Monday, October 6, 2025







বাড়ি"ধারাবাহিক গল্প"অতন্দ্রিলার রোদ পর্ব :২ ও ৩ (ইরাবতী)

অতন্দ্রিলার রোদ পর্ব :২ ও ৩ (ইরাবতী)

অতন্দ্রিলার রোদ
পর্ব :২ ও ৩ (ইরাবতী)

লেখা : শঙ্খিনী

রৌদ্র বা রোদ শব্দটার আলাদা কোনো ইংরেজি প্রতিশব্দ নেই। রোদ হচ্ছে একই সাথে সানশাইন এবং মুনশাইন।
নির্দিষ্ট কোনো ইংরেজি প্রতিশব্দ না থাকায়, বিদেশি কেউ যখন রোদের নামের অর্থ জিজ্ঞেস করে তখন বেশ ভালোই ঝামেলায় পড়তে হয় তাকে। রোদের এই ঝামেলা দেখে ইরা হাসতে হাসতে বলেছিল, “আচ্ছা যাও! আমি যখন বিখ্যাত ভাষাবিদ হয়ে যাবো, তখন রোদ শব্দের সুন্দর একটা ইংরেজি প্রতিশব্দ আবিষ্কার করে দেব।”
কিন্তু ইরা কথা রাখেনি।

বছর ছয়েক আগের কথা। রোদ তখন পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগে। আর ইরা ইংরেজি বিভাগে।
রোদের সঙ্গে ইরার পরিচয় হয় তানহার মাধ্যমে। তানহা রোদের মামাতো বোন এবং ইরার বান্ধবী।
ইরার একটা গুন হলো, সে খুব সহজেই একটা মানুষকে আপন করে নিতে পারে।
      প্রথম দর্শনেই ইরা উৎসাহিত গলায় রোদকে বলেছিল, “এমা, অংক নিয়ে পড়েন কিভাবে? স্কুল-কলেজে অংকের নাম শুনলেই জ্বর আসতো!”
      রোদ শুকনো গলায় বলে, “আর আমার জ্বর আসতো ইংরেজির নাম শুনলে।”

এমন কোনো হাসির কথা না হলেও ইরা হাসতে হাসতে গড়িয়ে যায়।
ইরার এই হাসিটাই আকর্ষিত করেছিল রোদকে।

রোদ ভালোবাসা নিয়ে নিজের মতো করে একটা থিওরি দাঁড় করিয়েছে। সেই থিওরি অনুযায়ী, একটা মানুষের প্রতি আরেকটা মানুষের ভালোবাসা সৃষ্টি হয় তিনটি ধাপে।

১ম ধাপ – আকর্ষন
২য় ধাপ – অনুভূতি
৩য় ধাপ – আসক্তি

একটা মানুষ তার হাসি, চোখ অথবা কথা বলার ভঙ্গি দিয়ে অন্য একটা মানুষকে আকর্ষণ করে। অন্য একটা মানুষের যদি সেই
আকর্ষণে আকর্ষিত হয়, তবেই ভালোবাসা প্রকিয়ার প্রথম ধাপ সম্পন্ন।
মানুষটার প্রতি আকর্ষিত হওয়ার পর তার পছন্দ অপছন্দ সম্পর্কে জানার আগ্রহ, তার হাসিতে নিজস্ব একটা সুখ খুঁজে পাওয়া, তার কান্নায় নিজস্ব একটা ব্যাথা খুঁজে পাওয়াই তার প্রতি এক ধরনের অনুভূতি। মানুষটার প্রতি এই অনুভূতি সৃষ্টি হলেই সে পৌঁছে যাবে ভালোবাসা প্রকিয়ার দ্বিতীয় ধাপে।
এর পরের ধাপ একটা মানুষকে পাগল করে দেওয়ার জন্যে যথেষ্ট।
মানুষটার প্রতি অনুভূতি সৃষ্টি হওয়ার পর যখন সেই মানুষটাকে নিয়ে দিবা-নিশী, আনন্দে-দুঃখে, শয়নে-সপনে তার কথা ভাবাই হলো আসক্তি।
এই ধাপ পর্যন্ত আশা মানেই একটা মানুষ অন্য আরেকটা মানুষকে গভীর ভাবে ভালোবাসে।

ইরাকে ভালোবাসার প্রথম ধাপে আছে রোদ।

হঠাৎই এক দুপুরে রাস্তায় রিকশার জন্যে অপেক্ষা করতে করতে, ইরার সাথে দেখা রোদের।
     ইরা রোদকে দেখে উৎসাহিত গলায় বলে, “আরে আপনি? কেমন আছেন?”
    রোদ অন্যরকম গলায় বলে, “ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?”
    “এইতো চলছে। তা আজ হঠাৎ এখানে?”
    “একটা কাজে এসেছিলাম। আপনি?”
    “আমাদের বাসা এখানেই।”
    “ওহ্ আচ্ছা। কোথায় যাচ্ছেন?”
    “পাবলিক লাইব্রেরির দিকে।”
     “তাই নাকি? আমিও তো সেদিকেই যাচ্ছি।”
কথাটা নিতান্তই মিথ্যা। রোদ বাসায় যাচ্ছিল। মেয়েরা নিজেদের সঙ্গে মিল আছে এমন ছেলে পছন্দ করে। তাই বোধ হয় এই ছোট্ট মিথ্যাটি বলে সে।

        ইরা ঠোঁটে হাসি নিয়ে বলে, “বাহ্ ভালোই তো হলো, একসাথে যাওয়া যাবে। তবে যদি আপনার কোনো আপত্তি না থাকে।”
       “না, না। আমার আপত্তি থাকবে কেনো?”
       “তাহলে চলুন, যাওয়া যাক।”

ইরা ও রোদ একটা রিকশায় উঠে যায়।
       রিকশায় উঠে আনন্দিত গলায় ইরা বলে, “আচ্ছা, আপনার কতো ঘর পর্যন্ত নামতা  মুখস্ত?”
        “এটা কেমন প্রশ্ন?”
        “না মানে, আপনি গণিত নিয়ে পড়াশুনা করেন তো, তাই ভাবলাম আপনার বোধ হয় একশ ঘর পর্যন্ত নামতা মুখস্ত!”
        “একশ ঘর পর্যন্ত নামতা মুখস্ত রাখাটা একটু কঠিন। আমার কুড়ি ঘর পর্যন্তই মুখস্ত। তবে এই ক্যালকুলেটরের যুগে কুড়ি ঘরও মুখস্ত রাখার প্রয়োজন হয় না।”
         “তাও বা কম কিসে? আমার তো নয় ঘর পর্যন্তই মুখস্ত!”
          “দশ-এগার?”
          “ওগুলো তো পানির মতো সহজ। ওগুলো তো আর মুখস্ত করার কিছু নেই। মুখস্ত নয় ঘর পর্যন্তই।”
         “নয়ের ঘরের নামতার কিন্তু মজার একটা দিক আছে। কখনো খেয়াল করেছেন?”
          “কি মজার দিক?”
           “এই যেমন ধরুন, ৯×২=১৮। এখানে ডানপাশের দুটি সংখ্যা মানে ১ এবং ৮ কে যোগ করলে কিন্তু ৯ হয়। আবার, ৯×৩=২৭। এখানেও ২ এবং ৭ কে যোগ করলে ৯ হয়।
পুরো ৯ এর ঘরের নামতার ডানপাশের সংখ্যাকে যোগ করলে যোগফল ৯ হয়।”
          “ওমা তাইতো! কখনো খেয়ালই করিনি। অন্য ঘরের নামতায় এমন হয় না?”
          “না শুধু ৯ এর ঘরেই হয়। গণিত আসলে একটা বোঝার বিষয়। যে বুঝতে পারে, তার কাছে গণিত পৃথিবীর সবথেকে মজার বিষয়। আবার যে বুঝতে পারে না, তার কাছে এর থেকে জটিল বিষয় আর নেই।”

রোদের এই সুন্দর কথা,গাণিতিক জ্ঞান ইরার বেশ ভালো লাগে।

এরপরও বেশ কয়েকবার কাকতালীয়ভাবেই তাদের দেখা হয়। এই দেখা হওয়ার মাঝেই একটা বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে তাদের মধ্যে।

     একদিন বিকেলে ইরা রোদকে ফোন করে বলে, “আপনি কি ফ্রি আছেন?”
    রোদ শান্ত গলায় বলে, “হ্যাঁ আছি। কেন বলুন তো?”
      “আমার সাথে একটু দেখা করতে পারবেন?”
       “অবশ্যই পারবো। কোথায় দেখা করতে হবে?”
        “শপিং মলে, আই উইল টেক্সট ইউ দ্য অ্যাড্রেস এন্ড টাইম। আসলে আমি একজনের জন্যে একটা উপহার কিনবো, আপনার সাহায্য দরকার।”
         “নিশ্চই সাহায্য পাবেন। দেখা হচ্ছে তাহলে!”
    
সময়মতো শপিং মলে পৌঁছে রোদ দেখে, ইরা একটা পাঞ্জাবির দোকানে। কয়েকটা পাঞ্জাবি নিয়ে ঘাটাঘাটি করছে।
      রোদ ইরার কাছে গিয়ে চিন্তিত গলায় বলে, “ইরা?”
ইরা তাকাল।
         রোদকে দেখে কিছু খুশি গলায় বলে, “আপনার অপেক্ষাই করছিলাম।”
         “বেশি দেরি করে ফেললাম নাকি?”
         “না, না! আচ্ছা, এখন এই পাঞ্জাবিগুলোর মধ্যে একটা বাছাই করুন।”
          “আমি?”
          “হ্যাঁ। আসলে ছেলেদের জিনিস, আমি অতো ভালো বুঝি না। তাই আপনাকে আসতে বলেছি।”
          রোদ পাঞ্জাবি বাছাই করতে করতে বলে, “আচ্ছা আপনি তো বলেছিলেন একজনের জন্যে উপহার কিনবেন। এটাই কি সেই উপহার?”
           ইরা অস্পষ্ট গলায় বলে, “হুঁ।”
           “তা, উপহারটা কার জন্যে?”
           “আমি আসলে একজন পছন্দ করি। পছন্দ বললে ভুল হবে। আমি আসলে তার প্রেমে পড়েছি। শুনেছি, বাঙালি মেয়েরা নাকি কারো প্রেমে পড়লে তাকে মুখ ফুটে বলতে পারে না। উপহার দিয়ে বুঝিয়ে দেয়।”

রোদ চমকে উঠে, তার মুখটা রক্তশূন্য হয়ে যায়। রোদ যে চমকে উঠছে এটা ইরাকে বুঝতে দেয়নি, খুব সহজেই নিজেকে সামলে নেয়।

কিছুক্ষণের মধ্যে রোদ সুন্দর একটা পাঞ্জাবি বেছে দেয়। ইরা সেই পাঞ্জাবি নিয়ে কাউন্টারের দিকে পা বাড়ায়।
পাঞ্জাবিটা কেনা হয়ে গেলে ইরা ও রোদ দোকানের বাইরে বের হয়ে কিছুক্ষণ নিঃশব্দে পায়চারি করে।
     অবশেষে ইরা মুখ খুলে, “রোদ?”
      “হুঁ?”
    ‌‌  ইরা পাঞ্জাবির প্যাকেটটা রোদের দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বলল, “আসলে এটা কিনেছি আপনার জন্যে। কারণটা আপনাকে বলেছি। তাই আবার জানতে চাইবেন না প্লিজ।”
রোদ হাত বাড়াল। রোদ প্যাকেটটা হাতে নেওয়ার সাথে সাথে ইরা প্রায় দৌড়ে সেখান থেকে চলে যায়।    

শুরু হয় রোদ ও ইরার গভীর প্রণয়।
প্রণয়ের কয়েক মাস যেতে না যেতেই তারা নিজের নিজের বাড়িতে পছন্দের কথা বলে।

রোদের মা এবং মামা বেশ আগ্রহের সঙ্গেই ইরাদের বাড়িতে তাকে দেখতে যান। মেয়ে সুন্দরী, শিক্ষিত,গুছিয়ে করে কথা বলতে পারে, রান্নাবান্নাও করতে পারে – তাদের ইরাকে খুবই পছন্দ হয়।
ইরার বাবা-মাও রোদকে পছন্দ করেন। করাটাই স্বাভাবিক।
মাস তিনেক পর বেশ ধুমধাম করে বিয়ে হয় রোদ এবং ইরার।

বিয়ের পর তাদের প্রথম সকালটা শুরু হয় একটু অন্যরকম ভাবে।
         “এই ইরা! ওঠো না!”, বেশ ব্যস্ত ভঙ্গিমায় কথাটি বলে রোদ।
          ইরা ঘুমের মধ্যেই বলে, “কি হয়েছে?”
          “আহ্ উঠো না!”
          “কয়টা বাজে?”
          “সাতটা।”
          “উফফ, আরেকটু ঘুমাই না!”
          “উঠো না প্লিজ! খুবই জরুরি একটা কাজ আছে!”

রোদ অসাধারন সুন্দর ছবি আঁকে। কোনো সুন্দর কিছু তার চোখে পরলেই সেটার ছবি আঁকা শুরু করে। ঘুমন্ত অবস্থায় ইরাকে দেখে তার ছবি আঁকতে খুব ইচ্ছে করছিল। তাই তো এত সকালে তাকে জাগিয়ে তোলা।

     ইরা ফ্রেশ হয়ে এসে ক্ষীণ গলায় বলে, “এখন বলো, কি তোমার জরুরি কাজ?”
      “ক্যানভাসটার ঠিক মুখোমুখি বসো।”
      “রোদ! তুমি ফাজলামো করছো না? একে তো এই সাত-সকালে আমার ঘুমটা ভাঙালে, এখন আবার বলছো ক্যানভাসের সামনে বসতে?”
        “হুঁ। তোমার ছবি আঁকবো।”
        “সেটা কি পরে আঁকা যেত না?”
        “যেত, কিন্তু আমার এখনি আঁকতে ইচ্ছে করছে।”

ইরার খুব রাগ করতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার ওপর রাগ করা তার পক্ষে অসম্ভব। তাই হাসিমুখেই ক্যানভাসের সামনে বসে গেল সে।

ছয় ঘন্টা ধরে বিশাল এক ক্যানভাসে আঁকা হচ্ছে ইরার ছবি। ইরাকে অবশ্য পুরোটা সময় বসে থাকতে হয়নি।
ছবিটা অসাধারন হয়েছে। আঁকা শেষ করে রোদ ছবিটাকে খাটের পেছনের দেয়ালে টানিয়ে দিলো।
এভাবেই সূচনা ঘটে রোদ ও ইরার সুখের সংসার।

রোদের বাড়ির সামনে এক বিশাল বাগান।
বাগানের একদিকে চৌবাচ্চায় বিভিন্ন ধরনের দেশীয় মাছ চাষ করেন রোদের মা ফিরোজা।
কিন্তু তার একটাই আক্ষেপ, মাছগুলোর কোনোটাই বেশি দিন বাঁচে না।
বাগানের আরেক দিকে দেশীয় ফলমূল এবং তরি-তরকারির গাছের সমাহার। গ্রীষ্মকালীন আম-কাঠাঁল থেকে শুরু করে শীতকালীন বরই-আমলকি, সবই আছে ফিরোজার বাগানে।
বাগানের একটা কোণা এখনো ফাঁকা পরে আছে। রোদের বাবার ইচ্ছা ছিল সেখানে ছোট্ট একটা গলফ কোর্ট করার। তিনি মারা যাওয়ার পর সেই কোণাটা ওভাবেই পরে আছে।
ফিরোজার ইচ্ছা সেখানে মুরগির খামার করার। একটা খামার হলেই বাগানটা মাছ-মাংস এবং ফল-মূলে পরিপূর্ণ হবে।
কিন্তু বাগানে খামার করা নিয়ে রোদের ঘোর আপত্তি রয়েছে।
রোদের কথা, “বাগান ঘুরে বেড়ানোর জায়গা। এখানে খামার বানিয়ে সুন্দর জায়টাকে বাজার বানিয়ে ফেলার কোনো অর্থ নেই।”

সেই বাগানে বসেই এক ভোরে, সূর্যোদয় উপভোগ করছে ইরা।
       রোদ তখন দৌড়ে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, “তুমি এখানে? আর আমি তোমাকে সারা বাড়ি খুঁজছি!”
        ইরা ইশারায় রোদকে বসতে বলে। রোদ কথা না বাড়িয়ে ইরার পাশে বসে পড়ে।
        ইরা রোদের কাঁধে মাথা রেখে বলে, “আমাদের বাগানটা না, অনেক সুন্দর।”
        “হুঁ! মায়ের শখের জায়গা, সুন্দর তো হবেই।”
        “আমি ঠিক করে এখন থেকে আমি গাছ লাগাবো। গোলাপ গাছ। লাল, গোলাপী, হলুদ,কমলা সব রঙের গোলাপ গাছ থাকবে এখানে!”
          রোদ গম্ভীর গলায় বলে, “এখন তুমিও?”
           “তুমিও মানে?”
           “না মানে, মা এত দিন এই গাছ-গাছ করে আমার মাথাটা খেয়েছে! এখন তুমিও সেই দলে যোগ দিবে?”
           “আম্মা যা করেন একদম ঠিক করেন।তাছাড়া আমরা যে পরিমাণে অক্সিজেন ব্যাবহার করি এবং যে পরিমাণে গাছ কাটি, সে অনুযায়ী সারা জীবনে আমাদের ৭ লক্ষ গাছ লাগানো উচিত। তুমি সারা জীবনে ৭ টা গাছও লাগিয়েছো?”
              “ইরা, তোমার এই জ্ঞানের কথাগুলো একটা বই আকারে লিখে ফেলো! আমি নিজ খরচে ছাপিয়ে দেব।”
             ইরা হাসতে হাসতে বলে, “অবশ্যই লিখবো। অসংখ্য ধন্যবাদ!”
            
পরেরদিন খুব গভীর রাতে ইরার ঘুম ভেঙে যায়। ঘুম ভাঙার পেছনের কারণ হলো একটা শব্দ। শব্দটা নির্ঘাত আসছে রান্নাঘর থেকে।
ইরা ব্যস্ত ভঙ্গিমায় বিছানা থেকে উঠে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালো।

          “রোদ?”
          “হুঁ?”
          “এই রাতে রান্নাঘরে কি করছো তুমি?”
          “ ঘুম ভেঙে গেল। এখন কিছু না খেলে ঘুমও আসবে না। তাই ভাবলাম রান্নাঘরে এসে কিছু বানাই!”
         “ভাবলেই হলো! তুমি আবার কিছু বানাতে পারবে নাকি?”
          “চেষ্টা করলেই পারবো।”
           “তুমি ঘরে যাও আমি বানাচ্ছি!”
           
রোদ বাধ্য ছেলের মতো ঘরে চলে যায়। মধ্যরাতে সবথেকে কম সময়ে, কম পরিশ্রমে যে খাবার বানানো যায় তা হলো মাইক্রোওয়েভ পাস্তা।
একটা মগে কাঁচা পাস্তা, দুধ এবং চিজ দিয়ে তিন মিনিট মাইক্রোওয়েভ করলেই তৈরি হয়ে যায় খাবারটি। খেতে অতটা আহামরি ধরনের না হলেও রাতের ক্ষুধা মেটাতে কার্যকরী। 

ইরা ৫ মিনিটের মধ্যেই এটা বানিয়ে ঘরে চলে যায়।

        রোদ হতভম্ব গলায় বলে, “এটা তুমি এখন বানালে!”
         “হ্যাঁ!”
        ‌“কিভাবে সম্ভব?”
        “চাইলেই সম্ভব! এখন তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো আর আমাকেও ঘুমাতে দাও!”

ইরা অন্য মেয়েদের মত খুব ছোট ছোট বিষয় নিয়ে রাগ করেনা। কিন্তু ইরা যখন রেগে যায়, তখন বুঝতে হবে কেউ কোনো বিরাট অপরাধ করেছে।
ইরা এখন বেশ রেগে আছে, রাগ করার পেছনের কারনটা হলো সিগারেট।
একটা মানুষ ও তার পরিবারকে বিপর্যস্ত করে তোলার জন্য সিগারেট যথেষ্ট। তাই বিয়ের আগেই ইরা রোদকে সিগারেট খেতে নিষেধ করেছিল।
কিন্তু কিছুক্ষণ আগেই রোদের শার্টের পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট পায় ইরা।

রোদ তখন বারান্দায় বসে পত্রিকা পড়ছে।
ইরা প্রায় ছুটতে ছুটতে বারান্দায় যায়।

       “রোদ?”
        “হুঁ?”
       ইরা সেই সিগারেটের প্যাকেট রোদ দেখিয়ে বলে, “এটা কি?”
      রোদ স্বাভাবিক গলায় বলে, “সিগারেটের প্যাকেট!”
      “এটা তোমার পকেটে কি করছিলো?”
       “কাল সন্ধ্যায় কিনেছিলাম।”
        “কেন জানতে পারি?”
        “অবশ্যই পারো। আসলে কাল আমার অফিসে খুব কাজের চাপ ছিল তো, তাই স্ট্রেস কমানোর জন্যে সিগারেট খেতে ইচ্ছে হলো।”
          “স্ট্রেস কমাতে সিগারেট খেতে হবে এটা কোন দেশী লজিক? তাছাড়া আমি তো তোমাকে একদিন না হাজার দিন মানা করেছি সিগারেট খেতে! আমার কথার তো দেখছি কোনো মূল্যই নেই তোমার কাছে!”
            “ইরা, তুমি এখন খুবই উত্তেজিত অবস্থায় আছো। একজন উত্তেজিত মানুষকে কোনো কিছু বোঝানো যায় না। তাই আমি এখন তোমাকে কিছু বোঝাবো না।”
           “ফড়ফড় করা বন্ধ করো। তুমি খুব ভালো করেই জানো যে তুমি দোষ করেছো!”
          “হ্যাঁ জানি। জানি এবং স্বীকারও করে নিচ্ছি।”

ইরা উত্তেজিত অবস্থায় বারান্দা থেকে বের হয়ে যায়।

ঘন্টা দুয়েক পর ইরার রাগ কমলে, বান্দায় গিয়ে দেখে রোদ মন খারাপ করে আকাশের দিকে তাঁকিয়ে আছে।
ইরা কোনো কিছু না ভেবে দৌড়ে গিয়ে রোদকে জড়িয়ে ধরে।
        “আই এম স্যরি।”
         “তুমি স্যরি হতে যাবে কেন? আমি স্যরি। আমিই তো তোমার কথা শুনিনি।”
          ইরা কাঁদতে কাঁদতে বলে, “রোদ, বিশ্বাস কর আমি কখনোই চাই না তোমার কোনো ক্ষতি হোক। তোমার কোনো ক্ষতি হলে আমি বাঁচতে পারবো না। তাই আমি তোমাকে সিগারেট খেতে নিষেধ করেছিল।”
        রোদ ইরাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে বলে,  “তোমাকে কথা দিচ্ছি, আর কোনো দিনও সিগারেট স্পর্শ করবো না!”
      
ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর যেকোনো বিষয় নিয়ে ফিরোজা একটা বাড়াবাড়ি পর্যায়ে না হওয়া পর্যন্ত তার শান্তি হয় না।
বাড়িভর্তি কাজের লোক। ফিরোজা যখনই যা চাচ্ছেন, হাতের নাগালে পেয়ে যাচ্ছেন। তাই ওনার বাড়াবাড়ি করাটা শোভনীয়।
কিন্তু এমন অনেক মানুষ আছেন যাদের বাড়িতে কাজের লোকের নাম-গন্ধ পর্যন্ত নেই। তাদের ছোট ছোট বিষয় নিয়ে বাড়াবাড়ি করা উচিত নয়।
নাস্তা করা নিয়ে ফিরোজার বাড়াবাড়ি কিছুটা এমন – টেবিলে ইন্ডিয়ান, ইটালিয়ান, ইংলিশ, জাপানিজ এবং বাংলাদেশী সব ধরনের নাস্তা থাকতে হবে। যদিও তিনি বাংলাদেশী নাস্তা খাবেন, তারপরেও চোখের শান্তির জন্যে অন্যান্য দেশের নাস্তাগুলো থাকতে হবে।
বাসার সবাই যে যেখানে থাকুক না কেন, নাস্তার টেবিলে সময়মতো আসতে হবে।

রোদ ইরাকে নিয়ে নাস্তায় টেবিলে এসেছে।
        ইরাকে দেখে ফিরোজা চিন্তিত গলায় বলেন, “কি ব্যাপার ইরা? তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?”
         ইরা বলে, “কেমন দেখাচ্ছে আম্মা?”
         “মনে হচ্ছে তুমি যেন অনেক ক্লান্ত, সারা রাত ঘুম হয়নি!”
        ‌  “না, না আম্মা। ঘুম হয়েছে। কিন্তু কাল দেরিতে ঘুমিয়েছিলাম তো তাই কম ঘুম হয়েছে।”
    
ইরা ব্যস্ত ভঙ্গিমায় নাস্তা খেয়ে ঘরের দিকে পা বাড়ালো। কিন্তু চেয়ার থেকে উঠতেই ইরা মাথা ঘুরে পড়ে যায়।
রোদ ইরাকে কোলে করে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দেয়।

মিনিট দশেকের মধ্যে ইরার জ্ঞান ফেরে।
        “কি হয়েছে রোদ?”
        “তুমি সেন্সলেস হয়ে পরেছিল।”
        “সে কি!”
        “দুপুরে খাওয়া দাওয়া সেরেই তোমাকে নিয়ে হসপিটালে যাবো।”
         “একটু মাথা ঘুরে পড়ে গেছি, এজন্য আবার হসপিটালে যেতে হবে নাকি?”
          “হ্যাঁ যেতে হবে। তুমি বেশি কথা না বলে চুপচাপ শুয়ে থাকো!”

বিকেলের দিকে রোদ ইরাকে নিয়ে হসপিটালে চলে যায়।
ড.হাফিজ, গাইনোকলোজিস্ট। ওনার চেম্বারটা বেশ সুন্দর করেই গোছানো।
দেয়ালে মা ও শিশুর যত্ন সম্পর্কিত বেশ কয়েকটা পোস্টার টানানো। পোস্টারগুলো পাশেই একজন বৃদ্ধার ছবি, সম্ভবত ওনার মায়ের ছবি।
কিছুটা দূরে একটা দেয়াল ঘড়ি। ইরা সেই ঘড়ি দেখে অবাক না হয়ে পারলো না, কারন ঘড়িটার কোনো কাঁটা নেই। একজন ডাক্তারের চেম্বারের ঘড়ি বন্ধ! হতে পারে তিনি বিষয়টা খেয়াল করেননি, কিংবা হতে পারে উনি সময়কে তোয়াক্কা করেন না। সময় চলবে সময়ের মতো, আমি চলবো আমার মত – টাইপ মানুষ তিনি।

ডাক্তাররা স্বভাবতই বেশি কথা বলেন। ড. হাফিজও তার ব্যতিক্রম নন। তিনি অনবরত কথা বলছেন, শ্রোতা রোদ। ইরা কিছুই শুনছে না, শোনার চেষ্টাও করছে না। মনোযোগ দিয়ে দেখছে ঘরটার সাজসজ্জা।

     চেম্বার থেকে বেরিয়ে ইরা আগ্রহ নিয়ে বলে, “কি বললেন উনি?”
      “তুমি তো ভিতরেই ছিলে!”
      “শুনিনি। ডাক্তারদের কঠিন কঠিন কথাগুলো আমার মাথায় ঢোকে না। উনি এতক্ষণ যা যা বলেছেন, তুমি সহজ বাংলায় আমাকে বুঝিয়ে বলো।”
        “বলার মত অনেক কিছুই বলেছেন। কিন্তু সারমর্ম হলো উনি কতগুলো টেস্ট দিয়েছেন, যেগুলোর রেজাল্ট আজকের মধ্যেই ওনাকে দেখাতে পারলে ভালো হয়।”
        “ডাক্তারদের এই একটা বিষয় আমার অসহ্য লাগে। সামান্য একটা সমস্যার জন্যেও টেস্ট!”
         “কিছু করার নেই, নিজের ভালো চাইলে ডাক্তারদের কথা মানতে হবে।”
         “আচ্ছা আজকে টেস্ট করালে, রিপোর্ট আজকেই দিবে?”
          “অবশ্যই দিবে, কারন উনি প্রেসক্রিপশনে ‘ইমারজেন্সি’ কথাটা লিখে দিয়েছেন।”

ইরা বিরক্ত হয়ে টেস্টগুলো করাতে চলে গেল।

টেস্টগুলো করা শেষ হলে রোদ এবং ইরা রিপোর্টের জন্যে বসে আছে।
        রোদ ক্লান্ত গলায় ইরাকে বলে, “ইরা? তোমাকে বাসায় দিয়ে আসবো?”
         “নাহ্! কয়েক ঘণ্টার ব্যাপারই তো।”
         “আমার কি ধারনা জানো?”
          “কি?”
          “আমাদের মাঝে জুনিয়র ইরা আসছে।”
           ইরা হাসতে হাসতে বলে, “যদি তাই হয়, তাহলে আমার থেকে বেশি খুশি, আর কেউ হবে না।”
             “তাই হবে দেখো!”

১ ঘণ্টার মধ্যে রিপোর্ট চলে এলো।  রিপোর্ট হাতে পেয়ে রোদ সাথে সাথে ড.হাফিজের চেম্বারে চলে গেল।

ড. হাফিজ অনেক্ষণ যাবত ইরার রিপোর্টটা নাড়াচাড়া করে দেখছেন।
           তিনি ভ্রু সামান্য কুঁচকে বলেন, “মি.রোদ, আপনি ড.নাহিদের চেম্বারে চলে যান। আমি ফোন করে বলে দিচ্ছি যাতে আপনাদের অপেক্ষা করতে না হয়।”

ড. নাহিদের চেম্বারের সামনে এসে রোদ চমকে ওঠে। কারণটা হলো, ড. নাহিদ একজন নিউরোলজিস্ট।

নাহিদের চেম্বারে ঢুকে রোদ ইরার রিপোর্টের ফাইলটা নাহিদকে এগিয়ে দেয়।
       ড. নাহিদ রিপোর্টগুলো ভালোমত দেখে ইরাকে বলেন, “আপনার নামই তাহলে ইরাবতী! এই রিপোর্টগুলো আপনার তাইতো?”
        ইরা ঠোঁটে মুচকি একটা হাসি নিয়ে বলে, “জ্বী।”
        “দেখুন কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার আগে আপনাদের মনোবল রাখতে হবে।”
        রোদ শুকনো গলায় বলে, “সব কিছু ঠিক আছে তো ডক্টর?”
          “দেখুন এমন কিছু বলার সময় আমাদেরও খারাপ লাগে। কিন্তু কিছুই করার নেই, বিষয়টা এই মুহূর্তে আপনাদের জানা খুবই জরুরি।
ইরাবতীর ব্রেইন টিউমার, বেশ অনেক দিন ধরেই। লক্ষণগুলো কখনো প্রকাশ পায়নি, তাই এত দেরিতে ধরা পরেছে।”

রোদ কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকে। তার গা বেয়ে শীতল হওয়া বয়ে গেল।
           অবশেষে রোদ মুখ খুলে আহত গলায় বলে, “এটা কিভাবে বলতে পারেন আপনি? মাত্র কয়েকটা টেস্টের ভিত্তিতে আপনি এত বড় একটা কথা কিভাবে বললেন আপনি?”
            “একজন মানুষ হয়ে অন্য আরেকজন মানুষকে এত কষ্টদায়ক কথা বলতে আমারও খারাপ লাগে।”

ইরার মধ্যে কোনো রকমের প্রতিক্রিয়া কাজ করছে না। চুপচাপ নিচের দিকে তাকিয়ে সে ভাবছে, ব্রেইন টিউমার মানে কি? মরে যাওয়া? মৃত্যুর কাছাকাছি যাওয়া? নাকি সারাজীবন মৃতের মত বিছানায় পরে থাকা?

রোদ ইরা নিয়ে নাহিদের চেম্বার থেকে বেরিয়ে গেল। তারা দুজনে চুপচাপ বসে আছে।
           রোদ কিছুক্ষণ পর শুকনো গলায় বলে, “ইরা শোনো, কাল সকালে অন্য আরেক ডাক্তারের কাছে যাবো। দেখো তিনি বলবেন যে এরা উল্টোপাল্টা কথা বলেছে, তোমার কিছুই হয়নি।”
ইরা চুপ করে বসে থাকে।

পরেরদিন রোদ ইরাকে নিয়ে অন্য এক হসপিটালে যায়।
      সেখানকার ডক্টর ইরার রিপোর্টগুলো ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে বলেন, “ওনারা ঠিকই বলেছেন। এটা ব্রেইন টিউমারই।”

রোদ অনেক্ষণ চুপ করে থাকে। তার সমস্ত শরীর থর থর করে কাঁপছে।
        নিজেকে সামলে রোদ বলে, “আমরা এখন কি করবো ডক্টর?”
         “দেখুন ওনার টিউমারটা একবার অপারেশন করলে আর দ্বিতীয়বার হওয়ার আশঙ্কা থাকবে না। উনি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যাবেন। কিন্তু ব্রেইনের যে জায়গায় টিউমার রয়েছে সেই জায়গায় অপারেশন করাটা বেশ রিস্কি।”
          ইরা কাঁপা গলায় বলে, “যদি অপারেশন না করাই তাহলে কি হবে?”
          “তাহলে আপনার অসুস্থতা বেড়ে যাবে। বমি বমি ভাব, মাথা ব্যাথা, চোখে ঝাপসা দেখা এসব মাত্রাতিরিক্ত ভাবে বেড়ে যাবে।
আর অপারেশনটা করলেই আপনি পুরোপুরি সুস্থ!”
           “আপনি যে রিস্কের কথাটা বললেন, সেটা কি ধরনের রিস্ক?”
            “টিউমারটি আপনার ব্রেইনের খুব সেনসেটিভ অঞ্চলে। তাই অপারেশনের সময়ে প্রচুর রক্তক্ষরণ হতে পারে।”
            ইরা হতাশ গলায় বলে, “প্রচুর রক্তক্ষরণ হলে কি আমি মারা যাবো?”
            রোদ ইরাকে থামিয়ে দিয়ে বলে, “ইরা! একদম বাজে কথা বলবে না। কিচ্ছু হবে না তোমার। ডক্টর, আমরা অপারেশন করাবো।”
             “তাহলে যত দ্রুত পারেন ওনাকে অ্যাডমিট করে ফেলুন। আমরা ৭ দিন অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে অপারেশনে যাবো।”

পরেরদিন ইরাকে হসপিটালে ভর্তি করা হয়। ওষুধ, সেলাইন, ইনজেকশন এসব নিয়ে ছোটাছুটি করছে।

মানুষের মন বড়ই অদ্ভুত। মাত্র দুদিন আগে ইরা জানতে পেরেছে তার ব্রেইন টিউমার সম্পর্কে। খবরটা জানার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত তার মাথায় যন্ত্রণা করছিল না।
কিন্তু জানার পর থেকেই মাথায় একটা সুক্ষ্ম যন্ত্রণা অনুভব করছে।

সকালে ইরার বাবা মা এসেছিলেন। ঘন্টাখানেক কান্নাকাটি করে বাইরে গিয়ে বসেন তারা। পরের শিফটে কান্নাকাটি করেন ফিরোজা।
একটা অসুস্থ মানুষের সামনে কান্নাকাটি করে তাকে আরো অসুস্থ করে দেওয়ার কোনো অর্থ নেই। অসুস্থ মানুষটার চারপাশের সকলের উচিত তাকে সাহস জোগানো, বেঁচে থাকতে অনুপ্রেরণা দেওয়া।
  
ইরা চোখদুটো বুজে শুয়ে আছে। রোদ তখন কেবিনে ঢুকলো। ইরার পাশে বসে, তার ডান হাতটা ধরে।
        ইরা স্বাভাবিক গলায় বলে, “কি রোদ? ভয় লাগছে?”
রোদ কোনো জবাব দেয় না।
          ইরা আবার বলতে শুরু করে, “ভয় পেওনা। আমি তোমাকে ছেড়ে এত সহজে যাচ্ছি না! দেখো, আমার কিচ্ছু হবে না।”
          রোদ অনেক কষ্টে স্বাভাবিক গলায় বলে, “আমি জানি তুমি কোথায় যাচ্ছ না। তোমার সাথে এখনো অনেক হিসেব-নিকেশ বাকি আমার।”
            “কান্না চেপে রেখেছ কেন রোদ? কান্না চেপে রাখলে কিন্তু কষ্ট বেড়ে যায়। যাও, বাইরে গিয়ে মন খুলে কাঁদো। আমার সামনে আবার কেঁদো না। তোমাকে কাঁদতে দেখলে আমার কষ্ট হবে।”
রোদ বাইরে গিয়ে কিছুক্ষণ চিৎকার করে কাঁদে। ইরা ঠিকই বলেছে, কান্না চেপে রাখলে কষ্টের ভার বেড়ে যায়।

ইরার কেবিনটা খুব সুন্দর করে সাজানো। চারিদিকে ফুলদানিতে গোলাপের গুচ্ছ, ঝুড়িতে ফলমূল। কেবিনে বড় বড় দুটো জানালা আছে। সেই জানালা দিয়ে ভরপুর আলো বাতাস আসে।
ইরা জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। আকাশটা যেন তাকেই ডাকছে।

রোদ তখন এসে ইরার হাতটা ধরল।
         ইরা হতাশ গলায় বলে, “জানো আমার না অনেক শখ শান্তিনিকতনের মত আমিও নিজের একটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান করবো। নাম দিব, ইরাবতীর ইশকুল। নামটা সুন্দর না?
       “অনেক সুন্দর। অবশ্যই তোমার সব স্বপ্ন পূরণ করবে। আগে সুস্থ হয়ে ওঠো! তোমার কথা বলতে অনেক কষ্ট হচ্ছে। আর কথা বলোনা তো।”
        “তোমার সাথে কথা বলতে অনেক ইচ্ছে করছে রোদ। আর তো কোনো দিনও বলতে পারবো না।”
        “কে বলেছে বলতে পারবে না? অবশ্যই পারবে!”
        ইরা রোদের কপালে হাত রেখে বলে, “তোমার তো জ্বর! ওষুধ খেয়েছ?”
        “না না আমার কিছু হয় নি। আমি ঠিক আছি।”
         “নিজের দিকে একটুও খেয়াল রাখছো না। তাই না?”
           “আমি ভালো মতোই নিজের যত্ন নিচ্ছি।”
           “তোমাকে দেখে বেশ বুঝতে পারছি, তুমি খাওয়া দাওয়া, ঘুম সব বাদ দিয়ে আমার কাছে পরে আছো!”
             “আমাকে নিয়ে এত ভাবতে হবে না! তুমি ঘুমানোর চেষ্টা করো।”

ইরা সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর থেকে রোদকে দেখতে পাচ্ছে না। হয়তো রোদ আড়ালে দাঁড়িয়ে কাঁদছে।
          ইরা বিড়বিড় করে তার মাকে বলে, “রোদ কোথায় মা?”
           “এই তো, বাইরেই আছে।”
           “ওকে একটু ডেকে দাও তো।”

ইরার মা বাইরে গিয়ে রোদকে বলে, “বাবা ইরা ডাকছে!”

রোদ চোখেমুখে পানি ছিটিয়ে ইরার কাছে যায়। ইরার কথা বলার শক্তি নেই। তারপরও কথাগুলো রোদকে বলা দরকার। কাল ইরার অপারেশন করা হবে। এই কথাগুলো হয়তো কখনো রোদকে বলা হবে না।
ইরা লক্ষ করল রোদের চোখভর্তি পানি। মনে হচ্ছে অনেক্ষণ কান্নাকাটি করছে।

        ইরা বিড়বিড় করে রোদকে বলে, “রোদ? আমার কাছে বেশি সময় নেই।”
         “তুমি এসব আজেবাজে চিন্তা বন্ধ করো তো ইরা।”
          “আজেবাজে কথা নয়, সত্যি কথা। একজন মানুষ কিন্তু তার মৃত্যুর আগে বুঝতে পারে যে, সে মারা যাচ্ছে। আমিও পারছি।”

রোদ শক্ত করে ইরার হাত চেপে ধরে।
      ইরা বলে, “তোমার অনেক কষ্ট হবে আমি চলে যাওয়ার পর। কিন্তু তাই বলে জীবনে থেমে যেও না কিন্তু।
তুমি কিন্তু অবশ্যই চমৎকার একটা মেয়েকে বিয়ে করবে, তার সঙ্গে সুখে শান্তি জীবন কাটাবে!”
      “আহ্ ইরা! থামো তো এবার। তোমার কিচ্ছু হবে না। আমি তোমার সঙ্গেই সুখে শান্তিতে জীবন কাটাবো।”
        “রোদ, আমার আয়ু আর মাত্র কয়েক ঘন্টা। আমার কথাগুলো মন দিয়ে শোনো।
একদম ভেঙে পরবে না কিন্তু, নিজের খেয়াল রাখবে। ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করবে, সিগারেট একদম খাবে না! আর দিন অন্তত একবার আমাকে মনে করবে।”

রোদ থমকে যায়। এসব কথার কোনো উত্তর তার জানা নেই। তার কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়।

সকাল থেকেই নার্সরা বেশ ছোটাছুটি করছে। কিছুক্ষণ পরেই ইরার অপারেশন।
অপারেশন থিয়েটারে যাওয়ার আগে ইরা শেষ বারের মতো রোদকে দেখে নিল। রোদকে এর আগে এত বিপর্যস্ত কোনো দিন বোধ হয় দেখেনি ইরা।
         ইরা রোদকে জড়িয়ে ধরে বলে, “রোদ, তোমাকে একটা কথা কখনো বলা হয়নি। তোমর হাসিটা অনেক সুন্দর। তুমি না কখনো কাঁদবে না। কাঁদলে তোমাকে বিশ্রী দেখায়।”

অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হলো ইরাকে। রোদের বারবার মনে হচ্ছে এইতো কিছুক্ষণ পর ইরা হাসতে হাসতে বলবে,“কি বোকার মত কথা বলেছিলাম দেখেছো? আমার তো কিছুই হলো না! আমাকে তাড়াতাড়ি বাসায় নিয়ে চলো। ঢেঁড়স দিয়ে রুই মাছের একটা ক্লাসিক ঝোল রাঁধবো!”

কিন্তু তা হলো না।
১২ ঘন্টা পর রোদ ইরার সামনে বসে আছে। কিন্তু ইরার শরীরে নাকি প্রাণ নেই। সে নাকি আর তাকাবে না, আর কথা বলবে না।
প্রকৃতি খুব নিষ্ঠুর, খুব। ইরা তো সারাজীবন শুধু রোদের পাশে থেকে তাকে ভালোবাসতে চেয়েছিল। ইরার সেই একমাত্র ইচ্ছেটাও পূরণ হতে দিলো না প্রকৃতি।

রোদ দুহাতে ইরার ডান হাতটা চেপে ধরেছে।
       অস্পষ্ট গলায় বলল, “ইরা তাকাও তো! তোমাকে বাসায় যেতে হবে, ইরাবতীর ইশকুলের কাজ শুরু করতে হবে। ইরা উঠো!
তোমাকে না নিয়ে আমি যাবো না।”

(চলবে)

RELATED ARTICLES

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments

Md masrur Hasan mahi على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
আমিনুল ইসলাম على প্রয়োজন পর্ব: ৩০ ( অন্তিম)
সাজিবুল ইসলাম على ধর্ষিতাবউ২ ৯ তথা শেষ পর্ব
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
Nita Sarkar على স্বপ্নীল ৬৮
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على রহস্য শেষ_পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على অলক্ষ্যে তুমি পর্ব-০৬ এবং শেষ পর্ব
Nazmun Nahar Akhi على Psycho_is_back? part_7
Nazmun Nahar Akhi على Dangerous_Villian_Lover part 2
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على জানালার ওপারে পর্ব-১৭ এবং শেষ পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على লীলা বোর্ডিং ১২১৫ পর্ব-১১ এবং শেষ পর্ব
মিজানুর রহমান রাহুল على সেই তুমি পর্ব-০১
@feelings على প্রহেলিকা
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Nusrat jahan على coffee & vanilla Part-10
Pallabi Roy على স্বপ্নীল ৬৮
M.D Mahabub على The_Villain_Lover Part_2
Labani sarkar على Dangerous_Villain_Lover part 23
MD Akas Apc على বিবেক
Tanisha Ahmed على Devil love part-18 
Aius Barmon shorob على নারীর দেহকে নয়
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Priya Banerjee على devil love married life last part
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Riya Biswas على তুমি রবে ৫২
Mohammad Adib على তুমি রবে ৬০
Avni Ayesha على তুমি রবে ২৮
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
সুমিত على তুমি রবে ২৮
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
Samiah Begum على তুমি রবে ৫১
biddut das rocky على নর নারী
গল্প পোকা على নষ্ট গলি শেষ পর্ব
Md Jobayer Hossain Shohag على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على দুই অলসের সংসার
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤৪২.
A.J.S Rakib على মন ফড়িং ❤৪২.
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
Samiya noor على গল্পঃ ভয়
Sadikul على গল্পঃ ভয়
Samia Islam على গল্পঃ ভয়
শূন্য মায়া على মন ফড়িং ❤ ৪০.
Sutapa biswas على মন ফড়িং ❤৩৯.
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৮.
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৭
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
Siyam على বিবেক
Sudipto Guchhait على My_Mafia_Boss পর্ব-৯
saptami karmakar على devil love married life last part
saptami karmakar على devil love married life last part
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ২৬.
Shreyashi Dutta على  বিয়ে part 1
Sandipan Biswas على  বিয়ে part 1
Paramita Bhattacharyya على অনুরাগ শেষ পর্ব
জামিয়া পারভীন তানি على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
মায়া على মন ফড়িং  ২২
সুরিয়া মিম على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على মন ফড়িং ২১
গল্প পোকা على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
Sahin ssb على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৮. 
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৭.
Jannatul Ferdous على খেলাঘর পর্ব-৩৫
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ফাল্গুনের_ফুল last_part_8
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ছাত্রী যখন বউ পাঠঃ ১
গল্প পোকা على বাজির প্রেম পাঠঃ ১
Foujia Khanom Parsha على মা… ?
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৮
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
Ibna Al Wadud Shovon على স্বার্থ