রাহমিদ ছোট দেখে ইফরা এখন কথাবার্তা বলছে। বড় হয়ে গেলে আর দেখাও দিবে না।
ইফরা ঘর গুছিয়ে রান্নার উদ্দেশ্যে রান্নাঘরে যাওয়ার সময় রাহমিদের রুম থেকে হালকা গোঙানির আওয়াজ শুনতে পায়। সে উঁকি দিয়ে দেখে রাহমিদ কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে আর কাঁপছে। বিষয়টায় ইফরার খটকা লাগে। সে খিমার দিয়ে মুখ ঢেকে রুমে ঢুকে কাঁথা সরিয়ে রাহমিদের কপালে হাত দিলো। হাতে ভীষণ গরম অনুভূত হওয়ায় হাত দ্রুত সরিয়ে ফেললো।
রাহমিদ অবচেতনে বির বির করে, “মা মা” ডেকে চলেছে। ইফরার এতো খারাপ লাগছিল ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। আহারে বাচ্চাগুলো কতো ছোট বয়সে মাতৃহারা হয়েছে। মাকে না দেখেলেও, মায়ের আদর স্নেহ না পেলেও অবচেতনে ঠিকই মাকে খুঁজে বেড়ায় বাচ্চাগুলো। ইফরা আর দেরি না করে মাথায় জলপট্টি দিলো। রাহমিদ এখন বলছে,
“ভাইয়ু আমার ভীষণ শীত করে, তুমি ঝাপটে জড়িয়ে ধরো।”
ইফরা বুঝলো বাচ্চাটার ভালোই শীত লাগছে। রায়হানকে কি একটা ফোন করবে সে? না থাক কোচিং করাচ্ছে সব ছেড়ে চলে আসতে পারে। রাহমিদের অসুস্থতা নিয়ে ইনফর্ম করলে চিন্তায় চিন্তায় অস্থির হয়ে যাবে। ইফরা উঠে থার্মোমিটার নিয়ে রাহমিদের মুখে দিলো। রাহমিদ এ পর্যায়ে চোখ খুললো। চোখ দুটো ভীষণ জ্বালা করছে তার। চোখ খুলেই ভাবিকে তার সামনে বসে থাকতে দেখে ভীষণ অবাক এবং বিব্রত হলো। মুখ খুলে কিছু বলতে গেলেই ইফরা নিষেধ করে বললো,
“কথা বলো না। মুখে থার্মোমিটার আছে।”
কথাটি শুনে রাহমিদ কথা না বলে চুপটি মেরে থাকলো। ইফরা এক মিনিট পর থার্মোমিটার উঠিয়ে দেখে জ্বর একশো তিন ডিগ্রি। সে উঠে বালতিতে করে পানি নিয়ে আসলো। বালিশের উপরে পলিথিন দিয়ে রাহমিদকে ধরে শোয়ালো। রাহমিদ প্রথমে ইতস্তত করলেও ইফরার চোখ গরমে শুয়ে পড়লো। ইফরা মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে পানি দিতে থাকলো। পানি দেয়া শেষ হলে মাথা মুছিয়ে দিলো। বালতি বাথরুমে রেখে রান্নাঘরে চলে গেলো। একটু পর জাউ ভাত রান্না করে নিয়ে আসলো। পোলাওয়ের চাল দিয়ে রান্না করা হয়েছে এই জাউ ভাত।
ইফরা রাহমিদকে উঠিয়ে অল্প অল্প করে খাইয়ে দিলো। খাওয়ানো শেষ করে মুখ মোছালো। রাহমিদ অবাক নজরে ইফরার দিকে তাকিয়ে আছে। এতদিন ইফরাকে ঝগড়া করা অবস্থায় আর তার প্রতিদ্বন্দ্বী অবস্থায় দেখেছে। আজ একজন মায়ের রূপে দেখলো। যে গভীর মমতা নিয়ে তার প্রতিদ্বন্দ্বীর সেবা করছে। এ সেবায় না আছে অতিরঞ্জিত ভাব আর না আছে তাড়াহুড়া। চোখ মুখ আগের মতোই গম্ভীর কিন্তু সেবাযত্ন যেন এক অপূর্ব মায়ার থালি। রাহমিদের হঠাৎ করে ইফরাকে মা মনে হলো। যে তার বাচ্চার জ্বর হয়েছে দেখে চিন্তায় অস্থির হয়ে মুখ গম্ভীর করে রেখেছে। তার চোখ ছলছল করে উঠলো কি?
_________
—–
রাহমিদের জ্বর এসেছে শুনে রায়হানের অস্থির অস্থির লাগছে। বাসায় এসে মাত্র হাত, মুখ ধুয়ে বের হয়েছে। এরমধ্যে ইফরা জানালো সকাল থেকে রাহমিদের ভীষণ জ্বর শরীরে। তাকে ওষুধ আনার জন্য তাড়া দিতে থাকলো। রায়হান এক মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে ভাইয়ের রুমে চলে গেলো। গিয়ে দেখলো রুদ ছোট ভাইয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। রায়হান দৌঁড়ের ভঙ্গিতে রুমে ঢুকে ভাইয়ের কপালে, চোয়ালে হাত ছোঁয়ালো। দেখলো জ্বরে শরীর পুড়ে যাচ্ছে। সে অস্থির হয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
“কলিজা কি হয়েছে আপনার? এতো জ্বর বাঁধালেন কি করে?”
রাহমিদ পিটপিট করে চোখ খুলে ভাইকে দেখেই বলে উঠলো,
“ভাইয়ু এসেছো? আমার ভীষণ খারাপ লাগছে।”
রায়হান ভাইয়ের মাথা নিজের কোলে নিয়ে বললো,
“কেমন লাগছে বাচ্চা? ভাইয়ুকে বলেন। কোথায় কষ্ট হচ্ছে? ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো?”
রাহমিদ মাথা ছেড়ে দিয়ে থেমে থেমে বললো,
“ভাইয়ু আমি বোধহয় মারা যাচ্ছি। ভাবির সাথে অনেক ঝগড়া করেছি, তোমাদের অনেক জ্বালিয়েছি। তোমরা আমাকে মাফ করে দিও। ভাবিকে বইলো তার এই পুঁচকিকে মাফ করে দিতে। জানো ভাইয়ু ভাবি না অনেক ভালো। আমরা ভাবিকে যেমন দেখি উনি আসলে তেমন না। ওনার খুব সুন্দর একটা মন আছে।”
এতটুকু বলে রাহমিদ আর কিছু বলতে পারলো না। শরীর একেবারে ছেড়ে দিলো। রায়হান অস্থির ভঙ্গিতে ওকে ডাকতে থাকলো। চিল্লিয়ে বললো,
“ও কলিজা, টোটন রে। কি হলো কথা বলিস না কেন?”
ইফরা দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করাতে বললো। রায়হান ভাইকে তাড়াতাড়ি কোলে নিয়ে হাসপাতলের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো। রুদও ভাইয়ের পিছু পিছু মাথায় হিজাব পেঁচিয়ে বেরিয়ে পড়েছে। ইফরা আর বোরকা পড়ার সময় পেলো না। এর আগেই রায়হান ভাইকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে। ইফরা দ্রুত গিয়ে ওযু করলো। জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজ পড়তে বসলো। দীর্ঘ আঠারো বছর কান্না না করা শক্ত খোলসের ইফরা ঝরঝর করে কেঁদে দিলো।
শুধু বিয়ের পর দাদিকে জড়িয়ে ধরে আধা ঘণ্টা কান্না করা ছাড়া দীর্ঘ আঠারোটি বছর ইফরা চোখের পানি ফেলেনি। এমনকি মহান রবের নিকটও কেঁদেকেটে কিছু চায় নি। ভীষণ অভিমান জমেছিল রবের প্রতি। তাই মুখ ফুটে নিজের জন্য কিছুই চাইনি। তবে আজকে ছোট্ট একটা বাচ্চা ছেলের জন্য তার বুক ফেটে যাচ্ছে একেবারে। এই অল্প কয়েকদিনেই বাচ্চাগুলোর প্রতি তার ভীষণ মায়া তৈরি হয়েছে। এতদিন তা টের না পেলেও আজকে রাহমিদকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময় খুব করে তা টের পাচ্ছে।
সিজদায় গিয়ে উচ্চস্বরে কেঁদে উঠে বললো,
“আল্লাহ ওইটুকু বাচ্চার সাথে খারাপ কিছু করো না। ও এখনো নিষ্পাপ। মা, বাবাকে বাচ্চাটা একেবারে ছোট্ট থাকতে হারিয়েছে। ওকে এতো অল্প সময়ে এতো বড় পরীক্ষা দিও না। ওর কিছু হলে ওর ভাই নামক মানুষটা মরে যাবে মাবুদ।”
ইফরা কান্নার দমকে কথা বলতে পারলো না।
______
রায়হানের শরীর থেকে ঘাম টপটপ করে পড়ছে। হাসপাতালের দেয়াল ঘেষে উপরের দিকে তাকিয়ে আছে সে। দেখে মনে হচ্ছে জীবন্ত পাথর। রুদ পাশে বসে কেঁদে চলেছে। রায়হানের কোনো সাড়া শব্দ নেই। যেন ছুঁয়ে দিলেই ঠাস করে পড়ে যাবে এমন দেখাচ্ছে তাকে। অনন্তকাল ধরে ক্লান্ত সে। ফোন বাঁচছে পকেটে। কিন্তু ধরছে না সে। অনেকক্ষণ বাজার পর রায়হান আস্তে করে ফোন বের করলো। না দেখেই রিসিভ করলো। ওপাশে ইফরা অস্থির কন্ঠে বলে উঠলো,
“আপনারা কোন হাসপাতালে আছেন। আমাকে অ্যাড্রেস বলুন দ্রুত।”
রায়হান রোবটের মতো অ্যাড্রেস বলে রেখে দিলো ফোন। খানিকক্ষণের মধ্যে কালো বোরকা পরিহিত ইফরাকে ছুটে আসতে দেখা গেলো। এসেই রায়হানের পাশে ধপ করে বসে পড়লো। আতঙ্কিত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলো,
“ডাক্তার কি বলেছে?”
রায়হান মূর্তির মতো বসেই থাকলো। না নড়াচড়া করলো আর না কিছু বললো। ইফরা ওকে ধাক্কা দিলে রোবটের মতো মাথা ঘুরিয়ে তার দিকে চাইলো। ইফরাও তাকিয়ে আছে। ইফরা অনেক কিছু বলেই গেলো কিন্তু রায়হান কিছুই বললো না। ইফরার মুখের দিকেই তাকিয়ে রইলো। ইফরা বুঝলো রায়হান ভিতরে ভিতরে ভীষণ ভেঙে পড়েছে। ডাক্তার রুম থেকে বের হলে রায়হান দ্রুত উঠে ডাক্তারের সামনে দাঁড়ালো। কেমন উন্মাদের মতো বলতে লাগলো,
“এই যে স্যার, আমার এইটুকু বাচ্চা ভালো আছে তো।”
রায়হান হাত অল্প প্রসারিত করে দেখালো। ডাক্তার কিছুটা হকচকিয়ে উঠেছিল আচমকা রায়হানের আগমনে। তারপর মুখ গম্ভীর করে বললো,
“ওর তো অনেকদিন ধরেই অ্যানিমিয়া। আপনারা কোথায় ছিলেন? এতটুকু বাচ্চার রক্তের হিমোগ্লোবিন এতোটা কমে গেলো কি করে? এছাড়াও ওর মাইগ্রেইন এর প্রবলেমস আছে। স্নায়ুবিকভাবে ভীষণ দুর্বল বাচ্চাটা। বাচ্চাটার এতো মারাত্মক রোগ হওয়ার কারণ কি? আপনারা কি করেন? বাচ্চার বাবা কি আপনি?”
রায়হান উদ্ভ্রান্তের ন্যায় বললো,
“হ্যাঁ হ্যাঁ আমিই ওর বাবা।”
ইফরা বুঝলো রায়হানের সেন্স হারিয়ে গেছে। কি বলছে, কি করছে সেটাও বলতে পারছে না। ডাক্তার সন্দেহ নিয়ে বললো,
“কিন্তু আপনাকে দেখে তো অতো বয়সী মনে হচ্ছে না। এইটুকু বয়সেই এতবড় বাচ্চার বাবা? যাইহোক যেটাই হন, রক্তের ব্যবস্থা ইমিডিয়েটলি করুন। বেশি অপেক্ষা করা যাবে না।”
ডাক্তার এরপর নার্সকে বললো,
“ওনাদেরকে ব্লাড গ্রুপ পরীক্ষা করে দ্রুত জানান।”
নার্স “ইয়েস স্যার” বলে চলে গেলো। রায়হান শরীর ছেড়ে দিয়ে আবারও বসে পড়লো। মাথায় হাত দিয়ে শক্ত করে চেপে ধরলো। মাথা ব্যথায় ছিঁড়ে হচ্ছে তার। ইফরার ভীষণ মায়া লাগলো। মাথায় হাত দিয়ে টিপে দিতে নিলেই রায়হান হাত ঝাড়া দিয়ে উঠলো। রাগ কণ্ঠে বললো,
“দূরে সরুন। আমার ভাইয়ের সকাল থেকে জ্বর আর আপনি কিনা বসে বসে তামাশা দেখেছেন? বাচ্চাটা যে অসুস্থ হয়ে পড়ে ছিল আমাকে একটা ফোন দিয়ে জানাতে পারলেন না? আপনি ইচ্ছে করে ইনফর্ম করেন নি তাই না? ও তো আপনার শত্রু তাই ইচ্ছে করেই জানান নি। ও মরে গেলে আপনার কি? আপনি তো বেঁচে যান।”
এরকম নানা কথা বলতে থাকলো। যার সবকিছু ইফরাকে দোষী করে। রায়হানের যে হুঁশ নেই তা বোঝাই যাচ্ছে। ইফরার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। ও রাহমিদকে মেরে ফেলতে চায়। নার্স এসে রায়হানকে রক্তের গ্রুপ বললে রায়হান রক্তের জোগাড়ে বেরিয়ে পড়লো। এদিকে যে একজনের মন ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিয়ে গেলো সেটা ঘুণাক্ষরেও টের পেলো না।
_______
“আলহামদুলিল্লাহ বাচ্চাটা সুস্থ আছে। আর টেনশনের কিছু নেই। আল্লাহ আপনাদেরকে সাহায্য করেছেন। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানান।”
কথাটি শুনে শুষ্ক পাতায় একফোঁটা পানির ন্যায় রায়হানের বুক তৃষ্ণিত হলো যেন।
চলবে…