Monday, October 6, 2025







শক্তিময়ী পর্ব-২৪+২৫

#শক্তিময়ী
পর্ব ২৪
বড় গল্প
নাহিদ ফারজানা সোমা

“মা,প্লিজ,আমাকে বিয়ের কথা বোলো না।আমি বিয়ে করবো না মা।”

“এটা সম্পূর্ণ তোর ইচ্ছার উপরে নির্ভর করে। ইচ্ছা না হলে বিয়ে করবি না। তবে অভি তোকে মনে প্রাণে ভালোবাসে। আমরা যতভাবে সম্ভব, খোঁজ নিয়ে দেখেছি।ছেলেটা খুব ভালো। ফ্যামিলিও ভালো।”

“সবাই ভালো মা,সবাই ভালো। কিন্তু বিয়ে শাদি এসবে আমার এতোটুকু আগ্রহ নেই। কি হয় সংসার না করলে? আমি আমার স্বপ্নগুলো পূরণ করতে চাই মা। ”

“এমনও হতে পারে, অভি তোর স্বপ্ন পূরণ করতে সহযোদ্ধা হয়ে পাশে দাঁড়াবে। ”

“আমার স্বপ্নপূরণে আমি আব্বু,দাদা,দাদু, ভাইয়া,পরী,ভাবী, ভাবীর মা,চাচু,ফুপিদের আর সবচেয়ে বড় কথা, তোমার দোয়া চাই। বিয়ে করলে একটা পিছুটান, দায় দায়িত্ব থাকে।সেটাকে অবহেলা করা ঠিক নয়। কিন্তু আমি যে কাজের স্বপ্ন দেখছি, সেই কাজ করতে গেলে আমাকে শতভাগ পিছুটানমুক্ত হতে হবে। আর মা, বিয়ের পরে খোঁটা আমাকে খেতে হবেই। তুমি নিজেও সেটা বুঝতে পারছো। অভির বাবা-মা,ভাই-বোন,আত্মীয় স্বজন এবং অভিও কোনো না কোনো ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কথা আমাকে শোনাবেই। ছেলের চাপাচাপিতে বাবা-মা মেনে নিলেও মন থেকে কখনো আমাকে কাছে টানতে পারবেন না। এতে তাঁদের দোষ ও দেওয়া যায় না।”

ফুপু তীক্ষ্ণ গলায় বললেন,” তুই অভির সাথে দেশের বাইরে সেটল করবি।”

“আমার দেশ ছেড়ে আমি কোথাও যাবোনা,দাদুমনি। বাংলাদেশে হাজার হাজার বাচ্চাকে পেটের মধ্যে জ্যান্ত মেরে ফেলা হচ্ছে। জীবিত অবস্থায় জন্ম নিলে তাকে মেরে লাশ এদিকে ওদিকে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। কিংবা জীবন্ত বাচ্চাকে ডাষ্টবিনে ফেলে দিচ্ছে। দেখার কেউ নেই। ম্যাটার্নিটি ক্লিনিকগুলোতে এগুলো চলে, আবার নার্স নাম নিয়ে অসংখ্য মহিলা তাদের বাসাবাড়ির একটা ঘরে এইসব কাজ চালায়। আমি বুঝি না,এতো বড় অন্যায়ের প্রতিকার কেন হয় না? সবাই সবকিছু জানে,তারপরও এই রমরমা ব্যবসা চলছে। আমি এর প্রতিকার করবো।”

“তাহলে তো আম্মু, তোমাকে পুলিশ, সাংবাদিক এমন কিছু হতে হবে।”

“আব্বু, আমাকে বুদ্ধি দেন,কি করতে পারি আমি! আমি কিছু করতে চাই, করতে চাই। এতোবড় অন্যায় চলতে দেওয়া যায় না। কি করবো আমি?দেশে এতো মানবাধিকার সংস্থা, নারী ও শিশু সংস্থা আছে, সবাই মিলে কেন বিহিত করতে পারে না আব্বু?”

” অনেক কারণ রে মা। এটা একটা লম্বা চেইন। এই চেইনের সাথে চুনোপুঁটি, রাঘব বোয়াল অনেকেই জড়িত। আমাদের দেশে রক্ষকই বেশিরভাগ সময় ভক্ষক। এসব ব্যবসা চালানোর জন্য পাড়ার সাধারণ মাস্তান, পুলিশ, পলিটিশিয়ান অনেককে হাতে রাখতে হয়, তাদের যত্ন-আত্তি করতে হয়। এছাড়া নীতিহীনতা, কাজে গাফিলতি এসব তো আছেই। কিন্তু আম্মু, বিয়ের পরেও তুমি তোমার কাজ নির্বিঘ্নে করতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস।অভিকে আমার বেশ ভালো লেগেছে। বাপ-মাও মন্দ নয়। বিয়েটা লাইফের একটা পার্ট। যেমন তোমার মা ছাড়া আমি একজন অসম্পূর্ণ মানুষ। তোমার মা ও…….”,

“জ্বী না, আপনাকে ছাড়া আমি অসম্পূর্ণ মানুষ না। এই যে মা, আমি,অদিতি _ আমরা তিনজনই সম্পূর্ণ মানুষ। আমরা সবার কথা ভাবি, কারোর ক্ষতি করিনা, পারলে উপকার করি,আমরা পায়ের উপর পা তুলে বসে থাকি না, খাটা খাটনি করি নিজের জন্য ও অপরের জন্য,আমরা বিবেক নিয়ে চলি, নীতি মেনে চলি,কাজেই আনন্দ সাহেব, আপনি আমার জীবনের অতি গুরুত্বপূর্ণ মানুষ বটে,কিন্তু আপনাকে ছাড়া আমি অসম্পূর্ণ মানুষ না।”

অদিতি কিছুতেই বিয়েতে রাজী হয় না। শেষ পর্যন্ত সে বাপ-মা’কে বললো, “উনারা জানেন,আমার জন্ম অবৈধ ভাবে, আমি নিম্নবিত্ত অশিক্ষিত পরিবারের কোনো মেয়ের পেটে জন্মেছি। কিন্তু বিস্তারিত বৃত্তান্ত তাঁরা জানেন না। যার পেটে আমি ছিলাম তার স্বভাব চরিত্র, ব্যাভিচার, দুই দুইটা বিয়ে, যার ঔরসে আমি হয়েছিলাম, সেই ব্যাপারি সাহেবের নোংরামি, নিজের ছেলেদের হাতে খুন হওয়া, সেই ছেলেদের আবার মহিলার ভাইয়ের হাতে খুন হওয়া, মহিলার বাপ,মা,দুই ভাইয়ের স্বভাব চরিত্র, বিস্তারিত তাঁদের খুলে বলো। থানায় তাদের ছবি দেওয়া আছে, তোমাদের কাছেও তো ছবি আছে,উনাদের ডেকে দেখাও। ওরা যে এখানে টাকা হাতাতে এসেছিলো,এটাও বলো।তারপরেও যদি তাঁরা রাজি হন,তাহলে আমি তোমাদের কথার উপরে কোনো কথা বলবো না।”

“এতো ইতিহাস তাদের বলতে হবে কেন? ওই মানুষগুলো তোর কেউ না। জন্মের পর থেকেই তুই তিথির কোলে। তুই আমাদের নাতনি, আনন্দ -তিথির মেয়ে, তোর এই পরিচয় থেকে অন্য পরিচয় বেশি বড় হয়ে গেলো?”

“দাদুমনি,ভালো করেই জানো,তোমরা আমার সব। তবে বিয়ের ক্ষেত্রে আমি কোনো তথ্য গোপন করতে চাইনা। সবকিছু জেনে কেউ যদি ভালো মনে এগিয়ে আসে, তাহলে ভাবা যায়।তবে বিবাহিত জীবনে নানা রকম খোঁচা আমাকে খেতে হবে, এটা তোমরা নিশ্চিত থাকো।”

আনন্দ ভাইয়া অদিতির আড়ালে বললেন,”ওর ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে দেওয়ার দরকার নেই। ও যেভাবে বাঁচতে চায়, সেভাবে ওকে বাঁচতে দেওয়া উচিৎ। ”

“কি যে বলিস আনন্দ! অদিতি ছোট মানুষ, দুনিয়ার কিছু বুঝে না,তাই এসব কথা বলছে। ওর যখন ঘর সংসার হবে, বাচ্চা হবে, ও তখন বুঝবে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত ভুল ছিলো না। ওরে, ওর রক্তের সম্পর্কের কেউ নেই ওর পৃথিবীতে। বাচ্চা হলে নিজের রক্তের একজনকে সে পাবে।”

“কি বলো মা! রক্তের সম্পর্ক ই বড় হলো? তুমি কি সমুদ্র -পরীর মতো অদিতিকে ভালোবাসো না? নাকি কম বাসো।”

“না রে বাবা, সমুদ্র -পরীর থেকে অদিতিকে আমি একটু বেশিই ভালোবাসি।তাই ওকে একা দেখতে চাই না। ওর পাশে অভির মতো ভালো একটা ছেলেকে দেখতে চাই। ওর কোলে একটা জ্যান্ত পুতুল দেখতে চাই। ওর সমবয়সীরা সব বিয়ে করে ফেলেছে বা ফেলবে, আর আমার নাতনি একা একা জীবন পার করবে? সমাজতো এই নিয়েও ওকে কথা শুনাবে। আইবুড়ো বলবে। নানা আজেবাজে কথা ছড়াবে। ওর জন্ম বৃত্তান্ত নিয়ে আরও বেশি করে গালগপ্পো করবে। ”

তিথি ভাবী -আনন্দ ভাইয়া গেলেন একদিন অভিদের বাড়িতে। অদিতির রক্তের সম্পর্কীয়দের নিকৃষ্ট ইতিহাস জানাতে।

সব শুনে আর ফটোগুলো দেখে অভি পর্যন্ত আমতা আমতা করতে থাকলো। অভির বাবা-মা বললেন,” অদিতি যদি সত্যি আপনাদের মেয়ে হতো, তাহলে ওকে বৌ হিসাবে পেয়ে আমরা নিজেদের পরম সৌভাগ্যবান মনে করতাম। কিন্তু এতো কিছু জানাশোনার পরে ওকে বৌ হিসাবে বরণ করা আমাদের জন্য সত্যি খুব ডিফিকাল্ট হবে। যে কারোর জন্যই হবে। আপনারা বলেন, আপনাদের ছেলে যদি ঘরে এমন বৌ আনতে চাইতো, আপনাদের কেমন লাগতো?”

“আমাদের বৌমা পলিন বড় হয়েছে একজন প্রসের কাছে। বলেছিলাম আপনাদের। কিন্তু আমার বেয়ান মার্থার মতো ভালোমানুষ খুব কম দেখেছি। আর পলিনের তো তুলনা নেই। ”

“এ আপনাদের উদারতা। আর আমেরিকা আর বাংলাদেশের কালচার এক নয়। ”

“দেখেন,অদিতির বিয়ে নিয়ে আমরা এতোটুকু টেন্সড না। বিয়ের প্রসঙ্গও আমরা উঠাই নি। আমরা অভির কাছ থেকে প্রোপোজাল পেয়েছি, ওর মধ্যে যথেষ্ট আন্তরিকতা দেখেছি,শুনেছি একসময় আপনাদের আপত্তি থাকলেও আমার মেয়েকে দেখে, তার সাথে কথা বলে, তার সম্পর্কে খোঁজ খবর নিয়ে আপনারা ছেলের পছন্দ খুশিমনে মেনে নিয়েছিলেন। এসবের জন্য ই আমাদের আসা। আর কোনো কথা গোপন রেখে আমার মেয়ের নতুন জীবন আরম্ভ হোক,এটা আমরা কোনো ভাবেই চাই না। মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার জন্য আমরা উদগ্রীব না। আপনাদের মতামত ডিরেক্টলি বলে দেন,উইদাউট হেজিটেশন।”

” আমাদের গোড়া থেকে মত ছিলো না। আর এখন, এখন ভাবতেই পারছি না।”

“ওকে। স্পষ্ট কথাবার্তা হয়ে যাওয়াই ভালো। অভি, তোমার আব্বা-আম্মা নারাজ, তোমার কি মতামত?এর আগে বলেছিলে বাবা-মা যাই বলুন,তুমি অদিতিকে বিয়ে করবে, নইলে আজীবন কুমার থাকবে।”

“আন্টি, কি দরকার ছিলো আমাদের এতো ইতিহাস জানানোর?”

