স্নিগ্ধ প্রেমের মায়ায় পর্ব-১৩(অন্তিম পর্ব)

0
1439

#স্নিগ্ধ প্রেমের মায়ায়
#অন্তিম পর্ব
#লেখিকা সাদিয়া জান্নাত সর্মি

সকাল বেলা রুম থেকে বের হয়ে আমি বাবা বাবা বলে চেঁচাতে চেঁচাতে নিচে এলাম। কালকের পর থেকে আমি বাবাকে এক মুহুর্তের জন্যও দেখতে পাই নি, সেই সকালে বাবা বাসা থেকে দরকারি কাজের জন্য বের হয়েছিল তার পর থেকে আর দেখিনি বাবাকে, এমন কি হৃদান ভাইয়ের লাশের কাছেও না। আমার চেঁচামেচি শুনে বাসার সবাই বসার রুমে চলে এলো, সবার দিকে তাকিয়ে আমি অবাক হলাম।সবার চোখের কোণে পানি জমে আছে, আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম,, বাবা কোথায় মামনি?কাল থেকে বাবা কে কোথায়ও দেখছি না যে?
মামনি আমার প্রশ্ন শুনে নিচের দিকে তাকিয়ে চুপ করে রইলেন, ভাইয়া এতোক্ষণ শান্ত ছিল কিন্তু আমার প্রশ্ন শুনে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করল।

তোমার বাবা কোথায় সেটা আমি জানি স্নিগ্ধা।

পিছনে ঘুরে তাকিয়ে দেখি আফিফ বুকে দুই হাত ভাঝ করে দাঁড়িয়ে আছে। আমি বললাম,,কি জানো তুমি? বাবা কোথায়,,

একটু আমার সাথে এইদিকে এসো তো।
আমি আফিফের পিছু পিছু বাসার বাইরে বাগানের কাছে চলে এলাম,আফিফ আমাকে বেঞ্চে বসতে বললে আমি বেঞ্চে বসে ওকে জিজ্ঞাসা করলাম,,বলো আমার বাবা কোথায়?
আফিফ উল্টো দিকে ঘুরে দাঁড়ালো আর তার পর বললো,,

জানি না।

তাহলে তুমি বললে কেন যে তুমি জানো আমার বাবা কোথায়?

সেটা তো তোমাকে বাইরে আনার জন্য ডেকেছি আমি। নাহলে তো তুমি বাইরে আসতে না এই টুকু বলেই হঠাৎ আফিফ আমার দিকে ঘুরে আমার গলায় ছুরি ধরলো। আমি ওর এমন কর্মকান্ডে ভয় পেয়ে গেলাম খুব, তোতলাতে তোতলাতে বললাম,,,

ত ত তুমি আমার গলায় ছুরি ধরেছো কেন? আমাকে মা’র’তে চাও নাকি তুমি,এ এই টা সরাও আমার গলা থেকে, লেগে যাবে আমার।

হা হা হ,সরাবো বলে কি ধরেছি না কি গলায়? মা’রবো বলেই তো এখানে নিয়ে এসেছি তোমাকে।

ত তুমি আমাকে মা’রতে চাও কেন? আমি কি করেছি তোমার?

কি করেছো তুমি হ্যা? বলো কি করো নি আমার সাথে। তোমার কারনে আমাকে জ্বেলে যেতে হয়েছিল, তুমি স্বরযন্ত্র করে আমাকে জেলে পাঠিয়ে ছিলে। জানো আমাকে পুলিশ ধরে জেলে নিয়ে যাওয়ার পর খুব কষ্ট হয়েছিল ওখানে আমার। প্রতিদিন ওরা মা’র তো আমাকে, শক্ত লাঠি দিয়ে প্রচুর মেরেছে আমাকে।হাত পা ব্যাথা হয়ে যেতো হাঁটতে পারতাম না, কেঁদে কেঁদে বলতাম আমাকে ছেড়ে দাও কিন্তু ওরা আমাকে ছেড়ে দেয় নি। আমার চোখের পানির কোনো দাম দেয় নি ওরা,আর এই সব কিছু হয়েছে তোমার জন্য শুধু মাত্র তোমার জন্য। তখনি আমি মনে মনে ঠিক করে নিয়েছিলাম আমার মতো এতো ভয়ানক কষ্ট আমি তোমাকে ও দেবো, তোমাকে ও কাদাবো আমি।তার পর তোমাকে এই পৃথিবী থেকে বিদায় করে দিবো, তোমাকে কষ্ট দেওয়ার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হচ্ছে তোমার ভালোবাসার মানুষ।তাকে যদি আমি শেষ করে দেই তাহলে তুমি বেঁচে থেকেও মরে যাবে তখন তোমাকে শেষ করতে আমার বেশি সময় লাগবে না।তাই আমি তোমার বয়ফ্রেন্ড খুঁজতে শুরু করেছিলাম, একদিন তোমার ডায়েরী ঘেঁটে দেখলাম আয়াশ তোমার ভালোবাসার মানুষ। তাকে তুমি খুব ভালো বাসো ব্যাস আমি সেদিনই আয়াশ কে তুলে নিয়ে যাই। কিন্তু যখন আয়াশ কে অর্ধমৃত করে ফেলেছি তখন আমার লোক আমাকে ফোন করে বলল যে আয়াশের সাথে তোমার রিলেশনশিপ ভেঙে গেছে, আর তোমার বর্তমান ভালোবাসার মানুষ হৃদান যার সাথে তোমার বিয়ে ঠিক হয়েছে।কি আর করা যাবে তখন আয়াশ কে ওই অবস্থায় ওর বাসার সামনে ফেলে আসতে হলো আমাকে।তার পর প্ল্যানিং শুরু করলাম হৃদান কে মা’রার কিন্তু ওকে একা পাওয়া টা খুব কষ্টকর ছিল। দুই দিন আগে জানতে পারলাম হৃদান অফিসের কাজে শহরের বাইরে গেছে আর কালকে ফিরবে, আমার কাছে হৃদান কে মা’রার এর থেকে বেশী ভালো সুযোগ আর হয় না তাই কালকে আমার প্ল্যান মতো ট্রাকের ধাক্কায় হৃদান কে শেষ করে দিয়েছি আমি আর এখন বাকি আছো তুমি। এখন তোমাকে শেষ করে দিতে পারলেই আমার মন টা শান্তি পাবে, না হলে তোমাকে যতোদিন বেঁচে থাকতে দেখবো আমার মাথা তত খারাপ হতে থাকবে।নাও বেইবি ইউর ট্রান,গুড বাই বেইবি।।

আফিফের কথা শুনে আমি যতো টা অবাক হলাম তার থেকে বেশি মাথায় রাগ চেপে বসলো। আমার হৃদান ভাই কে ও এক্সিডেন্ট করিয়ে মেরে ফেলেছে এই কথাটাই আমার শরীরে আগুন ধরিয়ে দিলো। আমি এক ঝটকায় আফিফের হাত থেকে হঠাৎ করে ছুরি টা টান দিয়ে নিয়ে নিলাম, এই ভাবে হঠাৎ করে টান দেওয়ায় আমার গলাতে হালকা আঁচড় কেটে গেল ছুরি দিয়ে। আমি এমন একটা কাজ করে বসবো এটা হয়তো আফিফ স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি, কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে গেল,যেই মেয়ে মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে আছে সেই মেয়ে এইভাবে সাহস দেখিয়ে ওর হাত থেকে ছুরি টা নিয়ে নিবে এটা ওর স্বপ্নাতিত। আমি আফিফের হাত থেকে ছুরি টা নিয়ে দাড়িয়ে ওর গলাতেই ধরলাম, চিবিয়ে চিবিয়ে বললাম,,, তুই আমার হৃদান ভাই কে মেরে ফেলেছিস আবার এটা গর্ব করে বলছিস আমাকে? আমার জীবনে সুখ পাখি একটু ধরা দিতে চেয়েছিলো কিন্তু তুই সেটা কে শেষ করে দিয়েছিস আফিফ। এবার তুই আমাকে কি মা’রবি আমি নিজেই তোকে মেরে ফেলবো, আমার হৃদান ভাই কে মা’রার শাস্তি আমি নিজে হাতে দেবো তোকে এর পরে আমার জেল হবে না কি হবে হোক কিন্তু আমি তোকে ছাড়বো না।
আফিফের দিকে আগুন চোখে তাকালাম আমি, ওর মুখে একটা অন্যরকম ভয় কাজ করছে।যেটা দেখে মনে হচ্ছে ও আমার হুমকি তে নয় অন্যকিছু তে মারাত্মক ভয় পেয়েছে।ও ঠিক তাকিয়ে আছে আমার পিছন দিকে, আমার দিকে নয়, আমি অনেকটাই অবাক হয়ে ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে আমার পিছনে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম। পিছনে ঘুরে তাকিয়ে আমার হাত থেকে ছুরি টা পড়ে গেল, হাত পা কাপাকাপি শুরু করলো আমার। মাত্র কয়েক ফুট দুরত্বের ব্যবধানে হৃদান ভাই হাসি মুখে দাঁড়িয়ে, গায়ে হলুদ রঙের একটা পাঞ্জাবি আর সাদা পায়জামা পড়া।আফিফের প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে আমি ভুত বলে যেই চেঁচাতে যাবো তখনি হৃদান ভাই এগিয়ে এসে আমার মুখে হাত চেপে ধরলো। আমার মুখে হাত চেপে ধরে চোখ দিয়ে কাকে কি যেন ইশারা করলো, আমি ধরেই নিয়েছি এটা একটা দুঃস্বপ্ন দেখছি।হৃদান ভাই কে খুব ভালোবাসি তো তাই হয়তো ও বেঁচে আছে এটা স্বপ্নে দেখছি,এক হাত দিয়ে আরেক হাতে চিমটি কাটলাম, সঙ্গেই ব্যাথা পেলাম খুব। মুখে অস্ফুট স্বরে আহ্ বলে উঠলাম কিন্তু মুখে হাত চাপা থাকার কারণে শব্দ বাইরে এলো না।হৃদান ভাই আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল,,, একদম ভয় পাওয়ার চেষ্টা ও করবি না। আমি মরে যাই নি বেঁচে আছি।
এই টুকু বলে হৃদান ভাই আমার মুখ থেকে হাত সরিয়ে নিল, আমি বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে রইলাম হৃদান ভাইয়ের দিকে।চোখ কে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে আমার,কাল যাকে লাশ হিসেবে দেখলাম আজ সে জীবিত জলজ্যান্ত অবস্থায় আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে আর বলছে সে বেঁচে আছে। আমি কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে হৃদান ভাই কে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করলাম, কেন জানি মনে হচ্ছে এটা আমার স্বপ্ন তার পরেও স্বপ্নে হৃদান ভাই কে কাছে পেয়েছি তাকে জড়িয়ে ধরতে বাধা কোথায়। হোক না এটা স্বপ্ন তার পরেও তো পেয়েছি ওকে,কাদছি আর ভাবছি মানুষ তাহলে স্বপ্নেও কাঁদতে পারে। তখন হঠাৎ করে কে যেন বললো,, এই নির্লজ্জ মাইয়া, বাসার সবার সামনে একটা ছেলে কে জড়িয়ে ধরে আছিস?বলি লজ্জা করছে না তোর সবার সামনে এইভাবে প্রেম করতে?
আমি ভ্যাবাচেকা খেয়ে ঘুরে তাকিয়ে দেখি বাসার সবাই কিছু টা দূরে দাঁড়িয়ে। ওদের সাথে বাবা ও আরো কয়েক জন পুলিশ সদস্য আফিফের হাতে হাতকড়া লাগিয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, আমি এইসব দেখে অবাকের চরম সিমায় পৌঁছে গেলাম। এইসব কি হচ্ছে, পুলিশ এইখানে কেন?

হৃদান ভাই হয়তো আমার মনের অবস্থা বুঝতে পারলো তাই বললো,, তুই খুব অবাক হচ্ছিস জানি। তাহলে শোন, আমি সত্যিই মারা যাই নাই স্নিগ্ধ। কালকে তুই আমাকে লাশ হিসেবে দেখিছিলি ঠিকই কিন্তু আমি তখন জীবিত ছিলাম।লাশ সেজে মৃত্যুর এই নাটক টা করতে হয়েছিল আফিফের মুখ দিয়ে সবকিছু স্বীকার করানোর জন্য। কালকে সকালে যখন আমি আমার কাজ শেষ করে অফিস থেকে বাসার পথে ফিরছিলাম তখন ফুপা আমাকে ফোন করে আফিফের প্ল্যানিং এর ব্যাপারে বলে,আফিফ যখন ফোনে কারো সাথে এই প্ল্যানের ব্যাপারে কথা বলছিল তখন ফুপা সবকিছু শুনে ফেলে আর আমাকে ফোন করে বলে।ফুপার কাছ থেকে আমি সবকিছু শুনে একটা প্ল্যান করি আফিফের জন্য। আমি আগেই জানতে পেরেছিলাম আয়াশের কথা, আয়াশ কে যে আফিফ মেরেছে সেটা আমি গোপন সূত্রে খবর পেয়েছিলাম আর তার কারণ যে তুই সেটাও জেনে ছিলাম। সেই কারণেই আমার গাড়িতে আমি অটো ড্রাইভ সেট করে দিয়ে এক্সিডেন্ট স্পোটের আগেই গাড়ি থেকে নেমে যাই আর একটু পরেই গাড়ির এক্সিডেন্ট হয়। কিন্তু আফিফের কাছে আমার মৃত্যুর ব্যাপার টা সত্যি করার জন্য পুলিশের সাহায্য নিয়ে নিজের মিথ্যা মৃত্যুর নাটক টা করি। আমি জানতাম আমি মারা যাওয়ার পর আফিফ তোকে মেরে ফেলতে চাইবে আর কেউ কাওকে মেরে ফেলার আগে তাকে কেন মা’রছে সেই সত্যি টা ওকে জানায়।ব্যাস আমরা সবাই এই মুহূর্তেরই অপেক্ষায় ছিলাম আর আমাকে এইসব কিছু করতে সাহায্য করেছে বাসার সবাই সাথে তোর ছোট ফুপিও। উনি মা হলেও নিজের সন্তানের অন্যায় কে প্রশ্রয় দেননি তাই তিনি আমাকে সাহায্য করেছেন।

পরক্ষনেই হৃদান ভাই আমার গালে একটা হাত রেখে বলল,আই এম সরি স্নিগ্ধ। তোকে খুব কষ্ট দিয়েছি এই মিথ্যে নাটক করে তার জন্য রিয়েলি ভেরি সরি। কিন্তু দেখ আমি তোকে বেশিক্ষণ কষ্ট দেই নি আফিফের সত্যি এতো তাড়াতাড়ি সামনে চলে এসেছে যে তোকে এক দিনের বেশি কষ্ট পেতে হয় নি।

_______________________________

ছাদের এক কোণে হৃদান ভাইয়ের বুকে মাথা রেখে বসে আছি আমি।যেই যায়গায় একদিন বসে শাস্তি পেয়েছিলাম আজ সেই জায়গায় বসে ভালোবাসা পাচ্ছি। তখন পুলিশ আফিফ কে ধরে নিয়ে গেছে আর এইবার তার অনেক দিনের জেল হবে সেটাও বলে গেছে।এতে ফুপি কষ্ট পান নি বরং খুশি হয়েছে যে তিনি তার ছেলে কে যখন মানুষ করতে পারেন নি তাহলে সেই ছেলে যখন শাস্তি পাবে তখন তার শাস্তি তে কষ্ট পাওয়া উচিত নয়।হৃদান ভাই আমাকে জিজ্ঞেস করলো,, স্নিগ্ধ তুই কি আমাকে ভালোবাসিস?
আমি একটু মুচকি হেসে বললাম,, হুম ভালোবাসি খুব বেশি ভালোবাসি তোমায়। আমিও তোমার স্নিগ্ধ প্রেমের মায়ায় জড়িয়ে গেছি খুব করে, ঠিক তোমার মত যেমন করে তুমি জড়িয়েছো।
হৃদান ভাই আমার কথা শুনে ঠোঁটে হাসির রেখা টেনে সামনের দিকে তাকালো,আজ তার খুব আনন্দের দিন। ভালোবাসার মানুষ টির মুখ থেকে সে ভালোবাসি শব্দ টি শুনতে পেয়েছে যে।

সমাপ্ত……….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে