Sunday, October 5, 2025







বাড়ি"ধারাবাহিক গল্প"উড়ো পার্সেলউড়ো পার্সেল পর্ব -৯(অন্তিম পর্ব)

উড়ো পার্সেল পর্ব -৯(অন্তিম পর্ব)

গল্প:#উড়ো পার্সেল(অন্তিম পর্ব)
লেখা:#নাজিফা_তাবাসসুম
মধ্যরাতে জায়ান বাড়ি ফিরে দেখল, তার বাবা ইমতিয়াজ আহমেদ এতক্ষণ অপেক্ষা করছিলেন; তার ফিরে আসার। জায়ানের বাসায় ফিরতে দেরি হতে দেখে ইমতিয়াজ আহমেদ বেশ গম্ভীর গলায় বললেন, “ইদানিং তুমি দেখছি নিজের মতো থাকছো….. নিয়মকানুনের কোন পরোয়া করছো না। বেপরোয়া ভাবে চলাফেরা করছো”।

– “আমি কারোর হাতের পুতুল না; যে আমাকে যেভাবে করে চালনা করবে আমি সেভাবেই থাকবো… আমারও ব্যক্তিগত জীবন আছে। সেখানে কারো অনধিকার প্রবেশ আমি গ্রহন করবো না”।

ইমতিয়াজ আহমেদ বেশ অবাক হয়ে তার ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তুমি কি কোন কারনে আমার উপর রাগ করেছো? এভাবে কথা বলছো কেন”?

জায়ান চিৎকার করে উত্তর দিল, “আমার রাগ করাটাই কি আমার স্বাভাবিক নয়? আমার জীবনের প্রত্যেকটি মুহূর্ত তুমি নিয়ন্ত্রণ করছো। একটি মুহূর্ত তুমি আমাকে আমার নিজের মতো করে বাঁচতে দিচ্ছো না! আমি আমার নিজের মতো করে বাঁচতে চাই”!!

জায়ানের আকস্মিক এরকম ভয়াবহ রাগ দেখে ইমতিয়াজ আহমেদ হকচকিয়ে গেলেন।
তিনি শুকনো গলায় তার ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন,”অবশ্যই তুমি তোমার নিজের মতো করে বাঁচবে। আমি তো তোমার জীবন যাপনে কোন প্রকার বাধা প্রদান করছি না; যে তুমি এতটা উত্তেজিত হয়ে যাচ্ছ”!!
জায়ানের তার বাবার উপর প্রচন্ড রাগ হল। সে রেগে গেলে নিজেকে সামলাতে পারে না। এবারও তার ব্যতিক্রম হলো না। জায়ান তার পাশে থাকা বড় ফুলদানিটা হাতে তুলে নিল। সে কোন কিছু চিন্তাভাবনা না করেই তার হাতে থাকা ফুলদানিটি তার বাবার দিকে ছুড়ে মারল।
ইমতিয়াজ আহমেদ দ্রুত সরে গেলেন। ফুলদানিটি তার পাশ ঘেষে গিয়ে দেয়ালে লেগে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। তিনি বিস্ফোরিত চোখে তার ছেলের দিকে তাকিয়ে থাকলেন।জায়ানের এই ধরনের আচরণ দেখে তিনি প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেলেন।

জায়ান তার বাবার ভয়ার্ত তো দৃষ্টি অগ্রাহ্য করে নিজের রুমের দিকে হন্তদন্ত করে হেঁটে চলে গেল। ইমতিয়াজ আহমেদকে কানে বিকট শব্দ ভেসে আসলো। তিনি বুঝতে পারলেন জায়ান শব্দ করে তার ঘরের দরজা বন্ধ করেছে।

ইকবাল হোসেন চিন্তিত হয়ে গেলেন। তবে কি জায়ানের সেই সমস্যা গুলো কি আবার ও ফিরে আসছে!!

নিশাত বিরক্ত হয়ে তার ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে।গত চার দিন ধরে জায়ানের কোন হদিস মিলছে না। তার জন্মদিনের পর প্রায় ছয় মাস কেটে গেছে। তার সাথে জায়ানের সম্পর্কটা বেশ গাঢ় হয়ে উঠেছে। কিন্তু; এর মধ্যেই জায়ানকে একটু অন্যভাবে নিশাত লক্ষ্য করেছে। জায়ানের আচরণ যেন দিনকে দিন পাল্টে যাচ্ছে।গত চারদিন ধরে জায়ানের ফোন বন্ধ। নিশাত প্রায় হাজারের উপরেও তাকে ফোন দিয়েছে।তাও তার সাথে কথা হয়নি।

জায়ানের নিশাতের বাসায় আসার কথা ছিল। তার বাবা মার সাথে দেখা করার জন্য। কিন্তু জায়ান সেই কথা রাখেনি। নিশাতের প্রচণ্ড রাগ উঠেছে। রাগে তার নিজের মোবাইল আছড়ে ভেঙে ফেলতে ইচ্ছা করছে। তবু সে নিজেকে সামনে নিল।
জায়ান যা করছে সেটা মোটেও ঠিক না নিশাত বুঝতে পারছে। তার মা-বাবা জায়ানের সাথে তার সম্পর্কের কথা জেনে গিয়েছে।
সেজন্যই মূলত তার বাবা জায়ানকে তাদের বাসায় আসতে বলেছিল। নিশাত প্রথমে জায়ানকে তাদের বাসায় আসার জন্য বলাতেই জায়ান এক বাক্যে রাজি হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তারপর থেকেই তার নানা রকম টালবাহানা শুরু হয়ে গেছে।
প্রথমবার নিশাতের পরিবার সব ধরনের আয়োজন করে রেখেছিল, জায়ানের তাদের বাসায় আসার উপলক্ষে। কিন্তু সে সেদিন আসলো না তার গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাজের অজুহাত দেখিয়ে। ইকবাল হোসেন মেনে নিলেন। তিনি বললেন, আচ্ছা আরেকদিন না হয় দেখা আসবে।
এর কিছুদিন পর দুপুরের খাবার জন্য আরেকবার তাকে দাওয়াত দেওয়া হলো। সেবার জায়ান ফোন বন্ধ করে রাখল। জায়ান আবার ও অজুহাত দিল সে খুবই গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাজে ব্যস্ত আছে। তার পক্ষে আজকে আসা সম্ভব না।
কিন্তু, নিশাত লক্ষ্য করেছে তার পরিবারের সবাই যেন জায়ানের ওপর কিছুটা বিরক্ত হয়েছে। গত চার দিন আগেও জায়ানের তৃতীয়বারের মতো তাদের আসার কথা ছিল। কিন্তু আসার আগ মুহূর্ত থেকেই তার ফোন বন্ধ।
এ বিষয়গুলো দেখতে দেখতে নিশাতের অনেক রাগ হয় জায়ানের উপর। এতটা রাগ হলো যে সে কিছুতেই সহ্য করতে পারছে না।
নিশাত ঈশিতাকে তার কাছে ডেকে নিল। ঈশিতা তাকে জিজ্ঞেসা করলো,”আপু কি হয়েছ”?

– “আচ্ছা; শোন আমাদের আলমারিতে যতগুলো গিফটের বাক্স আছে সবগুলো আমি এই তিনটা সুটকেসে রাখবো। তুই আমাকে সাহায্য কর”।

– “আপু…হঠাৎ কেন”?