” আমাদের মেয়ে হেলাফেলা মেয়ে না যে তথ্য গোপন করে বিয়ে দিতে হবে।
ধরো,তোমাদের যদি না জানাতাম, বিয়ের পরে তোমরা যদি কোনো ভাবে জানতে পারতে, সত্যি কথা কি, ওরাই কেউ চলে এলো তোমাদের বাসায়,আত্মীয়তার দাবী নিয়ে, তখন তোমরা ই আমাদের মিথ্যাবাদী, প্রতারক এগুলো বলতে, ঠিক না? ”

“আন্টি, আমার মাথা কাজ করছে না আসলে, এতোটা নোংরা হিস্ট্রি, ফ্যামিলি এতো লোয়ার লেভেলের, আমি…, আন্টি,আমাকে একটু সময় দেন। ”

“অভি, রিল্যাক্স। তুমি বিয়ে করতে চাইলেও আমি আমার মেয়েকে তোমার সাথে বিয়ে দিবো না।এই বিয়ে সুখের হবে না। অদিতি আমাদের অতি আদরের মেয়ে, তাকে বুঝে শুনে আমরা অসুখী জীবনে ঠেলে দিতে পারি না। আসি। চলো আনন্দ। ”

অদিতির ছোট ভাই বোনদেরও বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। মানে আমাদের কাজিনদের ছেলেমেয়েদের।অদিতি নির্বিকার। এরমধ্যে একদিন পরী ফোনে কাঁদতে কাঁদতে জানালো, তার বয়ফ্রেন্ড আছে তিন বছর ধরে। বাংলাদেশী। একই ইউনিভার্সিটিতে। পরীর ইয়ারমেট। ছাত্র খুব ভালো। ছেলের ফ্যামিলি কানাডাতেই সেটেল্ড। পরীকে ছেলের বাবা-মাও খুব আদর করেন। পরী ছেলেটার কাছে তার ভাই বোন, পরিবারের অনেক গল্প করেছে। ছেলের বাবা-মা সামনের মাসে এসে পরীর দাদা,দাদু,বাপ-মায়ের সাথে কথা বলবেন। পরী আজ ছেলেটাকে অদিতি,পলিন আর মার্থা সম্পর্কে সবকিছু বলেছে। বোন তার প্রাণ, ভাবীও খুব প্রিয় আর মার্থা আন্টির মতো ভালো মানুষ খুব কমই আছে। সামনের মাসে ছেলের বাপ-মা দেশে যেয়ে পাছে অন্যের মুখ থেকে হাবিজাবি কিছু শোনেন, তাই পরী আগেই ছেলেটাকে সত্যিটা জানিয়ে দিয়েছিলো। সব শুনে ছেলেটা ভীষণ রেগে গেছে, পরী এতোদিন এগুলো না বলে তার সাথে নাকি বিরাট প্রতারণা করেছে, এমন ফ্যামিলির মেয়েকে সে নিজেও বিয়ে করবে না, আর তার বাপ-মাতো রাজি হবেন ই না।

তিথি ভাবী ঠান্ডা গলায় বললেন,”আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করো, পরী। যে সরে গেছে, তাকে নিজের থেকে কাছে টানতে যেও না। কি বললে? ওকে ছাড়া বাঁচবে না? পরী, আমার মেয়ের মুখে এমন কথা শোভা পায় না। নিজেকে রেসপেক্ট করো, মা। এক জীবনে অনেক কিছু করার আছে। সেগুলো নিয়ে ভাবো। কয়েক বছরের পরিচিত একটা ছেলের জন্য তোমার জীবন থেমে যাবে? আমরা তোমার কেউ না? কারোর জন্য কিছু থেমে থাকে না বাবা। আমরা বেশির ভাগ মানুষ একটা বড় ভুল করি। যারা আমাদের জীবনে গুরুত্ব পাওয়ার যোগ্যতা রাখে না,তাদেরকে আমরা বেশি ইম্পরট্যান্স দিয়ে ফেলি। তুমি বরং দেশে এসে কিছুদিন বিশ্রাম নিয়ে যাও। ”

চলবে।

#শক্তিময়ী
পর্ব ২৫
বড় গল্প
নাহিদ ফারজানা সোমা

নামকরা তিনটা মার্কেটে অদ্বিতীয়ার তিনটা “Tithy’s food shop.” অনেক স্পেস ও কর্মচারী নিয়ে। Tithy’s food shop এ সব খাবারেরই খুব চাহিদা। খাটতে পারে বটে অদিতি। ভোর চারটা থেকে রাত এগারোটা। পাঁচ ঘন্টা গাঢ় ঘুম। ওর এতো রেস্টলেস অবস্থা আমাদের ভালো লাগে না। খুব কষ্ট হয়।

এক সকালে নাশতা করতে করতে ফুপা বললেন,”দিদিভাই, তোমার বদৌলতে নিত্য চারবেলা আমি আর তোমার দাদু ফ্যাট ফ্রী মজার মজার খাবার খাই বটে,কিন্তু তোমার চাঁদ পানা মুখটা দেখতে পাই না যে। সকালে এক ঝলক শুধু। পেট ভরে দিদিভাই,মন তো ভরে না। এতো ব্যস্ত থাকিস তুই। তোর আরেকটু রেষ্টের দরকার। ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া দরকার। আমি আর বেশিদিন নেই দিদিভাই, যে কটা দিন আছি, একটু কাছে কাছে থাক্।”

অদিতি ফুপাকে জড়িয়ে ধরে বাচ্চাদের মতো কেঁদে ফেললো।

“এমন ভাবে আর কখনো বলবে না দাদাভাই, আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচবো না। ”

“বোকা মেয়ে। মানুষ কি সারাজীবন বাঁচে রে? সবাইকে একদিন চলে যেতে হয়। ওসব কথা থাক। তুই নিজের অযত্ন করছিস খুব। তুই তিনবেলা অন্তত আমাদের সাথে খেতে বস। মাত্র পাঁচ ঘন্টা ঘুমিয়ে হয়? কমপক্ষে সাত-আট ঘন্টা ঘুমের দরকার।”

“আচ্ছা দাদাভাই, তুমি যা বলবে আমি তাই করবো। কিন্তু এমন কথা বোলো না দাদাভাই। কি হয়েছে তোমার? শরীর কি খারাপ লাগে? ডাক্তার চাচা তো প্রায় দেখে যান। আল্লাহর কাছে সবসময় বলি,তিনি যেন আমার আয়ু আব্বু,মা,দাদুমনি আর তোমাকে ভাগ করে দিয়ে দেন। সবার আগে আমি যেন চলে যাই।”

“চুপ! কি বলিস এসব? ”

” এক থাপ্পড় লাগিয়ে দিবো।”

” কি বলো আম্মু এসব?”

“একদম চুপ,ফাজিল মেয়ে। ”

প্রথম কথাটা ফুপার,দ্বিতীয়টা ফুপুর, তৃতীয়টা আনন্দ ভাইয়ের,চতুর্থটা তিথি ভাবীর। এক সাথে চারজনের চার রকম কথা।

তিথি ভাবী বললেন,”অদিতি, তোমাকে আরও প্র্যাকটিকাল হতে হবে সোনা। বাস্তবকে মেনে নেওয়ার মানসিকতা থাকতে হবে। এতো ইমোশনাল হলে তোমার ড্রিম প্রজেক্ট চালাতে পারবে না। তুমি তোমার প্রিয় মানুষদের জন্য ভালোবাসায়,কর্তব্যে এতোটুকু ফাঁকি রেখো না। সেটা কোনোভাবে উচিৎ নয়। কিন্তু কোনো একজনের অনুপস্থিতির জন্য তোমার জীবন যেন স্তব্ধ না হয়ে যায়। তোমার কাজ যেন থেমে না যায়। এটুকু মানসিক শক্তি তোমার থাকতে হবে মা।”

“পরিবেশ বেশি ভারি হয়ে গেছে। হালকা করার দরকার। চলো,আউটিং এ যাই। আব্বা,মা, রেডি হও। তিথি, গুষ্টিকে ফোন করো। কারা কারা এই মুহূর্তে নানার বাড়িতে যেতে পারবে, তারা যেন এখনই চলে আসে। আব্বা-আম্মাকে আমি যেয়ে নিয়ে আসি। অদিতি, তোর রেষ্টুরেন্টের লোকজনকে জানিয়ে দে,তুই আজ যাবি না। কেক,টেক যা বানিয়ে ফেলেছিস,পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা কর।”

দুই বাস ভরে আমরা রওনা হলাম। আগেই বলেছি, মেজ চাচার পরিবহন ব্যবসা। কাজেই গাড়ি,বাস নিয়ে আমাদের কোনো সমস্যা হয় না।
প্রায়ই আমরা দল বেঁধে এদিক সেদিক বের হয়ে পড়ি।

এবারেও দারুণ মজা হলো। দুই বাসে একশত জন। আনন্দ ভাই সমানে একে ওকে ফোন দিচ্ছেন। আনন্দ ভাইয়ের নানা বাড়ি অর্থাৎ আমার দাদাবাড়িতে বড় একটা বাবুর্চি দল চলে এসেছেন। দূর সম্পর্কের আত্মীয়রা যাঁরা কেয়ারটেকার হিসাবে থাকেন, তাঁরা ঘর দুয়ার,বিছানাপত্র ঝাড়াপোঁছা শুরু করে দিয়েছেন। বড় বড় পুকুরে জাল ফেলা হচ্ছে। আনন্দ ভাইয়া বিকাশে টাকা পাঠিয়ে দিয়েছেন বাজার ঘাট করার জন্য। ফুপুরা,চাচীরা সব একসাথে বসেছেন। চাচারা-ফুপারা অন্য বাসে। আমরা আড্ডাতে মত্ত। এতো অল্প সময়ের মধ্যে বাসে খাওয়ার জন্য প্রচুর খাবার যোগাড় হয়েছে। অদিতির তৈরি বিখ্যাত কেক,স্যান্ডউইচ, আমার আনা শামী কাবাব, মেজ চাচীর কেনা নান, শিক কাবাব, তিথি ভাবীর আম্মার আনা প্রচুর পরিমাণে কমলা,আপেল,খেজুর,আরও নানা জিনিস।

বাড়িতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে দুপুর আড়াইটা। রাস্তায় জ্যাম ছিলো না বললেই চলে। আমরা ঝাঁপিয়ে পড়লাম পুকুরে। পুকুর না বলে দীঘি বলাই ভালো। মাছের পুকুরগুলো আলাদা। দীঘিতে ঝাঁপাঝাপির পরে আমরা অনেকেই গ্রামটায় ঘুরে বেড়ালাম। কেউ কেউ বাসায় বসে আড্ডা দিলেন। অনেকদিন গ্রামটায় এতো ভালো করে ঘোরা হয়নি। আনন্দ ভাইয়া অদিতির হাত ধরে হাঁটছেন। অনেক বছর ধরে তিনি এই কাজই করেন। বড় মেয়ের হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে হাঁটেন। আনন্দ ভাইয়া আমাদের অর্ডার দিলেন,” আশেপাশের সব বাড়িঘর খেয়াল করতে করতে যা। ঘরবাড়ি, মানুষজনের শরীর স্বাস্থ্য, জামাকাপড় দেখে তাদের অবস্থা বোঝার চেষ্টা কর। অবস্থা খারাপ মনে হলে নোট করে নে। ”

আনন্দ ভাইয়া এমনই। কোন অসহায়,দরিদ্র দেখলে আনন্দ ভাইয়া যে কোনো উপায়ে তাঁকে স্বাবলম্বী করে তুলবেন। আমরা বেশীর ভাগ ভাই বোনই এমন,তবে আনন্দ ভাইয়ের ধারে কাছে না। আনন্দ ভাইয়ের মধ্যে অনেকে আমার দাদাজানের ছায়া দেখতে পান।

” মেয়ে থাকলে তোদের ভাই আমাকে আর চোখেই দেখতে পায় না,দেখেছিস তোরা?” তিথি ভাবী হাসতে হাসতে বললেন। আসলেও তাই। আনন্দ ভাইয়া আগে সবসময় ভাবীর হাত ধরে হাঁটতেন।

“নিজের মেয়েকে হিংসা? হা,হা,হা। শোনো তিথি, নানীজানের হাত ধরে হাঁটা শিখেছি। তারপরে মায়ের হাত ধরে হাঁটতাম। আমার যন্ত্রণায় মায়ের হাত বাবা,আনিলা,এই যে কাচ্চা বাচ্চারা কেউ ধরতে পারতো না, এরপরে ধরলাম তোমার হাত, এখন আমার মেয়ের হাত, তারপরে ইনশাআল্লাহ নাতনির হাত, কি রে অদিতি, বাপের এই ইচ্ছা পূরণ করবি না?”

অদিতি বিষম লজ্জা পেয়েছে। বাপের হাত ছাড়িয়ে বললো,”আব্বু,আপনি এক্ষুনি মা’র হাত ধরেন। ”

অদিতিটা আনন্দ ভাইয়াকে কিছুতেই তুমি বলতে পারলো না। ভাইয়ার বারবার অনুরোধ স্বত্বেও। এ এক ভারি আশ্চর্যের বিষয়। দাদা-দাদি, চাচা-ফুপু-বড় ভাই সবাইকে শেষ পর্যন্ত তুমি করে বলেছে কিন্তু বাপকে বলতে পারলো না কোন একটা জড়তায়,অস্বস্তিতে। কিন্তু আনন্দ ভাইয়া যেমন অদিতিকে চোখে হারান, অদিতিও কঠিন পিতৃভক্ত মেয়ে।ফুপু মাঝে মধ্যে বলেন,”আনন্দের মা কি আমি নাকি তুই? ” তিথি ভাবীও প্রায় বলেন,”আমার থেকে বাপকে বেশি ভালোবাসে অদিতি। পরিস্কার বুঝি আমি।”

আনন্দ ভাইয়া -তিথি ভাবী হাত ধরে হাঁটছেন। অপূর্ব দৃশ্য। আমাদের পরিবারের সবচেয়ে রোমান্টিক কাপল। কি মিষ্টি বাতাস! চারদিক সবুজ আর সবুজ। আমরা হাঁটছি, গল্প করছি, কেউ কেউ গলা ছেড়ে গান ধরেছে। কি আনন্দ! কি সুখ! আল্লাহর দরবারে শত শুকরিয়া এমন একটি সুন্দর পরিবারে জন্মানোর জন্য।

সন্ধ্যায় বাড়িতে চাঁদের হাট। আত্মীয়রা দেখা করতে আসছেন। সবাইকে পোলাও, রুই মাছ ভাজা,খাসীর মাংস, বেগুন ভাজা,দই দিয়ে আপ্যায়ন করা হচ্ছে। একজন অন্যজনকে জড়িয়ে ধরছেন। কতো সুখের কথা,দুখের কথা। কতো মিষ্টি স্মৃতিচারণ।

রাতে খাওয়ার পরে সবাই উঠে গেলাম ছাদে। আকাশে থালার মতো এক ঝলমলে চাঁদ। সবার অনুরোধে অদিতি গান শুরু করলো। এতো সুন্দর গান কিভাবে গাইতে পারে মানুষ!

সবাই তন্ময় হয়ে গান শুনছি। হঠাৎ অদিতি গান থামিয়ে উৎকন্ঠিত গলায় বললো,” আব্বু,আপনার কি শরীর খারাপ লাগছে? আব্বু, আব্বু,”

আনন্দ ভাই প্রচন্ড ঘামছেন। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে বোঝাই যায়। তিথি ভাবী আনন্দ ভাইয়াকে জড়িয়ে ধরেছেন। শাড়ির আঁচলে ঘাম মুছিয়ে দিচ্ছেন।

“কি হলো রে? ও আনন্দ! রাতে খেলিও না। এসিডিটি হলো নাকি?আনন্দ, বাবা, বাবারে, বেশি খারাপ লাগছে? কি কষ্ট রে, বাবা?”

লুবনা আপার স্বামী রুবেল ভাই খুব ভালো ডাক্তার। তিনি আনন্দ ভাইয়াকে সিপিআর দিতে লাগলেন।

ছোটাছুটি পড়ে গেছে সারা বাড়িতে। ভাইয়ারা ফোন করছেন অ্যাম্বুলেন্সের জন্য। আমরাতো বাসে এসেছি, কেউ গাড়ি আনিনি। কয়েকজন হুড়মুড় করে দৌড়ালো ঘুমন্ত বাস ড্রাইভারদের ডাকার জন্য।

অদিতির গলা শোনা যাচ্ছে, “আব্বু, তাকাও, তাকিয়ে থাকো,চোখ বন্ধ করবে না প্লিজ, আব্বু, আমার আব্বুসোনা, তাকাও, তুমি যা বলবে আমি তাই শুনবো, আব্বু তুমি এমন করছো কেন? মেজ দাদা,আপনি কলেমা পড়ছেন কেন? তোমরা কাঁদছো কেন? আব্বু,কথা বলো,এই যে আমি তোমার অদিতি, আমি তোমার অদিতি, তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচবো না,আব্বু তাকাও।”

