Monday, October 6, 2025







বাড়ি"ধারাবাহিক গল্প"কলা পাতায় বাঁধিব ঘরকলা পাতায় বাঁধিব ঘর পর্ব-০৬+০৭

কলা পাতায় বাঁধিব ঘর পর্ব-০৬+০৭

#কলা পাতায় বাঁধিব ঘর
#জিন্নাত_চৌধুরি_হাবিবা
#পর্ব_০৬+০৮

বউয়ের ডাকে সাড়া দিতে এসেই চমকে গেলো রাউফুন। বিড়বিড় করে বলল,
-“কি সাংঘাতিক! কি সাংঘাতিক! বউ দেখছি আমাকে পুড়িয়ে মা’রার সমস্ত বন্দোবস্ত করে রেখেছে।”

পুষ্প মিষ্টি হেসে বলল,
-“খাবার কি দেবো?”

রাউফুন মেকি হেসে বলল,
-“না থাক, আমার পেট মনে হয় ভরে যাচ্ছে।”

পুষ্প ঠোঁট কামড়ে হাসলো। রাউফুন ঢোক গিলে এদিকওদিক তাকিয়ে বলল,
-“আমাকে একটু শান্তিতে খেতে দাও। তুমি আপাতত রুমে যেতে পারো।”

পুষ্প গেলোনা। বরং রাউফুনের পাশের চেয়ারে বসে পড়লো। শাড়িতে নিজেকে আকর্ষণীয় করে সাজিয়েছে। রাউফুনের উদ্দেশ্য বলল,
-“আমি কিন্তু খাইনি, আপনার হাতে খাবো বলে।”

রাউফুন বিড়বিড় করে বলল,
-“এই মেয়ে তো দেখছি আজ আমায় জ্বালিয়ে খাবে।”

অগত্যা পুষ্পকে খাইয়ে দিতে হলো। খাওয়া শেষে ন্যাপকিনে মুখ মুছে রাউফুন বলল,
-“আমি কি চলে যাব?
কিন্তু আমি তো যেতে চাইছিনা।”

পুষ্প রাউফুনের সামনে দাঁড়ালো। দৃষ্টিতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে মিটিমিটি হেসে বলল,
-“দেখুন তো আমাকে কেমন লাগছে? লাল রং টাতে ভালোলাগছে না?”

রাউফুন পুষ্পের হাত চেপে ধরে বলল,
-“পুষ্প ঘরে আসোতো। আজ কেনো? আগামী একবছরেও আমি শশুর বাড়ি থেকে যেতে রাজি নই।”

ঘরে গিয়ে পুষ্প এক ভয়ানক কাজ করে ফেললো। রাউফুনের গালে নরম ঠোঁট জোড়া ছুঁইয়ে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো। হতভম্ব রাউফুন ভেবে কূল করতে পারলোনা তার সাথে আজ সাংঘাতিক ব্যাপারগুলো কেনো হচ্ছে। বিষ্ময়ভাব কাটিয়ে পাশে শুয়ে পড়লো। সিলিং এ দৃষ্টি রেখেই বলল,
-“আমাকে মেসেজ করার উদ্দেশ্য কী ছিলো? এত এত সাজুগুজু করে নিজেকে আকর্ষণীয় করার কারণ কী?”

পুষ্প কথা বলতে পারলোনা। শুধু রাউফুনের দিকে ফিরে দু’হাতে তার গলা জড়িয়ে ধরলো। মিটিমিটি হাসলো রাউফুন।

★★★

ভোরটা ছিলো স্নিগ্ধময়, মিষ্টি রোদ ক্ষণে ক্ষণে উত্তাপ বাড়িয়ে দিচ্ছে। খোলা জানালার পর্দাগুলো সরিয়ে দিতেই মিটিমিটি রোদ হেসে খেলে গড়িয়ে গেলো রঙিন কার্পেটে। রাউফুনের হসপিটাল যেতে হবে। তাড়াতাড়িই ঘুম থেকে উঠলো সে। একহাতে জড়িয়ে রাখা পুষ্পর দিকে কোমল দৃষ্টি ফেলে তার কপালে, গালে, নাকে অধরের ছোঁয়া বসিয়ে দিলো। একটু খানি উষ্ণ ছোঁয়ায় আরেকটু মিশে গেলো পুষ্প। রাউফুনের আগেই তার ঘুম ভেঙেছে। উঠে জানালা খুলে পর্দাগুলো সরিয়ে দিয়ে আবারও শুয়ে পড়েছে। সদ্য ঘুম থেকে জাগা ভাঙা ভাঙা গলায় পুষ্প বলল,
-“আপনি ছয়দিন আমাকে কোনো কল বা মেসেজ করেননি। একবার আসলেন ও না। কি সাংঘাতিক কঠিন মানুষ আপনি?”

রাউফুন আলতো হেসে বলল,
-“মাঝেমাঝে গুরুত্ব বোঝাতে দূরত্ব বাড়াতে হয়। তবে খুব বেশি দূরত্ব বাড়াতে গেলেও সম্পর্ক টেকে না। তুমি যদি মেসেজ নাও করতে, আজ আমি নিজ থেকেই আসতাম। তোমার যে এত সহজে বুদ্ধি হবে ভাবিনি আমি।”

একটু থেমে রাউফুন আতঙ্কিত গলায় বলল,
-“পুষ্প আমি বাইরে বের হবো কিভাবে? লোকে আমায় লজ্জা দেবে। লজ্জায় ম’রি ম’রি হয়ে আমি ঘরেই থেকে যাবো। আজ আর চিকিৎসা করতে হবেনা।”

পুষ্প অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-“আজব তো, লজ্জা পাবেনই বা কেনো?”

রাউফুন বিষ্ময়কর দৃষ্টিতে তাকিয়ে অবাক গলায় বলল,
-“কি সাংঘাতিক পুষ্প, তুমি তো দেখছি গতরাতের কথা ভুলেই গেলে। নিজেই তো সেজেগুজে কত রোমান্টিকতা দেখালে।”

রাউফুনের হাত সরিয়ে উঠে পড়লো পুষ্প। মুখে কিছুই আটকায়না এই লোকের। ওয়াশরুমের দরজার কাছাকাছি যেতেই শুনতে পেলো,

-“নিজের সংসারে ফিরছো কবে? আমায় বিয়ে করবেনা বলে বাহানা দিয়েছিলে তুমি বিয়ের জন্য প্রস্তত নও। এবার কৃপা করে স্বামী-সংসারে ফিরুন। আপনার শশুর-শাশুড়ি, ননদ আমার কানের পোকা মে’রে ফেলছে আপনার ফেরা নিয়ে।”

পুষ্প উত্তর না দিয়েই দরজা আটকে দিলো।

★★★

নাস্তার টেবিলে একজোট হয়ে সবাই উপস্থিত হয়েছে। নাবিল রাউফুনকে দেখতেই লাফিয়ে এসে দুলাভাইয়ার কোলে উঠেছে। রাউফুনের দুষ্টুমি করে বলল,
-“শালাবাবু তোমাকে বড় একটা মেয়ে দেখে বিয়ে করিয়ে দেবো। তখন বউয়ের কোলে চড়ে ঘুরতে পারবে।”

নাবিল বিয়ের কথা শুনে লজ্জা পেয়ে মুখ গুঁজে নিলো। রাউফুন চোখ ঈষৎ বড় করে বলল,
-“বাব্বাহ্ বিয়ের কথা শুনে দেখছি লজ্জা ও পাও।
তা কাকে বিয়ে করবে?”

পুষ্প খেতে খেতেই বলল,
-“রিশার তো নাবিলকে বেশ মনে ধরেছে। কি বলিস নাবিল, বিয়ে করবি আমার ননদকে?”

রাউফুন মাঝখানে কথা বলল,
-“তাহলে তো ভালোই হয়। আমি নাবিলের দুলাভাইয়া, তখন নাবিল হয়ে যাবে আমার দুলাভাইয়া। এখন নাবিল আমার কোলে চড়ে, তখন আমিও আমার দুলাভাইয়ার কোলে চড়বো।”

নাবিল চোখ বড় বড় করে বলল,
-“আমি তোমাকে কোলে নিতে পারবোনা দুলাভাইয়া। তুমি আপুর কোলে উঠিও।”

খাবার টেবিলে নাবিলের কথা শুনে সবাই একদফা হাসলো। রাউফুন মুখ ছোট করে বলল,
-“কিন্তু তোমার আপু নাকি আমায় কোলে নেবেনা। তাই আমি তোমার কোলেই চড়বো।”

নাবিলের বাবা এবার বললেন,
-“নাবিল এবার নেমে এসো। ভাইয়াকে খেতে দাও ঠিক করে।”

নাবিল নামতে চাইলোনা। রাউফুন ও নামার জন্য জোর দিলোনা। তাই আর কেউ বাড়াবাড়ি করলোনা।
সকাল থেকেই রেহানা খালা ফুলে আছেন। মূল সমস্যা হলো পুষ্পর দাদু। এই মহিলার জন্য ব্রাশ রাখা যায়না। রেহানা খালা রাতের বেলা এবাড়ি থাকলে পুষ্পর দাদুর সাথেই ঘুমায়। তাই ব্রাশ ও তেনার ওয়াশরুমে রাখে। কিন্তু পুষ্পর দাদু সকালে নামাজ পড়তে আগে উঠলেই রেহানা খালার ব্রাশ দিয়ে দাঁত মেজে বসে থাকে। কিছু বললেই খিটখিট করেন।
আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে রেহানা খালা দেখলেন তার ব্রাশ ভেজা। তিনি বুঝে গেলেন কাম সারছে। পুষ্পর দাদুকে বললেন,
-“এই বুড়ি, আপনি আমার বেরাশ দিয়া দাঁত মাজলেন ক্যান? ওয়াক থু, পান খাওয়া লাল লাল দাঁত গুলা দিয়ে আমার বেরাশের ইজ্জত শেষ করলেন।”

পুষ্পর দাদু তেতে উঠে বলল,
-“এক চটকনা মাইরা দাঁত ফালাই দিমু। তুই আমার বেরাশের লগে বেরাশ রাখোস ক্যান?”

রেহানা খালা দ্বিগুণ তেতে বললেন,
-“বুড়া মানষ, কয়লা বা ছাঁই দিয়ে মাজলেই পারেন। আবার বেরাশ ও লাগে।”

পুষ্পর দাদু লাঠি হাঁকিয়ে বললেন,
-“তোগোই খালি বেরাশ কইত্তে মন চায়। আমার মন চায় না? ঘর থেইকা বাহির হ। নইলে লাঠি দিয়া বাইড়াইয়া তোর কোমর ভাঙুম।”

রেহানা খালা ভাব দেখিয়ে বেরিয়ে এসেছেন। এ দুজন মানুষের মাঝে সাপে নেউলে সম্পর্ক। অথচ দাদু কিছু খাওয়ার আগে চুপে চুপে বউদের জিজ্ঞেস করবে “রেহানা চেমরিডারে দিছো?”

রোহানা খালাও দাদির সব এগিয়ে রাখেন। দাঁত নড়বড়ে বলে পান চিবুতে কষ্ট হয়। পান গুলো চেঁচে রেখে কৌটো ভরে রাখেন।

রেহানা খালার থমথমে চেহারা নজরে পড়তেই পুষ্পর মা জিজ্ঞেস করলেন,
-“রেহানা কি হয়েছে তোমার?”

রেহানা খালা চায়ের কাপ শব্দ করে রেখেই বললেন,
-“আপনেগো ঘরের এই আলাদিনের চেরাগের ভিরের জ্বীনটা আইজ আবার আমার বেরাশ দিয়া দাঁত মেজেছে। এই বাড়িত রাখতে হইলে আমার ঘর পাল্টান।”

পুষ্পর দাদু খ্যাঁক করে উঠলেন,
-“দূর কর এই হারামজাদিরে, নষ্ট করছে, ধ্বংস করছে। পায়খানার গন্ধ ছাড়াচ্ছে। শয়তান দূর হ, দূর হ শয়তান।
বলেই বিড়বিড় করে দোয়া দূরদ পড়তে লাগলেন।

রেহানা খালার রাগ কমাতে নাবিলের বাবা বলল,
-“আম্মা থামুন তো। কি শুরু করলেন দুজনে?”