– “এই গিফট গুলো আমি জায়ানকে রিটার্ন করে দেব”।
– “কেন আপু? কি হলো হঠাৎ”? ঈশিতা চিৎকার করে নিশাতকে জিজ্ঞেস করল।

– “আমি গিফট গুলো রাখতে চাচ্ছি না। আমি জায়ানকে এগুলো ফিরিয়ে দিব। আর আমার উপরে তুই কোন কথা বলবি না। যদি সাহায্য করতে পারিস তাহলে কর, না হলে চলে যা”।

ঈশিতা অনিচ্ছা স্বত্বেও নিশাতকে সাহায্য করতে রাজি হল। কারন সেও জায়ানের এই ধরনের দায়সারা গোছের আচরণে বিরক্ত । গত কিছুদিন ধরে জায়ান তাদের পরিবারের সাথে যে কাজটা করে আসছে সেটি খুবই খারাপ লাগছে। প্রত্যেকবার সে তাদের বাসায় আসার আশ্বাস দিয়ে পরে তার কোন খোঁজ খবর পাওয়া যাচ্ছে না।

ইমতিয়াজ আহমেদ বিজনেস ট্রিপের জন্য মালয়েশিয়া যাচ্ছিলেন। তিনি তার বাসা থেকে বের হওয়ার সময় একটি অদ্ভুত বিষয় লক্ষ্য করলেন। তিনটি বড় সুটকেস তাদের কেয়ারটেকার দরজার সামনে এনে রাখলো।
তিনি বেশ অবাক হয়ে তাদের কেয়ারটেকার রহিম মিয়াকে জিজ্ঞেস করলেন,”এই সুটকেস কে দিয়েছে”?

– “জানিনা স্যার। দুইটা আপা এসে দিয়ে গেল”।

ইমতিয়াজ আহমেদ লক্ষ করলেন তার পাশে জায়ান এসে দাঁড়িয়েছে। সে সুটকেসটি দেখে মনে হল না খুব একটা বিস্মিত হয়েছে।
জায়ান তাকে বললো, “বাবা তুমি যেখানে যাচ্ছিলে যাও। সব কিছুর মধ্যে তোমাকে ঢুকতে হবে না”।

তিনি অবাক হয়ে বললেন, কেন?কে বা কে একটা জিনিস পাঠিয়ে সেটা দেখতে হবে না?

– “নিশাত পাঠিয়েছে এটা”।

– “নিশাত কেন পাঠাবে? কি পাঠিয়েছে?”

– “আমি এতদিন নিশাতকে যা যা পাঠিয়েছি সেই সবকিছু নিশাত রিটার্ন করে দিয়েছে”।

– “তুমি কিভাবে বুঝলে? সুটকেস তো এখনো খোলা হয়নি”।

-“আমি জানি এটাই হয়েছে।কারণ আমি নিশাতের সাথে সম্পর্কটা শেষ করে দিয়েছি”।

– “মানে!! কি বলছো এসব?তুমি তো নিশাতকে নিয়ে অনেক সিরিয়াস ছিলে। হঠাৎ করে তোমার ভিতরে এরকম পরিবর্তন আসার কারণ কি”?

– “বাবা কারণটা তুমিও জানো, আমিও জানি। আমার মতো এরকম একজন অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মানুষের সাথে নিশাতের জীবন জড়িয়ে নিশাতকে কষ্ট দেওয়ার কোন মানে নেই। সেজন্যই আমি এখানেই আমাদের সম্পর্কটা শেষ করে দিলাম। তবে আমি যা করেছি তার জন্য আমি অনুতপ্ত। নিশাতের সাথে আমার সম্পর্কটা একদমই করা উচিত হয়নি। আমি এখন বুঝতে পারছি”, জায়ান কথাগুলো বলেই চুপ হয়ে গেল।
ইমতিয়াজ আহমেদ কিছু বললেন না। বেশ কিছুক্ষণ পর তিনি নীরবতা ভেঙে বললেন, “জায়ান তোমার ট্রিটমেন্টের সময় চলে এসেছে। আমাদের আমেরিকা ফিরে যাওয়া উচিত। আমার মনে হচ্ছে তোমার স্কিনের ইনফেকশনটা আরো বেড়ে গিয়েছে”।

জায়ানন মৃদু গলায় বলল, “আমার জীবনটা এখানেই থেমে যাবে”। আমি সেটা বুঝতে পারছি। আমার শারীরিক অসুখ কিংবা মানসিক অসুখ কোনটিই কোনদিন সারবে না”।

ইমতিয়াজ আহমেদ তার ছেলের কথা শুনে বললেন, দেখো জায়ান,নিজেকে কেন এত কষ্ট দিচ্ছ? একজন এক্সপি পেশেন্ট হয়ে বেঁচে থাকাটা খুব একটা সহজ নয়, আমি জানি। কিন্তু এতটাও কঠিন নয় বেঁচে থাকা। নিজেকে তুমি বছরের উপর বছর কষ্ট দিয়ে আসছো।

জায়ান হাসার ব্যর্থ প্রচেষ্টা করে বলল, “হ্যাঁ। ঠিকই বলেছো আমার বেঁচে থাকাটা সহজ নয়। আমি একজন এক্সপি পেশেন্ট। আমি “জেরোডার্মা পিগমেন্টোসাম” এ আক্রান্ত। যার সারাটা জীবন অন্ধকারে কাটবে, যে সূর্যের আলোর নিচে কোনদিন যেতে পারবে না। যা সারাটা জীবন অন্ধকারাচ্ছন্ন; তার বেঁচে থাকাটা সহজ নয়। আমাকে নিশাচর প্রাণী হয়ে বাঁচতে হবে। আমি অন্য পাঁচ-দশটা মানুষের মত নই। আমি সকালে বাইরে যেতে পারি না। দিনের আলো আমার জন্য অভিশাপ। সূর্যের আলোর নিচে দাঁড়াতে পারি না। নিজের কোন প্রয়োজন থাকলেও যেতে পারিনা।রাতের অপেক্ষায় থাকতে হয়। অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে রাত নামলে আমায় বেরোতে হয়। এরকম একটা জীবন থাকার চেয়ে কি না থাকাটাই ভালো নয়?আমার স্কিন সূর্যের আলোতে পুড়ে যাবে। আমাকে নিজেকে আত্মগোপন করে লুকিয়ে থাকতে হয়। কখনো আমি স্বাভাবিক মানুষের মতো বাঁচতে পারব না।আমার মত একটা মানুষের জীবনের সাথে নিশাতের জীবন জড়িয়ে আমি বড্ড ভুল একটা কাজ করতে চাচ্ছিলাম। সেটা আমি বুঝতে পেরেছি। সেজন্য আমি নিশাতকে মুক্তি দিয়ে দিলাম। হ্যাঁ, বাবা তুমি ঠিকই বলেছ… আমার আমেরিকাতে ফিরে যাওয়া উচিত। এখানে আমার থাকা সম্ভব নয়।

ইমতিয়াজ আহমেদের তার ছেলের কথা শুনে কষ্ট বুকটা ফেটে যাচ্ছিল। তার চোখের কোনে পানি জমলো। জায়ান তার নিজের ভিতরে তার এই কষ্টগুলো সব সময় লুকিয়ে রাখে। তার ছেলে এমন একটি বিরল রোগে আক্রান্ত; যে রোগ সম্পর্কে হয়তোবা অনেক মানুষ জানেই না। সারা পৃথিবীতে খুব কম মানুষেরই এই রোগটি আছে। জায়ানের মায়েরও এই রোগটি ছিল। তার কাছ থেকে জায়ানের মাঝে অসুখটি এসেছে।
ব্যবসায়িক স্বার্থে আজ পর্যন্ত জায়ানের মায়ের মৃত্যুর কারন সবার কাছ থেকে তাকে লুকিয়ে রাখতে হয়েছে। জায়ানের মায়ের মৃত্যু অগ্নি দুর্ঘটনায় ঘটেনি; ঘটেছিল এই অসুখের কারণে। অনেক কষ্টে জায়ানের মা মারা গিয়েছিল। জায়ান আজ পর্যন্ত নিজেকে মৃত ভাবে। সারা পৃথিবী জানে জায়ান মৃত। সে তার মায়ের সাথে মারা গিয়েছিল, আট বছর আগে।
ইমতিয়াজ আহমেদের নিজেকে খুব ছোট মনে হতে লাগলো। তিনি কিভাবে পারলেন তার ছেলেকে সবার সামনে মৃত মানুষ রূপে সাজিয়ে রাখতে?হয়তোবা তিনি মানুষটা বড্ড খারাপ!!

————————–

নিশাতের মনে হল বিপদ যখন আসে চারদিক থেকেই আসে। এমন একটা সময় তারা পার করছে যে সময়টা তাদের অনুকূলে নেই। বর্তমানে ইকবাল হোসেনের কোন চাকরি নেই, রাহেলা বেগমের ও অপারেশনের ডেট এসে পড়েছে। রাহেলা বেগমকে হসপিটালে ভর্তি করাতে হয়েছে। তাদের তিন মাসের বাসা ভাড়া বাকি পড়েছে, হসপিটালের বিল সব মিলিয়ে জীবনটা যেন ঝামেলায় ভরপুর।
এর মধ্যে নিশাত মানসিক দহনে জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। জায়ানের সাথে তার এক মাস ধরে কোন প্রকার যোগাযোগ নেই। জায়ান তাদের সম্পর্কটা সেখানে শেষ করে দিয়েছে। নিশাত বুঝতে পারছে, তবে এই মুহূর্তে তার করারও কিছু নেই। এসব বিষয় ঝেড়ে ফেলে দিয়ে জীবনে এগিয়ে যাওয়াটাই মুখ্য তার কাছে।

নিশাত হসপিটালের করিডোরে পায়চারি করছিল। সে লক্ষ্য করলো, ঈশিতা তার কাছে এগিয়ে আসছে।
ঈশিতা তার কাছে এসে ক্লান্ত গলায় বলল, “আপু কোন কিছু ভালো লাগছে না। খুব কষ্ট হচ্ছে…. জানো মায়ের কষ্ট আর দেখতে পারছি না। আমার না মরে যেতে ইচ্ছা করছে”।

ছোট বোনের কথা শুনে নিশাতের খুব খারাপ লাগলো। ঈশিতার ভিতরে সেই ছটফটে ভাব আর নেই। আস্তে আস্তে সে যেন ঝিমিয়ে যাচ্ছে। তার ছোট্ট বোনটি বাস্তবতা বুঝতে শিখছে। তার ভিতরে বিরাট এক পরিবর্তন আসছে….. নিশাত বুঝতে পারল।

নিশাত ঈশিতাকে সান্ত্বনা দেওয়ার উদ্দেশ্যে বলল, “এত কষ্ট পাওয়ার কিছুই নেই‌। দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে। মার অপারেশনটা সাকসেসফুল হবে। বাবার চাকরি হবে। বাসা ভাড়া দিতে পারব। আমার পড়াশোনা শেষে একটা বড় চাকরি করব। আমাদের আর কোন প্রকার অর্থনৈতিক সমস্যায় থাকবে না”।

ঈশিতা তার দিকে তাকিয়ে আস্তে করে বলল, “আজ মায়ের অপারেশন। আমার খুবই ভয় লাগছে। আপু, ডাক্তার কিন্তু পুরোপুরি বলেনি; মার অপারেশনটা হলে মা সুস্থ হয়ে উঠবে। তিনি বলেছেন অপারেশনটা সাকসেসফুল নাও হতে পারে।আপু যদি মায়ের কিছু একটা হয়ে যায়, তবে আমি বাঁচবো কি করে”??

তার কথা শুনে নিশাতের বুকটা কেঁপে উঠল। তাও সে শক্ত গলায় বলল, “ধুর পাগলি!! কিছুই হবে না দেখবি সব ঠিক মত হয়ে যাবে”!!

যদি নিশাতের কথা মতই সবকিছু হত; তবে হয়তোবা বেশ ভালই হতো। কিন্তু তেমন কিছুই হলো না।ভোর চারটার দিকে ছয় ঘন্টার অপারেশন শেষে…. অপারেশন টেবিলেই রাহেলা বেগম মারা গেলেন। তিনি ইহকালের সকল মায়া ত্যাগ করে পরকালের দিকে পাড়ি জমালেন।

——————————-

ছয় বছর পর,

একদিন সকালে দেশ থেকে জায়ানের কাছে একটি পার্সেল আসলো। জায়ান বেশ অবাক হল। হঠাৎ কাছে কে পার্সেল পাঠাতে পারে!! সে বর্তমানে লস অ্যাঞ্জেলেস আছে। গত ছয় বছর আগেই বাংলাদেশ থেকে চিরতরে বিদায় নিয়ে সে আমেরিকায় চলে এসেছে। তবে দেশ থেকে তার কাছে পার্সেল কে করতে পারে? সেটা তার কাছে খুবই অস্বাভাবিক লাগলো।

জায়ান পার্সেলটি হাতে তুলে নিলো।
একটা অতি সাধারণ বাক্স। তার উপরে কালো মার্কার দিয়ে খুবই পরিচিত একজনের নাম স্পষ্ট লেখা। জায়ান বেশ অবাক হয়ে পড়ল, “নিশাত”!!!
এত বছর পরে নিশাত তাকে কি পাঠাতে পারে? আর নিশাত কিভাবেই বা জানবে তার ঠিকানা?

সে দ্রুত বাক্সটি খুলল। বাক্সটি খুলে তার হাতে খুবই পরিচিত একটি জিনিস আসলো। একটা কালো ডায়েরী। এই ডায়েরীটা সে নিশাতকে দিয়েছিল। গিফট হিসাবে।
নিশাত তার পাঠানো সকল পার্সেল ফিরিয়ে দিলেও এই ডায়রীটি দেয়নি। কখনো তার এ সম্পর্কে কিছু মনেও ছিল না। সে ডায়রী খুললো, ডায়েরীর প্রথম পাতায় গোটা গোটা হরফে লেখা,

“প্রিয় জায়ান”,
আশা করি তুমি ভালো আছো। আমি সৃষ্টিকর্তার দয়ায় ভালই আছি। জায়ান তোমাকে বেশ কিছু কথা বলার ছিল।
যে কথাগুলো হয়তোবা কখনোই বলা হতো না। তোমার ঠিকানা অনেক কষ্টে ম্যানেজ করেছি। ছয় বছর লেগে গেছে…. প্রথমে ভেবেছিলাম তোমার সাথে ফোনে কথা বলবো কিংবা মেসেজ করব। কিন্তু, কোন কিছুই করতে ইচ্ছা করলো না। ইচ্ছে করলো তোমার তোমার দেওয়া এই ডায়েরীতে আমার কিছু মনের কথা লিখে পাঠিয়ে দিই তোমার কাছে।
তুমি আমার কাছ থেকে দূরে সরে গেছো, তাতে আমার বিন্দুমাত্র আক্ষেপ নেই। কারণ আমাদের সম্পর্কটা কখনোই কোন রূপ নেয়নি। সম্পর্ক সৃষ্টি হওয়ার আগেই তুমি ভেঙে দিয়েছো। হয়তোবা ভেবেছো আমি তোমার সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। সত্যি কথা বলতে বিষয়টা এমনটি না, আমি জানতাম তুমি একটি বিরল রোগে আক্রান্ত। কিভাবে জানতাম? জানাটাও খুব একটা বিচিত্র নয়। আমি তোমার বন্ধু হিমেলের কাছ থেকে সবকিছু জেনেছিলাম।তুমি দেশ থেকে চলে যাবার পর সে আমার সাথে যোগাযোগ করছিলো।
হয়তো তোমার কাছে বলিনি। তাই বলে তুমি যদি মনে কর, আমি তোমার সম্পর্কে কিছুই জানিনা… তবে ভুল করছো।
তুমি আমাকে কিছু না জানিয়েই হঠাৎ করে আমার সাথে সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেছিলে। তুমি কি জানো, আমি ভীষণ কষ্ট পেয়েছিলাম। যন্ত্রনায় আমি রাতে ঘুমাতে পারতাম না। শুধু একটাবার তোমার সাথে কথা বলতে চাইতাম। কিন্তু পারিনি…. তোমার সাথে ঠিক কথা বলে উঠতে আমার ছয়টা বছর লেগে গেল। এর মাঝে অনেক কিছুই হয়ে গিয়েছে। জীবনে অসংখ্য পরিবর্তন এসেছে। আমার মা মারা গিয়েছে। যন্ত্রণায় দিনের পর দিন পার করেছি।
তোমাকে না পাওয়ার কষ্টটা মা হারানো যন্ত্রণা থেকে খুব একটা বেশি ছিল না। আমি নিজেকে সামলে নিয়েছিলাম। আমি ভেবেছিলাম আমার দুঃসময়ে তুমি আমার পাশে আসবে। আমার কাঁধে হাত রেখে সাহস যোগাবে। কিন্তু তুমি এমনটির কোন কিছুই করনি….তাতেও আমার তোমার প্রতি কোনরকম অভিযোগ নেই।
আমি তোমাকে বারবার ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করেছি কিন্তু পারিনি। তবে শেষ পর্যন্ত হয়তোবা আমি পেরেছি!!! আমি এতোটুকুতেই অনেকটা আনন্দিত কারণ….. জীবনের কিছুটা সময় হলেও তোমার মত একটা বন্ধু পেয়েছিলাম।

যাই হোক শেষ কথায় আসি, নভেম্বরের ১৮ তারিখ আমার বিয়ে। তুমি আমার বিয়েতে অবশ্যই আসবে। তোমাকে কোন প্রকার কষ্ট কিংবা দুঃখ দেয়ার জন্য আমি তোমাকে নিয়ন্ত্রণ জানাইনি।

আমি তোমার জীবনের একটা অধ্যায়….যেটা গত ছয় বছর আগেই শেষ হয়ে গিয়েছে…. তুমিও আমার জীবনের একটা অসম্পূর্ণ অধ্যায়। আমি মনে করি, কোনো কিছু যখন শেষ হয়ে যায়, তখন সেটাকে শেষ হতে দেওয়াই উচিত। সেটাকে আঁকড়ে ধরে রেখে আর লাভ নেই। আশা করি তুমি আমার বিয়েতে আসছো।

ইতি,
তোমার বন্ধু “নিশাত”।

জায়ান লক্ষ্য করল, ডায়েরীর বেশ কয়েক পাতা পর, একটা বিয়ের কার্ড রাখা। সে ভীষণ অবাক হল নিশাত এত বছর পরে তাকে হঠাৎ মনে করলো।

জায়ান নিশাতের বিয়ের কার্ড টা দেখে মৃদু হাসলো। এই নিশাত নামের মেয়েটি জীবনের একটা সময় হলেও তাকে ভালোবেসে ছিল। এটাই তা তার জীবনের কম পাওয়া নাকি!!! জায়ানের অদ্ভুদ এক মিশ্র অনুভূতি হল। সে কি কষ্ট পাবে নাকি আনন্দিত হবে!! সে বুঝতে পারল না?
তবে এটা বুঝতে পারল, জীবনের অনেক কিছুই পরিণতি পায় না…. তার জন্য কখনো জীবন থেমে থাকে না। জীবন…. জীবনের আপন গতিতে চলতে থাকে। তাদের সম্পর্কটা হয়তোবা এরকম অপরিণতই থাকবে চিরকাল। কিন্তু; তাদের সময়টা হয়তোবা কখনোই পৃথিবীর বুক থেকে মুছে যাবে না।

(সমাপ্ত)

পূর্ববর্তী নিবন্ধ
পরবর্তী নিবন্ধ
গল্প পোকা
গল্প পোকাhttps://golpopoka.com
গল্পপোকা ডট কম -এ আপনাকে স্বাগতম......
RELATED ARTICLES

1 মন্তব্য

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments

Md masrur Hasan mahi على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
আমিনুল ইসলাম على প্রয়োজন পর্ব: ৩০ ( অন্তিম)
সাজিবুল ইসলাম على ধর্ষিতাবউ২ ৯ তথা শেষ পর্ব
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
Nita Sarkar على স্বপ্নীল ৬৮
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على রহস্য শেষ_পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على অলক্ষ্যে তুমি পর্ব-০৬ এবং শেষ পর্ব
Nazmun Nahar Akhi على Psycho_is_back? part_7
Nazmun Nahar Akhi على Dangerous_Villian_Lover part 2
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على জানালার ওপারে পর্ব-১৭ এবং শেষ পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على লীলা বোর্ডিং ১২১৫ পর্ব-১১ এবং শেষ পর্ব
মিজানুর রহমান রাহুল على সেই তুমি পর্ব-০১
@feelings على প্রহেলিকা
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Nusrat jahan على coffee & vanilla Part-10
Pallabi Roy على স্বপ্নীল ৬৮
M.D Mahabub على The_Villain_Lover Part_2
Labani sarkar على Dangerous_Villain_Lover part 23
MD Akas Apc على বিবেক
Tanisha Ahmed على Devil love part-18 
Aius Barmon shorob على নারীর দেহকে নয়
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Priya Banerjee على devil love married life last part
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Riya Biswas على তুমি রবে ৫২
Mohammad Adib على তুমি রবে ৬০
Avni Ayesha على তুমি রবে ২৮
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
সুমিত على তুমি রবে ২৮
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
Samiah Begum على তুমি রবে ৫১
biddut das rocky على নর নারী
গল্প পোকা على নষ্ট গলি শেষ পর্ব
Md Jobayer Hossain Shohag على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على দুই অলসের সংসার
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤৪২.
A.J.S Rakib على মন ফড়িং ❤৪২.
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
Samiya noor على গল্পঃ ভয়
Sadikul على গল্পঃ ভয়
Samia Islam على গল্পঃ ভয়
শূন্য মায়া على মন ফড়িং ❤ ৪০.
Sutapa biswas على মন ফড়িং ❤৩৯.
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৮.
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৭
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
Siyam على বিবেক
Sudipto Guchhait على My_Mafia_Boss পর্ব-৯
saptami karmakar على devil love married life last part
saptami karmakar على devil love married life last part
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ২৬.
Shreyashi Dutta على  বিয়ে part 1
Sandipan Biswas على  বিয়ে part 1
Paramita Bhattacharyya على অনুরাগ শেষ পর্ব
জামিয়া পারভীন তানি على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
মায়া على মন ফড়িং  ২২
সুরিয়া মিম على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على মন ফড়িং ২১
গল্প পোকা على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
Sahin ssb على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৮. 
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৭.
Jannatul Ferdous على খেলাঘর পর্ব-৩৫
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ফাল্গুনের_ফুল last_part_8
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ছাত্রী যখন বউ পাঠঃ ১
গল্প পোকা على বাজির প্রেম পাঠঃ ১
Foujia Khanom Parsha على মা… ?
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৮
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
Ibna Al Wadud Shovon على স্বার্থ