স্নিগ্ধ অনুভব পর্ব-০৪

0
1355

#স্নিগ্ধ_অনুভব
#পার্ট:৪
#পিচ্চি_লেখিকা

অনুভব ভাইয়া গাড়ি চালাচ্ছে আর আমি তার দিকে বার বার আড় চোখে তাকাচ্ছি। কিছু জিজ্ঞেস করবো কিন্তু সাহস করে উঠতে পারছি না। জোড়ে করে একটা শ্বাস নিয়ে অনুভব ভাইয়ার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দিলাম,,
“আপনি ওদের সাথে এত সুন্দর করে কথা বললেন কেন? আপনি তো আমাকে সহ্যই করতে পারেন না তাহলে ওদের সামনে এমন ভাব কেন ধরলেন?”
অনুভব ভাইয়া গাড়ি চালানোতে মন দিয়েই বললেন,,
“কেমন ভাব ধরছি?”
“কেমন মানে? এই যে আপনি এমন ভাব করলেন মনে হলো আমরা প্রেম করে বিয়ে করেছি আর নয়তো আমাদের মধ্যে গভীর প্রেম রয়েছে।”
“হ্যা তাতে কি হয়ছে?”
এই লোককে কিছু বলাই ঠিক না। আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে আমাকেই প্রশ্ন করে। যা লাগবো না তোর উত্তর। কোনো উত্তর পাবো না জেনে জানালা দিয়ে মাথা বের করে রেষ্টুরেন্টের কথা ভাবছি।

ফ্ল্যাশব্যাক______

অনুভব ভাইয়াকে দেখে তো আমার জানের পানিই শুকিয়ে গেছে। না জানি সবার সামনে থাপ্পড় মারে। উনার দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে গালে হাত নিয়ে মাথা নিচু করে আছি। সবার সামনে আজও মার খেতে হবে! কিন্তু আমার সব ভাবনাকে মিথ্যা করে দিয়ে অনুভব ভাইয়া হাসি মুখে আমার পাশে বসে বললো,,
“স্নিগ্ধু কি হয়ছে? গালে হাত দিয়ে আছিস কেন?”
আমি উনার মুখের দিকে তাকাতেই উনি মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললো,,
“চিন্তা করিস না! আজ আমার থাপ্পড় দেওয়ার মোটেও মুড নেই তাই তোকে থাপ্পড় খেতেও হবে না। হাতটা নামিয়ে নে নয়তো সবাই আবার বলবে অনুভবের বউ অনুভবের ভয়ে গালে হাত দিয়ে বসে আছে। তখন আবারও সবাই এটাাই ভাববে আমি আমার বউকে অত্যাচার করি।”
আমি উনার কথা শুনে যেন আকাশ থেকে পড়লাম। উনি আমাকে বউ বললেন? আমাকে? সত্যি? নাকি ভুল শুনলাম? উনার দিকে তাকিয়ে দেখি ঠোট চেঁপে হাসছে।
“এই স্নিগ্ধু এটা কে রে?”
তামিমের কথা শুনে ধ্যান কাটিয়ে ওর দিকে তাকালাম। তামিম সুক্ষ্ম চোখে অনুভব ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি কিছু বলার আগেই অনুভব ভাইয়া বললো,,
“আরে স্নিগ্ধু তুই এখনো সবাইকে বলিসনি আমি কে? বাই দ্যা ওয়ে তোর বলতে হবে না আমিই বলে নিচ্ছি।”
তামিম কে উদ্দেশ্য করে নিজের হাত বাড়িয়ে বললো,,
“হেই ব্রো আ’ম অনুভব। স্নিগ্ধুর হাজবেন্ড।”
তামিম এই কথা শুনে হা করে অনুভব ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি আর কি বলবো! তাই চুপ করে মাথা নিচু করে বসে আছি। অনুভব ভাইয়া তামিমের সামনে তুরি মেরে বললো,,
“হেই কই হারিয়ে গেলে?”
“হ্যা? হ্যা..আমি তামিম। স্নিগ্ধু তন্নি আর মেঘুর বেষ্ট ফ্রেন্ড।”
“তোমরা সবাই বেষ্ট ফ্রেন্ড?”
“ইয়াপ। আচ্ছা ভাইয়া আপনি ই কি সেই অনুভব? স্নিগ্ধুর মামুনির ছেলে!”
“হুম। আমাকে চেনো দেখছি!”
“আরে চিনবো না? আপনি তো সেই অনুভব যাকে স্নিগ্ধু…..
আমি তাড়াতাড়ি তামিমের মুখ চেপে ধরলাম। এখনি বলে দিচ্ছিলো খবিশটা। এর পেটে কিছু থাকে না। আমি চোখ গরম দিয়ে তামিমের দিকে তাকিয়ে ওর মুখ ছেড়ে দিয়ে ঠিক মতো বসলাম। অনুভব ভাইয়া একবার আমার দিকে আরেকবার তামিমের দিকে তাকাচ্ছে। তামিম আমতা আমতা করে বেক্কলের মতো হাসি দিলো। অনুভব ভাইয়া ভ্রু যুগল কিঞ্চিত কুচকে বললো,,
” কি বলতে লাগছিলে বলো! যাকে স্নিগ্ধু কি?”
“ইয়ে মানে যা..যাকে হবে না ওইটা..ওইটা তো যার হবে মানে যার কথা স্নিগ্ধু প্রায়ই বলতো😬।”
মনে হলো উত্তর টা অনুভব ভাইয়ার সত্যি বলে মনে হয়নি তাই কেমন করে যেনো তাকিয়ে আছে। উনার এভাবে তাকানো দেখে তামিম এক গাল হেসে বললো,,
“সে যাই হোক এই রাক্ষসী তুই আমাকে না জানিয়ে বিয়ে করে ফেললি? আমি তো ভেবেছিলাম এই মেঘু ডাইনির পর তোর বিয়ে খাবো কিন্তু তুই তো পুরাই সেঞ্চুরি কইরা ফেলসোস। ভাইয়া এই রাক্ষসী কে সামলাতে পারবেন তো?”
“আরে বস পারবো না মানে! একদম পারবো।”
উনাদের কথার মাঝেই মেঘলা বলে উঠলো,,
“এই এই তুই কি বললি? আমি ডাইনি?” (মেঘলা)
“হ হ তুই ডাইনি!”
“এই তামিম্ম্যা তুই আমারে রাক্ষসী কইলি কোন সাহসে? তুই আমারে কি খাওয়াইছোস যে রাক্ষসী কস! এই মেঘু ওর মাথা ফাটাই দে।”
” তোরা ফাইট কর! এই যে অনুভব ভাইয়া আপনি কি এদের ঝগড়া শুনেই পেট ভরাবেন?”(তন্নি)
“নো মাই ডিয়ার শালিক পাখি,,আর এই তোমরা সবাই ঝগড়া থামাও ট্রিট দিতে আসছি সবার ঝগড়া দেখে পেট ভরালে কি হবে?”
“আচ্ছা ঠিক আছে! ঝগড়া করবো না আর।”
ওয়েটার এসে অর্ডার করা সব দিয়ে চলে গেলো। এর মধ্যেই ফাহিম ভাইয়া চলে আসলো। সবাই মিলে আড্ডা দিয়ে খেয়ে দেয়ে বেরিয়ে আসলাম।

গাড়ির ব্রেক কষার শব্দে অতীত থেকে ফিরে আসলাম। আমার আগেই অনুভব ভাইয়া বাড়িতে ঢুকে পড়লো। আমিও পিছু পিছু গেলাম। লিভিং রুমে বাড়ির সবাই বসে আছে। অনুভব ভাইয়া রুমে যাচ্ছে দেখলাম। আমাকে দেখে মামুনি ইশারায় বললো উপরে চলে যেতে। সবার মুখটা কেমন গম্ভীর হয়ে আছে। কিছু না বলে চুপচাপ উপরে চলে গেলাম। রুমে যেতেই দেখি অনুভব ভাইয়া ওয়াশরুমে ঢুকলো। আমিও একটু রেস্ট নেওয়ার জন্য বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলাম। কিছুক্ষণ পর অনুভব ভাইয়া চুল ঝাড়তে ঝাড়তে রুমে আসলো। শাওয়ার নিয়েছে উনি! চুল থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে আর ঠোটের নিচের তিল টা তে এক ফোটা পানি মুক্তর মতো চিকচিক করছে। হায়! এই অবস্থায় দেখে আরেক দফা ক্রাশ খেয়ে ঢোক গিললাম।
“হা করে না থেকে গোসল করে নে যা।”
উনার কথায় থতমত খেয়ে আমতা আমতা করে বললাম,,
“আব..আপনাকে কে বললো আমি আপনার দিকে তাকিয়ে আছি? সব সময় উদ্ভট কথা বলেন ধুর সরেন।”
আমার কথায় উনি হা করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে ধারাম করে দরজা বন্ধ করে জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিলাম।

