সুপ্ত অনুভূতি ২ পর্ব-০৪

0
2094

#সুপ্ত_অনুভূতি🍂♥️
#সিজন_২
#পর্ব_৪
#Writer_Nusrat_Jahan_Sara

রুমিঃঅনু আমি তোমার অবস্থাটা বুঝতে পারছি৷ দেখো সবার মন-মানসিকতা তো আর একরকম হয়না তাইনা৷ তাই এতো হাইপার হয়োনা প্লিজ৷
.
“আমার হাইপার হওয়াটা কী স্বাভাবিক নয় বলুন৷ আর কি যেনো বলছিলেন আপনি আমার অবস্থা বুঝতে পারছেন? না বুঝতে পারছেন না আর পারবেনও না৷ আমি যে পজিশনে আছি সেই পজিশনে আপনারা কেউ নেই৷ আচ্ছা একটি বারও কী ভেবে দেখেছেন যে একটা মেয়ে এতোগুলো রুমমেট থাকা সত্ত্বেও কেনো কারও সাথে মিশেনা এতো চুপচাপ থাকে৷ হ্যাঁ আপনারা ভেবেছেন কিন্তু জিজ্ঞেস করতে আসেননি৷উল্টো আমার চুপচাপ থাকাটা আপনাদের মনে এক প্রকার রাগের সৃষ্টি করেছে যে কারনে আপনারা যেকোন বিষয়ে ভালোমন্দ না জেনে তার বিচার করতে শুরু করেছেন৷ যে মানুষটার বিয়ে ভেঙে গিয়েছে সাথে চড় মেরে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে সবার সামনে অপমান করা হয়েছে তার উপর তার বাবাকে খুন করা হয়েছে সেই মেয়েটা এক সাথে এতো ধাক্কা খেয়ে কীভাবে নিজেকে ঠিক রাখবে বলুন আর তারমধ্যে আবার আপনাদের খোঁচা মেরে কথা বলা শুনলে তো একদমি না৷
.
অনুর রুমমেট সবাই ওর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে৷ রুমির চোখে অলরেডি পানি চলে এসেছে৷সবার মনে শুধু একটাই প্রশ্ন অনুর বাবা খুন হয়েছে আর কে বা কারা খুন করেছে আর রিজনটা কী ছিলো?অনু সবার দিকে তাকিয়ে বাবার ছবিটা রেখে কাঁথা টেনে শুয়ে পরলো৷
🍁
রাত এগারোটা কী মনে হতেই অনু শুয়া থেকে উঠে পরলো৷ তারপর আস্তে আস্তে রুমির দিকে এগিয়ে গেলো৷ রুমি তখন টেবিলে বসে বসে পড়ছে৷
.
“আপু আপনার ফোনটা একটু দিবেন প্লিজ৷আমি আমার বান্ধবীকে ফোন করবো৷ ভার্সিটির ব্যাপারে কিছুই জানিনা তাই৷
.
হুম৷
রুমি ওর ফোনটা অনুকে দিলো৷ অনু ওর বান্ধবী রিমিকে ফোন করলো৷ বেশ কয়েকবার রিং হওয়ার পর রিমি ফোন রিসিভ করলো৷

রিমিঃহ্যাঁলো কে বলছেন?
.
“রিমি আমি অনু বলছি৷
.
তুই!!তোকে এই তিন চার দিন যাবৎ ফোন দিচ্ছি বাট ফোন সুইচড্ অফ বলছে৷ আচ্ছা তুই কেমন আছিস আর আংকেল কেমন আছেন?
.
ভালো৷ আচ্ছা রিমি ভার্সিটির কী খবর৷
.
হে তোকে বলতে তো ভুলেই গেসিলাম, শুন কাল ভার্সিটিতে একটা অনুষ্ঠান আছে৷ কোনো স্পেশাল অনুষ্ঠান বোধহয়৷ আর নাজমা ম্যাম বলেছেন শাড়ি পরে সুন্দর করে সেজেগুজে আসতে৷ তুইও শাড়ি পড়ে সুন্দর করে সেজেগুজে চলে আসিস৷অনেক মানুষ আসবে তাই৷ আমি বাবাকে নিয়ে আসবো তুইও চলে আসিস আংকেল কে নিয়ে
.
হুম৷ আচ্ছা আমি রাখছি বাই৷ কাল দেখা হচ্ছে৷
অনু তারাতাড়ি ফোন রেখে কেঁদে দিলো৷ এতদিন সেও তার বাবাকে যেকোন অনুষ্ঠান হলে নিয়ে যেত৷কিন্তু এখন সবকিছুতেই তাকে একা একা যেতে হবে৷ কারও বুকে পরমে মাথা রেখে যে একটু গল্প করবে সুখ দুঃখ প্রকাশ করবে সেই আশাটুকু নেই৷
রুমি উঠে এসে অনুর কাঁধে হাত রাখলো৷

“আমি তোমার কষ্ট হয়তো ভাগ করে নিতে পারবোনা কিন্তু এতটুকু বলি যারা তোমার বাবাকে খুন করে তোমার সাথে এতবড় অন্যায় করেছে তাদের তুমি ছেড়োনা শাস্তি দিতে হবে ওদের আর এটা তখনি সম্ভব যখন তুমিও নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে৷তুমি মনে এতো কষ্ট নিয়ে ঘুরছো৷ আসলেই আমার ভিষন খারাপ লাগছে+কষ্টও হচ্ছে৷ আর একটা কথা,তুমি এত সময় ধরে কাঁদছো নিশ্চয় তোমার মাথা ব্যাথা করছে৷ আমি তোমার জন্য কড়া করে চা বানিয়ে আনছি দেখবে চা টা খেলে মাথা ব্যাথা কমে যাবে৷
অনু রুমির দিকে তাকিয়ে রইলো৷ রুমের চারটা মেয়েদের মধ্যে রুমিই একটু অন্যরকম মিশুক সবার সাথে ভালো ভাবে কথা বলে, বুঝার চেষ্টা করে৷

কিছুক্ষণ পর রুমি দুই কাপ চা নিয়ে এলো৷ একটা অনুকে দিয়ে আরেকটা নিজে নিলো৷

“আচ্ছা আপু এখন থেকে ভার্সিটিতে যেতে কত সময় লাগবে৷
.
পায়ে হেঁটে গেলে এক ঘন্টা,বাসে গেলে পনেরো মিনিট আর রিক্সায় করে গেলে ত্রিশ মিনিট চল্লিশ মিনিট লেগে যায়৷
.
ওহ৷
🍁🍁
সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখলো নয়টা বেজে গেছে৷ অনু তারাতাড়ি ফ্রেশ হয়ে এসে রান্না বসালো৷ কিন্তু এখন রান্না করলে ভার্সিটিতে যেতে লেট হয়ে যাবে তাই সে ভাত,কাঁচা মরিচ আর পেয়াজ দিয়ে বেজে নিলো৷

অনু খাবার মুখে দিচ্ছে কিন্তু গিলতে পারছেনা৷ কালকের রাখা ভাজি ভাতে মিক্স করে নিলো৷ এখন খেতে পারবে৷
খাবার খেয়ে কী পড়ে যাবে ভার্সিটিতে সেটাই ভাবছে৷ হঠাৎ ওর মনে পরলো অনেক দিন আগে একটা নীল শাড়ি আর দু মুঠো নীল চুড়ি কিনেছিলো ব্যাগে রেখেছিলো আর খোলে দেখা হয়নি৷
অনু তারাতাড়ি ব্যাগ খোলে দেখলো শাড়ি, চুড়ি যেভাবে রেখেছিলো সেভাবেই আছে ব্যাগের এক কোনায় পড়ে৷

জলদি করে শাড়ি, চুড়ি পড়ে রেডি হয়ে নিলো৷ লম্বা চুলগুলো ছেড়ে দিলো৷
ম্যাচ থেকে বেড়িয়ে একটু সামনে এগুলো৷ সেখান থেকে রিক্সায় করে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পরলো৷
🍁
রিমি ভার্সিটির গেটে দাঁড়িয়ে অনুর জন্যই অপেক্ষা করছিলো৷ অনুকে আসতে দেখে রিমি খুশি হয়ে দৌড়ে ওর কাছে চলে গেলো৷ কিন্তু অনুর কাছে গিয়ে রিমির মুখ মলিন হয়ে গেলো৷

“অনু সিরিয়াসলি এটা তুই৷
.
ক্লাসে চল তোর সাথে কথা আছে৷
🍁
অনু আর রিমি একটা ফাকা ক্লাস রুমে গেলো৷

“এখন বল আর এটা তুই বিশ্বাস করতে পারছিনা আমি৷লিপস্টিক শেড দিবি তো দূর একটু কাজল পর্যন্ত দিসনি৷আজকে অনুষ্ঠান আছে ভুলে গেছিস৷
.
তুইও দেখছি অন্যদের মতো ব্লেম করতে শিখে গেছিস৷
.
অনু তুই ভুল ভাবছিস আমি তোকে ব্লেম করছিনা৷ অন্যদিন তুই সেজেগুজে আসতি আর অনুষ্ঠান হলে তো কথাই নেই৷ আজকে এতো সাদাসিধে হয়ে এসেছিস তাই একটু খটকা লাগলো৷ আর একাই এসেছিস আংকেল আসেননি?
.
আংকেল বেঁচে থাকলে তবেই না আসবে৷
.
কীহ!!!!মানে আংকেল,,,,,,
.
হ্যাঁ আমার বাবা মারা গেছেন৷খুন করা হয়েছে আমার বাবাকে৷ আমার বিয়েও ঠিক ছিলো কিন্তু আমার বিয়েও একটা মিথ্যার ফাঁদে পড়ে ভেঙে গেছে৷শুধু তাই নয় আমার বাড়ি থেকে পর্যন্ত আমাকে বিদায় করে দেওয়া হয়েছে৷ এবার তুই বল এতো শক একসাথে পেয়ে আমি কীভাবে আগের মতো থাকবো৷লিপস্টিক, শেড,কাজল লাগাবো৷
.
এসব কী বলছিস তুই? আমি তো কিছুই জানিনা আর কে বা কারা আংকেল কে খুন করলো আর কেনো?৷
.
আমার চাচা,চাচী চাচাতো ভাইবোন মিলে সম্পত্তির জন্য আমার বাবাকে খুন করেছে৷আমি এখন ম্যাচে থাকছি তারপরও যতটুকু পারছি নিজেকে শক্ত রাখার চেষ্টা করছি৷ আচ্ছা এখন বল কিসের অনুষ্ঠান আজ৷
.
জানিনা রে তবে প্রত্যেক ক্লাসের ফার্স্ট, সেকেন্ড,থার্ড যারা আছে তাদের কে বক্তব্য দিতে হবে৷ যেহেতো তুই ক্লাসের থার্ড গার্ল তাই তোর নামও দেওয়া হয়েছে৷ আর শুনলাম আজকের অনুষ্ঠানে যে চিফ গেস্ট হিসেবে থাকবে সে নাকি স্পেশাল৷ চল অডিটরিয়াম রুমে যাই৷ নাহলে পরে সিট পাবোনা৷
🍁
চিফ গেস্ট হিসেবে যার আসার কথা ছিলো উনি জ্যামের কারনে আসতে পারছেননা৷ তাই বক্তব্য শুরু করে দেওয়া হয়েছে৷ অনুর হাত পা কাঁপছে৷ কী বক্তব্য দিবে সেটাই জানেনা৷ ক্লাসের ছেলে মেয়েরা অনুকে দেখে হাসছে, ভেঙচি কাটছে কেউ কেউ শুনিয়ে শুনিয়ে কটু কথা বলছে৷ অনু বুঝতে পারছে এসব করার কারন তবুও সে এসবে তোয়াক্কা না করে কী বক্তব্য দিবে সেটাই ভাবছে৷

“অনিতা রহমান অনু৷”
.
অনুর নাম এনাউস করা হয়েছো বক্তব্য দেওয়ার জন্যে৷ অনু কাঁপা কাঁপা পায়ে স্টেজে গেলো৷

