Monday, October 6, 2025







বাড়ি"ধারাবাহিক গল্প"গুমোট অনুভুতি পর্ব-২৯+৩০+৩১

গুমোট অনুভুতি পর্ব-২৯+৩০+৩১

#গুমোট_অনুভুতি
#লিখাঃ Liza Bhuiyan
#পর্ব_২৯

সায়ান রুশির চোখের দিকে তাকালো, রুশির চোখজোড়া টলমল করে উঠছে। চোখমুখ শুকিয়ে আছে আর নাকের ডগা লাল হয়ে আছে, চেহারা দেখে মনে হচ্ছে না রুশি রেগে আছে বরং অভিমানে ছেয়ে আছে চোখেমুখে! সায়ান রুশির দিকে সামান্য এগিয়ে এলো,রুশি নিজের স্থান থেকে একচুলও নড়ে নি বরং সায়ানের এগিয়ে আসা দেখে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো চোখের কার্নিশ বেয়ে তবুও সায়ানের থেকে দৃষ্টি সরায়নি। সায়ান আলতো করে চোখের পানি মুছে দিলো তারপর নরম স্বরে বললো

“কেউ কিছু বলেছে তোমায়?”

রুশি মুখ ঘুরিয়ে নিলো তারপর জড়ানো কন্ঠে বললো

“নাহ কেই কিছু বলেনি, এটা আমার নিজের সিদ্ধান্ত”

সায়ান নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রাখার চেষ্টা করলো, চোখ বন্ধ করে জোরে শ্বাস নিয়ে আবার বলে উঠলো

“হঠাৎ এমন সিদ্ধান্ত মানুষ এমনিই তো নেয়না তার পেছনে যথেষ্ট কারণ থাকে। তোমাকে আমি খুব ভালো করে চিনি, কারণ হুট করে এমন কথা বলার মেয়ে তুমি না। আমাকে বলো কি হয়েছে!”

“আমি আপনার সাথে কোন কৈফিয়ত দিতে রাজি নই, আমার ইচ্ছে হয়েছে তাই আমি বলেছি। আমার ডিভোর্স চাই আর আপনি আমাকে তা দিবেন।আমি আপনার সাথে থাকতে চাইনা”

সায়ান রুশির একদম কাছে এসে ওর বাহু চেপে ধরলো তারপর চড়া কন্ঠে বললো

“তখন থেকে ডিভোর্স ডিভোর্স করে যাচ্ছো! কি করেছি আমি তোমাকে যার জন্য হুট করে এমন কথা বলছো? ট্রাস্ট মি রুশি এই শব্দটা শুনতে আমার কতোটা খারাপ লাগছে!তুমি এই শব্দটা আমার সামনে আর কক্ষনো বলবে না”

“কেনো, আপনার কেনো খারাপ লাগছে?আপনার তো খুশি হওয়ার কথা, আপনার লাইফে আর কোন ঝামেলা থাকছে না। আপনাদের ভালোবাসার মাঝে আমি তৃতীয় ব্যাক্তি হয়ে থাকছি না,আপনার তো ভালোই হবে। এমনিতেও আপনার প্রেমিকার মনে হয় আমি আপনাকে বশ করে ফেলেছি, নিজের রুপ দেখিয়ে আপনাকে সিডিউস করেছি আর বাচ্চার দোহাই দিয়ে আপনাকে ট্রেপে ফেলে দিয়েছি। বিশ্বাস করুন এই শব্দগুলো আপনার জন্য স্বাভাবিক হলেও আমার জন্য অনেক কষ্টের। আই জাস্ট ওয়ান্ট ডিভোর্স, শুনতে পাচ্ছে আপনি? আমি মুক্তি চাই আপনার কাছে, জাস্ট লিভ মি এলোন!”

রুশি কথাগুলো বলে সায়ানের হাত ঝাড়া দিয়ে ফেলে দিয়েছে কিন্তু পুরোপুরি না ছাড়তেই সায়ান ওকে হাত টেনে চেপে ধরে নিজের কাছে নিয়ে যায়। রুশি কিছু বুঝে উঠার আগেই ওর অধর যুগল অন্যের অধীনে চলে যায়,নরম স্পর্শ গুলো আরো তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে যেনো জমানো সব ক্ষোভ আর রাগ প্রকাশ পাচ্ছে স্পর্শে স্পর্শে। রুশি কিছুক্ষণ চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দেয়, দেহ কেমন যেনো অসাড় হয়ে আসে, পা হাল্কা কাঁপতে থাকে। নিজের সম্পুর্ণ ভার ও সায়ানের উপর ছেড়ে দেয়, জীবনের এই অনুভুতিগুলো স্বজ্ঞানে উপভোগ করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই,,,

সায়ান আলতো করে রুশিকে ছেড়ে দিয়ে রুশির গালে হাত রাখে তারপর ভারী শ্বাস নেয়া কন্ঠে বলে

“এরপর থেকে যদি তোমার মুখে ডিভোর্সের কথা শুনি তবে খবর আছে তোমার।তুমি চাইলেও আমি তোমাকে যেতে দিবো না আর আমাদের সন্তানের প্রপার পরিবার দরকার। তুমি কি চাও ও যেকোন একজনের ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হোক!তুমি কিসব কথা শুরু করেছো বলোতো?রুশি…”

কিছু বলার পুর্বেই ঠাসস করে শব্দ হলো আর সায়ান রুশির দিকে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। রুশির চোখেমুখে রাগ স্পষ্ট, ও রিতীমত রাগে ফুসছে। সায়ানকে ধাক্কা দিয়ে চিৎকার করে বলে উঠলো

“সাহস কি করে হয় আপনার আমাকে টাচ করার?আমি আপনাকে অনুমতি দিয়েছি আমাকে ছোঁয়ার?ভুলে যাবেন না আপনি শুধু আমার কাগজের স্বামী আর ইসলাম অনুযায়ী আমাদের বিয়ে জায়েজ নয়। প্রেগন্যান্ট থাকা অবস্থায় কোন নারীর বিয়ে হয়না, যদিও আমি জানতাম না তবে আজ জেনেছি তাই চেয়েছি কাগজের দিক থেকে আপনার থেকে মুক্ত হতে। কিন্তু আপনি আমার সম্মতি ছাড়া আমাকে টাচ করেছেন, হাউ ডেয়ার ইউ?আমার এতোদিন মনে হতো আপনি আর যাইহোক সম্মান করতে জানেন মেয়েদের কিন্তু না আমি ভুল ছিলাম। আই জাস্ট হেট ইউ!আপনি আমার জীবনে আসার পর থেকে আমার জীবনের কিছুই ঠিক নেই, কিচ্ছুনা। আমি এতোটা অপমানিত কখনো হইনি এর আগে যতোটা আপনার কারণে হতে যতোটা হয়েছি। আম জাস্ট ফেড আপ,প্লিজ জাস্ট লিভ মি এলোন!”

রুশি কথাগুলো বলতে বলতে নিচে বসে পড়লো, চোখ থেকে অথৈজল গড়িয়ে পড়ছে। মাথায় দুহাত দিয়ে চুল চেপে ধরে বসে আছে,সায়ান রুশির অবস্থা দেখে ওর সামনে এগিয়ে আসতে লাগলো আর বলতে লাগলো

“রুশি আমার কথাটা শুনো প্লিজ!”

রুশি সেটা লক্ষ্য করতে হাত দিয়ে থামিয়ে দিলো তারপর জোরে বলে উঠলো

“ডোন্ট ইউ ডেয়ার!আপনি জাস্ট আমার লাইফ থেকে চলে যান প্লিজ, আমি সহ্য করতে পারছিনা আপনাকে। জাস্ট লিভ মি এলোন!”

সায়ান শান্ত দৃষ্টিতে রুশির দিকে তাকালো, রুশির চোখে ও ঘৃণা দেখেছে। ওর সাথে থাকাতে রুশি কতোটা আনহেপি তা দেখেছে, সায়ান কতোক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে তারপর বেরিয়ে পড়লো। সায়ান বেরিয়ে যেতেই রুশি হাটুর উপর থাকা রেখে বসে পড়লো, অনেক কষ্ট হচ্ছে এই মুহুর্তে!ও তো এমন জীবন চায়নি?থাহলে কেনো হচ্ছে এমন ওর সাথে?কেনো ওকেই বারবার ঠকতে হয়! কেনো বারবার আঙুল ওর দিকেই তোলা হয়?

আজ সকালে যখন ভার্সিটিতে যায় ও তখন দেখে সবাই ওর দিকে তাকিয়ে আছে, হঠাৎ সবার দৃষ্টি ওর দিকে দেখে ও ঠিক বুঝতে পারেনা কেনো তাকিয়ে আছে সবাই। হুট করে একটা মেয়ে এসে ওর কানে কানে কিছু একটা বলে যাতে ও দ্রুতপায়ে নিজেদের ক্লাসরুমের সামনে যায় গিয়ে যা দেখে ও থমকে যায়। রুশি আর সায়ানের সেই হোটেলের কিছু ছবি এখানে আছে, কিন্তু সায়ানের মুখ এখানে সম্পুর্ণ স্পষ্ট না হলেও তবে রুশির মুখ স্পষ্ট। রুমের বাইরে এইরকম অনেকগুলো ছবি দেয়ালে আটকানো সাথে প্রত্যেকটা ছবির নিচে লিখা ‘মিস্ট্রেস’।রুশি রাগে ক্ষোভে সেই ছবিগুলোর অনেকগুলো ছবি ছিঁড়ে ফেললো তারপর সেখান থেকে বেরিয়ে পড়লো। আশেপাশের মানুষের কানাঘুষা কানে আসছিলো বিশেষ করে ছেলেদের,অনেকে এক রাতের রেটও জিজ্ঞেস করা শুরু করে দিয়েছে।

লজ্জায় রুশি কেঁদে দিলো, ভার্সিটির গেটে আসতেই হঠাৎ করে কিছু লোক ক্যামেরা দিয়ে ওকে কেপচার করা শুরু করলো, সায়ান জামিল খান খুব ইয়াং একজন বিজনেস ম্যান আর ব্রেন্ডের মালিক হওয়ায় খুব পরিচিত মুখ দেশে, প্রায়ই তার বিভিন্ন ইন্টার্ভিউ নেয়া হয়। তাই দেশের সফল একজন ব্যাক্তির ঘটনায় সাংবাদিকরা আসবে এটাই স্বাভাবিক। সেই লোকগুলোর মাঝে কিছু লোক প্রশ্ন করা শুরু করলো

–আপনার সাথে সায়ান জামিল খানের কি সম্পর্ক?

–উনার অলরেডি একজন বাগদত্তা আছে কিন্তু তারপরেও আপনার সাথে ওনার এই ধরনের ছবি কি করে আসলো?

–তাহলে কি আপনার সাথে তার কোন অবৈধ সম্পর্ক রয়েছে যা তার বাগদত্তা অবগত নয়?

–আপনাকে দেখলে যদিও তা মনে হয়না তবে কি এটাই সত্যি যে আপনি একজন মিস্ট্রেস?

এতোগুলা প্রশ্নের বিপক্ষে রুশি কিছু বলতে পারেনি, কি বলবে ও এই লোকগুলোকে?কি সম্পর্ক ওর সায়ানের সাথে? শুধুমাত্র কাগজের স্ত্রী! সায়ানের যদি সত্যিটা প্রকাশ করার থাকতো তবে অনেক আগেই প্রকাশ করে দিতো কিন্তু সে করেনি তারমানে সে স্বিকার করতে চায়না যে রুশি তার স্ত্রী!আদোও রুশির পরিচয় কি?সবার কাছে তো এইমুহুর্তে ও সায়ানের রক্ষিতা ছাড়া আর কিছুই নয়। রুশি কিছু বুঝে উঠার পুর্বেই কয়েকজন বডিগার্ড এসে রুশিকে সেখান থেকে সেফলি বের করে নিয়ে আসলো আর একটা গাড়িতে বসিয়ে দিলো। গাড়িতে উঠেই ও সায়ানকে ফোন দিতে থাকলো, কিন্তু সায়ানের ফোন বন্ধ দেখাচ্ছিলো তবুও ও চেষ্টা করে গেছে। হয়তো এখন ধরবে কিন্তু ওইপাশ থেকে কোন রেস্পন্স পায়নি।রুশি সায়ানকে ফোন করাতে এতোই ব্যাস্ত ছিলো যে পাশে যে ইনান বসে ছিলো তা খেয়াল করেনি।

বাসায় আসার পর সবাই মিলে বসে ছিলো সায়ানের জন্য, রুশি কতোক্ষণ পর পর দরজার দিকে তাকিয়ে ছিলো কিন্তু সায়ান আসেনি। ও নিজের রুমে বসেছিলো হুট করে ফোন আসলো, রুশি নাম্বার না দেখেই বলে উঠলো

“সায়ান আপনি কই? কি অবস্থা আপনার? ফোন ধরছিলেন না কেনো?”

কিন্তু অপরপাশ থেকে একটা নারীকন্ঠ ভেসে আসলো

“এখনো সায়ানের অপেক্ষা করে আছো?তোমার মনে তোমার কিছু হওয়া না হওয়াতে সায়ানের কিছু যায় আসে?যদি আসতো তাহলে তোমার প্রয়োজনে নিজের ফোন অফ করে রাখতো না, ও চায়না বিরক্ত হতে তাই অফ করে রাখছে ফোন। আমি জানি একটা মেয়ে হিসেবে এটা তোমার জন্য কষ্টকর কিন্তু সায়ান তোমাকে তার কাছে রাখছে শুধুমাত্র তোমার গর্ভে থাকা ওর সন্তানের জন্য নাহয় কবে তোমাকে ছুড়ে ফেলে দিতো! ও তোমার সাথে ভালো ব্যবহার করে যাতে তুমি মানসিক ভাবে ভালো থাকো আর বেবির কোন ক্ষতি না হয় বাট হি ডাসেন্ট কেয়ার এবাউট ইউ। আর মনে রেখো তিনবছর পর তোমার বাচ্চা কিন্তু আমার কাছে থাকবে আর সায়ান বলেছে সে তোমার সাথে তার কোন সম্পর্ক রাখবে না।মেয়ে হিসেবে একটা এডভাইজ দেই যদি এতোটুকুও আত্মসম্মান থাকে তবে নিজ থেকে সরে দাঁড়াও নাহয় সায়ান থেকে এই কথাগুলো শুনলে একসময় এরচেয়ে বেশি কষ্ট পাবে।আর যাইহোক ও আমাকে ভালোবাসে তাই আমার উপর তোমাকে কখনোই চুজ করবে না”

কথাগুলো বলেই চন্দ্রিকা ফোন রেখে দিলো আর রুশি ঠায় হয়ে বসে রইলো,শেষ পর্যন্ত ওই তৃতীয় ব্যাক্তি হিসেবে রইলো। চন্দ্রিকা যা বলেছে তা সত্যি, শুরুতেই সায়ান বলেছিলো ওদের সম্পর্ক তিনবছরের কিন্তু সায়ান ওর সন্তানের সাথে ওকে দেখা করতে দিবে না এটা ভেবেই রাগ উঠে গেলো। এমনটাতো কথা ছিলো না, ও সবকিছু মেনে নিলেও নিজের সন্তানকে নিজের থেকে আলাদা হতে দিবে না, যেকোন মুল্যে না। ও সেটা ভেবেই কান্না করে দিলো আর ঠিক ওইসময়েই সায়ান ঘরে প্রবেশ করে। সারাদিনের জমে থাকা রাগ, ক্ষোভ সবকিছু ঝেড়ে দিলো সায়ানের উপর। কিন্তু এখন রিগ্রেট হচ্ছে, রাগের মাথায় এতোগুলো কথা শুনানো উচিৎ হয়নি। তাছাড়া সায়ান কিছু বলতে চাইছিলো ওকে কিন্তু কি?চন্দ্রিকার কথা বিশ্বাস করে কি ঠিক করলো ও!

#চলবে

#গুমোট_অনুভুতি
#লিখাঃ Liza Bhuiyan
#পর্ব_৩০

হাসপাতালের করিডোরে বসে আছে রুশি, চারপাশের ফিনাইলের গন্ধ নাকে এসে বাড়ি খাচ্ছে তবে সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই ওর। ও নিজের মতো বেঞ্চে বসে আছে মাথা নিচু করে, এতোক্ষন কান্না করলেও এখন আর করছেনা তবে থেকে থেকে কেঁপে উঠছে হয়তো কান্নার রেশটা এখনো যায়নি। ওর অদুরেই মিসেস খান অপারেশন থিয়েটারের সামনে এলোমেলো ভাবে বসে আছে, মাঝেমাঝে হয়তো বিলাপ করে উঠছেন আর বিড়বিড় করে জিজ্ঞেস করছেন তার ছেলে আসছে না কেনো? কবে খুলবে এই দরজা!তার পাশেই সামু তাকে সামলানোর বৃথা চেষ্টা করেছেন।

স্বামীর মৃত্য বেশ দাগ কেটে গিয়েছে তার মনে, এখনো স্বামীর মৃত্যুর শোক কাটিয়ে উঠতে পারেন নি প্রায় সময় কেঁদে উঠেন হঠাৎ সেখানে ছেলের এই করুণ অবস্থা কি করে সহ্য করবেন?চোখ বন্ধ করলেই যেনো ছেলের রক্তাক্ত দেহ ভেসে উঠছে!ঘন্টাখানেক পুর্বে ছেলেকে নিজের চোখের সামনে দিয়ে সুস্থ অবস্থায় বেরিয়ে যেতে দেখেছেন, সায়ান তাড়াহুড়ায় বেরুতে দেখে ভেবেছিলেন কোম্পানিতে কিছু হয়েছে তাই ছেলের মনের অবস্থা চিন্তা করে কিছু জিজ্ঞেস করেন নি। কিছুক্ষণ পুর্বেই হঠাৎ কল আসে তার ফোনে আর বলে যে এই নাম্বারের মালিকের খুব বড় এক্সিডেন্ট হয়েছে আর তাকে সিটি হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কথাটা শুনতেই তার হাত পা যেনো অসাড় হয়ে আসতে লাগলো, স্বামীর মৃত চেহারা ভেসে আসতে লাগলো। কোনরকম সামুকে বললো কথাগুলো, তারপর সামু গিয়ে রুশিকে রুম থেকে ডেকে আনে। ইনান সেই সন্ধ্যায় সায়ানের পরেই এসেছিলো তাই সে শুনেই তাদের ড্রাইভ করে নিয়ে আসে,,,

হসপিটালে আসার মিনিট দশেক পর এম্বুলেন্সে করে সায়ানকে নিয়ে আসা। সারা শরীর রক্তাক্ত অবস্থায় ছিলো! তাড়াতাড়ি করে তাকে অটিতে ঢুকানো হয়। যারা নিয়ে এসেছে তাদের জিজ্ঞেস করার পর জানতে পারে সায়ান ফুল স্পিডে গাড়ি চালাচ্ছিলো আর ট্রাফিক রুলস ব্রেক করে, এজন্য পুলিশের গাড়ি তাকে ফলো করা শুরু করে। হাইওয়ে থেকে সাধারণ রাস্তায় গাড়ি আসার কতোক্ষণ পরে একজন রাস্তা পার হচ্ছিলো কিন্তু ফুল স্পিডে থাকায় সায়ান ব্রেক করতে না পেরে গাড়ি ইউ টার্ন নিতে চায় কিন্তু রাস্তার পাশে থাকা পিলারের সাথে বাড়ি খেয়ে থেমে যায়। সেই পুলিশরা দ্রুত তাকে গাড়ি থেকে বের করে আর এম্বুলেন্স খবর দেয় আর তারা ওকে এখানে নিয়ে আসে।

ইনান রুশির অদুরেই দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, রুশির এই অবস্থা দেখে সত্যি বলতে ওর খারাপ লাগছে কিন্তু ও যেতে পারছেনা কারণ সামু এখানে আছে আর সামুর মনে কোনপ্রকার ভুল ধারণা ও ক্রিয়েট করতে চায়না। কিছুক্ষণ পুর্বেও চন্দ্রিকা এখানে ছিলো, এসেই রুশিকে ব্লেম করা শুরু করে আর কান্না জুড়ে দেয়। মিসেস খান তো নিজেই চন্দ্রিকাকে কিছু বলার অবস্থায় ছিলেন না আর সামু তাকে সামলানোতে ব্যাস্ত ছিলেন। ইনান এগিয়ে এসে কিছু বলতে নিলে চন্দ্রিকা ওকে চুপ করিয়ে দেয়, হুট করেই বলে উঠে

“আমাদের ঘরের কথায় আমি কোন বাইরের মানুষ অপিনিয়ন চাইনি আর তাও তার থেকে যে কিনা এই মেয়েটির এক্স বয়ফ্রেন্ড। নিজের প্রেমিকার পক্ষে কথাতো বলবেনই আপনি, বুঝিনা সামুর পেছনে কেনো পড়ে আছেন?এই সাথে দুই জনকে চালাচ্ছেন! টেলেন্ট আছে বলতে হবে আপনার।”

ইনান দমে গেলো, ও বুঝতে পারলো না যে রুশি আর ওর সম্পর্কের কথা চন্দ্রিকা জানলো কি করে?সায়ান আর সামু জানে মানা গেলো কিন্তু চন্দ্রিকা সেখানে না থাকা সত্ত্বেও কি করে জানলো? আর সবচেয়ে বড় কথা সায়ান হাসপাতালে ভর্তি এই নিউজ ওকে কে দিয়েছে?এতো এতো কনফিউশন থাকলেও জবাব খোঁজার মানসিকতা আসলে এই মুহুর্তে ছিলো না ওর। ও রুশির দিকে এগিয়ে যেতে গিয়েও গেলো না কারণ লক্ষ্য করলো রুশির চন্দ্রিকার কথায় কোন মনোযোগ নেই। ও নিজের মতো করে কেঁদে যাচ্ছে আর বসে আছে,বুঝতে পারলো চন্দ্রিকার কথার কোন ইফেক্ট নেই ওর মাঝে।

এটাকেই হয়তো ভালোবাসা বলে! এইযে চন্দ্রিকা চিল্লিয়ে ভালোবাসা জাহির করছে আদোও কি তা সত্যিই? অথচ রুশি চুপচাপ বসে আছে, চারপাশে কি হচ্ছে তা নিয়ে কোন মাথাব্যথা নেই বরং সে হয়তো মনে মনে সায়ানের সুস্থতা কামনা করছে আর চোখের জল ফেলছে। তাই চিল্লিয়ে ভালোবাসি বলতে হয়না, অনেকসময় নিস্তব্ধতাও অনেক কিছু বুঝিয়ে দেয়! রুশির সম্মানের কথা চিন্তা করে ইনান আর ওর দিকে এগোয়নি, দূর থেকে চন্দ্রিকার কান্না দেখছে আর ভাবছে মিনিট কয়েক আগে যে ঝগড়া করেছিলো হঠাৎ তার চোখে ভরপুর পানি। অভিনয়ের জগতে হয়তো অনেক নাম করতে পারতো!একটা মানুষ এতো ফেক কি করে হতে পারে?

মাকে কোনরকম শান্ত করে সামু কেবিনে নিয়ে যেতে চাইলো কারণ তিনি বেশ দুর্বল হয়ে গেছেন কিন্তু মিসেস খান ক্ষনিকের জন্য থামলেও দরজা সামনের থেকে উঠলেন না বরং সেখানেই বসে পড়লেন। সামুর মনের অবস্থা ভালো নেই, ভাইকে এই অবস্থায় দেখে মেনে নিতে পারছেনা। ছোট থেকেই ওর ভাই হচ্ছে ওর সুপার ম্যান, যার সুপার স্ট্রং বডি কিন্তু এখন ওর সুপারম্যান সুয়ে আছে এটা মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে, মনে মনে শুধু দোয়া করছে ওর ভাই যেনো সুস্থ হয়ে ফিরে।ভাইয়ের এখনো আরো কতোবছর বাঁচা বাকি, নিজের অনাগত সন্তানের মুখ দেখা বাকি, তাকে বেড়ে উঠতে দেখা বাকি। ও চায়না সেই সন্তান পুর্বেই তার বাবাকে হারাক, অন্তত সন্তানের কথা চিন্তা করে হলেও ভাইকে সুস্থ হতে হবে তারউপর রুশি ভাবির সাথে এখনো সব কিছু ঠিক হয়নি, রুশি ভাবি কি করে বাঁঁচবে তাকে ছাড়া?

কথাগুলো ভাবতেই সামু রুশির দিকে তাকালো, এই কয়েকঘন্টায় মুখটা কেমন শুকিয়ে গেছে। ও রুশিকে নিজের বড়োবোন ভাবে, এই কয়েকদিনে সম্পর্ক অনেক গাঢ় হয়ে গিয়েছে। ও প্রায়ই ভাবতো রুশির সাথে আগে দেখা হলোনা কেনো ওদের?কতভালো হতো যদি রুশি ওদের জীবনে আরো আগে আসতো। ওর বড়োবোনের খুব শখ ছিলো যা রুশিকে দিয়ে পুরণ হয়ে গিয়েছে, রুশি এমন একটা মানুষ যাকে না ভালোবেসে থাকাই যায়না! ওর নিজের চোখ সরিয়ে কাঙ্খিত মানুষকে খুঁজতে লাগলো আর পেয়েও গেলো। এক কোনায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ও বেশ অবাকই হলো যে ইনান রুশির পাশে যায়নি কেনো?এই মুহুর্তে তো রুশির কাউকে দরকার! সামু পরে বুঝতে পারলো ইনান হয়তো ওর অনুভুতির কথা ভেবেই যায়নি। ও ইনানের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো তারপর বললো

“আপনি এখানে দাঁড়িয়ে কেনো? যান রুশি ভাবিকে গিয়ে সামলান তো!আমি একা দুজনকে কি করে সামলাবো?তাছাড়া রুশি ভাবি সেই কতক্ষণ ধরে না খেয়ে আছে, এটা বেবির জন্য ক্ষতিকর।যান তার কাছে প্লিজ”

“সামু আমি কি করে…”

“দেখুন এই মুহুর্তে ভাবির মনের অবস্থা খুব খারাপ, তার একজন বন্ধুর প্রয়োজন আর আপনার থেকে ভালো বন্ধু কেউ হতেই পারেনা ভাবির জন্য। তাই তাকে গিয়ে শান্তনা দিন আর বলুন কিছু খেতে নাহয় সে অসুস্থ হয়ে পড়বে”

সামুর কথা শুনে ইনান এগিয়ে গেলো, একসময় রুশির ভালো একজন বন্ধু ছিলো এখন আছে কিনা জানেনা। তবে আর কিছু না হোক একজন বন্ধুর পরিচয়ে তার পাশে দাঁড়াতেই পারে, আর অতীতের সবকিছু সবাই ভুলতে চায় ইনানও তার ব্যাতিক্রম নয়।ওর হুট করে রুশির পাশে বাসলো, রুশি মাথা তুলে তাকালো ওর দিকে একবার তারপর আবার নামিয়ে ফেললো। ইনান একটু ইতস্তত বোধ করলো তারপর শান্ত স্বরে বললো

“এভাবে একটানা এখানে বসে থাকলে শরীর খারাপ করবে আর সেটা বেবির জন্য ভালো নয়। চলো পাশের কেবিন বুক করা হয়েছে আমাদের জন্য, ওখানে চলো গিয়ে কতক্ষণ রেস্ট নিবে”

“আমি এখানেই ঠিক আছি”

রুশি মাথানিচু করে দুর্বল গলায় বললো, ওর কন্ঠস্বর এতোটাই ক্ষীণ ছিলো যে আরেকটু দূরে থাকলে ইনান হয়তো স্পষ্ট শুনতে পেতো না। ইনান বুঝতে পারলো রুশি ক্ষীণ গলায় না করলেও ও প্রচণ্ড জেদি। ওর সম্মতি ছাড়া ওকে এখান থেকে উঠানো সম্ভব নয় তাই বৃথা চেষ্টা করে লাভ নেই। ইনান আবারও বললো

“আচ্ছা কোথাও যেতে হবে না, অন্তত কিছু খাও। আমি অর্ডার দিয়েছি। যেকোন সময় আসবে হয়তো”

রুশি আবারও ক্ষীণ গলায় বললো

“আমার ক্ষুদা নেই,আমি খাবো না”

“রুশি এটা কোন জেদ করার বিষয় নয়। ভুলে যেওনা তুমি একা নয়, তোমার গর্ভে কেউ একজন বেড়ে উঠছে আর না খেয়ে থাকলে তার ক্ষতি হবে।তোমার সবার উপরে নিজের সন্তানের কথা ভাবতে হবে, তার জন্য হলেও খেতে হবে। তুমি কি চাও তার ক্ষতি হোক!”

ইনানের কড়া কথায় রুশি দমে গেলো, মাথা নেড়ে না বোধক উত্তর দিলো। ও কখনোই চায়না ওর সন্তানের খারাপ হোক, ওর সন্তানের জন্যই তো বেঁচে আছে তাহলে তার ক্ষতি কি করে চাইবে?ওর কষ্ট হলেও ওকে খেতে হবে। রুশির কথা শুনে ইনান স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেললো তারপর সেখান থেকে উঠে নিজে খাবার আনতে গেলো। সামু সেদিকেই তাকিয়ে ছিলো, আজকে ইনানের চোখে ও রুশির প্রতি অন্য কোন অনুভুতি দেখেনি বরং একজন বন্ধুর মতো বুঝিয়েছে। এই কয়দিন ইনান ওর পেছনে যথেষ্ট সময় ব্যয় করেছে, ইনানের মতো একটা ছেলে ওর পেছনে ঘুরবে এটা ওর বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়েছিলো!এমনকি ইনান সামুকে কোন প্রকার ফোর্স করেনি বরং ওর কড়া কথা শুনার পরেও আবার ফোন করে খোঁজ নিয়েছে। ভার্সিটি শেষে নিজ দায়িত্বে ওকে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছে, কোন দিন গাড়িতে না উঠলে সারা রাস্তা গাড়ি দিয়ে ফলো বাড়ি পর্যন্ত এসেছে, এমনকি ভার্সিটির গেটের সামনে গাড়ি থামিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো। ইতিমধ্যে সবাইকে বলা হয়ে গেছে তার যে সে সামুর ফিয়ন্সি! সামু এমন এটেনশন সবসময় চেয়েছিলো ইনানের কাছ থেকে আর পেয়েও গিয়েছে। ও খুব খুশি সত্যি বলতে, ইনানের সিন্সিয়ারিটি দেখে ওর জমে থাকা অভিমান গলে গিয়েছে কিন্তু এতো সহজে ও হার মানবে না বরং ইনান যে ওকে এতোবছর ঘুরিয়েছে তাকেও তো ঘুরতে হবে ওর পেছনে তারপর গিয়ে মানবে।

ইনান খাবার নিয়ে আসার পর রুশি নিজে না খেয়ে থাকার হুমকি দিয়ে মিসেস খানকেও সাথে করে খাইয়েছে। ইনান আর সামু বাধ্য হয়ে খেয়েছে রুশির জন্য এমনকি চন্দ্রিকাকেও সামু জোর করে খাইয়েছে। এভাবে না খেয়ে থাকলে ভালো কিছু হবে না। দীর্ঘ দুইঘন্টা পর ডাক্তার বেরিয়ে আসে, সায়ানের অনেক ব্লাড লস হয়েছিলো তাই তাদের অনেক সময় লেগেছে, ভাগ্য ভালো হাসপাতালে এই গ্রুপের রক্ত আগে থেকেই ছিলো।ডাক্তার বেরুতেই সবাই তার কাছে গেলো, ইনান দ্রুত প্রশ্ন করলো

“ডক্টর এখন সায়ানের কি অবস্থা?”

“দেখুন পেইশেন্ট এখন আউট অফ ডেঞ্জার, উনি এখন ঘুমাচ্ছেন। কিছুক্ষনের মধ্যেই তাকে বেডে শিফট করা হবে। আপনাদের কাছে অনুরোধ জ্ঞান না ফেরা পর্যন্ত তাকে বিরক্ত করবেন না, তাকে বাইরে থেকে দেখবেন প্লিজ!তার যথেষ্ট রেস্ট প্রয়োজন এখন”

বলেই ডাক্তার চলে গেলো, রুশি ধপ করে নিচে বসে পড়লো। সায়ান বেঁচে আছে এই সংবাদ ওর জন্য যথেষ্ট ছিলো খুশি হওয়ার। সায়ানের কিছু হয়ে গেলে নিজেকে কখনোই ক্ষমা করতে পারতো না ও, সায়ানের এই অবস্থার জন্য শুধুমাত্র ও দায়ী। ও উচিৎ ছিলো সায়ানের কথা শুনা, অন্তত সায়ান কিভাবে এক্সপ্লেইন করতে চায় সেটা দেখা উচিৎ ছিলো। জেদের বসে শুধু নিজের কথাই বলে গেছে, সায়ানের কথা শুনার প্রয়োজন বোধ করেনি। আর যাইহোক চন্দ্রিকার মতো মেয়ে কখনো বিশ্বাসযোগ্য হতে পারেনা, কি করে বিশ্বাস করলো সত্য মিথ্যে যাচাই না করে?ওর উচিৎ ছিলো অন্তত একবার সায়ানকে নিজের পক্ষে কথা বলার সুযোগ দেয়া!

#চলবে

#গুমোট_অনুভুতি
#লিখাঃ Liza Bhuiyan
#পর্ব_৩১

হসপিটালের ভিআইপি রুমে সুবিধা অন্যরুমের তুলনায় একটু বেশিই হয়, বড় বেড, বেড ল্যাম্প আরোও কত কি!কিন্তু যতই সুবিধা থাকুক না কেনো রোগীর কষ্ট কোন অংশে কম করা সম্ভব হয় না শারিরীকভাবে, ট্রিটমেন্টের পরও যতটুকু কষ্ট পাওয়ার তা পেতেই হয়। শরীরের অসহ্য ব্যাথা অনুভুত হতেই সায়ান চোখ মেলার চেষ্টা করলো কিন্তু চোখের পল্লবগুলোর রন্ধ্রে রন্ধ্রে যেনো ব্যথা! খুব কষ্টে নিজের চোখ জোড়া খুললো, খুলতেই তীব্র আলো চোখে পড়াতে মুহুর্তেই বন্ধ করে ফেললো। কিছুক্ষণ চেষ্টা করার পর আবার চোখ খুলতে পারলো, সায়ান চারপাশে চোখ বুলাতে লাগলো।বুঝতে পারলো হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে, রুমটা খুব গুছানো। অদুরেই একটা সোফার মতো কিছু আছে কিন্তু তাতে কোন মানুষ নেই। হয়তো সবাই ওকে রেস্ট করতে দিয়ে আশেপাশে কোথাও আছে!

সায়ান নিজের হাত পা নাড়ানোর চেষ্টা করলো, প্রায় সাথেই তীব্র ব্যথা অনুভব হলো সারাশরীরে। ও কিছুক্ষনের জন্য দমে গেলো, বুঝতে পারলো ডান হাতে ক্যানেলা লাগানো তাই বাম হাত টান দিলো কিন্তু তা ভারী অনুভুত হতেই পাশে তাকালো আর একটা নারী অবয়ব কে দেখতে পেলো, শুয়ে থাকায় চেহারা স্পষ্ট না হলেও সায়ান জানে মেয়েটি কে! মুহুর্তেই নিজের হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়া অনুভব করলো, খুব করে ইচ্ছে করলো মুখের সামনে এসে থাকা চুলগুলো সরিয়ে দিতে কিন্তু হাতের ব্যথায় সেটা পারলো না।শুধু তাকিয়ে রইলো!

অক্সিজেন মাস্ক পরে থাকায় সায়ানের খুব অস্বস্তি হচ্ছিলো তাই সেটা খুলার চেষ্টা করলো সাবধানে কিন্তু নড়াচড়া করে উঠতেই রুশি ধড়ফড়িয়ে উঠলো। সায়ান থেমে গেলো, ও চায়নি রুশি ঘুম ভাঙুক তাই সাবধানে নড়াচড়া করেছিলো কিন্তু তারপরেও রুশি উঠে গেলো তাই ও অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রুশির দিকে। রুশি উঠেই বলা শুরু করে দিলো

“আপনি ঠিক আছেন?কখন জ্ঞান এসেছে আপনার? আমায় ডাক দেননি কেনো? খুব খারাপ লাগছে!ডক্টরকে বলবো আসতে? কোথায় ব্যাথা লাগছে আপনার? বলুন না চুপ করে আছেন কেনো?”

রুশির একটানা কথাগুলো বলার পরেও সায়ানের থেকে কোন জবাব এলো না, বরং ও চোখ বড় বড় করে কিছু বুঝানোর চেষ্টা করছে কিন্তু রুশি বুঝতে পারছে না। অনেকক্ষণ চেষ্টার পর সায়ান হাল ছেড়ে দিয়ে সায়ান অন্যদিকে মুখ করে তাকালো। রুশি কিছু একটা ভাবলো তারপর হুট করে সায়ানের অক্সিজেন মাস্ক সরিয়ে দিলো আর সায়ান ওর দিকে তাকালো। রুশির চোখমুখ ফুলে আছে, আর রুশি ওর সামনে মাথানিচু করে বসে আছে। প্রায় অনেকক্ষণ কেটে গেলো কিন্তু রুশিও কিছু বললো না আর না সায়ান। কথায় আছে না,’শব্দসংকট খুবই জঘন্য একটি বিষয়, দুজন মানুষ কথা বলতে চাইছে অথচ বলার কিছু খুঁজে পাচ্ছে না। এর থেকে করুণ দৃশ্য আর কি হতে পারে?’

কিন্তু ওইযে সকল নিস্তব্ধতা একসময় আওয়াজে পরিণত হয়, তাই সেই নিস্তব্ধতাকে যেকোন একজনকে ভাংতে হয় নাহয় সম্পর্কটাই স্তব্ধ হয়ে যায়। রুশি মাথা তুলে সায়ানের দিকে তাকালো তারপর আবার নামিয়ে ফেললো,সায়ান রুশির টলমলে চোখজোড়া দেখতে পেলো। রুশি ক্ষীণ স্বরে বলে উঠলো,,

“আম স্যরি! আম রিয়ালি স্যরি! আমি রাগের মাথায় অনেকগুলো কথা শুনিয়ে ফেলেছি যা আমার বলা উচিৎ হয়নি। আমি আসলে একটু ডিপ্রেসড ছিলাম তাই রাগের মাথায় ওই কথাগুলো বলেছি, আমি ভাবতে পারেনি আমার কথার আপনার উপর এভাবে পড়বে। আপনার যদি কিছু হয়ে যেতো তাহলে আমি নিজেকে কখনো ক্ষমা করতে পারতাম না”

এতোক্ষন চোখের কোনে জমে থাকা কালো মেঘগুলো বৃষ্টি হয়ে নামতে শুরু করলো,চোখের কার্নিশ বেয়ে চোখের জল সায়ানের হাতের উপর পড়লো। সায়ান সেদিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো,রুশির চোখে ও অনুতাপ দেখতে পাচ্ছে। সায়ানকে কথাগুলো শুনিয়ে রুশি বেশ অনুতপ্ত! কিন্তু সায়ান এটা দেখতে চায়নি,ও রুশির চোখে শুধুমাত্র ওর জন্য ভালোবাসা দেখতে চায় তবে সেটা ও দেখতে পাচ্ছে না। এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়, সায়ান রুশিকে তো এখনো বলেইনি যে ও রুশিকে ভালোবাসে, ও রুশিকে আর নিজের সন্তান নিয়ে সুখে থাকতে চায়। ওর মনে শুধুমাত্র রুশি আছে চন্দ্রিকা নয় কিন্তু এই পরিস্থিতিতে বলা ঠিক হবে না বরং ওকে আগে সুস্থ হতে হবে তারপর সুন্দর করে ও রুশিকে নিজের মনের খবর জানাবে আর রুশির মন জয় করবে। সায়ান আলতো করে রুশির মাথায় হাত রাখলো তারপর বললো

“তোমার জন্য কিছু হয়নি রুশি, শুধু শুধু নিজেকে দোষারোপ করোনা।আমার সামনে একজন মানুষ চলে আসায় হুট করে ব্রেক কাজ করেছিলো না তাই গাড়ি সরাতে হয়েছে আর গাছের সাথে বাড়ি খেয়েছি। এটা শুধুমাত্র একটা এক্সিডেন্ট এতে তোমার কোন হাত নেই। নিজেকে ব্লেম করবে না একদম, আমার এই অবস্থার জন্য আমি দায়ী!”

রুশিকে সায়ানের কথা শুনে কিছুক্ষণ দমে গেলো তারপর নাক টেনে বললো

“আপনি মিথ্যে বলছেন আমি জানি, আমার জন্যই এই অবস্থা হয়েছে। না আমি আপনাকে ওই কথাগুলো বলতাম, না আপনি হাই স্পিডে গাড়ি চালাতেন আর না আপনার এই অবস্থা হতো। সব আমার দোষ, আমার ওভাবে বলা উচিৎ হয়নি কিন্তু আপনি এতো স্পিডে গাড়ি চালান কেনো বলেন?মরার খুব শখ হয়েছে আপনার?”

সায়ান রুশির শেষ কথাগুলো শুনে কেনো যেনো হাসলো তারপর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো

“কেউ একজন আমার সাথে থাকতে চায়না,আমাকে ছেড়ে চলে যেতে চায় এই দুঃখে আমার বেঁচে থাকার ইচ্ছে চলে গিয়েছিলো। এই জন্য মরতে গিয়েছিলাম”

সায়ানের কথা শুনে রুশি চুপ মেরে গেলো,সায়ান ওর কথা শুনে রাগ করে এমন করেনি বরং ও ছেড়ে চলে যাবে বলে কষ্টে এমন করেছে!এটা কি আদোও বিশ্বাসযোগ্য?রুশির ভাবুক চেহারা দেখে সায়ান হাসলো, সত্যি বলতে ও আসলে এই কারণেই ফুল স্পিডে গাড়ি চালাচ্ছিলো। রুশির মুখে ডিভোর্সের কথা শুনে ও ঠিক সহ্য করতে পারছিলো না, মনে হচ্ছিলো রুশি চলে গেলে ও কি করবে?কি করে বলতে পারলো রুশি ওকে এমন কথা?ওর বেঁচে থাকার ইচ্ছেটাই মরে গিয়েছিলো,তাই ও এমনটি করেছিলো। কিন্তু ভাগ্য ভালো ও বেঁচে ফিরেছে নাহয় কতোবড় ভুল হয়ে যেতো!

রুশির সাথে এখনো ওর সম্পর্কই শুরু হয়নি সেখানে ও যদি নাই থাকে তাহলে ওর রুশির সাথে দেখা স্বপ্ন গুলো তো স্বপ্নই থেকে যাবে। যখন ওর এক্সিডেন্ট হচ্ছিলো তখন এই কথা গুলো মনে হয়েছিলো, দোয়া করেছিলো যাতে ও বেঁচে যায় কারণ ও বাঁচতে চায় রুশি, ওর সন্তান,ওর পরিবার সবার সাথে বাঁচতে চায়। আর তার জন্য ওর বেঁচে থাকা খুব জরুরি!

সায়ান রুশির দিকে তাকিয়ে বললো

“মাম্মা বা সামু কই?ওরা কি এখানে আছে?”

“মা আর সামু পাশের কেবিনে, মায়ের শরীর ভালো ছিলো না অতোটা তাই তাদের পাঠিয়ে দিয়েছি। আর ইনান ভাই বাসায় গেছেন যাতে কাল সকালে খাবার আর জামাকাপড় নিয়ে আসতে পারেন।আমি বলেছি আমি এখানে থাকবো তাই তারা আর জোর করেনি”

রুশির মুখে ‘ইনান ভাই’ শুনে সায়ানের কেমন যেনো হাসি পেলো, ও হাল্কা কেশে বললো

“ইনান ভাই?ইনানকে ইনান ভাই বলো কবে থেকে?”

“না মানে আসলে সামু ডাকে তাই আমিও ডাকতে ডাকতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে”

“গুড! এভাবেই ডাকবা সবসময়। সামু ডাকা বন্ধ করে দিলেও তুমি বন্ধ কইরো না”

রুশি কনফিউশন নিয়ে সায়ানের হাত চেপে ধরে বসেছিলো আর সায়ান ওর দিকে তাকিয়ে ছিলো।এমন সময় খট করে দরজা খুললো, গেটে চন্দ্রিকা দাঁড়িয়ে আছে। রুশি কি ভাবে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো,তারপর উঠে দাঁড়ালো। এই মুহুর্তে চন্দ্রিকার সাথে ঝগড়া করার কোন মানেই হয়না, অযথা হয়রানি। তারউপর এতো এনার্জিও নেই ঝগড়া করার!আর এমনিতেও সায়ানের শরীর ভালোনা, অতিরিক্ত চেঁচামেচি ওর শরীরের জন্য ক্ষতিকর এটা ভেবে দমে গেলো আর সোজা বেরিয়ে গেলো। শুধু এমন একজনের সাথে ঝগড়া করে লি লাভ যে পরিস্থিতি বুঝেনা বরং নিজের স্বার্থ অনুযায়ী কাজ করে।

রুশি বেরিয়ে যেতেই সায়ান সেদিকে তাকিয়ে রইলো এক ধ্যানে! রুশি ওকে এখানে একা রেখে কি করে চলে গেলো?সায়ান চন্দ্রিকার দিকে তাকালো তারপর শান্ত কন্ঠে বললো

“আমি এখন রেস্ট নিতে চাই, তুমি শুধুশুধু এখানে বসে থেকে কি করবে?তুমি বরং নিজেও কেবিনে গিয়ে রেস্ট নাও।”

কথাটা বলেই সায়ান চোখ বন্ধ করে ফেললো, মনে মনে ভাবছে রুশি কি আর আসবে না এখানে?তাহলে কোথায় ঘুমাবে ও!এসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে পড়লো ও, ঘুমের তীব্র ডোজ দেয়াতে সেই রেশ এখনো রয়ে গেছে!

#চলবে

গল্প পোকা
গল্প পোকাhttps://golpopoka.com
গল্পপোকা ডট কম -এ আপনাকে স্বাগতম......
RELATED ARTICLES

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments

Md masrur Hasan mahi على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
আমিনুল ইসলাম على প্রয়োজন পর্ব: ৩০ ( অন্তিম)
সাজিবুল ইসলাম على ধর্ষিতাবউ২ ৯ তথা শেষ পর্ব
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
Nita Sarkar على স্বপ্নীল ৬৮
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على রহস্য শেষ_পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على অলক্ষ্যে তুমি পর্ব-০৬ এবং শেষ পর্ব
Nazmun Nahar Akhi على Psycho_is_back? part_7
Nazmun Nahar Akhi على Dangerous_Villian_Lover part 2
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على জানালার ওপারে পর্ব-১৭ এবং শেষ পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على লীলা বোর্ডিং ১২১৫ পর্ব-১১ এবং শেষ পর্ব
মিজানুর রহমান রাহুল على সেই তুমি পর্ব-০১
@feelings على প্রহেলিকা
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Nusrat jahan على coffee & vanilla Part-10
Pallabi Roy على স্বপ্নীল ৬৮
M.D Mahabub على The_Villain_Lover Part_2
Labani sarkar على Dangerous_Villain_Lover part 23
MD Akas Apc على বিবেক
Tanisha Ahmed على Devil love part-18 
Aius Barmon shorob على নারীর দেহকে নয়
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Priya Banerjee على devil love married life last part
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Riya Biswas على তুমি রবে ৫২
Mohammad Adib على তুমি রবে ৬০
Avni Ayesha على তুমি রবে ২৮
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
সুমিত على তুমি রবে ২৮
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
Samiah Begum على তুমি রবে ৫১
biddut das rocky على নর নারী
গল্প পোকা على নষ্ট গলি শেষ পর্ব
Md Jobayer Hossain Shohag على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على দুই অলসের সংসার
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤৪২.
A.J.S Rakib على মন ফড়িং ❤৪২.
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
Samiya noor على গল্পঃ ভয়
Sadikul على গল্পঃ ভয়
Samia Islam على গল্পঃ ভয়
শূন্য মায়া على মন ফড়িং ❤ ৪০.
Sutapa biswas على মন ফড়িং ❤৩৯.
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৮.
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৭
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
Siyam على বিবেক
Sudipto Guchhait على My_Mafia_Boss পর্ব-৯
saptami karmakar على devil love married life last part
saptami karmakar على devil love married life last part
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ২৬.
Shreyashi Dutta على  বিয়ে part 1
Sandipan Biswas على  বিয়ে part 1
Paramita Bhattacharyya على অনুরাগ শেষ পর্ব
জামিয়া পারভীন তানি على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
মায়া على মন ফড়িং  ২২
সুরিয়া মিম على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على মন ফড়িং ২১
গল্প পোকা على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
Sahin ssb على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৮. 
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৭.
Jannatul Ferdous على খেলাঘর পর্ব-৩৫
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ফাল্গুনের_ফুল last_part_8
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ছাত্রী যখন বউ পাঠঃ ১
গল্প পোকা على বাজির প্রেম পাঠঃ ১
Foujia Khanom Parsha على মা… ?
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৮
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
Ibna Al Wadud Shovon على স্বার্থ