Monday, October 6, 2025







মন বিনিময় পর্ব-৪২

#মন_বিনিময়
#পর্বঃ৪২
#লেখনীতে- তাসফিয়া হাসান তুরফা

রাহিতা রুমে ঢুকতেই বিছানায় শয়নরত স্বপ্নিলের দিকে চোখ গেলো সবার আগে। ডানহাত কপালের উপর আর বাম হাত বুকের উপর রেখে সে শুয়ে আছে শান্তভাবে। সেদিক চেয়েই রাহিতা হেটে গেলো বিছানার নিকট, আস্তে করে স্বপ্নিলের হাত সরিয়ে দিলো কপালের উপর থেকে। কিন্তু স্বপ্নিল চোখ খুললোনা, রাহিতা বুঝলো জার্নির ধকলে ও সারাদিনের ক্লান্তিতে খেয়েদেয়ে বিছানায় শুতেই রাজ্যের ঘুম পেয়ে বসেছে জনাবকে। এখন যে হাজারবার ডাকলেও সে উঠবেনা ঘণ্টা কয়েকের আগে, এটা রাহিতা ভালোভাবেই জানে। তাই স্বপ্নিলকে না ডেকে আলতোভাবে ওর কপালে হাতের উল্টোপিঠ ছুয়ে তাপমাত্রা পরখ করে সে। কপালটা এখনো গরম, ছেলেটা ওষুধ খেয়েছে কিনা কে জানে? সে তো ওষুধ খাওয়ার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতেই এসেছিলো কিন্তু এখন স্বপ্নিলকে জাগিয়ে তুলতে সায় দিচ্ছেনা মন৷ কিছুক্ষণ ভাবা শেষে রাহিতা হাল ছেড়ে দেয়। স্বপ্নিলের এখন একটা ভালো ঘুমের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, তাই এসির উপযুক্ত টেম্পারেচার সেট করে ওর গায়ে কাথা টেনে দিয়ে রুম ছেড়ে বের হয় রাহিতা।

এরই মাঝে ওর মায়ের ফোন আসে। হাসিমুখে ফোন ধরে মায়ের সাথে কথা বলতে বলতেই নিচে নেমে যায় রাহিতা। কথাবার্তা শেষে সামিরার রুমে উকি দিয়ে দেখে সেও স্বপ্নিলের মতো কাথা মুড়ি দিয়ে উপর হয়ে ঘুমোচ্ছে। এরা ভাই-বোন দুটো একিরকম!
মনে মনে মুচকি হেসে ভাবে রাহিতা। অতঃপর রান্নাঘরে এসে রহিমা খালাকে চায়ের পানি বসাতে বলে। মূলত বিকেলের এ সময়টা কড়া লিকারের আদা মিশানো রং চা খেতে পছন্দ করে তার শাশুড়ি এটা রাহিতা জানে। খানিকবাদে চা বানানো শেষ করে কাপ হাতে নিয়ে সে চলে যায় দিলারা বেগমের নিকট। কি এমন কথা তিনি বলতে চাইছিলেন, জানার জন্য রাহিতার তর সয়না আর!

দিলারা বেগম নামাজ পড়ে উঠেছেন মাত্র। এমন সময় রাহিতাকে চায়ের কাপ হাতে রুমে প্রবেশ করতে দেখে সৌজন্যমূলক হাসলেন তিনি। কাপ নিতে নিতেই বললেন,

—স্বপ্নিল ওষুধ খেয়েছে?

—উনি ঘুমাচ্ছেন, মা। আমি রুমে ঢুকেই দেখি গভীর ঘুমে মত্ত তাই আর ডাকিনি পরে।

চায়ে ফু দিতে দিতে একবার চুমুক দিয়ে দিলারা বেগম মাথা নাড়িয়ে বললেন,

—এই ছেলেটাও না! এরকমই করবে। নির্ঘাত রাতে জ্বর আসবে ওর দেখিস। ছেলে-মেয়ে দুটোই হয়েছে একরকম, কথা বুঝবেনা আমার। শুধু পাকনামি!

রাহিতা হেসে ফেলে উনার কথা শুনে। ওর হাসি দেখে মৃদু হাসলেন দিলারা বেগম নিজেও। তিনি নিরবে চা খাওয়ার মাঝেই প্রসঙ্গ তুলতে রাহিতা সুযোগ বুঝে বলে,

—তারপর বলুন, মা। তখন কি যেন বলতে চাইছিলেন আমায়। রুমে আসতে বল্লেন যে কারণে?

রাহিতার প্রশ্নে এক মুহুর্তের জন্য থমকালেও ধীরেসুস্থে চা শেষ করেন দিলারা বেগম। রাহিতা ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে। কাপ টেবিলে রেখে রাহিতার কৌতুহলী চেহারার দিকে দৃষ্টি রেখে বললেন,

—স্বপ্নিল আর তোর মধ্যে সব ঠিক হয়েছে, রাহি?

হঠাৎ এমন প্রশ্নে রাহিতা চমকায়। সত্যি বলতে সে ভাবেনি দিলারা বেগম এমন কিছু জিজ্ঞেস করবেন। নিজের বিস্মিত ভাব না ঢেকেই সে হালকা অবাক হওয়া গলায় প্রশ্ন করে,

—হঠাৎ এ প্রশ্ন করছেন যে, মা? আমাদের মধ্যে আবার কি হবে?

—না মানে বলছিলাম, স্বপ্নিল তো তোকে মন থেকে মেনে নিয়েছে তাই না?

রাহিতা এবার চমকালেও খেই হারায়না। নিজেকে যথেষ্ট স্বাভাবিক রেখে উত্তর দেয়,

—হ্যাঁ। কিন্তু মা, এটা তো আপনি জানেনই। আপনাকে বলেছিলাম না আমি?

দিলারা বেগম প্রত্যুত্তরে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন,

—আমি জানি সবটাই। কিন্তু আমার জিজ্ঞেস করার পেছনে একটা কারণ আছে। তোর কাছে লুকিয়ে তো লাভ নেই। তাই যা বলছি মনোযোগ দিয়ে শুনবি ও উত্তর দিবি। কেমন?

—ঠিক আছে।

—স্বপ্নিলের চলে যাওয়ার পর থেকে আমি খেয়াল করছি তোরা একে-অপরের সাথে আগেকার মতো কথা বলিস না। এমনকি ফিরে আসার পরেও তোদের দুজনের মধ্যে আগেকার সেই টান আমি খেয়াল করিনি। যেন একপ্রকার এড়িয়ে চলছিস তোরা দুজন একজন আরেকজনকে৷ এমনটাই মনে হয়েছে আমার কাছে। কিন্তু কারণটা কোনোভাবেই ধরতে পারলাম না! স্বপ্নিলের চেয়ে বেশি আমি তোর কাছে আশাবাদী এ সম্পর্ক নিয়ে তাই তোকেই ডেকে জিজ্ঞেস করছি। তোদের দুজনের মধ্যে আবার কোনো বড়সড় ঝামেলা হয়নি তো, রাহি? বিষয়টা নিয়ে আমি বেশ অনেকদিন থেকেই দুশ্চিন্তায় ভুগছি। কিচ্ছু লুকোস না এখন আমার থেকে। সব সত্যি করে বল তো আমায়!

এক শ্বাসে এতকিছু জিজ্ঞেস করে থেমে যান দিলারা বেগম। এদিকে শাশুড়ির মুখে এসব শুনে আকাশ থেকে পড়ে রাহিতা! মানুষ তিল কে তাল বানায় সে এতদিন শুনে এসেছিলো, এদিকে দিলারা বেগম নিজেও যে সেটা করে বসে আছেন। আজ সচক্ষে দেখেও নিলো! কিন্তু কিভাবে শাশুড়ির ভুল ধারণা ভাংবে রাহিতা ভেবে পেলোনা। যতই তিনি বলুক সবকিছু তাকে খুলে বলতে, তাই বলে আর স্বামী-স্ত্রীর ভেতরের সব কথা অন্য কাউকে তো বলা যায়না তাইনা! এ তো ভারী চিন্তার বিষয়!

স্তব্ধ রাহিতা নিজ ভাবনায় বিভোর থাকার মাঝেই দিলারা বেগম ওর হাত আকড়ে ধরেন। রাহিতার চিন্তাভরা চোখের দিক চেয়ে করুণ চোখে কম্পিত কণ্ঠে বললেন,

—কখনো ভাবিনি তোকে এ কথাটা বলবো। কিন্তু তুই যখন এতই দ্বিধা করছিস আমাকে বলতে তখন তোকে আশ্বাস দিতে এটুকু বলতে বাধ্য হচ্ছি আজ!

—ম,মানে?

রাহিতার গলা কাপে। শাশুড়ির চেহারার কাঠিন্য ও কণ্ঠের দৃঢ়তা দেখে তার বুক কাপে। এমন সময় দিলারা বেগম পুনরায় বলেন,

—তোর মনে আছে, রাহি? যখন তুই প্রথমবার আমার কাছে বিচার দিতে আসিস যে কেন আমি তোকে সবকিছু না বলেই তোর সাথে স্বপ্নিলের বিয়ে দিয়েছি? কেন তোকে অন্ধকারে রেখেছি, তোর সাথে অন্যায় করেছি। তখন আমি তোকে একটা কথা বলেছিলাম। একটা ওয়াদা করেছিলাম তোর কাছে?

পুরনো দিনগুলো স্মৃতি চারণ করে ঘোলা চোখে রাহিতা আস্তে-ধীরে মাথা নাড়তেই দিলারা বেগম বড়সড় এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন,

—আমি বলেছিলাম তোর যদি ভবিষ্যতে কখনো মনে হয় স্বপ্নিল তোকে স্ত্রী হিসেবে সম্পূর্ণ অধিকার দিচ্ছেনা বা তোর প্রতি অবহেলা করছে, তোকে ভালোবাসতে পারছেনা তবে তুই চাইলে আমি স্বেচ্ছায় তোদের দুজনকে আলাদা করে দিবো। বেশ ক’দিন ধরে তোদের মধ্যে যা দেখছি তাতে আমি প্রশ্ন করতে বাধ্য হচ্ছি, এখন কি সে সময় এসে গেছে?

—মা..!

রাহিতা স্তব্ধ বনে যায়! দিলারা বেগম যে হঠাৎ করে ওকে ডেকে এনে এমন কথা বলবে সে স্বপ্নেও ভাবেনি মোটেও! স্বপ্নিল যে এখন ওকে পাগলের মতো ভালোবাসে, রাহিতা জানে। স্বপ্নিল মুখে না বললেও ও অনুভব করতে পারে। এমতাবস্থায় শাশুড়ির মুখে আলাদা হওয়ার কথা শুনে রাহিতার মাথা ঘুরায়। তবু চোখমুখ শক্ত করে নিজেকে সামলায়। গলার স্বর যথেষ্ট স্বাভাবিক রাখার চেস্টা করে বলে,

—আমি উনাকে ছাড়তে চাইনা, মা। যদি ছাড়ার হতো তবে তখনি ছেড়ে যেতাম যখন তিনি আমায় মেনে নেননি। এখন হঠাৎ করে এটার প্রশ্ন কিভাবে উঠলো? আমি বিশ্বাস করতে পারছিনা আপনি এ কথা বলছেন। যে আপনি আমাদের দুজনকে এক করেছেন তিনি এ কথা বলছেন! এটা আমি কোনোভাবেই মানতে পারছিনা, মা!

রাহিতার কথায় দিলারা বেগম মাথা নোয়ান। বুকের ভেতর হাহাকার করে উঠে তার। তার মনে হলো রাহিতা মেয়েটা একটু বেশিই ভালো, স্বপ্নিলকে মন থেকে ভালোবাসে৷ তাই তো ওর পক্ষ থেকে এত অবহেলা পেয়েও ওর সাথেই থাকতে চাইছেন! দিলারা বেগমের বিশ্বাস ছিলো তার স্বপ্নিলের পাগলাটে ভালোবাসা দিয়ে রাহিতার শুরুর দিকের আক্ষেপ মিটে যাবে। স্বপ্নিল রাহিতা সেভাবেই ভালোবাসবে, ওর জন্য ততটাই পাগল হবে যতটা আনিকার জন্য ছিলো। কিন্তু এখন তার মনে হচ্ছে তার ধারণা হয়তো ভুল ছিলো। তার ছেলে রাহিতার যোগ্য-ই নয়। কেননা সে পারেনি রাহিতাকে ভালোবাসতে, যেভাবে রাহিতা ওকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসে।
রাহিতার দিক তাকিয়ে মনে মনে অনেকক্ষণ চিন্তাভাবনা করেন দিলারা বেগম।

এভাবেই তিনি রাহিতার সাথে দুজনের বৈবাহিক জীবনের আরও কিছু খুটিনাটি বিষয়ে বেশ কিছুক্ষণ ধরে আলোচনা করেন, রাহিতার সকল কথা বেশ মনোযোগ দিয়ে শুনেন। দুজনের দুপাক্ষিক কথার সাক্ষী হয় নিশ্চুপ কক্ষের বাকহীন দেয়াল।
অতঃপর রাহিতার অগোচরেই মনে মনে এক ফন্দি আঁটেন দিলারা বেগম।

#চলবে

#মন_বিনিময়
#পর্বঃ৪২ (বর্ধিতাংশ)
#লেখনীতে- তাসফিয়া হাসান তুরফা

দিলারা বেগমের সাথে কথাবার্তা শেষ করে রাহিতা যখন বের হলো তখন সন্ধ্যা ৭টা। রুমে ঢুকে দেখে স্বপ্নিল তখনো ঘুমিয়ে, সেই যে ৫টার দিকে ঘুমিয়েছিলো এতক্ষণেও ঘুম ভাঙেনি তার। এদিকে রাহিতার মনে বইছে উথাল-পাতাল ঝড়। সে তো বেশ বড় মুখ করে শাশুড়িকে বলে এলো স্বপ্নিল ওকে ভালোবাসে, কিন্তু আদৌ এ কথাটা স্বপ্নিলের মুখ থেকে শুনতে পাবে তো? ছেলেটা দুনিয়ার সব কথা বলে ওর সাথে শুধু ভালোবাসি বলেনা কখনো। রাহিতার মনে অভিমান জাগে, অজানা কস্টে দু’চোখ ভরে যায়। আর কতদিন এভাবে চলবে? সব যেন ঠিক হয়েও ঠিক নেই ওদের মধ্যে। কিছু একটার অনুপস্থিতি স্পষ্ট ভাসে দুজনের সম্পর্কে। মনের দুঃখে মত্ত রাহিতা আজানের ধ্বনি শুনে ওযু করে এসে জায়নামাজ বিছিয়ে লুটিয়ে পড়ে সিজদায়। মহান আল্লাহর কাছে নিজের কস্টের ফরিয়াদ শেষে বারান্দায় চলে যায়। সন্ধ্যা শেষের শান্ত পরিবেশ ওর অশান্ত মনকে শান্ত করতে কিছুটা সক্ষম হলো। সেখানেই চেয়ার পেতে রেলিং এ রাখা হাতের উপর মাথা ঠেকিয়ে একদৃষ্টিতে আকাশ দেখতে মগ্ন হলো রাহিতা।

এভাবেই কেটে গেলো বেশ অনেকক্ষণ। সময়ের হুশ ফিরতেই রাহিতা রুমে প্রবেশ করে। ঘড়ির দিক তাকাতেই খেয়াল হয় সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হয়ে গেছে। একিসাথে খেয়াল করে স্বপ্নিল উঠে গেছে। ওকে দেখে মনে হচ্ছে যেন কিছুক্ষণ আগেই উঠেছে। সেভাবেই বিছানা ছেড়ে দরজার দিক হেটে যাচ্ছে। স্বপ্নিলকে রুমের বাহিরে যেতে দেখে রাহিতা প্রশ্ন করে,

—কোথায় যাচ্ছেন?

রাহিতার কথায় স্বপ্নিল থেমে যায়। ঘাড় বাকিয়ে বারান্দার দিকে তাকাতেই রাহিতার অবয়ব নজর কাড়ে ওর। মুহুর্তেই রাহিতার নিকট চলে আসে স্বপ্নিল। ওকে দেখে বলে,

—তোমাকেই খুজতে যাচ্ছিলাম। অনেকক্ষণ আগে উঠেছি, তুমি এতক্ষণ রুমে আসছিলেনা তাই দেখতে যাচ্ছিলাম কোথায় আছো।

স্বপ্নিলের কথায় মনে মনে হাসে রাহিতা। ওকে কিছুক্ষণ রুমে পায়নি বলে এ অসুস্থ শরীরে খুজতে যাচ্ছিলো, অথচ সেই ব্যক্তি কখনো মুখে স্বীকার করেনা ওকে ভালোবাসে! রাহিতার ভাবনার মাঝেই স্বপ্নিল ওর হাত ধরে বলে,

—এ রাতের বেলা একা একা বারান্দায় কি করছিলে, রাহি?

—এমনিই আকাশ দেখছিলাম। কিন্তু আপনার হাত এত গরম কেন? জ্বর কি বেড়েছে? দেখি মাথাটা!

কথা বলতে বলতেই স্বপ্নিলের কপালে হাত রেখে আঁতকে উঠে সে। ভীষণ জ্বর স্বপ্নিলের। সদ্য ঘুম থেকে উঠা ফুলো ফুলো চোখ দুটোর লালচে ভাব কমেনি এখনো। সেভাবেই স্বপ্নিলের হাত ধরে বিছানার দিকে এগিয়ে আনে রাহিতা। ওকে বসিয়ে দিয়ে কড়া গলায় বলে,

—তখন ভাত খাওয়ার পর জ্বরের ওষুধ খাননি আপনি তাই না?

জ্বরের মাঝেও স্বপ্নিলের গা-ছাড়া ভাব কমেনা। সে বেশ সহজভাবেই মাথা নাড়িয়ে স্বীকার করে ওষুধ খায়নি। রাহিতা হতাশ হয়। এখন তো খালি পেটে ওষুধ খাওয়ানোও যাবেনা, তাই স্বপ্নিলকে জিজ্ঞেস করে কি খেতে চাইছে সে। কিন্তু খাটে হেলান দিয়ে আধশোয়া স্বপ্নিল চোখ বন্ধ করে জবাব দেয়,

—সামান্য জ্বর এসেছে, রাহি। আমার এরকম জ্বরের অভ্যাস আছে৷ এতে এত টেনশন নেওয়ার কিছু নেই। কাল সকালে ঠিক হয়ে যাবে!

—সামান্য জ্বর, তাই না? হাত-কপাল পুড়ে যাচ্ছে আপনার। এক কাজ করি, থার্মোমিটার নিয়ে আসি? মেপে দেখি আগে কেমন জ্বর। তারপর ওষুধ খাবেন তো নাকি?

—কোনো প্রয়োজন নেই। বলছি তো এসবের দরকার নেই।

স্বপ্নিলের ত্যাড়া কথায় রাহিতার বেশ রাগ হয়। সে রেগে কিছু বলবে এর মাঝে রুমে প্রবেশ করেন দিলারা বেগম। দুজনকে এভাবে বসে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করেন কি হয়েছে। তাকে দেখে রাহিতা হতাশ সুরে বলে উঠে,

—আপনি ঠিকি বলেছিলেন, মা। আপনার ছেলে ওষুধ খায়নি। এখন জ্বর বেড়ে গেছে। মাপতেও দিচ্ছেন না জ্বর কত আবার বলছে ওষুধ নাকি খাবেন না। তার এমন জ্বরের অভ্যাস আছে। অথচ শরীর পু’ড়ে যাচ্ছে জ্বরে।

স্বপ্নিলের প্রতি রাহিতার চিন্তা দেখে দিলারা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। ছেলের দিকে তাকিয়ে কড়া কণ্ঠে বলেন,

—তোর সমস্যা কি স্বপ্নিল? তখনো ওষুধ খাসনি, এখনো খেতে চাইছিস না। এ বয়সে এসে বউয়ের সামনে মা’ইর খেতে চাস নাকি?

—উফ, মা। ভালো লাগছেনা। এখন কথা বলোনা তো প্লিজ। মাথা প্রচন্ড ব্যাথা৷

স্বপ্নিলের কণ্ঠে ক্লান্তি মিশানো, মাথার উপর হাত। তা দেখে দিলারা বেগম বলেন,

—আমি নরম করে ভাত বসাচ্ছি তোর জন্য। পাতলা ঝো’ল দিয়ে খাইয়ে দিবো একটু পর। না খেতে চেয়েও লাভ নেই। আমি তোর বউয়ের মতো নরম নই। একদম পিটিয়ে সোজা করে দিবো বলে দিচ্ছি।

একনাগাড়ে কথাগুলো শেষ করে রুম ছাড়লেন দিলারা বেগম। স্বপ্নিল সেদিকে করুণ চোখে তাকিয়ে থাকলে রাহিতা হেসে বলে,

—ঠিক হয়েছে। আমি কিছু বলিনা দেখে আমার সাথে যা ইচ্ছা তাই করেন। এবার মা-কে মানা করে দেখান দেখি কিভাবে পারেন!

কথাটা বলে রাহিতা উঠে যেতে নিলেই স্বপ্নিল ওর ওড়নার কিনারা টেনে ধরে বা-হাত দিয়ে। রাহিতা পিছু ফিরতেই ব্যাকুল কণ্ঠে শুধায়,

—তুমি আবার কোথায় যাচ্ছো? থাকো না আমার সাথে! ভালো লাগছেনা আমার!

স্বপ্নিলের কথায় রাহিতার হাসির প্রস্থ চওড়া হয়। ওর হাত থেকে ওড়না ছাড়িয়ে নিতে নিতে বলে,

—থার্মোমিটার আনতে যাচ্ছি। মাপতে হবে তো জ্বর কত! আমি আবার কই যাবো? বসুন চুপচাপ, আসছি।

রাহিতার জবাবে স্বপ্নিল শান্ত হয়। যথারীতি দিলারা বেগম জোর করে ওকে খাইয়ে দিয়ে যাওয়ার পরে রাহিতার ওষুধ খাইয়ে দেয়। কিন্তু ততক্ষণে ১০৩° এর মতো জ্বর এসে গেছে স্বপ্নিলের, সে শুয়ে আছে নিশ্চলভাবে। চিন্তিত রাহিতা কিছুক্ষণ পর ঠিক করলো স্বপ্নিলের মাথায় জলপট্টি দিয়ে দিবে। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। রাহিতা উঠে গেলো। বাথরুম থেকে মগ ভরে ঠান্ডা পানি এনে তাতে রুমাল ভিজিয়ে পট্টি দিতে থাকলো স্বপ্নিলের মাথায়। খাওয়ার আগে তে’জ দেখালেও জ্বরের প্রকোপে এখন নিস্তেজ স্বপ্নিল। চোখমুখ লালচে তার, তবু জ্বরের মাঝেই শক্ত করে ধরে আছে রাহিতার এক হাত। সে হাত সরিয়ে নিতে গেলেই দূর্বল কণ্ঠে স্বপ্নিল বলে উঠে,

—প্লিজ হাত ছেড়োনা, রাহি।

স্বপ্নিলের এমন আকুতি শুনে রাহিতার বুকে ধ্বক করে উঠলো। শক্ত করে ওর হাত ধরে রেখেই গায়ের উপর কাথাটা ভালোভাবে টেনে ওকে মুড়িয়ে দিলো। কিছুক্ষণ সেভাবেই জলপট্টি দেওয়ার মাঝে স্বপ্নিলের তাপমাত্রা কিছুটা কমে এলেও ওর মাথাব্যথা থামার কোনো নাম নেই। আস্তে করে ওর হাত ছাড়িয়ে মগ ও রুমাল সরিয়ে সাইড টেবিলে রেখে এক দীর্ঘশ্বাস ফেললো রাহিতা৷ তবে সন্ধ্যায় ঘুমোনোর কারণে স্বপ্নিলের ঘুম ধরছেনা, মাথাব্যথার দরুণ চোখমুখ কুচকে রেখেছে বাজেভাবে। তবু রাহিতাকে কিছু বলছেনা। কিছুক্ষণ বিরতির পর স্বপ্নিলকে লক্ষ্য করে রাহিতা মৃদু স্বরে ওর মাথায় হাত রেখে বললো,

—মাথা বেশি ব্যাথা করছে? টিপে দেবো?

স্বপ্নিল হ্যাঁ বা না কিছুই বললোনা। চোখ মেলে একপলক রাহিতার দিকে তাকালো শুধু। ব্যস! তাতেই যেন সবটা বুঝে নিলো সে। চুপচাপ স্বপ্নিলের চুলে বিলি কেটে মাথায় হাত বুলিয়ে আস্তে আস্তে টি’পে দিতে লাগলো রাহিতা। আরামে পুনরায় চোখ বুজে ফেললো স্বপ্নিল। কিছুক্ষণ সেভাবেই চলার মাঝে স্বপ্নিল যেন ঘুমিয়ে গেলো। তাপমাত্রাও বেশ অনেকটা কম এখন। তা দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে আস্তে করে উঠে গেলো রাহিতা। অতঃপর সময় নিয়ে এশার নামাজ পড়ে স্বপ্নিলের পাশে বিছানায় বসলো। দোয়া শেষে ওর কপালে হাত রেখে ফু দিতেই স্বপ্নিল জেগে উঠলো। চোখ মেলে শিয়রে বসা মাথায় ওড়না প্যাচানো রাহিতাকে দেখে মুচকি হাসলো সে, বিনিময়ে রাহিতাও হাসলো। এতক্ষণে অল্প অল্প ঘামতে শুরু করেছে স্বপ্নিল, জ্বর ছেড়ে এসেছে প্রায়। তাই ধীরেসুস্থে শোয়া থেকে উঠে বসলো সে। আলগোছে রাহিতার হাত নিজের দু’হাতের মুঠোয় নিয়ে সময় নিয়ে চুমু খেলো। রাহিতা কিছু বললোনা, কোনো প্রতিক্রিয়াও দেখালোনা। নীরবে স্বপ্নিলের কান্ড দেখে গেলো শুধু। চুমু শেষে রাহিতার হাত নিজের বুকের সাথে ঠেকিয়ে স্বপ্নিল হঠাৎ বললো,

—আমায় এত ভালোবাসো কেন, রাহি?

এবার স্বপ্নিলের মুখে ভালোবাসার কথা বলে রাহিতা চমকায়। তবু মুখে কিছু বলেনা দেখে স্বপ্নিল বলে,

—এতটাই যখন ভালোবাসো তবে কখনো মুখে বলোনি কেন?

—আপনি ভালোবাসেন আমায়?

স্বপ্নিলের প্রশ্নের জবাবে রাহিতা পালটা প্রশ্ন করলো। ওর প্রশ্নে স্বপ্নিল শান্ত চোখে তাকালো। মাথা নিচু করে হালকা হাসলো। রাহিতার চোখে চোখ রেখে বললো,

—তুমি কি বুঝোনা?

—সবসময় শুধু বুঝলেই হয়না, স্বপ্নিল। সামনের মানুষটাকে মাঝেমধ্যে মুখে বলেও বুঝাতে হয়। নয়তো অনেক সময় শুধু বুঝার মতো ধৈর্য থাকেনা!

মাথা নিচু করে জবাব দিলো রাহিতা। ওর কথায় স্বপ্নিল ভ্রু কুচকায়। রাহিতার মুখে স্পষ্ট বিষাদের চিহ্ন। যেন কোনোকিছু নিয় ভীষণ দ্বিধায় আছে। ও কি বলছে বুঝতে না পেরে স্বপ্নিল প্রশ্ন করে,

—মানে? কিছু হয়েছে কি? এভাবে কথা বলছো কেন?

—কিছু হয়নি। আপনার শরীর ভালোনা। শুয়ে পড়ুন। ঘুমানোর চেস্টা করুন, রাত অনেক হয়ে গেছে। আজ রাত জাগাটা উচিত হবেনা।

—কিন্তু রাহি…

—আমিও অনেক ক্লান্ত, স্বপ্নিল… সবকিছু থেকেই। আমায় একটু রেস্ট নিতে দিন!

এবার স্বপ্নিল আর কথা বলেনা। মেয়েটা এমনিতেই অনেকক্ষণ সেবাযত্ন করেছে ওর। রাহিতার বিশ্রাম প্রয়োজন! আর কথা না বাড়িয়ে স্বপ্নিল হাত ছেড়ে দেয় রাহিতার। লাইট অফ করে ড্রিমলাইট জ্বা’লিয়ে রাহিতা পাশ ফিরে শুয়ে পড়ে। ওকে দেখতে দেখতে শুয়ে পড়ে স্বপ্নিল নিজেও। সেভাবেই রাত কেটে যায় দুজনের নিভৃতে!

___________________

পরেরদিন বেশ বেলা করে ঘুম ভাঙে স্বপ্নিলের। জ্বরের কারণেই হোক বা এ ক’দিনের জেটল্যাগ, সব মিলিয়ে ১১টা বাজে ওর উঠতে উঠতে। জ্বর সেড়ে শরীর ভালো লাগছে এখন। আড়মোড়া ভেঙে ফ্রেশ হয়ে নিচে নেমে যায় সে। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে দিয়ে পুরোবাড়িতে কোথাও রাহিতাকে খুজে পায়না সে। স্বপ্নিল অবাক হয়। শেষমেশ দিলারা বেগমের কাছে যেতেই ওকে জবাব না দিয়ে সরাসরি নাস্তার টেবিলে নিয়ে আসেন উনি। মায়ের চাপে চুপচাপ খেতে বসে স্বপ্নিল। ব্রেডে জ্যাম লাগিয়ে মুখ দিতে দিতেই জিজ্ঞেস করে,

—রাহিতাকে কই, মা? জানো তুমি? সকাল থেকে ওকে দেখছিনা!

ছেলের প্রশ্ন ও উদ্বিগ্নতা কিছুক্ষণ আড়চোখে লক্ষ্য করেন দিলারা বেগম। অতঃপর ধীরেসুস্থে গম্ভীর মুখে বলেন,

—রাহিতা চলে গেছে।

মায়ের কথায় মাত্র খাবার গি’লতে নেওয়া স্বপ্নিলের গলবিলে খাবার আটকে যায়। ওকে কাশতে দেখে উঠে গিয়ে ছেলের পিঠ চাপড়ে দিয়ে পানি এগিয়ে দেন দিলারা বেগম। কোনোমতে নিজেকে সামলে নেয় স্বপ্নিল। তবু মায়ের কথায় প্রশ্নের দল মাথায় ভীড় জমায়। হৃদপিণ্ড কেঁপে ওঠে ওর। রাহিতা চলে গেছে মানে?

#চলবে

পূর্ববর্তী নিবন্ধ
পরবর্তী নিবন্ধ
গল্প পোকা
গল্প পোকাhttps://golpopoka.com
গল্পপোকা ডট কম -এ আপনাকে স্বাগতম......
RELATED ARTICLES

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments

Md masrur Hasan mahi على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
আমিনুল ইসলাম على প্রয়োজন পর্ব: ৩০ ( অন্তিম)
সাজিবুল ইসলাম على ধর্ষিতাবউ২ ৯ তথা শেষ পর্ব
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
Nita Sarkar على স্বপ্নীল ৬৮
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على রহস্য শেষ_পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على অলক্ষ্যে তুমি পর্ব-০৬ এবং শেষ পর্ব
Nazmun Nahar Akhi على Psycho_is_back? part_7
Nazmun Nahar Akhi على Dangerous_Villian_Lover part 2
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على জানালার ওপারে পর্ব-১৭ এবং শেষ পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على লীলা বোর্ডিং ১২১৫ পর্ব-১১ এবং শেষ পর্ব
মিজানুর রহমান রাহুল على সেই তুমি পর্ব-০১
@feelings على প্রহেলিকা
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Nusrat jahan على coffee & vanilla Part-10
Pallabi Roy على স্বপ্নীল ৬৮
M.D Mahabub على The_Villain_Lover Part_2
Labani sarkar على Dangerous_Villain_Lover part 23
MD Akas Apc على বিবেক
Tanisha Ahmed على Devil love part-18 
Aius Barmon shorob على নারীর দেহকে নয়
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Priya Banerjee على devil love married life last part
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Riya Biswas على তুমি রবে ৫২
Mohammad Adib على তুমি রবে ৬০
Avni Ayesha على তুমি রবে ২৮
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
সুমিত على তুমি রবে ২৮
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
Samiah Begum على তুমি রবে ৫১
biddut das rocky على নর নারী
গল্প পোকা على নষ্ট গলি শেষ পর্ব
Md Jobayer Hossain Shohag على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على দুই অলসের সংসার
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤৪২.
A.J.S Rakib على মন ফড়িং ❤৪২.
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
Samiya noor على গল্পঃ ভয়
Sadikul على গল্পঃ ভয়
Samia Islam على গল্পঃ ভয়
শূন্য মায়া على মন ফড়িং ❤ ৪০.
Sutapa biswas على মন ফড়িং ❤৩৯.
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৮.
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৭
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
Siyam على বিবেক
Sudipto Guchhait على My_Mafia_Boss পর্ব-৯
saptami karmakar على devil love married life last part
saptami karmakar على devil love married life last part
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ২৬.
Shreyashi Dutta على  বিয়ে part 1
Sandipan Biswas على  বিয়ে part 1
Paramita Bhattacharyya على অনুরাগ শেষ পর্ব
জামিয়া পারভীন তানি على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
মায়া على মন ফড়িং  ২২
সুরিয়া মিম على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على মন ফড়িং ২১
গল্প পোকা على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
Sahin ssb على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৮. 
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৭.
Jannatul Ferdous على খেলাঘর পর্ব-৩৫
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ফাল্গুনের_ফুল last_part_8
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ছাত্রী যখন বউ পাঠঃ ১
গল্প পোকা على বাজির প্রেম পাঠঃ ১
Foujia Khanom Parsha على মা… ?
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৮
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
Ibna Al Wadud Shovon على স্বার্থ