শাওয়ার শেষ করে এসে দেখি অনুভব ভাইয়া লেপটপে কাজ করছে। ব্লাক একটা শার্ট পড়েছে। হাতা ফোল্ড করা। ওরে আল্লাহ আমি শেষ। তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে আয়নার সামনে চলে গেলাম।
“তোর হয়ছে?”
“হুমম!”
“আচ্ছা চল।”
“কোথায় যাবো? আর বাড়ির সবার কি হয়ছে? এমন গম্ভীর মুখ করে কেন ছিলো?”
“সেইটাই জানবি এখন চল!”
আমি আর কিছু না বলে উনার পিছন পিছন যেতে লাগলাম। বাইরে থেকে খেয়ে আসায় দুজনের আর খেতে হবে না। বাড়ির সবাই একেক রকম ভাবে বসে আছে। সব আমার মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে। অনুভব ভাইয়া গিয়ে সোফায় বসে ফোনে মন দিলো। কয়েক মিনিট সবাই উনার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। নিরবতা ভেঙে বাবাই বললো,,
“এরকম ভাবে বসে থাকার কি মানে অনুভব? যা বলবে তাড়াতাড়ি বলো!”
অনুভব ভাইয়া একটু ঠিকঠাক ভাবে বসে বললো,,
“আম্মু, আব্বু এখান থেকে আমার হসপিটাল যেতে প্রবলেম হয় আর তোমাদের স্নিগ্ধুরও ভার্সিটি দুরে হয়ে যায়। তাই ভাবছি আমি আর স্নিগ্ধা আমার ওই ফ্ল্যাট টা তে থাকবো!”
“এসব কি বলছিস অনুভব? ২ দিনই হয়নি তোদের বিয়ে হলো! আর মেয়েটা একা সব সামলাতে পারবে না..তুই এসব ভাবা বাদ দে।”
“আম্মু প্লিজ বুঝার চেষ্টা করো!৷ আমার এখান থেকে হসপিটালটা অনেক দুর হয়ে যায় কিন্তু আমার ওই ফ্ল্যাট টা থেকে হসপিটাল আর ওর ভার্সিটি সব টাই কাছে।”
বাবাই কি যেন ভেবে বললো,,
“স্নিগ্ধু মা তোর কি মতামত?”
বুঝতে পারছি না কি আন্সার দিবো। আমি তো মাত্র জানলাম এসব। আর সত্যি অনুভব ভাইয়ার হসপিটাল এখান থেকে অনেক টা দুরই হয়। কি করবো? আমি মামুনি তিশা আপু ওদের ছাড়া থাকতে পারবো না। আমাকে চুপ থাকতে দেখে কাকি বলে উঠলো,,
“এই মেয়ে আর কি বলবে ভাইজান! ওই ই তো অনুভবকে ফুসলিয়ে দুরে নিয়ে যেতে চায়ছে। অনুভবের বউ হতে না হতেই তোমাদেরকে পর করাতে চাচ্ছে। হুহ ঢং যত্তসব এখন আবার চুপ করে আছো দেখো!”
কাকির কথার পিঠে কি আন্সার দিবো বুঝতে পারছি না। কিছু বললেই তো শুনতে হবে আমি আশ্রীতা। তাই কিছু না বলে চুপ করেই দাঁড়িয়ে রইলাম। তখনই অনুভব ভাইয়া বললো,,
“কাকি স্নিগ্ধু জানেও না আমরা ওই ফ্ল্যাটে যাবো!তাই ওকে উলটা পালটা কথা না বলে প্লিজ কাজের কিছু বলো আর আব্বু আম্মু দেখো আমি এটুকুই বলতে আসছি আমরা ওই ফ্ল্যাটে যাবো আর আমি চায়না আমার ওয়াইফ কারো কাছে অপমানিত হোক বা কেউ তাকে অযথা আশ্রীতা বলুক।”
অনুভব ভাইয়ার কথা শুনে সত্যি অনেক অবাক হলাম। আজ উনার ব্যবহার অন্য দিনের চেয়ে অনেক স্বাভাবিক। কিন্তু কেন?
বাবাই একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,,
“কবে যাচ্ছো?”
“এই তো ২ দিন পর।”
“ঠিক আছে। তুমি তো সিদ্ধান্ত নিয়েই নিয়েছো। আর আমি জানি তোমার সিদ্ধান্ত কখনোই খারাপ হবে না। তবে প্রতিদিন না পারলেও ২ দিন পর পর এসে তোমার মায়ের সাথে দেখা করে যেও।”
এটুকু বলেই বাবাই চলে গেলো। পিছন পিছন মামুনিও চলে গেলো। মামুনি ভালো ভাবেই জানে তার ছেলেকে কিছু বলা মানেই কলা গাছের সাথে কথা বলা। কাকি বকবক বকবক করতে করতে চলে গেলো। অনুভব ভাইয়াও নিজের রুমে চলে গেলো। তিশা আপু আর আমি আছি লিভিং রুমে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছি। তিশা আপু কি বুঝে এসে আমার মাথায় হাত দিতেই চোখ তুলে তাকালাম। চোখ ২ টা ছলছল করছে কখন যেন টপ করে পানি পড়ে। আপু সামনে আসায় জাপটে ধরে কেঁদে উঠলাম,,
“এই স্নিগ্ধু কাদছিস কেন?”
“……………
” কান্না থামা বল কি হয়ছে?”
আমি একটু থেমে বললাম,,
“আ..আপু আমি জানতামও না অনুভব ভাইয়া এসব ভাবছে! বিশ্বাস করো আমি বাড়ি চেঞ্জ করার কথা বলিনি।”
“আমি জানি তো। কাকির কথায় কিছু মনে করিস না।”
“আপু মামুনি আর বাবাইও কি আমাকে ভুল বুঝলো?”
“ধুর পাগলি কি বলিস এসব! আম্মু আর আব্বু ভালো ভাবেই জানে তুই কেমন? তাই উনারা তোকে ভুল বুঝবেন না। এখন রুমে যা নয়তো ভাইয়া বকা দেবে।”
আমি আর কথা না বাড়িয়ে বাধ্য মেয়ের মতো রুমের দিকে হাটা লাগালাম। চোখ মুখ ভালো করে মুছে রুমে ঢুকতেই অনুভব ভাইয়া হেঁচকা টানে দেয়ালের সাথে চেপে ধরে বললো,,
“সব সময় ফ্যাছ ফ্যাছ করে কান্না না করে বিষয়গুলো শান্ত ভাবে হ্যান্ডেল করতে পারিস না?”
দেয়ালের সাথে চেপে ধরলেও খুব জোড়ে ধরে নাই তাই ব্যাথাও লাগছে না। উনার কথা শুনে উনার মুখের দিকে এক পলক তাকিয়ে আবার নুইয়ে গেলাম। উনি আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ওই চোখে তাকিয়ে থাকার মতো সাহস আমার নেই। তার ওপর উনি আমার এতো কাছে হার্ট বিট গুলো দৌড়ে চলেছে। ভিষন ভাবে নিষেধ করছি এত জোড়ে না দৌড়াতে কিন্তু তারা তে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে। আজ তারা কোনো মতেই আমার কথা শুনবে না। কিছুতেই না। কিছুক্ষণ ওভাবেই তাকিয়ে থাকলেন উনি। তারপর উনি আমাকে…….

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে