সুপ্ত অনুভূতি ২ পর্ব-০৫

0
2147

#সুপ্ত_অনুভূতি🍂♥️
#সিজন_২
#পর্ব_৫
#Writer_Nusrat_Jahan_Sara

আবির গেট পেরিয়ে দেখলো অনু কোথায়ও নেই৷ তারাতাড়ি কার নিয়ে আরেকটু সামনে এগিয়ে গেলো৷ রাস্তার একপাশে কার দাঁড় করিয়ে অনুকে আশে পাশে খুঁজতে লাগলো৷

আবিরঃনিজের চোখে দেখা ভুলের জন্য ও কী আমায় এভাবে শাস্তি দিবে নাকি৷
.
রাস্তাটা একেবারে নির্জন জনমানব নেই বললেই চলে৷ আবির আনাচে কানাচে ডানে বামে সবদিক দেখছে কোথাও অনু নেই৷ আবির হাল ছেড়ে দিলো৷ কারে হেলান দিয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে একমনে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো৷
অনু আবিরের থেকে একটু সামনে একটা বড় গাছের আড়ালে লুকিয়ে ছিলো সে মনে করছে আবির চলে গেছে তাই নিজেও আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে চলে যেতে নিলো৷
আবির আকাশের দিক থেকে মুখ সরিয়ে পাশে থাকাতেই সেই নীল শাড়ি পড়া মেয়েকে৷ আবির দৌড়ে অনুর কাছে গিয়ে ওর হাত ধরে টান মারলো৷ অনুর হাতে টান পরায় সে ঘাবড়ে গেলো৷ আবির মুখ দেখার আগেই সে আবারো আঁচল দিয়ে ঘোমটা দিয়ে দিলো৷ আবির রেগে অনুর হাত ছেড়ে ঘোমটা তুলে ফেললো৷

আবিরঃঅনু!!!আমি জানতাম এটা তুমিই৷ তোমাকে চিনতে আমার কখনো ভুল হয়নি আর হবেওনা৷
.
কেনো এসেছেন এখানে৷ আর আমাকেই বা কেনো ফলো করছেন৷ নিজের বউকে নিয়ে সুখে থাকেন৷
.
অনু আমি তোমাকে সেদিনও বলেছি আর আজও বলছি সব সময় চোখের দেখা সত্যি হয়না৷ তাছাড়া তুমি আমাদের সম্পর্কে যা ভাবছো সেইরকমটা একদমি না৷ দেখো অনু তোমার কথায় আমি পাঁচটা বছর তোমার থেকে দূরে দূরে থেকেছি আর থাকা সম্ভব নয়৷
.
আপনি যদি ভেবে থাকেন আমি আপনাকে মেনে নিবো তাহলে আপনি ভুল৷বাবার পরে আপনাকেই বিশ্বাস করতাম বেশি কিন্তু এর পরিবর্তে আমি কী পেলাম বিশ্বাসঘাতকতা৷দেখুন চলে যান এখান থেকে আর আমার পিছু নিবেননা এতে আপনার মঙ্গল না হলেও আমার মঙ্গল হবে৷ আপনার মুখও দেখতে চাইনা আমি৷আপনার যদি লজ্জা শরম বলতে কিছু থাকে তাহলে আর আমার সামনে আসবেননা৷

অনু একফোটা চোখের জল বিসর্জন দিয়ে চলে আসলো সেখান থেকে৷
আবির রেগে কারের গ্লাসেই ঘুষি মারলো৷

“ড্যাম!!! কতোবার বলেছি তুমি যা দেখেছো তা সত্যি নয় কিন্তু আমার কথা শুনার প্রয়োজনই মনে করছে না৷ এতোটা ইগু ওর তাহলে আমিও ওর এই ইগু যদি ভেঙে চুরমার না করছি তাহলে আমার নামও আবির রায়হান চৌধুরী নয়৷
আবির ফোন বেড় করে কল করে জানিয়ে দিলো সে আজ অনুষ্ঠানে পার্টিসিপ্যাট করতে পারবেনা৷
তারাতাড়ি করে চলে গেলো অনুর বাড়ির উদ্দেশ্যে সেখান থেকে যদি কিছু জানা যায়৷
🍁
প্রায় বিশ মিনিট পর পৌঁছালো অনুর বাড়িতে৷ অনুর চাচী তখন শুকনো লাল মরিচ রোদে শুকাতে দিচ্ছেন৷

“এক্সকিউজ মি! মিস অনু কী বাসায় আছেন?