তিথি ভাবী জ্ঞান হারিয়েছেন। ঘটনার আকষ্মিকতায় আমরা স্তব্ধ। ফুপা হতভম্ব চোখে আনন্দ ভাইয়ের মাথার কাছে বসে আছেন, মেঝেতে , একটা হাত আনন্দ ভাইয়ের চুলে। ফুপু আনন্দ ভাইয়ের বুকে লুটিয়ে পড়ে আছেন, আকাশ ভরা তারারা আর ঝলমলে চাঁদ নির্লজ্জের মতো তাকিয়ে রইলো, অদিতির গগনবিদারী চিৎকারে অনেক গ্রামবাসী চমকে ঘুম থেকে উঠে বসলো,”আব্বু……”

চলবে

পূর্ববর্তী নিবন্ধ
পরবর্তী নিবন্ধ
গল্প পোকা
গল্প পোকাhttps://golpopoka.com
গল্পপোকা ডট কম -এ আপনাকে স্বাগতম......
RELATED ARTICLES

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments

Md masrur Hasan mahi على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
আমিনুল ইসলাম على প্রয়োজন পর্ব: ৩০ ( অন্তিম)
সাজিবুল ইসলাম على ধর্ষিতাবউ২ ৯ তথা শেষ পর্ব
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
Nita Sarkar على স্বপ্নীল ৬৮
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على রহস্য শেষ_পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على অলক্ষ্যে তুমি পর্ব-০৬ এবং শেষ পর্ব
Nazmun Nahar Akhi على Psycho_is_back? part_7
Nazmun Nahar Akhi على Dangerous_Villian_Lover part 2
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على জানালার ওপারে পর্ব-১৭ এবং শেষ পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على লীলা বোর্ডিং ১২১৫ পর্ব-১১ এবং শেষ পর্ব
মিজানুর রহমান রাহুল على সেই তুমি পর্ব-০১
@feelings على প্রহেলিকা
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Nusrat jahan على coffee & vanilla Part-10
Pallabi Roy على স্বপ্নীল ৬৮
M.D Mahabub على The_Villain_Lover Part_2
Labani sarkar على Dangerous_Villain_Lover part 23
MD Akas Apc على বিবেক
Tanisha Ahmed على Devil love part-18 
Aius Barmon shorob على নারীর দেহকে নয়
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Priya Banerjee على devil love married life last part
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Riya Biswas على তুমি রবে ৫২
Mohammad Adib على তুমি রবে ৬০
Avni Ayesha على তুমি রবে ২৮
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
সুমিত على তুমি রবে ২৮
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
Samiah Begum على তুমি রবে ৫১
biddut das rocky على নর নারী
গল্প পোকা على নষ্ট গলি শেষ পর্ব
Md Jobayer Hossain Shohag على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على দুই অলসের সংসার
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤৪২.
A.J.S Rakib على মন ফড়িং ❤৪২.
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
Samiya noor على গল্পঃ ভয়
Sadikul على গল্পঃ ভয়
Samia Islam على গল্পঃ ভয়
শূন্য মায়া على মন ফড়িং ❤ ৪০.
Sutapa biswas على মন ফড়িং ❤৩৯.
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৮.
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৭
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
Siyam على বিবেক
Sudipto Guchhait على My_Mafia_Boss পর্ব-৯
saptami karmakar على devil love married life last part
saptami karmakar على devil love married life last part
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ২৬.
Shreyashi Dutta على  বিয়ে part 1
Sandipan Biswas على  বিয়ে part 1
Paramita Bhattacharyya على অনুরাগ শেষ পর্ব
জামিয়া পারভীন তানি على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
মায়া على মন ফড়িং  ২২
সুরিয়া মিম على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على মন ফড়িং ২১
গল্প পোকা على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
Sahin ssb على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৮. 
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৭.
Jannatul Ferdous على খেলাঘর পর্ব-৩৫
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ফাল্গুনের_ফুল last_part_8
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ছাত্রী যখন বউ পাঠঃ ১
গল্প পোকা على বাজির প্রেম পাঠঃ ১
Foujia Khanom Parsha على মা… ?
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৮
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
Ibna Al Wadud Shovon على স্বার্থ