সব চুপ হয়ে গেলো।
রাউফুন হসপিটালে যাওয়ার আগে বলল,
-“আমি বাসায় ফিরে যাবো। ঠিকঠাক মতো নিজের খেয়াল রাখবে।”

পুষ্প পরিপাটি কলারটি আরেকটু হাত বুলিয়ে ঠিক করে দিলো। রাউফুন একটু কাছে ঘেষে দু,কপোলে চুম্বন করে বেরিয়ে পড়লো।

★★★

দুদিন পরই পুষ্প রাউফুনকে ডেকেছিলো তার বন্ধুদের সাথে দেখা করার জন্য। দেখা হওয়ার পর থেকেই প্রিয়া বলছে,
-“ইশ্! কি হ্যান্ডসাম ডাক্তার। এই ডাক্তার আমার হলেও পারতো।
জীবনে করলাম কী? প্রথমে জাবেদ স্যারের উপর ক্রাশ খেলাম। ক্রাশ খাওয়ার পর জানলাম স্যারের বউ প্রেগন্যান্ট। এখন ডাক্তারের উপর ক্রাশ খেলাম, অথচ ডাক্তার ও বিয়ে করে বসে আছে। কি ফুটো কপাল আমার।”

বিনিময়ে পুষ্প চোখ রাঙিয়ে বলল,
-“আমার ডাক্তারের দিকে নজর দিলে তোর চোখ গে’লে দেবো।”

ক্লাস শেষ করে বাড়ি ফিরতেই অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো পুষ্প। এই মুহূর্তে এই অনাকাঙ্ক্ষিত পুরুষকে সে আশা করেনি। যে অবহেলা দিয়ে চলে যায়, গুরুত্ব দেয়না, তাকে আমরা জীবনের বিশেষ মুহুর্তে আশা করিনা। পুষ্প সোজা নিজের ঘরে ফিরে দরজা আটকে দিলো। কিছুতেই সে বের হবেনা আজ।

#চলবে……

#কলা_পাতায়_বাঁধিব_ঘর
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#পর্ব_০৭

ঘর ছেড়ে বের হলোনা পুষ্প। রাতের খাবারের জন্য সবাই ডাকাডাকি করলেও বের হলোনা। শেষে একবার অপ্রত্যাশিত আগন্তুক গমগমে স্বরে ডাকলেন,
-“পুষ্প মামনী খেতে আসো। রাতে না খেয়ে ঘুমানো ভালো না।”

পুষ্প প্রতিত্তোরে কিছুই বললোনা, আর না দরজা খুললো। থম ধরেই বসে রইলো। এত আদিখ্যেতা সহ্য হচ্ছেনা। যখন সান্নিধ্য চেয়েছিলো তখন তো কাছে আসেনি, এখন কেনো এতটা মায়া দেখাচ্ছে? শুধু টাকা খরচ করলেই বাবার দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়না। একটা সন্তান সমস্ত সুযোগসুবিধা পাওয়ার পাশাপাশি বাবার কাছে আরও একটা জিনিস চায়, “ভালোবাসা”।
আর সেই ভালোবাসা নামক জিনিসটি পুষ্প পায়নি। বাদ বাকি পরিবারের সবার কাছ থেকে সে ভালোবাসা পেয়েছে। দাদি, চাচা-চাচি সবাই। পরিবারের একমাত্র মেয়ে হওয়ার সুবাদে চাচাদের কাছ থেকেও কম ভালোবাসা পায়নি। বড় চাচা তার আলাদা বাসায় থাকলেও আদর কমেনি।

ছোটবেলায় মাকে হারানোর পর থেকেই পুষ্প কাঁদেনা। খুব ব্যথা পেলে চোখমুখ কুঁচকে নেবে, কিন্তু চোখ দিয়ে দু’ফোটা অশ্রু ঝরেনা। কার জন্য কাঁদবে? পাষাণ মানুষটার জন্য?
পুষ্প ভেবে রেখেছে সে আবারও কাঁদবে। কোনো একদিন নিজের আপন মানুষের যন্ত্রণায় ছটফট করবে, হাউমাউ করে কাঁদবে। কিন্তু এই পাষণ্ড পিতার জন্য কাঁদবেনা।

পুষ্প যখন ছোট ছিলো, তখন তার বাবা পরনারীতে আসক্ত হয়। পুষ্পর মা একদিন ছাদ থেকে অসাবধানতা বশত পড়ে গিয়ে মৃ’ত্যু হয়। পুষ্পর মাঝেমাঝে সন্দেহ হয় তার মা কি সত্যিই পা পিছলে পড়েছিলো? নাকি স্ব-ইচ্ছায় নিজের জীবনটুকু জলাঞ্জলি দিলো। পুষ্পর খুব ব্যথা লাগে, যখন ভাবে মা তার কথাটা ভাবলোনা? তাকে ফে’লে কিভাবে যেতে পারলো?
বাবা অবশ্য শেষ মুহূর্তে এসে সুপথে এসেছেন। কিন্তু ততদিনে মা পৃথিবী ছাড়লো।
মাকে হারানোর পর পুষ্প বাবার সঙ্গ চাইতো, কিন্তু বাবা তাকে কাছে টে’নে নিতোনা। পুষ্প বাবার ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে কাঁদতো। তখন দাদি বা চাচি এসে তাকে কোলে তুলে নিয়ে যেতো।
কিছুদিন পরই বাবা আবার বিয়ে করলেন। তবে তাকে নয়, যার রূপের মায়ায় পড়ে পুষ্পর মাকে অবহেলা করেছেন। বিয়ে করলেন ভিন্ন এক নারীকে। যিনি পুষ্পর দেখাশোনা করবেন, মায়ের ভালোবাসা দেবেন। এই নারীটি হলো সে, যাকে এখন সবাই পুষ্পর মা হিসেবে জানে।
তিনি প্রথম প্রথম পুষ্পকে কাছে টা’নতে চাইলেও পুষ্প ভয়ে এগোতো না। সম্পূর্ণ অচেনা এই নারীর কাছ ঘেষতোনা। এরপর থেকে তিনিও পুষ্পকে কাছেও টানেননা আবার অবহেলা ও করেননা। বলতে গেলে বাবা-মায়ের ভালোবাসা বিহীন গড়ে উঠেছে পুষ্প নামক মেয়েটি।
একদিন বাবাই ভালোবেসে তার নাম দিয়েছিলো পুষ্প। অথচ এতগুলো বছর অযত্নে পুষ্পটি কেমন নেতিয়ে গেছে সেটা বাবা খেয়াল করেনি। এই ফুলের সুভাস নেই, কোমলতা নেই, আছে একরাশ অভিমান।

বাবার ডাকে সাড়া না দিয়ে পুষ্প বসে রইলো। জাহাজের ক্যাপ্টেন বাবা। কি আশ্চর্য! তিনি পুষ্পর বিয়েতেও ছিলেননা। অথচ সবাইকে বলেছিলেন তিনি পুষ্পর বিয়েতে আসবেন, কিন্তু পরমুহূর্তে ফোন করে জানালেন তিনি কাজে আটকা পড়েছেন।

নাবিলের বাবা বললেন,
-“পুষ্প মা, খেতে আয়। একসাথে সবাই খাবো। আমার কিন্তু খুব ক্ষুধা পেয়েছে। তুই না খেলে কিন্তু কেউ খাবেনা।”

এই পর্যায়ে এসে মুখ খুললো পুষ্প। কঠিন গলায় বলল,
-“আমার খেতে ইচ্ছে করছেনা। তোমারা খেয়ে নাও। আর যার ক্ষুধা পাবেনা সে খাবেনা। আমাকে জোর করোনাতো। যখন ক্ষুধা লাগবে আমি খেয়ে নেবো।”

সবাই হতাশ হলো। মীর হোসেন বাড়ি আসলেই মেয়েটা সবার সাথে তেমন খেতে বসেনা। বাবার সাথে কথা বলতে চায়না। মীর হোসেন কখনো জোর দিয়ে কিছু বললে দু’এক শব্দে উত্তর দিয়ে নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সম্পূর্ণ এড়িয়ে চলে।
সবাই খেতে বসে পড়লো। পুষ্পর মা ওর জন্য আলাদা খাবার ফ্রিজে রেখে দিলেন। রাতে ক্ষুধা পেলে খেয়ে নিবে।

★★★

রাত দশটার পর ব্যস্ততা শেষে ফোন তীব্র শব্দে ঝংকার তুললো। ‘ডাক্তার’ শব্দটি ভেসে উঠতেই সমস্ত গ্লানি দূর হয়ে ঠোঁটে এক চিলতে হাসি ফোটে উঠলো।
রাউফুন ভিডিয়ো কল দিয়েছে।
পুষ্প রিসিভ করেই একটুকরো হাসি উপহার দিলো। সালাম বিনিময়ের পর রাউফুন জিজ্ঞেস করলো,
-“কি করছো?”

পুষ্প বলল,
-“মিস করছি।”

রাউফুন শব্দ করে হেসে বলল,
-“বউ দেখি আমাকে চোখে হারাচ্ছে। কিন্তু এখন তো আসতে পারবোনা।”

পুষ্প মন খারাপ করে বলল,
-“থাক কষ্ট করে আসতে হবেনা।”

আজ পুষ্পর চেহারা কেমন শুকনো শুকনো লাগছে। রাউফুন বলল,
-“এমন দেখাচ্ছে কেনো? মন খারাপ হচ্ছে?”

পুষ্প মাথা দুলিয়ে না জানাতেই রাউফুন ফের বলল,
-“কিন্তু আমার তো মনে হচ্ছে তোমার মন খারাপ। খেয়েছো রাতে?”

মিথ্যে বললোনা পুষ্প। বলল,
-“নাহ্! খেতে ইচ্ছে করেনি।”

রাউফুন চোখ রাঙিয়ে বলল,
-“খাবার না খেয়ে একদম ঘুমাবেনা। খেয়ে ঔষধ নিয়ে নাকে স্প্রে করে তারপর ঘুমাবে।”

পুষ্প বাধ্য মেয়ের মতো বলল,
-“আচ্ছা।”

রাউফুন বলল,
-“এখানে খাবার নিয়ে এসো। খেতে খেতেই কথা বলো। পরে দেখা গেলো একা একা তোমার খেতে ইচ্ছে করছেনা।”

পুষ্প দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
-“আনছি।”

ফোন হাতে নিয়েই ফ্রিজ খুললো পুষ্প। খাবার গরম করে ঘরে ফিরে ভিডিয়ো কল সামনে রেখেই খাবার শেষ করলো। মাঝে এটা ওটা বলে রাউফুন হাসিয়েছে। অনেকরাত পর্যন্ত কথা বলে দুজনে ঘুমাতে গেলো।
রাউফুন বেশ কয়েকবার মন খারাপের কথা জিজ্ঞেস করলেও পুষ্প ব্যাপারটা এড়িয়ে গেলো। নিজেদের পারিবারিক কলহ স্বামীকে জানানো সমীচীন মনে করলোনা সে। যা আছে, তা কেবল তাদের বাবা-মেয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকুক। রাউফুনকে সে নিজের হাসিখুশি রূপ দেখাতে চায়।

সকালে ঘুম ভাঙতেই আশ্চর্য হলো পুষ্প। সকাল সকাল রাউফুন এ বাড়িতে এসেছে। সোফায় বসে তার বাবার সাথে কথা বলছে। শশুর-জামাইয়ের এই প্রথম দেখা। পুষ্পর মা কফি বানিয়ে দিয়ে গেছেন। দুজনেই কফিতে চুমুক দিচ্ছে আর খোশগল্প করছে। পুষ্প এগিয়ে যেতেই মীর হোসেন বললেন,
-“ঘুম ভেঙে গেছে মামনী?”

রাউফুনের সামনে নিজের অভিমানটুকু প্রকাশ পেতে দিলোনা পুষ্প। মাথা নেড়ে জানালো তার ঘুম ভেঙে গিয়েছে।
নাস্তা করে এক ফাঁকে রাউফুন পুষ্পর ঘরে গেলো। সে খেয়াল করেছে গতকাল রাতে, তার বউ কোনকিছু নিয়ে আপসেট ছিলো। তাই তাকে সঙ্গ দেওয়ার জন্যই সকাল সকাল শশুর বাড়িতে পদধূলি দিতে এসেছে। এখান থেকে আবার হসপিটালে ছুটতে হবে।

বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলো পুষ্প। পেছন থেকেই দুটো বলিষ্ঠ হাত তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো। ঘাবড়ালোনা সে। এই মুহূর্তে এই ঘরে কে আসতে পারে তা পুষ্পর জানা কথা। রাউফুন ঘাড়ে থুতনি রেখে বলল,
-“মন খারাপ কেনো? কি হয়েছে বলোতো?”

পুষ্প সামনে ঘুরে দুহাতে রাউফুনের গলা জড়িয়ে ধরে বলল,
-“কোথায় মন খারাপ? কিছু হয়নি। আমি ঠিক আছি।”

রাউফুন চোখ ঈষৎ বড় করে বলল,
-“কী সাংঘাতিক! কী সাংঘাতিক! তুমি দেখছি আমার বিরহে জ্বলেপুড়ে যাচ্ছো।”

আলতো হাসলো পুষ্প। এতে রাউফুন আরও নিশ্চিত হলো তার বউয়ের মন ভালো নেই। অন্য সময় হলে রাউফুনের এমন কথায় খিলখিল করে হেসে উঠতো সে। রাউফুন চিবুক ধরে পুষ্পর গালে শব্দ করে চুমু খেয়ে বলল,
-“এখন তো হসপিটালে যেতে হবে। কাজ শেষ করে রাতে লং ড্রাইভে যাবো।”

এতেও বিশেষ একটা খুশির আমেজ দেখা গেলোনা পুষ্পর মাঝে। এবার রাউফুন পুষ্পকে আরেকটু জড়িয়ে নিয়ে বলল,
-“আচ্ছা কি হয়েছে? তুমি না বললেতো আমি বুঝবোনা, তাইনা? বলো কীভাবে তোমার মন ভালো করতে পারি? কেনো মন খারাপ তোমার? আমি কি দোষ করলাম?”

পুষ্প এবার খানিকটা বিরক্ত হলো। সে নিজেদের পারিবারিক বিষয়ের সমস্যা নিয়ে রাউফুনের সাথে কথা বলতে চায়না। কিন্তু রাউফুন তখন থেকেই ওই একই টপিক জানার চেষ্টা করছে। তাই হালকা ঝাঁঝ মেশানো গলায় বলল,
-“উফফ! বললামতো আমার কিছু হয়নি? আমার কি ব্যক্তিগত কিছু থাকতে পারেনা? বিয়ে হলেই কি ব্যক্তিগত বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে হবে?
আপনি কাজ শেষ করে ফোন দেবেন, আমি তেরী হয়ে থাকবো।”

রাউফুন দমে গেলো। ভেতরে কোথাও একটা সূক্ষ্ম ব্যথা অনুভব করলো। খোঁচাটা বুকেই লেগেছে। আসলে সেই বেহায়া। যার কারণে বারবার সে নিজেই এখানে ছুটে আসে।
স্বামী-স্ত্রী মাঝে যে সুন্দর একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে, সেটা এখনো তাদের মধ্যে হয়ে ওঠেনি। শুধুমাত্র কবুল বলে শারীরিক চাহিদা মেটানোকেই সংসার জীবন বলেনা। সংসার হলো আস্ত এক ভালোবাসা, মায়া নামক বেড়াজাল। সে পুষ্পকে এখনো সেই বেড়াজালে আটকাতে পারেনি। হ্যাঁ প্রতিটি মানুষেরই একান্ত বলে কিছু একটা থাকে, তাই বলে স্বামী তার স্ত্রীকে মন খারাপের কথা জিজ্ঞেস করবেনা?
রাউফুন খুব হাস্যরসিক মানুষ, তবে পুষ্পর কথাটায় খুব গভীর ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে। সে চাইলেই ব্যাপারটা অন্যভাবে সামলে নিতে পারতো।
আপনি যখন কাউকে কোনো বিষয়ে জানাতে চাননা, তবে তার সামনে স্বাভাবিক থাকুন। তার সামনে কেনো নিজেকে আপসেট দেখিয়ে তার মনে কৌতুহলের বীজ বুনেন?

রাউফুন কিছুটা দূরে সরে গেলো। নরম গলায় বলল,
-“আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে, আমি আসছি। নিজের দিকে খেয়াল রেখো।”

রাউফুন চলে গেলে পুষ্প বুঝতে পারলো একজনের রাগ অন্যজনের উপর ঝাড়া উচিত হয়নি। মনে মনে রাগ, অভিমান পুষে রাখাও উচিত নয়। যাথা সম্ভব সামনাসামনি, স্পষ্টভাষী হয়ে তার সাথে কথা বলা উচিত। বাবাকে বলা উচিত আপনার লোকদেখানো ভালোবাসা আমার সহ্য হচ্ছেনা। রাউফুনকে কেনো জেদ দেখালো? বিষয়টি নিয়ে পুষ্প সারাদিন মন খারাপ করে থাকলেও রাতে রাউফুনের দেওয়া একটা শাড়ি পরে তৈরী হয়ে নিলো। কিন্তু রাউফুন আসলোনা। পুষ্প নিজ থেকে যতবার ডায়াল করেছে, ততবারই রিং হয়ে কে’টে গিয়েছে।
পুষ্প নিশ্চিত হলো রাউফুন তার কথায় কষ্ট পেয়ে আসেনি। এমন পাগলাটে প্রেমিককে কষ্ট দেওয়া তার উচিত হয়নি! একদমই উচিত হয়নি।
বহুবছর পর পুষ্পর চোখ ভিজে উঠলো। একফোঁটা, দু’ফোঁটা করে টপটপ বারি হলো, অশ্রুবারি।

#চলবে………

গল্প পোকা
গল্প পোকাhttps://golpopoka.com
গল্পপোকা ডট কম -এ আপনাকে স্বাগতম......
RELATED ARTICLES

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments

Md masrur Hasan mahi على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
আমিনুল ইসলাম على প্রয়োজন পর্ব: ৩০ ( অন্তিম)
সাজিবুল ইসলাম على ধর্ষিতাবউ২ ৯ তথা শেষ পর্ব
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
Nita Sarkar على স্বপ্নীল ৬৮
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على রহস্য শেষ_পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على অলক্ষ্যে তুমি পর্ব-০৬ এবং শেষ পর্ব
Nazmun Nahar Akhi على Psycho_is_back? part_7
Nazmun Nahar Akhi على Dangerous_Villian_Lover part 2
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على জানালার ওপারে পর্ব-১৭ এবং শেষ পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على লীলা বোর্ডিং ১২১৫ পর্ব-১১ এবং শেষ পর্ব
মিজানুর রহমান রাহুল على সেই তুমি পর্ব-০১
@feelings على প্রহেলিকা
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Nusrat jahan على coffee & vanilla Part-10
Pallabi Roy على স্বপ্নীল ৬৮
M.D Mahabub على The_Villain_Lover Part_2
Labani sarkar على Dangerous_Villain_Lover part 23
MD Akas Apc على বিবেক
Tanisha Ahmed على Devil love part-18 
Aius Barmon shorob على নারীর দেহকে নয়
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Priya Banerjee على devil love married life last part
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Riya Biswas على তুমি রবে ৫২
Mohammad Adib على তুমি রবে ৬০
Avni Ayesha على তুমি রবে ২৮
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
সুমিত على তুমি রবে ২৮
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
Samiah Begum على তুমি রবে ৫১
biddut das rocky على নর নারী
গল্প পোকা على নষ্ট গলি শেষ পর্ব
Md Jobayer Hossain Shohag على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على দুই অলসের সংসার
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤৪২.
A.J.S Rakib على মন ফড়িং ❤৪২.
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
Samiya noor على গল্পঃ ভয়
Sadikul على গল্পঃ ভয়
Samia Islam على গল্পঃ ভয়
শূন্য মায়া على মন ফড়িং ❤ ৪০.
Sutapa biswas على মন ফড়িং ❤৩৯.
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৮.
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৭
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
Siyam على বিবেক
Sudipto Guchhait على My_Mafia_Boss পর্ব-৯
saptami karmakar على devil love married life last part
saptami karmakar على devil love married life last part
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ২৬.
Shreyashi Dutta على  বিয়ে part 1
Sandipan Biswas على  বিয়ে part 1
Paramita Bhattacharyya على অনুরাগ শেষ পর্ব
জামিয়া পারভীন তানি على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
মায়া على মন ফড়িং  ২২
সুরিয়া মিম على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على মন ফড়িং ২১
গল্প পোকা على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
Sahin ssb على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৮. 
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৭.
Jannatul Ferdous على খেলাঘর পর্ব-৩৫
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ফাল্গুনের_ফুল last_part_8
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ছাত্রী যখন বউ পাঠঃ ১
গল্প পোকা على বাজির প্রেম পাঠঃ ১
Foujia Khanom Parsha على মা… ?
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৮
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
Ibna Al Wadud Shovon على স্বার্থ