বড় একটা নিশ্বাস ফেলে বিসমিল্লাহ বলে বক্তব্য দেওয়া শুরু করলো৷

” আসসালামু আলাইকুম৷আশা করি আপনারা সবাই ভালো আছেন৷আমি অনিতা রহমান অনু৷আজকের এই অনুষ্টান সম্বন্ধে বক্তব্যের বিষয়ে কিচ্ছু জানতাম না আমি৷তাই কী বক্তব্য দিবো সেটা বুঝতে পারছিনা৷ তাই অন্যদিন তো চিরস্মরণীয় ব্যাক্তিদের নিয়ে বক্তব্য দিতাম আজ নাহয় নিজের বিষয় নিয়ে একটা ছোট্ট বক্তব্য দেই৷ এখানে আমার সহপাঠী,জুনিয়র ভাইবোনেরা আছে৷ এদের মধ্যে অনেকেরই আজকের আমিকে দেখে অনেকটা অবাক লাগছে৷আমি কীভাবে এতো সাদামাটা হয়ে গেলাম এটা দেখে অনেকই অবাক হচ্ছে আর হওয়ারই কথা৷ কিন্তু কী করবো সময়ের সাথে সাথে নিজেকেও কীভাবে পরিবর্তন করে নিতে হয় সেটা আমি বুঝে গেছি৷ রঙের দুনিয়ায় বাস করতে করতে যখন রঙটাই হারিয়ে যায় তখন আর সেই রঙটাকে খুঁজে পাওয়া যায়না আর খুঁজে না পেয়ে মানুষ হয়ে উঠে রংহীন৷ আমার ক্ষেত্রেও তাই৷ আমার লাইফ থেকে রং নামক বস্তুটাই হারিয়ে গেছে৷ তাই এসব কৃত্রিম রং চংয়ের এখন আমার কাছে কোনো মানে নেই৷ আমার বাবা নামক রংটাই আমার জীবন থেকে হারিয়ে গেছে৷আমার পজিশনে কেউ হয়তো আসেননি তাই বুঝতেও পারবেননা৷হ্যাঁ মানুষ মরনশীল, সবারই বাবা মা মারা যায় কিন্তু আমার বাবা হারিয়ে যাওয়ার পিছনে বড় এক রহস্য আছে যেটা আমি ছাড়া আর কেউ জানেনা৷ এতো কিছুর মধ্যেও আমি নিজেকে ভেঙে না ফেলে নিজেকে গড়ার চেষ্টা করছি নিজের লক্ষ্যে পৌঁছানোর স্বপ্ন দেখছি৷হ্যাঁ আমি গরীব আমার অনেক বড় স্বপ্ন৷এটা নিয়ে অনেকে উপহাস করছে৷ আমিতো একটা মানুষ স্বপ্ন তো দেখতেই পারি৷ যতদিন আমার এই দেহে প্রান থাকবে ঠিক ততদিন আমি আমার স্বপ্নের সাফল্যের চুড়ায় পৌঁছানোর জন্য লড়াই করে যাবো৷ দুঃ সময়ে ভেঙে পড়া আমার সংস্কার, বা শিক্ষা কোনটিই নয়৷ বরং দুঃ সময়ের সব বিপদ, আশংকা,ভয়,অসহায়ত্বের সাথে লড়াই করাই হলো আমার শিক্ষা, আমার সংস্কার৷ গরীব,অসহায়দের মধ্যেও আলাদা একটা প্রতিভা থাকে যা সবার মধ্যে থাকেনা৷
এতক্ষণ আমার সম্পর্ক নিয়ে বক্তব্য দেওয়ার জন্য আমি খুব দুঃখিত৷ কিন্তু এই মুহুর্তে এটা ছাড়া আমার মাথায় আর কিছু আসেনি৷ স্যরি৷
.
অনু মাইক্রোফোন রেখে চলে আসতে নিতেই প্রিন্সিপাল ম্যাম এসে ওকে জড়িয়ে ধরলেন৷
.
“বরাবরই তোমার বক্তব্য অনেক ভালো লাগে এবার আরো বেশি৷ সত্যি মা খুব সুন্দর করে তুমি উপস্থাপন করেছো৷ তোমার আত্নবিশ্বাস দেখে আমরা মুগ্ধ৷ জীবনে অনেক বড় হও তোমার জন্য দোয়া রইলো৷
.
প্রিন্সিপাল ম্যামের কাঁধ থেকে মাথা তুলতেই অনুর চোখ গেলো করিডোর দিয়ে হেঁটে আসা ব্যাক্তির দিকে৷ আবির রায়হান চৌধুরী এখানে? অনু আর দেরি না করে স্টেজ থেকে নেমে দৌড়ে চলে গেলো৷ পিছন থেকে সবাই ওকে ডাকছে কিন্তু ও না শুনে চলে গেলো৷ করিডোর ছাড়া পালানোর আর কোনো রাস্তা নেই তাই অনু করিডোর দিয়েই গেলো৷ আঁচল দিয়ে মুখ ঢেকে নিলো৷ আবির তখন ফোনে কথা বলতে বলতে আসছিলো৷একটা মেয়েকে মুখ ঢেকে চলে যেতে দেখে কিছুটা অবাক হলো৷ আর যখন মেয়েটার পায়ের তিল আর চিরচেনা নুপুর দেখলো তখন আরও বেশি অবাক হলো৷

“আমি আপনাকে পরে ফোন করছি”
আবির ফোন রেখে পিছনে তাকিয়ে দেখলো অনু উধাও৷ আবির দৌড়ে মাঠে চলে গেলো গেটের দিকে তাকাতেই দেখলো অনু এতক্ষনে গেট পেরিয়ে গেছে৷

“বড্ড দেরি করে ফেলেছি আমি৷”
আবিরও আর দেরি না করে অনুর পিছন পিছন কার নিয়ে চলে গেলো৷

চলবে♥️

[ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন৷]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে