#প্রেম_প্রার্থনা
#লেখনীতে_নূরজাহান_আক্তার_আলো
[২০]
কিছুক্ষণ আগে স্পর্শীরা বাসায় ফিরেছে৷ বাসায় ফিরে তার মুখে ফুটে উঠেছে প্রাণোচ্ছল হাসি। বিশাল অট্টোলিকা হোক অথবা কুঁড়েঘর যার যেখানে মন টিকে সেটাই তার প্রশান্তির আবাস। এখন যেমন নিজের বাসায় পা রাখতে না রাখতেই তার মন মেজাজ ফুরফুরে রুপ ধারণ করেছে। অসুস্থবোধ অনেকটাই কমে গেছর। বুকচাপা দীর্ঘশ্বাস বিদায় নিয়েছে।
তবে মনে হচ্ছে বহুবছর পর নিজ আলয়ে পা রেখেছে। তার ছোটো থেকে বড় হওয়া এই বাসাতে। হঠাৎ তার অনুপস্থিতে বাসাটাও বুঝি তার বিরহে কেঁদেছে। মুখ মলিন করে তাকে খুঁজেছে। কিন্তু এই যে সুপরিচিত আপন আপন সুগন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে বাসার আনাচে কানাচে। অস্বস্তিবোধ নেই সংকোচ নেই এখন অবাধ পাখির মতো চলতে পারবে, ঘুরতে পারবে। স্বাধীনতা আসলেই শান্তির আরেক রুপ। বন্দী জীবন সত্যিই ভীষণ কষ্টের, এ’কদিনে হারে হারে টের পেয়েছে।
স্পর্শীকে ফ্রেশ হতে বলে মরিয়ম বেগম পোশাক পরিবর্তন করে ছুটলেন রান্নাঘরে। ঝটপট নাস্তাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
মেয়েটাকে ওষুধ খাওয়াতে হবে খালি পেটে ওষুধ খাওয়ানো যাবে না। এদিকে স্পর্শী তার বাবার সঙ্গে দেখা করে মনপ্রাণ জুড়িয়ে কত কথা বলছে। পুনরায় তার প্রাণোচ্ছল চঞ্চলতা উপচে পড়ছে সর্বাঙ্গ জুড়ে। বাচালরাণীর মুখে পুনরায় কথা
ফুটেছে। মুচকি মুচকি হাসি ঠিকরে পড়ছে চিকন ওষ্ঠকোণে।
স্পর্শীর মুখপানে স্নেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন তার বাবা। মেয়ের আদুরে মুখটা অনেক শুকিয়ে গেছে, কপালে, হাতে, ব্যন্ডেজ। চট্টগ্রামে যাওয়ার পর থেকে মেয়েটা শান্তি পাই নি।
একটার উপর একটা ঝামেলা পাঁকিয়েই চলছে। বাবাকে সব কথা উগড়ে দিয়ে স্পর্শী আশেপাশে তাকাল। দাদীমা এসেই পানের বাটা নিয়ে বসে পড়েছেন। গালভর্তি পান নিয়ে ফোনে কারো সঙ্গে কথা বলছেন। স্পর্শী বাবাকে বসতে বলে মায়ের বারণ অমান্য করে গুঁটি গুঁটি পায়ে পুরো বাসা ঘুরে দেখছে।
পেট ব্যথা নেই বিধায় হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে না তবে জোরে ধাপ ফেললে চিনচিন করে উঠল। সেই ব্যথাকে অগ্রাহ্য করে সে
হেঁটে চলে বেড়াচ্ছে আপনখেয়ালে। এমন কোনো জায়গা বাদ পড়ল না যেখানে তার আগমন ঘটলো না। বাসা ঘুরতে ঘুরতে তার খুশি আরো দ্বিগুন হলো যখন দেখল রজনীগন্ধা
ফুলের কলি এসেছে। তার পাশেই গোলাপের টপ। সেই গাছে তিনটে হলুদ গোলাপ ফুটেছে। কি যে সুন্দর লাগছে দেখতে!
যদিও গোলাপের চারাটা তার স্কুলের প্রধান শিক্ষকের বাসা থেকে চুরি করে আনা। তখনো জানতো না হলুদ গোলাপের চারা এটা। মোদ্দাকথা, সে চুরিটাই করেছিল এক্সপেরিমেন্ট করতে। এক বর্ষণের দিনে ক্লাস টিচার আসতে পেরেছিলেন না, সেদিন তাদের প্রধান শিক্ষক ক্লাসটা নিয়েছিলেন। ক্লাস বলতে গল্পের ক্লাস। বৃষ্টি নিয়ে মজার মজার সব গল্প। একে একে স্টুডেন্টরা গল্প বলছে বাকিটা মনোযোগ দিয়ে শুনছে।
কারো কারো গল্প শুনে হাসিতে ফেটে পড়ছে পুরো ক্লাসরুম।
গল্পের এক পর্যায়ে চুরি করার কথা উঠেছিল। রবিউল স্যার নিজেও মুখভর্তি হাসি নিয়ে গর্ব করে বলেছিলেন উনি নাকি বহুবার চুরি করেছেন। যুবক বয়সে কারো গাছে ডাব, আম, পেয়ারা, এমনকি মুরগি চুরি করে পিকনিক করেছেন। আর উনি এবং উনার বন্ধুরা এসব কাজ প্রায়ই করতেন। সেগুলো সোনালি দিন ছিল। আগ্রহী শ্রোতা হয়ে উনার কথা শুনছিল
প্রত্যেকটা স্টুডেন্টে। পুরনো কথা স্মৃতিচারণ করতে করতে উনার মুখে ঝলমল করছিল অনাবিল সুখে। গল্প শেষ করে
উনি গালভর্তি হেসে একটা কথা বলেছিলেন,’চুরি বিদ্যা মহা বিদ্যা যদি না পড়ো ধরা।’ উক্ত প্রবাদটা তার ভীষণণ ভালো
লেগেছিল তারপর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল রবিউল স্যারের বাসা থেকেই কিছু চুরি করবে। তারপর যেই ভাবা সেই কাজ স্কুলে যাওয়ার পথে স্যারা বাসা পড়ে। একদিন সে স্কুলে যাওয়ার পথেই বড় গেট দিয়ে উঁকি মেরে দেখে অনেক ফুলের চারা। মনে মনে পরিকল্পনা এঁটে স্কুলথেকে ফেরার পথে আশেপাশে কাউকে না দেখে পটাপট কয়েকটা চারা তুলে ভদ্রভাবে হাঁটা ধরল। এমন ভাব করলো যেন নিজের টাকায় কিনে বাসায় নিয়ে যাচ্ছে। লোকশূন্য রাস্তায় কেউ দেখলও না তাই ধরাও খেলো না। সেদিন চারটা চারা এনেছিল একটা ছিল হলুদ গোলাপের, একটা স্ট্রোবেরির, একটা জবাফুল, আরেকটা
জলপাই। চুরি করা গাছগুলো এখনো জীবিত আছে সজীব ও সতেজ হয়ে ফুল/ফলের ধরার উপযুক্ত হয়ে উঠছে। ইশ! আর কয়েকটা আনলে ভালো হতো।পূর্বের কথা ভেবে স্পর্শী খিলখিল করে হেসে উঠল। আগামীকাল থেকে স্কুলে যাওয়া শুরু করবে। স্কুলে গিয়ে কী করবে পরিকল্পনাও করে নিলো।
তারপর সিঁড়ি বেয়ে তরতর করে উঠে রুদ্রর রুমের কাছটায় এগিয়ে গেল। কি যেন ভেবে রুমের দরজাটা খুলে জানালার পর্দা সরিয়ে অবাধ আলো প্রবেশের ব্যবস্থা করে দিলো। মুখ
বের করে বাইরে দৃষ্টি ছুঁড়ে একগাল হাসল। পূর্বালী বাতায়ণ তার শরীর ছুঁয়ে গেল। এই বাসার সবচেয়ে সুন্দর রুম এইটা, কারণ এটা এই বাসার একমাত্র রাজপুত্রের রুম। এই নিয়েও তার খুব হিংসে হতো। রুদ্র কেন এইেরুমে থাকবে? তাকেই কেন সেরা জিনিসটা দিতে হবে? সে কি এই বাসার কেউ না?
রুদ্র যেমন ছেলে সেও এই বাসার মেয়ে আর ছেলেমেয়েদের সমান অধিকার। কেউ একচুল বেশিও না কমও না। তাছাড়া বড়দের উচিত সবচেয়ে ছোটো সদস্য হিসেবে তাকেই সেরা জিনিসটা দেওয়া। অথচ উনারা করেছে উল্টো, বিগতবছরে যখন পুরো বাসা রং করানো হলো তখন যে যার পছন্দমতো নিজেদের রুম সাজিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু সে স্কুল থেকে ফিরে নিজের রুম দেখে হতভম্ব। রুমের অবস্থা দেখে রাগে ক্ষোভে ফেটে পড়ে সে দাদীমাকে বলেছিল,
-‘দাদীমা রুদ্রভাইয়াকে বলো উনার রুমটা আমাকে দিয়ে দিতে। আর আমার রুমটা উনাকে নিতে।’
-‘এডি কেমুন কথা? ক্যান তর রুমে কিতা হইছে?’
-‘সব রুম রং করার পরে ভাইয়ার রুম বেশি সুন্দর দেখাচ্ছে।
অনেক বড় খোলামেলা সুন্দর ওই রুমটা। তাই ওটাই আমার চাই।’
-‘দাদুভাইয়ের রুম রং করনোর লাইগা দাদুভাই নিজেই রং বাইচ্ছা দিসে। রংমিস্ত্রিরে কইয়া দিসে কেমনে কেমনে করতে হইবো। মিস্ত্রি তার কথা শুইনা সেইরকমই কইরা দিসে। তুইও তুই পছন্দের কথা কইতি তাইলেই হইতো।’
-‘তোমার স্বার্থপর বেআক্কেল দাদুভাই সবসময় নিজের কথা ভাবে কেন? আমার রুমটা যদি সে নিজ দায়িত্বে রং কইরা দিতো খুব কী ক্ষতি হতো? নাকি ভাব কমে যেতো? সে ইচ্ছে করেই এমন করেছে? এই রুম নিবো না আমি। তুমি তাকে বলে আমাকে সুন্দর রুম এনে দাও।’
ওর পুরো কথা শুনে তখন কেউ পেছন থেকে বলে উঠলো,
-‘নিজের পছন্দের কাজ অন্যরা করে দিবে কেন? যে নিজের পছন্দের কথা বলতে পারে না তার এত চোটপাট কিসের? তাছাড়া তোর কমলা রং পছন্দ এজন্য মেজো মা এই রংটাই করিয়েছে।’
-‘মোটেও কমলা পছন্দ নয় আমার।’
-‘ তবে মেজো মাকে বলেছিস কেন কমলা রং তোর পছন্দ?
নিজে দোষ করে অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপানো অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে, ফাজিল কোথাকার।’
-‘বলেছি কি আর সাধে নাকি? সেদিন শপিং করতে গিয়ে কমলা রংয়ের একটা ড্রেস পছন্দ করেছিলাম। আম্মু নিয়ে দিচ্ছিল না তাই বলে়ছিলাম কমলা রং খুবই পছন্দ আমার।
একথা শুনে আম্মু যত বার শপিং করতে যায় কমলা রংয়ের ড্রেসই কিনে আনে। না পারি কিছু বলতে আর না পারি তার
কমলা ড্রেসেন অত্যাচার সইতে। তাছাড়া কমলা রং টা ড্রেস অবধি সীমাবদ্ধ ছিল তাই বলে রুমের রংটাও ওই ক্যাটকেটে কালার করতে হবে? এ কেমন অবিচার?’
-‘কিচ্ছু করার নেই এখন তোকে ওই রুমেই থাকতে হবে।’
-‘না! আমি তোমার রুমটা নিবো।’
-‘কেন, আমার রুম কেন?’
-‘কারণ ওই রুমটা খোলামেলা অনেক সুন্দর। ‘
-‘ওই রুমের মালিককে চেয়ে নে ফ্রিতে রুম পেয়ে যাবি।’
-‘কি বললে, জোরে বলো?
-‘কিছু না। তোকে আমার রুমের আশেপাশেও যেন না দেখি।’
একথা বলে রুদ্র প্রস্থান করেছিল। সেদিন বিরবির করে বলা রুদ্রর কথা না বুঝলেও আজ সে বুঝে, একটু একটু উপলব্ধি করতে পারে। এই রুমটা আগে থেকেই ভীষণ পছন্দের ছিল বর্তমানে রুমের মালিক আর রুম দু’টোই তার, একান্ত তার।
_____________________________________________
স্যাঁতসেঁতে বন্ধ রুমের মেঝেতে বসে কাঁদছে রুদাশা। ক্ষুধা
তৃষ্ণায় কাহিল অবস্থা। প্রায় সাতাশ ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে তাও কেউ একটু পানি অবধি দেয় নি তাকে। চোখ বাঁধা অবস্থায় কোথায় এনেছে তাও জানে না। বাবাকে খবর দিতে পারলে হতো চেষ্টাও করেছিল কিন্তু শিহাবের জন্য তা সম্ভব হয় নি। বরং তার চাটুকারিতা বুঝে তাকে কয়েকটা থাপ্পড় মেরেছে। ওই কাপুরষ শিহাব এখন কোথায়? আগে তো বউ বউ করে মুখে ফ্যাঁপরা তুলে দিতো, এখন পুলিশের দায়িত্ব দেখাচ্ছে?
ওর দায়িত্ব আরো ভালো করে বুঝাবে একবার ছাড়া পাক।
সব ক’টা বেইমানকে উচিত শিক্ষা দিয়ে ছাড়বে। কিন্তু এখন তার একটু পানির ভীষণ প্রয়োজন। গলা শুকিয়ে কাঠ। মনে হচ্ছে চৈত্রের খরা দেখা দিয়েছে তার পিপাসিত গলায়। ক্ষুধা জ্বালা এত যন্ত্রণাদায়ক কল্পনা করে নি সে । বাবার একমাত্র অতি আদরের মেয়ে বিধায় খাবার নিয়ে খুব জ্বালিয়েছে ওর মাকে। এটা খাবো না ওটা খাবো করে বায়নার শেষ ছিল না তার। কিন্তু ছয় মাসে আগে যখন মা মারা গেলে তখন থেকে এখন অবধি তার সেসব ফরমায়েশ খাঁটে কাজের লোকেরা। প্রতিবেলায় খাবার নষ্ট করা তার নিত্যদিনের কাজ। কিন্তু এ মুহূর্তে মনে হচ্ছে পৃথিবীর জঘন্যতম খাবারটাও সে গোগ্রামে গিলতে পারবে। মোদ্দাকথা, যে কারো এঁটো খাবারের তার ঘৃণা লাগবে না। পেট কারণ, বারণ, শরম, বুঝে না সেটা যেন
এই পরিস্থিতি নতুন করে চেনালো। অন্ধকার রুমে মশার উপদ্রব বেড়ে চলেছে। চিঁ চিঁ শব্দ তুলে ছুটাছুটি করছে ইঁদুর ছানা। দুটো তেলাপোকা ঘাপটি মেরে বসে আছে রুমের এক কোণে। কি শলাপরামর্শ করছে কে জানে! রুমে একটা ফ্যান নেই, জানালা নেই, শুধু টিমটিম করে একটা লাইট জ্বলছে।
ক্ষুধা তৃষ্ণায় কাঁদতে কাঁদতে রুদাশা মাটিতেই শুয়ে পড়লো।
একটুপরেই ক্যাঁচক্যাচঁ শব্দ তুলে কেউ রুমের দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করল। শিহাব গালভর্তি হেসে হাতের খাবার পাশে রেখে হাঁটু গেড়ে বসল। তাকে দেখে রুদাশা রাগে দুঃখে মুখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে তাকাল। এই পুরুষটাকে কেন জানি সহ্যই হয় না। এত পরিমাণ ঘৃণা করে কখনো কাছে ঘেষারও সুযোগ দেয় নি। তাকে মুখ ফেরাতে দেখে শিহাব তাকে টেনে তুলে পাশের রুমে নিয়ে গেল। ওয়াশরুম দেখিয়ে বলল দ্রুত
ফ্রেশ হয়ে নিতে। সাদামাটা নরমাল ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বসতেই তাকে খাবার দেওয়া হলো, ভাত আর পানি মতো পাতলা ডাল তাও পরিমাণে খুবই সীমিত। রুদাশা তাই খাওয়া শুরু করলো। শিহাব দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে
দেখছে অহংকারী এক মানবীকে। বিয়ের পরেরদিন তাদের
বিশাল বড় ডায়নিং টেবিলে খেতে বসেছিল বিধায় সকলের সামনে তাকে ছোটলোক বলে অপমান করেছিল। খাবারের প্লেট ছুঁড়ে মেরেছিল মেঝেতে। নামীদামী খাবার নাকি চোখে দেখে নি তাই উপহাশ করতেও ছাড়ে নি। অথচ আজ সেই অহংকারী মেয়েটাই মোটা চালের ভাত আর পাতলা ডাল
গোগ্রাসে গিলছে। ওইটুকু ভাতে রুদাশার পেট ভরে নি তাই সে বলল,
-‘আরো খাবার চাই আমার।’
-‘আর একফোঁটা পানিও দেওয়া হবে না। আপনি শাস্তিপাপ্য আসামী, আমার বিয়ে করা বউ নন যে প্লেটভর্তি বিরিয়ানি এনে কোলে বসিয়ে জান খাও! জান খাও! বলে গান্ডে পিন্ডে গিলাবো।’
-‘তোর খুব বাড় বেড়েছে শুধু একবার বের হতে পারি।”
-‘ততক্ষণে রুদাশার অস্বস্ত্বিই বদলে দিবো, প্রমিস।’
-‘ফাঁকা চেক দিবো ইচ্ছে মতো এমাউন্ট বসিয়ে নিও শুধু বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দাও।’
-‘সরি ম্যম! আজকে থেকে আপনার বন্দি জীবন শুরু। দিনে একবার এসে খাবার দিয়ে যাবো আমি। চেঁচামেচি হাকডাক করলেও আশেপাশের কেউ শুনতে পারবে না, জনমানবহীন এলাকায় এটা। বাইরের আলো, বাতাস, রোদ, বৃষ্টি আপনার জন্য নিষিদ্ধ। আজ আসি।’
একথা বলে শিহাব গটগট করে বেরিয়ে দরজা আঁটকে চলে গেল। রুদাশা এঁটো হাতে চোখের জল ফেলতে লাগল। রুমে
দৃষ্টি বুলিয়ে তার কান্না আরো বেড়ে গেল। রুমে বিছানা নেই, মাদুর নেই, আর না আছে কোনো আসবাবপত্র। এসব নাহয় বাদ কিন্তু পেটুপুরে খাবারটুকু দিক। পূর্বের রুমের মতো এই রুমটা খুব ছোটো, দয়া করে ওয়াশরুমের ব্যবস্থা করে দিলো এই যা।জানালা তো দূর রুমে কোনো ফুঁটো আছে নাকি তাও চোখে পড়ছে না। এভাবে বাঁচা যায়! এসবকিছুর জন্য রুদ্র দায়ী। রুদ্রকে সে ছাড়বে না, কিছুতেই না। ওর বউয়ের গায়ে হাত দিয়েছে বলে এসব শাস্তি দিচ্ছে তো। আজ অথবা কাল ছাড়া তো সে পাবেই তখন নাহয় হিসাব বরাবর করে নিবে।
________________________________________________
পরশুদিন আসার কথা থাকলেও চারদিন পর রুদ্র বাসায় ফিরলো। চট্টগ্রামের সবকিছু গোছগাছ করে ফিরেছে যাতে আর যেতে নাহয়। এদিকে ভোটের দিন ঘনিয়ে আসছে। যত দিন যাবে ব্যস্ততাও তত বাড়বে। মিছিল, সমাবেশ, প্রচারের কাজে ব্যস্ত থাকবে সর্বক্ষণ। তবেএই চারদিনে বাসায় থেকে অসংখ্যবার কল এলেও কাঙ্ক্ষিত মানুষটার থেকে একটাও কল বা মেসেজ পায় নি। আর না তার কল রিসিভ করেছে।
এখন মাঝরাত! কাউকে বলে আসে নি বিধায় কেউ জেগে নেই। কাফি আর রুদ্র বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। স্পর্শীকে কল করেই যাচ্ছে রিসিভ হচ্ছে না,কুম্ভকর্ণ অলসটা বোধহয় পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে। বাবা-মাকে এত রাতে বিরক্ত করতে চাচ্ছিল না কিন্তু এখন না ডেকে উপায় নেই। ওদিকে অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা দারোয়ান রুদ্রকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে যা বোঝার বুঝে নিলেন। ক্লান্ত শরীর বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা পছন্দ হলো না উনার।তাই না ভেবে ফট করে কল দিয়ে বসলেন মরিয়ম বেগমকে।সন্ধ্যার দিকে মরিয়ম বেগম নুডলস এনে দেওয়ার জন্য কল দিয়েছিলেন, নাম্বারটা সামনে থাকায় সেই নাম্বারে কল দিলেন। প্রথমবারেই রিসিভ করে মরিয়ম বেগম পাশে থাকা গভীর ঘুমে মগ্ন মেয়ের দিকে তাকিয়ে পুরো কথা শুনে কল কেটে দিলেন। তারপর গিয়ে দরজা খুলে তাদের ভেতরে আসতে বলে রান্নাঘরের দিকে যেতেই রুদ্র বলে তারা খেয়ে এসেছে। তারপর কাফিকে গেস্টরুমে যেতে বলে রুদ্রও তার রুমের দিকে পা বাড়াতেই মরিয়ম বেগম পাশ কাটিয়ে যেতে যেতে বললেন,
-‘স্পর্শী রুমে একা আছে। তাকে একা রাখা ঠিক হবে না। একটুপর পর পেট ব্যথায় কুঁকড়ে যাচ্ছে মেয়েটা।’
একথা বলে উনি উনার রুমের দিকে চলে গেলেন। আর রুদ্র দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল নিজের রুমের দিকে। হাতের ব্যাগটা রেখে পোশাক নিয়ে চলে গেল ওয়াশরুমে। জলদি ফ্রেশ হয়ে
বালিশ ঠিকঠাক করে গেল স্পর্শীর রুমে। গুঁটিশুঁটি হয়ে শুয়ে মেয়েটা। মুখে ব্যথার ছাপ। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে এগিয়ে
গিয়ে আস্তে করে কোলে তুলে নিলো স্পর্শীকে। কপালে গাঢ় চুমু এঁকে ফিরে এলো নিজের রুমে। খুব সাবধানে স্পর্শীকে শুঁইয়ে দিয়ে দরজা আঁটকে ফাস্ট এইডের বক্স নিয়ে বসলো বিছানায়। হাত আর কপালের ব্যান্ডেজ খুলে সন্তপর্ণে ড্রেসিং করে পুনরায় ব্যান্ডেজ করে দিলো। তারপর ড্রিম লাইট অন করে বুকে টেনে নিলো অতি প্রিয় মানুষটাকে। চারদিন পর,
স্পর্শীকে দেখতে পেয়ে, ছুঁতে পেরে, অবাধ্য মনটা এতক্ষণে শান্ত হয়েছে। স্পর্শী আদুরে বিড়ালছানার মতো লেপ্টে গেছে বুকের সাথে। তখন রুদ্র হাতের বাঁধন আর একটু শক্ত করে
চোখজোড়া বন্ধ করে বলল,
-‘অনেক রাত হয়েছে এখন অভিনয় ছেড়ে ঘুমিয়ে পড়ুন।’
একথা শুনে চোখ বন্ধ অবস্থায় জিহ্বাতে কামড় দিলো। এত নিঁখুত অভিনয় করেও ধরা পড়ে গেল, ইশ! কি লজ্জা, কি লজ্জা!
To be continue…..!!