ছেলে মানুষের কন্ঠ শুনে মুখ তুলে তাকালেন অনুর চাচী৷ তারপর আঁচলে হাত মুছে এগিয়ে এলেন আবিরের দিকে৷

“কে আপনি?আর অনুকে কেনো খুঁজছেন?
.
অনুর সাথে খুব দরকার ছিলো আমার তাই৷
.
অনু বাসায় নেই৷
.
অনু বাসায় না থাকলেও প্রবলেম নেই ওর বাবা থাকলেই চলবে৷
.
অনুর বাবা আর নেই উনি মারা গেছেন৷
.
কীহ!!! কিন্তু কীভাবে?
.
অনুর চাচী একটা ভেঙচি কেটে বললো,,,কীভাবে আবার উনার যে গুণবতী মেয়ে ওর কারনে৷
.
ও কী করেছে?
.
বাইরে যে আকাম কুকাম করে বেড়ায় সেইজন্যে ওর বাবা ওর বিয়ে ঠিক করেছিলো কিন্তু ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস দেখো বিয়ের দিনই ওর নষ্টামী করার সত্যিটা সবার সামনে আসলো আর ওর বাবাকে মানুষ যা নয় তাই বলে অপমান করলো৷তিনি অপমান সহ্য না করতে পেরে হার্ট এ্যাটাক করে সেদিনই মারা গেলেন৷ কিন্তু দেখেন উনার মেয়ে বাবার জন্য শুক পালন না করে নিজের সুখের জন্য অন্য ছেলের হাত ধরে চলে গেলো৷ হায় আল্লাহ এরকম মেয়ে যাতে কেউ গর্ভে ধারণ না করে৷

আবির কিছু না বলে চলে এলো৷ ওর রাগ উঠে গেলো অনুর চাচীর মুখে এসব কথা শুনে৷ কতটা নিকৃষ্ট হলে মানুষ এমন মিথ্যা কথা বার্তা বলতে পারে৷

“আমিতো জানি অনু অন্য কোনো ছেলের হাত ধরে যেতেই পারেনা৷ কারন ওর মনে এখনো আমার জন্যে অনুভূতি আছে৷ আই প্রমিস অনু আমি যদি আবারো তোমার মনে আমার জন্য সুপ্ত অনুভূতি জাগিয়ে না তুলতে পারি তাহলে আমিও আমার নাম পাল্টে ফেলবো৷
আবির কার নিয়ে চলে গেলো আর ভাবতে থাকলো কাকে জিজ্ঞেস করলে সব সত্যিটা জানতে পারবে৷
🍁
অনু হেঁটে হেঁটে মেসে ফিরছিলো৷আরও চল্লিশ মিনিটের পথ হাঁটলে তবে মেসে ফিরতে পারবে৷ পায়েও ব্যাথা করছে অনেক দিন হাঁটা হয়নি তো তাই৷
হাঁটার মধ্যেই অনুর জুতো ছিঁড়ে গেলো৷ অনু জুতোটা হাতে নিয়ে কেঁদে দিলো৷

“আমার বাবার হাতের জুতোটাও ছিড়ে গেলো৷ আমি এই জুতোটা ফেলতে পারবোনা মাথায় নিয়ে হাঁটবো আমি৷ আমার বাবার স্মৃতি এটা৷ আস্তে আস্তে সব শেষ হয়ে যাচ্ছে কী করবো আমি৷
অনু আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো দূরে একটা ছোট্ট চায়ের দোকান দেখা যাচ্ছে অনু জুতোটা হাতে নিয়ে সেখানে গেলো৷ কড়া রোদ হওয়াতে রাস্তা একেবারে ফুটন্ত পানির মতো গরম হয়ে আছে আর অনু সেখান দিয়েই হাঁটছে গরমের জন্য ওর পা লাল হয়ে গেছে জ্বালাপোড়া করছে৷ তবুও খুব কষ্ট করে সেখানে গেলো৷

চায়ের দোকানের চারিদিকে বাঁশের বেড়া দেওয়া আর উপরে টিন৷একটা আট নয় বছরের ছেলে চুলায় চা বসিয়েছে৷ একটা বাঁশে পেছানো তার আছে দেখে অনু তারটা খুলে নিলো৷তারের দিকে কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো৷ একদিন সে একটা ভিখারিকে দেখেছিলো তার দিয়ে জুতো আটকাতে অনুও নিচে বসে তারটা লাগিয়ে নিলো৷ পায়ে দিয়ে দেখলো না ঠিক আছে বুঝাই যায়না জুতোতে তার লাগানো আছে হিহি৷ গরীব হলে বুঝি মানুষ আলাদা ট্যালেন্টেড হয়ে যায় আমার তো তাই মনে হয়৷ অনু একা বকবক করে দেখলো ছেলেটা হাত ধরে কাঁদছে৷

“কী হলো তোমার?তুমি কাঁদছো কেনো?
.
আপা আমার হাত পুড়ে গেছে খুব জ্বলছে৷ আর চা বানাতেও কষ্ট হচ্ছে পারছিনা বানাতে৷ আগুনের আঁচে হাত আরও বেশি জ্বলছে৷ এখন যদি চা না বানাই তাহলে মালিক আমারে মারবে৷
কথাটা বলে ছেলেটা আবারো কেঁদে দিলো৷

যে জায়গায় নিজের চাচা চাচী আমার সাথে এমন করতে পারলো সেখানে মালিকের জন্য তো এই ছেলেটা কিছুইনা৷ হয়তো ছেলেটা দোষ করলে ওর মালিক ওকে মারধর করে তাই এতো ভয় পাচ্ছে৷
অনু ছেলেটার মাথায় হাত রেখে বললো,,

“চিন্তা করোনা ভাই আমি চা বানিয়ে দিবো৷
.
না আপা তুমি বড় ঘরের মেয়ে এসব করলে মানুষ তোমায় মন্দ ভাববে৷ রাস্তা থেকে এই জায়গাটা স্পষ্ট দেখা যায় তুমি চা বানালে মানুষ তোমাকে দেখে কী বলবে৷ থাক আপা আমি বানিয়ে নিবো প্রথমে কষ্টে হবে তারপর আস্তে আস্তে সেই কষ্ট দূর হয়ে যাবে৷ কষ্টের দ্বারাই কষ্ট দূর হয়৷
.
এতো ছোট ছেলের মুখে এসব শুনে নিজেকে আরও শক্ত করে নিলো অনু৷ ছেলেটা একটা কথা ওর মনে একেবারে গেঁথে গেছে৷”কষ্টের দ্বারাই কষ্ট দূর হয় ”

“তুমি কাল বানিয়ো৷ আর কে আমায় মন্দ বলবে হে৷ যে জায়গায় আমি স্বয়ং নিজে চা বানাচ্ছি৷
অনু ছেলেটাকে সরিয়ে চা বসিয়ে দিলো৷ সুন্দর করে চাপাতা দুধ দিয়ে চা বানালো৷

“ভাই আমি বরং আসি৷
.
আপা তোমারে খুব ক্লান্ত লাগতেছে এক কাপ চা খেয়ে যাও৷
.
না থাক, এমনিতেই গরম চা খেলে আরও গরম লাগবে৷ তাছাড়াও এক কাপ চা খেলে তোমার মালিকের পাঁচ টাকা কমে যাবে আর তাতে তার ক্ষতি হবে আমি কারও ক্ষতি করতে চাইনা৷ গরীবের জন্য যে পাঁচ টাকাই অনেক৷ আর শুন পেস্ট আছেনা যেটা দিয়ে দাঁত মাজো একটু পেস্ট হাতে লাগিয়ে দিয়ো দেখবে জ্বলা পুঁড়া কমে যাবে৷
.
আপা তুমি খুব ভালো আপা৷ সবাই যদি তোমার মতো হতো৷ দোয়া করি আপা তুমি অনেক বড় হও৷
.
অনু ছেলেটার মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে চলে এলো৷
এতোদিন সে গরীবের অবস্থা বুঝতে না পারলেও এখন পারে কারন এখন যে সে তাদের মধ্যেই একজন হয়ে গেছে৷
🍁
অনু টলমল পায়ে মেসে ফিরলো৷ঝুমা ওর মুখের দিকে তাকিয়ে একটা ভেঙচি কাটলো অনু দেখেও না দেখার ভান করে চলে গেলো৷

কিছু কিছু মানুষের স্বভাব কখনো পাল্টায় না৷

শাড়ি চেঞ্জ করে শাওয়ার নিয়ে চুলায় এসে চা বসালো৷ আপাতত ভাত রান্না করার কোন শক্তি বা ইচ্ছে কোনটিই নেই ওর মধ্যে৷

অনু চা নিয়ে জানালার পাশে বসলো৷ ওর খাট জানালার পাশেই পরেছে তাই মন খারাপ হলেই জানালায় হেলান দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে৷ আজও তার ব্যাতিক্রম হয়নি৷ অনু আকাশের দিকে একমনে তাকিয়ে আছে৷

“বাবা কেমন আছো?তুমি আবার কেমন থাকবে তুমিতো ভালোই আছো কিন্তু আমি যে ভালো নেই বাবা৷ যতক্ষণ না তোমার খুনিদের শাস্তি দিচ্ছি ততক্ষণ আমি ভালো থাকবোনা৷
আচ্ছা বাবা ওরা যখন তোমায় বালিশ চাপা দিয়েছিলো তখন তোমার খুব কষ্ট হয়েছিলো তাইনা গো বাবা৷ শ্বাস নিতে না পেরে দম বন্ধে তুমি মারা গেলে৷ তোমাকে মারা কী এতটাই প্রয়োজন ছিলো এদের আর কোন উপায় ছিলোনা ওদের কাছে৷ মা হারানোর বেদনা আমি বুঝতে পারিনি কারন তুমি আমার পাশে ঢাল হয়ে ছিলে কিন্তু এখন আমার পাশে যে আমি ছাড়া আর কেউ নেই বাবা৷ তুমি আমার যোগ্য বাবা হয়ে দেখিয়েছো কিন্তু আমি তোমার যোগ্য মেয়ে হয়ে দেখাতে পারলাম না৷ দেখোনা,কোথায় তোমায় কবর দেওয়া হয়েছে সেটাও জানিনা৷ তোমার কবর জিয়ারতও করতে পারিনি৷কাছ থেকে না হোক দূর থেকে ওতো দেখে করতে পারতাম কিন্তু আমি পারিনি৷বাবা তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিয়ো আর দোয়া করো যেনো আমি সফল হতে পারি৷বাবা আমি আমার মনে কতটা আর্দনাদ চেপে রেখেছি সেটা আমি আর আমার আল্লাহ ছাড়া কেউ জানেনা৷ বাবা তুমি ছাড়া আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে৷আমাকে কেউ ভালোবাসে না৷ প্লিজ ফিরে এসো বাবা প্লিজ৷আমি আর কক্ষনো তোমার সাথে রাগারাগি করবোনা৷তুমি যা বলবে তাই করবো৷
অনু ডুকরে কেঁদে দিলো৷
হঠাৎই ওর মনে হলো আবিরের কথা৷
আবির তো এতদিন আমেরিকায় ছিলো৷আর ও এখনো আমায় ভুলেনি ওর চোখে আমার জন্য এখনো ভালোবাসা দেখতে পাই আমি৷ আবিরের কথা ওতো সত্যি হতে পারে৷ আমরা চোখে সব সময় যা দেখি তা সত্যি না ওতো হতে পারে৷ আমার কী আবিরকে আরেকটা সুযোগ দেওয়া উচিৎ৷ কিন্তু কীভাবে সেদিন আমি নিজের চোখে দেখেছি আর অনেক প্রমানও পেয়েছি সব কীভাবে মিথ্যা হতে পারে৷ কিচ্ছু বুঝতে পারছিনা আমি৷

চলবে♥️

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে